বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের বড় কারণ হুন্ডি
১০ মার্চ ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১০ মার্চ ২০২৪, ১২:০৪ এএম
সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার পরও ডলার সংকট কাটেনি বরং দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রয়োজনীয় ডলারের অভাবে আমদানি বাণিজ্যে দারুণ সংকট সৃষ্টি হচ্ছে বলে পত্রপত্রিকা সূত্রে প্রকাশ। চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ না থাকায় টাকার মূল্যমান কমছে, ফলে আমদানিকৃত পণ্যের দামও বাড়ছে। দেশের অর্থনীতিতে এর বিরুপ প্রভাব পড়ায় মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৭১-৭২ সালে যেখানে ডলারের মূল্যমান ছিল ৭.৫০ পয়সা, সেখানে এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২০-১২৫ টাকায়। এক বছরের ভেতরে প্রায় শতাধিক বার টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।
সরকার হুন্ডি ব্যবসা বন্ধে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে এর মাত্রা সাময়িকভাবে কিছুটা কমলেও এখন নাকি আবার দারুণভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ দিকে যে বা যারা অবৈধ হুন্ডি ব্যবসায় জড়িত তারা কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। দেশের প্রচলিত আইনে তাদের বিচার হওয়া উচিত। তবে এটাও ঠিক, ঢালাওভাবে কোনো ব্যক্তিকে হুন্ডি ব্যবসায়ী বা বিশেষ কোনো গ্রুপের লোকজন এ ব্যবসায়ে জড়িত তা বলা সমীচীন নয়। যেমন ট্রাভেল এজেন্ট, মানি চেঞ্জার ব্যবসায়ী সবাই নিজ নিজ লাইসেন্স, অফিস, লোকজন নিয়ে ব্যবসা করছে। তাদের এসব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছে হাজার হাজার মানুষ। তাদের আয়ে চলছে সংসার। এসব ব্যবসায়ীর মধ্যে কেউ কেউ হয়তো হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। যদি থেকে থাকেন তবে তাদের ব্যাপারে নিরপেক্ষ তদন্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক, এটা দেশের প্রতিটি নাগরিকের প্রত্যাশা। সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ হিসেবে বিষয়টি সুষ্ঠুভাবে বিবেচনা করবেন, এটা সংশ্লিষ্ট সবারই প্রত্যাশা। এটা ঠিক, দেশে-বিদেশে অবস্থানরত কিছু অসৎ লোক হুন্ডির ব্যবসা করে দেশের অর্থনীতির প্রভূত ক্ষতি সাধন করছে। হুন্ডি ব্যবসা বন্ধে এবং দেশে বৈদেশিক মুদ্রার আগমন যাতে বৃদ্ধি পায় সে উদ্দেশ্য সামনে রেখে আমার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু পরামর্শ পেশ করছি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের অর্থনীতির অবস্থা নাজুক ছিল। তখন দেশের একমাত্র ভরসা ছিল স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী ঋণ ও ধনী দেশসমূহের সাহায্য। এ সময় মুষ্টিমেয় কিছু লোক বিদেশে কর্মরত ছিল আর তাদের দ্বারা অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা হুন্ডি হয়ে দেশে আসতো। ধনী ও উন্নত দেশের সঙ্গে ব্যাংকিং লেনদেন প্রায় ছিলই না। দেশে বৈধ পথে বৈদেশিক মুদ্রা না আসার ফলে বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডার প্রায় শূন্যের কোঠায় গিয়ে পৌঁছেছিল। বৈদেশিক মুদ্রা বৈধ পথে নিয়ে আসার লক্ষ্যে সরকার তখন দেশের অর্থনীতিবিদদের নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে তাদের পরামর্শ ক্রমে ‘ওয়েজ আর্নার্স স্কিম’ চালু করে। অর্থনীতিবিদদের এ সিদ্ধান্তে বিভিন্ন ক্ষেত্র ও পর্যায়ে তৎপরতা শুরু হয় এবং দেশে বৈদেশিক মুদ্রার আগমন বাড়তে থাকে। এ স্কিম চালু করার ফলে বিদেশে কর্মরত প্রবাসীরা ভীষণ উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাতে শুরু করেন। বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার ক্রমশ সমৃদ্ধ হতে থাকে। বিপরীতে হুন্ডি ব্যবসার দাপট কমতে থাকে।
এদিকে বেকারত্ব থেকে মুক্তি পেতে ও আয়ের উৎস সন্ধানে বিপুল সংখ্যক লোক আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, সৌদিআরব, কুয়েত, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, মালদ্বীপ, লিবিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেতে শুরু করে। তাদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আগমন শুরু হয়। এ সময় দেশে বৈদেশিক মুদ্রা ড্রাফট/চেক ইত্যাদি প্রবাসীদের পোষ্য বা বেনিফিশিয়ারিরা দেশে কয়েকটি নির্ধারিত ব্যাংক শাখায় তাদের হিসাবে জমা দিয়ে সুবিধা মতো সময়ে বিক্রয় করতে পারতেন। এছাড়া কিছু বৈধ লাইসেন্সধারী বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসায়ীও ছিলেন। তাদের মাধ্যমে ব্যাংকে নিলাম পদ্ধতি চালু ছিল। প্রতিদিন নিলামে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারদর উঠানামা করত। এতে একদিকে প্রবাসীদের বেনিফিশিয়ারিরা তাদের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকে নিজ একাউন্টে জমা রেখে সুবিধামত সময় বিক্রয় করতে পারতেন অন্যদিকে ব্যাংকের ফ্লোরে নিলামেও বিক্রয় করার সুবিধা ছিল। বৈদেশিক মুদ্রা দেশে এভাবে বেশি করে আসার ফলে দেশের অর্থ ভা-ার সমৃদ্ধ হতে থাকে। উন্নয়নমূলক কাজে সরকার এ মুদ্রার ব্যবহার করতে পারত। এছাড়া কিছু শিক্ষিত যুবকও এ ব্যবসাতে খেটে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে-শান্তিতে দিন কাটাতে পারতেন। এভাবেই সরকার প্রবর্তিত ‘ওয়েজ আর্নার্স স্কিম’ দেশ-বিদেশে জনপ্রিয়তা লাভ করে। মানুষের আগ্রহও ক্রমশ এ স্কিমে বাড়তে থাকে। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে এক অশুভ চক্র এ সহজ প্রথার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা হুন্ডি ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এ স্কিম বন্ধের পাঁয়তারা শুরু করে দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ‘ওয়েজ আর্নার্স স্কিম’ বন্ধ হয়ে গেলে হুন্ডি ব্যবসা চলবে জোরেশোরে। হলোও তাই। পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিজ্ঞপ্তি মারফত পূর্বের সহজ প্রথা বন্ধ করা হয়। এর ফলে দেশে বৈদশিক মুদ্রার আগমন কমতে থাকে। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা বিদেশে তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে বর্ধিত মূল্যে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় করতে থাকে। সরকার পাউন্ড/ডলারসহ সব বৈদেশিক মুদ্রার মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ায় ব্যবসায়ীরা এ পথে অর্থাৎ ব্যাংক মারফৎ বৈদেশিক মুদ্রা না পাঠিয়ে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের দ্বারস্থ হতে থাকে। এতে তারা এক দিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার দাম বেশি পেতে থাকে, অন্যদিকে কোনো জটিলতা ছাড়াই দেশে স্বল্প সময়ে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা প্রবাসীদের পোষ্যদের টাকা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতে শুরু করে। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত তৎপর হয়ে যায়, দেশ বঞ্চিত হতে থাকে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা হতে। তারা ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে বিদেশে কর্মরতদের প্রতি পাউন্ড/ডলারের মূল্য সরকার নির্ধারিত মূল্য হতে ৩/৪ টাকা বেশি দিতে থাকে। সহজে বাড়িতে টাকা পৌঁছে দেয়ারও গ্যারান্টি দিতে থাকে। এতে প্রবাসীরা সরকারি জটিলতা ও পদ্ধতি এড়ানোর জন্য হুন্ডি পদ্ধতিকেই গ্রহণ করতে শুরু করেন। অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, বিদেশের যেসব শহরে বাংলাদেশিদের অবস্থান বেশি, সে সব স্থানে তারা ব্যাংকের মতই বুথ খুলে বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশিদের কাছ থেকে নিয়ে তার বিপরীতে সাংকেতিক চিহ্ন সংবলিত ‘টুকা’ ইস্যু করছে। এটুকাই বাংলাদেশে তাদের টাকা পাওয়ার নিশ্চয়তা প্রদানের নিদর্শন। ইদানিং দেশের কোনো কোনো বেসরকারি ব্যাংক সরাসরিভাবে হুন্ডি ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়। এ অবৈধ ব্যবসার ফলে একশ্রেণির ব্যাংক কর্মকর্তা, হুন্ডি ব্যবসায়ী ও সরকারি কোনো কোনো এজেন্সির লোকজন লাভবান হলেও অস্বীকার করা যাবে না যে এতে দেশের প্রভূত ক্ষতি হচ্ছে। দেশ ও জাতি হাজারো কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে এবং মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা যাতে বেশি করে বৈধ পথে দেশে আসে সে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ওয়েজ আর্নার্স স্কিম চালু করার জন্য দেশের বিভিন্ন শিল্প ও বণিক সমিতি বৈধ মুদ্রা ব্যবসায়ী সংগঠনসহ নানা সংগঠন সরকার বরাবরে প্রস্তাব পেশ করেছে। পাউন্ড/ডলার খোলা বাজারে ক্রয়-বিক্রয়ের এবং হুন্ডি ব্যবসা বন্ধের জন্য তারা কয়েকটি সুচিন্তিত ও সুনির্দিষ্ট সুপারিশ বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অর্থ মন্ত্রণালয়ে দিয়ে থাকলেও এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা আজও গৃহীত হয়নি। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে: ১। প্রবাসীদের প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রা বেসরকারি পর্যায়ে অন্যান্য দ্রব্যের ন্যায় খোলা বাজারে কয়েকটি নির্ধারিত ব্যাংক শাখার মাধ্যমে ফ্লোরে ক্রয়/বিক্রয় এবং উচ্চমূল্যে নিলামের ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন। ২। একই সাথে ব্যাংকের এফসি একাউন্টে বৈদেশিক মুদ্রা জমা রাখা এবং একাউন্ট হোল্ডার বা বেনিফিশিয়ারদের যে কোনো সময়ে তা বিক্রয়ের সুবিধা প্রদান এবং ৩। এলসি খোলার জন্য আমদানিকারকদের মাধ্যমে দেশের এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে ফান্ড ড্রাফট মারফত ট্রান্সফারের ব্যবস্থাকরণ।
বৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবসা করার জন্য বেশ কিছু লাইসেন্স ইতোমধ্যে ইস্যু করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়াকে আরো গতিশীল করার পাশাপাশি বৈধভাবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধি দল প্রেরণ এবং এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস চালানো। এ ব্যাপারে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি দূতাবাসের তৎপর হওয়া উচিত। হুন্ডি ব্যবসা বন্ধ করতে এবং দেশে বৈধ পথে বৈদেশিক মুদ্রার আগমন বাড়াতে অবিলম্বে ওয়েজ আর্নার্স স্কিম পুনঃপ্রবর্তনের ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্তের আর গড়িমসি করা উচিত নয় বলে অভিজ্ঞমহল মতপ্রকাশ করেছেন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ডোপ টেস্ট দিয়ে ভর্তি হতে হবে চবিতে
গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি শর্ত সম্পর্কে যা জানা গেল
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ আইওএম মহাপরিচালকের
আগামী ৬ মাস বন্ধ থাকবে কমলাপুর-টিটি পাড়া সড়কের একটি লেন
অসময় ভাঙনের কবলে দৌলতদিয়া ৬নং ফেরি ঘাট, কোন ব্যবস্থা নেননি কর্তৃপক্ষ
বুধবার ঝিনাইদহের দুটি উপজেলায় নির্বাচন ভোটের মাঠে আ’লীগেরই ১০ প্রার্থী
সি-ম্যাখোঁ-ফন ডার লেইন ত্রিপক্ষীয় বৈঠক
আবারও বিশ্বের দীর্ঘতম রুটি বানালেন ফরাসি বেকাররা !
চেয়ারম্যান প্রার্থীকে ডেকে নিয়ে মারধর, হাসপাতালে ভর্তি
চুরির অভিযোগে রাশিয়ায় গ্রেপ্তার মার্কিন সেনা সার্জেন্ট
ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আজ ঢাকায় আসছেন
যুদ্ধবিরতির খবরে উল্লাসে ফেটে পড়ল গাজা
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে রাজি হামাস, ইসরায়েলের 'প্রত্যাখ্যান'
মৃত্যুর আগে কী করছিলেন প্লেটো, বলছে ছাইচাপা প্যাপিরাস
রাফায় ইসরায়েলের বোমাবর্ষণে নিহত ১২, যুদ্ধবিরতি অনিশ্চিত
ভারতে তৃতীয় দফার ভোটগ্রহণ শুরু, বিজেপি কি ব্যাকফুটে
চেয়ারম্যান প্রার্থী শাহীন বিপুল পরিমাণ টাকাসহ আটক
বাংলাদেশে শুভেচ্ছা সফরে আসছে তুরস্কের নৌবাহিনীর জাহাজ
ইসরায়েলি ঘাঁটিতে কয়েক ডজন রকেট নিক্ষেপ হিজবুল্লাহ’র
৫৪ বছর বাদে ফিরে পেলেন হারিয়ে যাওয়া বিয়ের আংটি ! খুশিতে ডগমগ ম্যারিলিন