তিস্তা বহুমুখী ব্যারাজ নির্মাণ নিয়ে ভারত-চীনের স্নায়ুযুদ্ধ

Daily Inqilab মুহাম্মদ শাহ আলম

১৫ মে ২০২৪, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ১৫ মে ২০২৪, ১২:১৯ এএম

বাংলাদেশের বহুল আলোচিত তিস্তা বহুমুখী ব্যারেজ প্রকল্প নির্মাণ নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে এক ধরণের ¯œায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছে। চলছে রশি টানাটানি। বাংলাদেশের কৃষি, জীববৈচিত্র্য, মৎস্য ও পানিস¤পদ, অর্থনীতি ইত্যাদি নানাবিধ দিক দিয়ে তিস্তা নদী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদীটি সিকিমের হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও শিলিগুড়ির মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের রংপুর বিভাগে প্রবেশ করেছে। নীলফামারি ও লালমনিরহাট দিয়ে নদীটি গাইবান্ধায় এসে ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মিলিত হয়েছে। ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে নদীটি অনেকদিন ধরে নাব্য ও পানি সংকটে ভুগছে। ফলে গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী এবং রংপুর অঞ্চলের কৃষিকাজ, মৎস্য স¤পদ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে ভারত একতরফাভাবে পানি ছেড়ে দেয়ায় দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। ফসলের ক্ষতিসহ ভাঙনে নিঃস্ব হয় হাজার হাজার পরিবার। মূলত ভারতের আগ্রাসী নীতির কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে, শুষ্ক মৌসুমে ভারত পানি প্রত্যাহার করে সংশ্লিষ্ট এলাকা বিরানভূমিতে পরিণত করে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য দিয়ে ৫৪টি অভিন্ন নদী প্রবাহিত হয়। প্রায় প্রত্যেকটি নদীতেই ভারত আন্তর্জাতিক নদী আইন অমান্য করে বাঁধ নির্মাণ করেছে এবং তাদের অংশে এসব নদী-উপত্যকায় সেচ প্রকল্প বা বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরী করেছে। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে অন্তত ৩৭টি নদী থেকে সংযোগ খালের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন স্থানে পানি সরিয়ে বা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এর ফলে এসব নদীর পানিা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে এবং নদীগুলো প্রয়োজনীয় পানি না পেয়ে শুকিয়ে গেছে। বাংলাদেশের সাথে কোন প্রকার আলোচনা ছাড়াই ভারত গজলডোবা বাঁধ ও তিস্তা বাঁধ প্রকল্প হাতে নেয়। ১৯৯৭ সালে তিস্তা বাঁধ চালু করে ভারত। বাঁধ দুটির ফলে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে স্বাভাবিক পানি প্রবাহিত হচ্ছে না। অর্থাৎ ভারত আন্তর্জাতিক নদী আইন অমান্য করে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশে শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। বর্ষা মৌসুমে বন্যায় প্লাবিত হয়।এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে বিকল্প তিস্তা বহুমুখী ব্যারেজ প্রকল্প নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশকে এগুতে হচ্ছে। ভারত যদি তিস্তা নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করতো কিংবা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, চুক্তির মাধ্যমে তিস্তার পানি বন্টন নিশ্চিত করতো, তবে আমাদের অংশে তিস্তা প্রকল্পের প্রয়োজন হতো না। তিস্তা নিয়ে ভারতের এই নীতির কারণে বাংলাদেশকে গুরুত্বের সাথে বিকল্প পদক্ষেপ নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।

তিস্তা প্রকল্প নির্মাণে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানে শুরু থেকেই চীন আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। ২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে ২৭টি প্রকল্পের চুক্তি হয়েছিল। তার মধ্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনার প্রকল্পও ছিল। তারই আলোকে চীন নিজ উদ্যোগ ও খরচে ২ বছর ধরে তিস্তার ওপর সমীক্ষা চালিয়ে একটি প্রকল্প নির্মাণ সম্ভব বলে বাংলাশেকে জানিয়ে দেয়। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত একাধিকবার তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন এলাকা পরিদর্শন করে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে এবং পরে চীনের রাষ্ট্রদূত তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু করার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। গত বছর ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘বাংলাদেশে চীনের ভাবমূর্তি’ শীর্ষক এক সেমিনারে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছেন, তার দেশ বাংলাদেশ থেকে তিস্তা নদীবিষয়ক কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের প্রস্তাব পেয়েছে। তার দেশ তিস্তা নদীর উন্নয়নে কাজ করতে আগ্রহী। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। নির্বাচনের পরে চীনের রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সাথে এক বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ চাইলে তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু করার বিষয়ে প্রস্তুত আছে চীন। এই অবস্থায় হঠাৎ করেই ভারত দৃশ্যপটে হাজির হয়ে বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়নের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়েত্রা গত ৯ মে বাংলাদেশ সফরে এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠকে এমন আগ্রহের কথা প্রকাশ করেছেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অথচ চীন দীর্ঘ দিন ধরে কুটনৈতিক চ্যানেলে কাজ করে আসছে। তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীনের এমন আগ্রহের পারও তিস্তা প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ বেশিদূর এগুতে পারেনি। তার কারণও কার্যত ভারত। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, ভারতের আপত্তির কারণেই চীনের সাথে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে এগুতে পারছে না বাংলাদেশ। তিস্তার গুরুত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশের মূলত প্রয়োজন একটি কার্যকর ও স্থায়ী সমাধান, যা গত ৩৫ বছরেও সম্ভব হয়নি। এজন্যই বাংলাদেশকে বিকল্প সমাধান খুঁজতে হয়েছে। চীনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং নদী শাসনের অভিজ্ঞতা, অর্থ বাংলাদেশকে এক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারবে। এমনিতেও চীন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নে চীন সহযোগিতা করে আসছে। এই অবস্থায় তিস্তা প্রকল্পে ভারতের সহযোগিতার আগ্রহ প্রকাশ এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকন্ঠা ও সংশয় দেখা দিতে পারে। কারণ, বাংলাদেশের সাথে ভারতের যে ভূরাজনৈতিক অবস্থান বিদ্যমান এবং দুই দেশের সরকারের মধ্যে যে স¤পর্ক রয়েছে, তাতে ভারতের প্রস্তাব পাশকাটিয়ে চীনের সাথে তিস্তা এগ্রিমেন্ট করতে যথেষ্ট কষ্টসাধ্য হবে। অপরদিকে, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং ডলার সংকট মোকাবেলায় চীনের সহযোগিতা এই মূহুর্তে আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তবতা হচ্ছে, এই মূহুর্তে চীন নাখোশ হবে, এমন পদক্ষেপ থেকে বাংলাদেশকে সচেতনভাবে বিরত থাকতে হবে। ফলে অনেকেই শংকা প্রকাশ করছেন, তিস্তা নিয়ে চীন-ভারতের এই খেলায় প্রকল্পটি আদৌ আলোর মুখ দেখবে কিনা? তবে ভারত তিস্তার ক্ষেত্রে ‘সর্প হয়ে দংশনের করে, ওঝা হয়ে ঝাড়ার’ নীতি অবলম্বন করেছে। ভারত আমাদেরকে নদীর ন্যায্য পানি থেকে বঞ্চিত করে এখন তিস্তা প্রকল্প নির্মাণে সহযোগিতা করার জন্য দেনদরবার করছে। এই ক্ষত্রে নুন্যতম লজ্জাবোধ করেনি। বস্তুত তিস্তাসহ সকল অভিন্ন নদ-নদীর ন্যায্য পানি প্রাপ্তি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আমাদের অধিকার। ভারতের উচিত আমাদের এই ন্যায়সংগত অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সুপ্রতিবেশী সূলভ মনোভাব নিয়ে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসা। সমস্যাকে জটিল ও কুটিল করা নয়। তিস্তা ব্যারেজ বাংলাদেশের প্রকল্প, এটি চীনের কোন প্রকল্প নয়। চীন শুধু এখানে অর্থায়ন করতে রাজী হয়েছে। কাজেই দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে এই ক্ষেত্রে আমাদেরকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: আইনজীবী।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

বছরের প্রথমার্ধে বিদেশি বিনিয়োগে দারুণ প্রবৃদ্ধি চীনে

বছরের প্রথমার্ধে বিদেশি বিনিয়োগে দারুণ প্রবৃদ্ধি চীনে

জাপানে রেকর্ড বৃষ্টিপাত, সরিয়ে নেওয়া হলো হাজারো মানুষকে

জাপানে রেকর্ড বৃষ্টিপাত, সরিয়ে নেওয়া হলো হাজারো মানুষকে

জন্মভূমির বিপক্ষে মুরের ফিফটি, মাডান্ডের অনাকাঙ্ক্ষিত রেকর্ড

জন্মভূমির বিপক্ষে মুরের ফিফটি, মাডান্ডের অনাকাঙ্ক্ষিত রেকর্ড

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড

পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও

পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও

বেতাগী দরবারে ওরশ আজ

বেতাগী দরবারে ওরশ আজ

সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা

সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা

কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে

কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে

নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি

নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি

বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে টুকুসহ বিএনপি জামায়াতের ৬ নেতা কারাগারে প্রেরণ

বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে টুকুসহ বিএনপি জামায়াতের ৬ নেতা কারাগারে প্রেরণ

শনিবার সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী

শনিবার সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী

মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার ঘটনায় আসামিদের ৫ দিনের রিমান্ড

মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার ঘটনায় আসামিদের ৫ দিনের রিমান্ড

গণবিরোধী কারফিউ দিয়ে মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে : ডা. মনীষা

গণবিরোধী কারফিউ দিয়ে মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে : ডা. মনীষা

নিহত রুদ্রের নামে শাবির প্রধান ফটকের নামকরণ

নিহত রুদ্রের নামে শাবির প্রধান ফটকের নামকরণ

তিনটি গুলি খেয়ে বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলেটা মরে গেছে’

তিনটি গুলি খেয়ে বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলেটা মরে গেছে’

মালয়েশিয়া ও প্রবাসী আর্ট মেলায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া ও প্রবাসী আর্ট মেলায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকুন- ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর এমপি

সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকুন- ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর এমপি

কুড়িগ্রামে তিন লাশ দাফন, পরিবারের আহাজারি

কুড়িগ্রামে তিন লাশ দাফন, পরিবারের আহাজারি

কুষ্টিয়ায় বছরে পাটের আবাদ কমেছে ৯০ হাজার বিঘা জমিতে

কুষ্টিয়ায় বছরে পাটের আবাদ কমেছে ৯০ হাজার বিঘা জমিতে

ভাঙন আতংকে যমুনা পাড়ের মানুষ

ভাঙন আতংকে যমুনা পাড়ের মানুষ