রক্ষক যখন ভক্ষক

Daily Inqilab ইনকিলাব

১০ জুন ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ১০ জুন ২০২৪, ১২:০৩ এএম

খবরটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ইংরেজি দৈনিক নিউএজ-এ প্রকাশিত এই খবরে বলা হয়েছে, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) অন্তত ১৫ হাজার ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য, এনআইডি কার্ডের যাবতীয় বিবরণ, কল রেকর্ডিং ও সিম ডাটা অন্যের কাছে বিক্রির অভিযোগে বাংলাদেশ পুলিশের এন্টিট্যারোরিজম ইউনিট (এটিইউ) ও র‌্যাব-৬ কে তার ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স প্লাটফরমে প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে। অতঃপর গোয়েন্দা এজেন্সি দু’টিকে নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য পুলিশ হেডকোয়ার্টার ও মোবাইল অপারেটরদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হবে। বিষয়টি নিশ্চিত করে এনটিএমসি’র ডাইরেক্টর জেনারেল মেজর জেনারেল জয়নুল আহসান বলেছেন, আমরা মেসেঞ্জার ও টেলিগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমে নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রির অভিযোগে এটিইউ ও র‌্যাব-৬ কে আমাদের ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স প্লাটফরমে প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছি। ওই দুই এজেন্সি তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। এজেন্সি দুটিকেই বের করতে হবে ওই ডাটা কাদের কাছে বিক্রী করা হয়েছে। খবরে জানা গেছে, ২৪ এপ্রিল এনটিএমসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বরাবর প্রেরিত এক পত্রে অভিযুক্ত এটিইউ সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পুলিশ (এসপি) ফারহানা ইয়াসমিন ও র‌্যাব-৬-এর অ্যাসিসট্যান্ট সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পুলিশ (এএসপি) তারেক আনাম বান্নার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানায়। এনটিএমসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে যে চিঠি দেয়, তাতে ব্যক্তির সংখ্যা উল্লেখ না থাকলেও এনটিএমসির ডাইরেক্টর জেনারেল নিশ্চিত করেন, এ সংখ্যা ১৫ হাজার হবে। যাহোক, এটিইউ, প্রধান অ্যাডিশনাল ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এআইজি এস এম রুহুল আমিনের দাবি, এসপি ফারহানা ইয়াসমিনের তথ্য বিক্রীর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি জানিয়েছেন, সাইবার ক্রাইম উইংয়ের কনস্টেবল মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী ও অপারেশন উইংয়ের কনস্টেবল খায়রুল ইসলাম এর সঙ্গে জড়িত এবং তাদের সাসপেন্ড করা হয়েছে। ওদিকে র‌্যাবের মিডিয়া ও লিগ্যাল উইংয়ের ডাইরেক্টর কমান্ডার আরাফাত ইসলাম জানিয়েছেন, অভিযুক্ত এএসপি’র বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ না হলে কিছু বলা যাবে না। স্মরণ করা যেতে পারে, এর আগে সরকারি ওয়েবসাইট থেকে নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যÑ নাম, ফোন নম্বর, ই-মেইল আইডি ইত্যাদি ফাঁস হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। ব্যক্তিগত তথ্যাবলী এভাবে ফাঁস হওয়া কিংবা বিক্রী হয়ে যাওয়া অত্যন্ত উদ্বেগের। ব্যক্তির তো বটেই, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্যও এটা ঝুঁকিপূর্ণ।

নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য যেখানেই সংরক্ষিত থাক, তা নিরাপদ থাকবে, ফাঁস, পাচার বা চুরি হবে না, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিশ্বাস করে যেসব জায়গায় তা রাখা হয়েছে, সে সব জায়গা থেকে তা ফাঁস বা চুরি হয়ে যাচ্ছে। ওই জায়গাগুলো বিশ্বাসযোগ্য নয়। যারা সেসব জায়গায় কাজ করেন, তারা সবাই বিশ্বাসযোগ্য নন। তাদের মধ্যে দুর্নীতিবাজ, টাকাখোর আছেন। রক্ষক যখন ভক্ষক তখন কিছু করার থাকে কি? র‌্যাব ও পুলিশের এন্টিট্যারোরিজম ইউনিট, আইনশৃংখলা, নাগরিক নিরাপত্তা বিধানে নিয়োজিত। অথচ তাদের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অন্য সংস্থা থেকে এনে বিক্রী করে দিয়েছেন। এর চেয়ে বড় অপকর্ম ও বিশ্বাসঘাতকতা আর কী হতে পারে! পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এ ধরনের সুপকল্পিত ও গুরুতর অপরাধ কনস্টেবলের কাজ নয়। এর সঙ্গে ‘বড়রা’ও কেউ না কেউ যুক্ত আছে। তাদের খুঁজে বের করতে হবে। এটা কোনো ছোটখাটো ব্যাপার নয়। এর সঙ্গে নাগরিক ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কোথায়, কাদের কাছে কী উদ্দেশে এতগুলো মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রী করা হলো, অবশ্যই তা বের করতে হবে। দ্রুত তদন্ত সাপেক্ষে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে পার্লামেন্ট বিস্তারিত আলোচনা হওয়া জরুরি। নাগরিকদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সংগৃহীত ও সংরক্ষিত ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার দায়িত্ব সরকারের। দেখা গেছে, তথ্যগুলো সেসব প্রতিষ্ঠানে বা জায়গায় রাখা হয়েছে, তার বেশির ভাগে নিরাপত্তা নেই, নজরদারি নেই, ভংগুর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তথ্য বিক্রী, নষ্ট, পাচার বা চুরি যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। ২০২৩ সালে যখন তথ্য ফাঁসের খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়, তখন পর্যবেক্ষকদের তরফে তথ্য নিরাপত্তার জোর দাবি জানানো হয় সেটা যে যথাযথভাবে হয়নি, হাজার হাজার মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রীর ঘটনা তারই প্রমাণ বহন করে।

অতি উদ্বেগ ও বিস্ময়ের ব্যাপার, এবার আইন শৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত দুটি এজেন্সির বিরুদ্ধে তথ্য বিক্রীর অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। অর্থ যে কতটা অনর্থের মূল, এটা থেকে সহজেই উপলদ্ধি করা যায়। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ বলে শেষ করা যাবে না। গুম-খুন, ছিনতাই, রাহাজানি, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ বা অপকর্ম নেই, যার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে নেই। এবার নাগরিকদের তথ্য বিক্রীর অভিযোগও যুক্ত হলো। সম্প্রতিকালে পুলিশের সাবেক আইজিসহ অনেক বড়কর্তার নাম চাউর হয়েছে, যারা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তাদের অপকর্ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কোনো শেষ নেই। চাকরিকালে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়া আলাদিনের চেরাগ হাতে পাওয়া ছাড়া সম্ভব নয়। প্রশাসন, পুলিশ, বিচারবিভাগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই চেরাগ হাতে পাওয়া মানুষের অভাব নেই। সব ক্ষেত্রে চরম দলীয়করণ এর প্রধান কারণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। যারা দলের প্রভাবে বা অর্থের বিনিময়ে চাকরি পেয়েছেন, তাদের সবচেয়ে বড় কাজ হয়ে দাঁড়ায় যেভাবেই হোক টাকা কামানো। তাদের নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই। পুলিশসহ সব ক্ষেত্রেই নৈতিকতার ব্যাপক স্খলন দেখা দিয়েছে। এটা দেশের জন্য অত্যন্ত পরিতাপজনক। অনিয়ম-দুর্নীতি ও যথেচ্ছাচার সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে। এর দায় সরকার এড়িয়ে যেতে পারবে না। দায় যখন সরকারের তখন প্রতিকার সরকারকেই করতে হবে। পুলিশের দুই এজেন্সির বিরুদ্ধে তথ্য বিক্রীর আলোচ্য অভিযোগের বিষয়ে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে সর্বক্ষেত্রে ও পর্যায়ে স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

প্যারিস অলিম্পিকের উদ্বোধন কেন সিন নদীতে গোলাপ ছুড়লেন আলজেরিয়ান অ্যাথলেটরা?

প্যারিস অলিম্পিকের উদ্বোধন কেন সিন নদীতে গোলাপ ছুড়লেন আলজেরিয়ান অ্যাথলেটরা?

লৌহজংয়ে অটোরিকশা চালককে কুপিয়ে হত্যা

লৌহজংয়ে অটোরিকশা চালককে কুপিয়ে হত্যা

নিখোঁজ মাদ্রাসা ছাত্রের লাশ মিললো পুকুরে

নিখোঁজ মাদ্রাসা ছাত্রের লাশ মিললো পুকুরে

‘চরম তাপ মহামারি’ বিশ্বকে ভোগাচ্ছে: জাতিসংঘ মহাসচিব

‘চরম তাপ মহামারি’ বিশ্বকে ভোগাচ্ছে: জাতিসংঘ মহাসচিব

গভীর রাতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ‘ব্লক রেইড’ অব্যাহত

গভীর রাতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ‘ব্লক রেইড’ অব্যাহত

সেতু ভবন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ পরিদর্শনে প্রধানমন্ত্রী

সেতু ভবন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ পরিদর্শনে প্রধানমন্ত্রী

নতুন নির্বাচনের দাবি ড. ইউনুসের

নতুন নির্বাচনের দাবি ড. ইউনুসের

মঙ্গলের লাল মাটিতে ‘হলুদ গুপ্তধনের’ সম্ভার! বিরাট আবিষ্কারে চাঞ্চল্য নাসায়

মঙ্গলের লাল মাটিতে ‘হলুদ গুপ্তধনের’ সম্ভার! বিরাট আবিষ্কারে চাঞ্চল্য নাসায়

পর্যটকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ শহরের তালিকায় কারাকাস, করাচি, ইয়াঙ্গুন

পর্যটকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ শহরের তালিকায় কারাকাস, করাচি, ইয়াঙ্গুন

বন্ধ ফেসবুকেই সক্রিয় প্রতিমন্ত্রী, জনমনে নানা প্রশ্ন

বন্ধ ফেসবুকেই সক্রিয় প্রতিমন্ত্রী, জনমনে নানা প্রশ্ন

আজ কোথায় কত ঘণ্টা শিথিল থাকবে কারফিউ?

আজ কোথায় কত ঘণ্টা শিথিল থাকবে কারফিউ?

বিয়ের বছর না ঘুরতেই বিস্ফোরক মন্তব্য পরিণীতির

বিয়ের বছর না ঘুরতেই বিস্ফোরক মন্তব্য পরিণীতির

রাশিয়ার পর এবার ইউক্রেনে যাচ্ছেন মোদি

রাশিয়ার পর এবার ইউক্রেনে যাচ্ছেন মোদি

আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মেহজাবীনের ‘সাবা’

আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মেহজাবীনের ‘সাবা’

আজও ঢাকাসহ ৪ জেলায় কারফিউ শিথিল ৯ ঘণ্টা

আজও ঢাকাসহ ৪ জেলায় কারফিউ শিথিল ৯ ঘণ্টা

মহাকাশে ‘বন্দি’ সুনীতা উইলিয়াম, ফেরা নিয়ে বড় আপডেট দিল নাসা

মহাকাশে ‘বন্দি’ সুনীতা উইলিয়াম, ফেরা নিয়ে বড় আপডেট দিল নাসা

আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

নির্বাচনে কঙ্গনার জয়কে চ্যালেঞ্জ করে মামলা, নোটিশ পাঠালো হাইকোর্ট

নির্বাচনে কঙ্গনার জয়কে চ্যালেঞ্জ করে মামলা, নোটিশ পাঠালো হাইকোর্ট

ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল, পালিয়েছে হাজার হাজার মানুষ

ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল, পালিয়েছে হাজার হাজার মানুষ

চীন-রাশিয়ার ৪ যুদ্ধবিমানকে ধাওয়া দিল যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা

চীন-রাশিয়ার ৪ যুদ্ধবিমানকে ধাওয়া দিল যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা