তৃতীয় মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি
১১ জুন ২০২৪, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ১১ জুন ২০২৪, ১২:০৭ এএম

ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। এই নিয়ে তিনি টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হলেন। প্রায় তিন মাসব্যাপী সাত দফায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তবে আগের দুই লোকসভায় তার দল বিজেপি ও জোট এনডিএ’র যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও দাপট ছিল, এবারের লোকসভায় সেটা নেই। ২০১৪ সালের নির্বাচনে গঠিত লোকসভায় বিজেপির আসন সংখ্যা ছিল ২৮২, এনডিএ’র ৩৩৬। ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপির আসন সংখ্যা ছিল ৩০৩ এবং এনডিএ’র ৩৫৮। এই দুইবার বিজেপি একাই সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। কিন্তু এবারের নির্বাচনে তা পায়নি। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ন্যূনপক্ষে ২৭২ আসন। এবারের নির্বাচনে বিজেপি ও এনডিএ জোটের শ্লোগান ছিল : ‘আব কি বার চারশ পার’। চারশ পার তো দূরের কথা, এবার বিজেপি ও তার জোট মিলে পেয়েছে ২৯৩ আসন। এতে জোটের পক্ষে সরকার গঠনে কোনো সমস্যা না থাকলেও বিজেপির একার পক্ষে সরকার গঠন সম্ভব নয়। তার আসন সংখ্যা ২৪০। এবারের নির্বাচনে মোদি জোটগতভাবে জিতলেও দলগতভাবে হেরেছেন। তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে যেমন জোটসঙ্গীদের সমর্থনের প্রয়োজন হয়েছে, তেমনি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যও তাদের ওপর নির্ভর করতে হবে। বিশেষ করে অন্ধ্রপ্রদেশের চন্দ্র বাবু নাইডু এবং বিহারের নীতীশ কুমারের সমর্থন ছাড়া তিনি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। চন্দ্রবাবু নাইডু ও নীতীশ কুমার যে কোনো কারণে ও মুহূর্তে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, ভোল পাল্টানো তাদের জন্য কোনো নতুন ঘটনা নয়। সে ক্ষেত্রে একটা অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে মোদিকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে হয়েছে। কতদিন প্রধানমন্ত্রিত্ব টিকে থাকবে, সেটা বলার কোনো উপায় নেই।
মোদির রাজনৈতিক উত্থান বিস্ময়কর। তিনি ছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার মুসলমান নিহত হয়। তাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার ও নির্যাতন চলে। বলা হয়, ওই হত্যা-নির্যাতনের পেছনে মোদির হাত ছিল। তাকে গুজরাটের কসাই বলেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। চরম মুসলিমবিদ্বেষ তার রাজনীতির মূলে। এটাই তাকে দিল্লীতে প্রতিষ্ঠা দেয়। তিনি হন প্রধানমন্ত্রী। গত ১০ বছরের প্রধানমন্ত্রিত্ব কালে তিনি কাউকে পরোয়া করেননি। বিজেপির বাজপেয়ীপন্থী প্রবীণ নেতাদের তিনি অপমানজনকভাবে বিদায় করে দিয়েছেন। অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথ প্রমুখের সঙ্গে মিলে ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলমানদের ওপর হত্যা-নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়েছেন। মোদিশাসনে মুসলমানদের জীবন, ধর্ম, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ইতিহাস ঐতিহ্য যেভাবে আক্রান্ত হয়েছে, অতীতে আর কারো শাসনে তেমনটি হয়নি। গোরক্ষার নামে নির্বিচারে মুসলমান হত্যা করা হয়েছে। জোর করে মুসলমানদের হিন্দু বানানো হয়েছে, বৈষম্যমূলক নাগরিক আইন ও নাগরিকপঞ্জী করা হয়েছে। সংবিধান থেকে ৩৭০ ও ৩৫ ধারা বাতিল করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা খর্ব করা হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা মোদির প্রকৃত লক্ষ্য। এক্ষেত্রে তিনি মুসলমানদের প্রধান প্রতিবন্ধক ও প্রতিপক্ষ মনে করেন। এবারের নির্বাচনে তার বিভিন্ন ভাষণে মোদি সংবিধানে ব্যাপক পরিবর্তন আনবেন, ধর্ম নিরপেক্ষতা তুলে দেবেন, হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবেন ইত্যাদি ঘোষণা দেন। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সরাসরি বক্তব্যও রাখেন, যাতে মুসলিমবিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে হিন্দুদের মধ্যে। তার লক্ষ্য পূরণে তিনি ভোটারদের কাছে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা চান। ভারতের সচেতন ভোটারদের আমরা সাধুবাদ জানাই এজন্য যে, তারা মোদির ফাঁদে পা দেয়নি। গণতন্ত্রের পক্ষে, সংবিধানের পক্ষে, ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও স্থিতির পক্ষে রায় দিয়েছে। মোদিকে কার্যত বিদায় যাত্রায় উঠিয়ে দিয়েছে। মোদিশাসনে কর্তৃত্ববাদ, হিন্দুত্ববাদ যেভাবে এগিয়ে গেছে, সেটা ভারতের ঐতিহ্যের সঙ্গে যায় না। রাজনৈতিক দল ভাংচুর, ভয় দেখিয়ে পক্ষে টানা, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ, বিচার বিভাগে প্রভাব বিস্তারÑ কোনো কিছুই মোদিশাসনে বাদ যায়নি। ভারতীয় জনগণ বুঝেছে, চেপে বসা পাথর সরানোর বিকল্প নেই। সেটাই তারা করার চেষ্টা করেছে এবং কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটকে ২৩৪ আসনে বিজয় দিয়ে ক্ষমতার প্রায় কাছাকাছি এনে দিয়েছে। অনেকের মতে, পরবর্তী সরকার ইন্ডিয়া জোটই গঠন করবে।
মোদিশাসন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে ভারতকে সম্মানিত ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে পারেনি। একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের সঙ্গে আর কোনো প্রতিবেশীর সম্পর্ক ভালো নেই। নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ভারতের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে গেছে। মালদ্বীপের মতো দেশের নাগরিকরাও ‘ভারত হঠাও’ শ্লোগান তুলতে বাধ্য হয়েছে এবং সফল হয়েছে। বাংলাদেশের সরকার ভারতের সঙ্গে সুম্পর্ক কেন বজায় রেখে চলেছে, তা কারো অজানা নেই। তবে জনগণ ভারতের আচরণে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলনে তার প্রমাণ বিদ্যমান। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ভারতের অবস্থানের অবনমন ঘটেছে। কানাডার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির কথা নজির হিসেবে উল্লেখ করা যায়। স্বীকার করতেই হবে, ভারতের নির্বাচনে ভোটাররা মোদিশাসনবিরোধী এক বিরাট বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। তাকে নিরঙ্কুশ বা একচ্ছত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয়নি, যাতে তিনি যাচ্ছেতাই করতে পারেন। একটি ‘ভঙ্গুর’ জোটের কর্তৃত্বে তাকে ন্যাস্ত করে দিয়েছে, যেখানে তিনি পদে পদে বিরোধিতার সম্মুখীন হতে পারেন। তার ইচ্ছা ও লক্ষ্য ব্যাহত হতে পারে। এর মধ্যেই তার আলামত মিলেছে। অন্ধ্রপ্রদেশে মুসলমানদের জন্য ৪ শতাংশ কোটা আছে। সেটা থাকবে বলে জানিয়েছে নির্বাচিত তেলেগু দেশম পার্টি। বিজেপি যে কোটা বিরোধী, নির্বাচনে তা প্রচার করেছে। তাছাড়া চন্দ্রবাবু নাইডু বা নীতীশ কুমার কেউই ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিতে রাজি নন। তারা পক্ষপাতি নন হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়ও। বুঝাই যায়, প্রধানমন্ত্রী মোদি আর আগের মতো ক্ষমতার দর্প প্রদর্শন করতে পারবেন না। তার দর্পচূর্ণ করার জন্য ভোটাররাই নিরবে ভূমিকা রেখেছে। এক্ষেত্রে ইন্ডিয়া জোটের কৃতিত্বও অনস্বীকার্য। রাহুল গান্ধী অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দোপাধ্যায় মোদির বিরুদ্ধে কথা ও কাজে যেভাবে লড়েছেন তার তুলনা হয় না। মোদি ছাড়া গতি নেই, এখন সে মিথ শেষ। ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশন তার সক্ষমতা ও নিরপেক্ষতার প্রমাণ রেখেছে। জনগণের কাছেই যে ক্ষমতা নিহিত রয়েছে, আবারও তার প্রমাণ মিলেছে। এখানে অধ্যাপক আলী রীয়াজের একটি মন্তব্য প্রাণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘ভারতে নির্বাচনের ফল বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রকামীদের সামান্য নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আমরা আশা করি, ভারতে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ তরান্বিত হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক সার্বভৌম ভিত্তিতে প্রসারিত হবে।’
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

চীন-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করলে উভয়েই হেরে যাবে : চীনা প্রধানমন্ত্রী

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব নাকচ ট্রাম্পের দূতের

ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নিহত হলেন হামাস নেতা বারহুম

গাজার নাসের হাসপাতালে ইসরায়েলি হামলা, নিহত হামাস নেতা

ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদে পানিকে অস্ত্র বানিয়েছে ইসরায়েল: আব্বাস

গাজায় মধ্যরাতে ইসরায়েলি হামলা নারীসহ নিহত ১২ ফিলিস্তিনি

ইনভেস্টমেন্ট সামিটে আমন্ত্রণ পাচ্ছে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি

বীরগঞ্জে তিন বছরের শিশু ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে ভ্যানচালক গ্রেফতার

রোমাঞ্চকর টাইব্রেকার জিতে সেমিতে ফ্রান্স

টাইব্রেকারে ডাচদের বিদায় করে সেমিতে উঠলো স্পেন

নাটকীয় জয়ে সেমিফাইনালে রোনালদোর পর্তুগাল

দুর্নীতি মামলায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের সেই মালেকের ১৩ বছরের কারাদণ্ড

এনআইডি সংশোধনের ঝুলে থাকা ৪ লাখ আবেদন সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিষ্পত্তি করবে ইসি

গাজায় ইহুদি হত্যাকাণ্ডে শহীদ ফিলিস্তিনি ৫০ হাজার ছাড়াল

জগন্নাথের সামনে অবৈধ বাসস্ট্যান্ড, চাঁদাবাজির দায় পড়ে ছাত্রনেতাদের ওপর

সস্তা শ্রম ও বাজার সুবিধায় প্রাধান্য দিচ্ছেন জাপানি ব্যবসায়ীরা : জেট্রোর প্রতিবেদন

জবি ভর্তি পরীক্ষার তিন ইউনিটের ফল প্রকাশ

মিডল্যান্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী

নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিতে হবে : শিল্প উপদেষ্টা

বাসস এমডিসহ ৩ জনের নামে যুগান্তর সম্পাদকের ১০ কোটি টাকার মানহানি মামলা