ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ করতে হবে

Daily Inqilab মো. জাহিদুল ইসলাম

১৪ জুন ২০২৪, ১২:২৮ এএম | আপডেট: ১৪ জুন ২০২৪, ১২:২৮ এএম

আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের মধ্য দিয়ে বর্তমান পৃথিবী চলমান। যত নতুন আবিষ্কার হচ্ছে ততই মানুষ যান্ত্রিকতায় মগ্ন হচ্ছে। বর্তমানে বাস্তবতাটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, আমরা যন্ত্রকে দখল করতে পারিনি। বরং আমরাই যন্ত্রের দখলে রয়েছি। আধুনিক প্রজন্মের কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরাই অত্যাধুনিক তথ্য প্রযুক্তির মূল ব্যবহারকারী। পৃথিবীর বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বিপুল সম্ভাবনার নতুন নতুন দ্বার খুলে দিচ্ছে তথ্য প্রযুক্তি। আধুনিক বিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য উন্নতির ফলে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিতে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনেছে অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি। বিভিন্ন উদ্ভাবনের ফলে বর্তমান বিশ্ব এগিয়েছে অনেক দূর। পক্ষান্তরে প্রযুক্তির অসংখ্য ইতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও এর অপব্যবহার গ্রাস করছে আধুনিক প্রজন্মকে। প্রযুক্তির অকল্যাণকর দিকগুলো যেন ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বকে। বর্তমান পৃথিবী সম্পূর্ণরূপে ডিজিটাল প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল। ডিজিটালাইজেশনের এ যুগে তথ্য খুব দ্রুত ও সহজে মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। তরুণ সমাজ মানেই ডিজিটালাইজড সমাজ। প্রযুক্তির অকল্যাণকর দিকগুলো ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে আমাদের বর্তমান সমাজকে। অনলাইন বা ডিজিটাল মাধ্যম যেমন অনেক কাজকে সহজ ও সাশ্রয়ী করে তুলেছে তেমনি আবার রয়েছে এর অনেক মারাত্মক বিড়ম্বনাও। অন্যদিকে বিভিন্ন বয়সী প্রযুক্তি ব্যবহারকারীরা নানা ধরনের গেমসের চরিত্রে নিজেকে আবিষ্কার করতে গিয়ে জড়াচ্ছে অপরাধে। এমনকি না জেনে এসব বিপদজনক পথে প্রাণও বিসর্জন দিচ্ছে। প্রযুক্তি যেন আমাদের কল্যাণ করতে গিয়ে কোনোভাবেই অকল্যাণ না করে সে দিকটায় অত্যন্ত সুদৃষ্টি দেওয়া খুবই প্রয়োজন।

বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে প্রযুক্তির ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা আমাদের মস্তিষ্ক অকার্যকর করে দেয়, যার প্রভাব প্রায় প্রতিনিয়তই আমাদের মধ্যে ঘটেই চলেছে। প্রযুক্তি ছাড়া আমরা কিছু ভাবতে বা করতে পারি না। এই অভ্যাসটাই হলো প্রযুক্তি অ্যাডিকশন। প্রযুক্তি অ্যাডিকশনে আমরা যত বেশি মত্ত হয়ে পড়ব ততই আমাদের ফিরে আসা কঠিন হবে। আসক্তি শুধুমাত্র মাদকজাতীয় দ্রব্যের অপব্যবহার নয়। যেকোনো কিছুর অপব্যবহার থেকে আমরা আসক্ত হতে পারি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অনলাইনে জুয়া খেলার আসক্তি। এছাড়াও যেকোনো কর্মকা-, যা মানসিক, শারীরিক বা সামাজিকভাবে হানিকারক এবং নিজের ক্ষতি জেনেও সেই ক্রিয়ার প্রতি ব্যবহারকারীর অপ্রতিরোধ্য আকাক্সক্ষার পুনরাবৃত্তিই সেই ব্যবহারকারীর আসক্ত হওয়ার পরিচয় বহন করে। একজন আসক্ত ব্যক্তি নিজের অজান্তেই কোনও বস্তুর প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে উঠে। এরপর এর মধ্য দিয়ে এক ধরনের আনন্দ উপভোগ করা শুরু করে। এক্ষেত্রে মানুষ যখন কোনও বস্তুর দ্বারা আচ্ছন্ন বা বশবর্তী হয়ে যায় তখন তার কাছে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলি যেমন, পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং দায়িত্ব-কর্তব্য সবই গুরুত্ব হারিয়ে যায়। ফলে সেই মানুষটি যেমন সমস্যায় পড়ে তেমন তার চারপাশে থাকা লোকজনরাও নানা অসুবিধার সম্মুখীন হয়। ইন্টারনেট বা অনলাইন কার্যকলাপের অত্যধিক ব্যবহার একজন ব্যক্তিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতিবাচক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। প্রযুক্তি আসক্তি স্বাভাবিকভাবেই একজন ব্যবহারকারীকে সামাজিক মিডিয়া, গেমিং, জুয়া, অনলাইন পর্নগ্রাফির সমস্যাযুক্ত ব্যবহার এবং অন্যান্য সহ বিভিন্ন ধরনের অনলাইন কার্যকলাপকে জড়িত করে ফেলতে পারে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাইবার বুলিং, অনলাইন স্ক্যাম, মাদকপাচার, এমনকি সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত করতে অপরাধীরা প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আবেগ-অনুভূতির জানানোর সবচেয়ে বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। কেউ একজন আত্মহত্যা করছে তার আগে সে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দিচ্ছে। আবার লাইভে গিয়েও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। এমনকি ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বলতেও বর্তমানে কিছুই নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর মধ্যে ফেসবুক সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। ফেসবুকের কল্যাণে বর্তমানে আমরা সবাই ভার্চুয়াল বন্ধু। ভার্চুয়াল এ ফ্রেন্ড জগতে কেবল লাইক, কমেন্ট আর শেয়ার করা এগুলোর মধ্যেই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকি আমরা অধিকাংশ ব্যবহারকারীরা। যদি আমরা এসব সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শিক্ষনীয় ভালো কিছু গ্রহণ করতে পারি তবে সেটিই হবে আমাদের জন্য সবচেয়ে কল্যাণকর। ফেসবুকে আমাদের তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ ব্যস্ত থাকছে। কাজেই তাদের চিন্তা ভাবনার একটি বড় অংশ ফেসবুকে মন্দ কাজের জন্য ব্যবহার না করে ভালো কাজে ব্যবহার করলে সবাই উপকৃত হবে। ইন্টারনেটের অপব্যবহার বৃদ্ধির কারণে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে বহুগুণ। এজন্য মোবাইল ফোনসহ সব ধরনের আধুনিক প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে সকলকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

ডিজিটাল ডিটক্স প্রযুক্তি এবং ডিভাইসের প্রতি আসক্তি প্রতিরোধে সাহায্য করে। ডিজিটাল ডিটক্স পদ্ধতি হলো এমন একটা সময়সীমা যেখানে একজন ব্যক্তি ইন্টারনেট কানেক্ট করা যায় এমন সমস্ত যন্ত্র যেমন স্মার্টফোন বা কম্পিউটার ব্যবহার থেকে দূরে থাকে। ডিজিটাল ডিটক্স পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা নিজের জন্য একটি সময়সীমা ঠিক করে (হতে পারে কয়েক ঘণ্টা কিংবা কয়েকদিন)। নির্ধারিত এই সময়সীমার মধ্যে ব্যবহারকারী সমস্ত স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ দূরে সরিয়ে রেখে এই সময়টায় ইন্টারনেট থেকে, সোশ্যাল মিডিয়া, টেলিভিশন এবং ভিডিও গেমস থেকে সম্পূর্ণ ডিসকানেক্ট করে নেয় নিজেকে। জীবনকে সহজ যেমন করছে প্রযুক্তি তেমনি মানুষের মাঝে বিভেদ, নিজস্ব স্বকীয়তা হারাতে বাধ্য করে তুলছে। আজকাল ইন্টারনেট ও এর সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে অপরাধীরা সহজেই জাল বিস্তার করে চলেছে। এমতবস্থায় আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। প্রয়োজনে তথ্য-প্রযুক্তি বা বিজ্ঞানসন্মত প্রযুক্তির অপব্যবহার রুখে দিতে তৈরি করতে হবে যুগোপযোগী আইন। অথবা আইনে আনতে হবে সময়োপযোগী প্রয়োজনীয় সংশোধনী। পাশাপাশি এর শতভাগ স্বচ্ছ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সচেতনতা ও শিক্ষার প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে, বর্তমান যুগে আমরা প্রযুক্তিকে পরিহার করে চলতে পারব না। বরঞ্চ প্রযুক্তির দক্ষ এবং সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা বিশ্বে সম্মানের আসনে আসীন হতে পারবো। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষিত ও দক্ষ জনগোষ্ঠীতে পরিণত করতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটির অপব্যবহার জাতির জন্য অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য প্রযুক্তির অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান থাকলে অপরাধীরা অপরাধ সংঘটন থেকে বিরত থাকবে। প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়ে পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এছাড়াও, গণমাধ্যমের মাধ্যমে প্রযুক্তি ব্যবহারের সচেতনতামূলক প্রচারণা চালালে অনেক সুফল পাওয়া যাবে ।

লেখক: নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

 


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা