ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

মেগা-প্রজেক্ট গ্রহণের বাতিক ও হিড়িকে অর্থনীতি বিপদে

Daily Inqilab ড. মইনুল ইসলাম

১৪ জুন ২০২৪, ১২:২৮ এএম | আপডেট: ১৪ জুন ২০২৪, ১২:২৮ এএম

 

২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল নির্ধারিত ‘স্বল্পোন্নত দেশের’ ক্যাটেগরি থেকে ‘উন্নয়নশীল দেশের’ ক্যাটেগরিতে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ঐ প্রক্রিয়ার সফল পরিসমাপ্তির পর ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে। গত দু’দশক ধরে বাংলাদেশের জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির হার ৫.৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮.১৩ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। করোনা ভাইরাস মহামারির আঘাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৩.৮ শতাংশে নেমে গেলেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ২০১৯ অর্থবছরের ১৯০৯ ডলার থেকে বেড়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন তারিখে ২৭৬৫ ডলারে এবং ২০২৪ সালের মে মাসে ২৭৮৪ ডলারে পৌঁছেছে বলে সরকার দাবি করছে। যে দশটি গুরুত্বপূর্ণ ডাইমেনশন বাংলাদেশের অর্থনীতির এই ইতিবাচক পরিবর্তনকে ধারণ করছে সেগুলো নি¤œরূপ:
১। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২’ মোতাবেক ২০২২ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার অনুপাত ১৮.৭ শতাংশে নেমে এসেছে। অথচ ১৯৭২ সালে এদেশের ৮২ শতাংশ মানুষের অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল।
২। ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছর থেকে ১৯৮১-৮২ অর্থ-বছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি’র অনুপাত হিসেবে বৈদেশিক সাহায্য ১০ শতাংশের বেশি ছিল এবং ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে ঐ অনুপাত ১৩.৭ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। বৈদেশিক সাহায্যের ওপর এদেশের অর্থনীতির নির্ভরতা ক্রমান্বয়ে কমে ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে জিডিপি’র এক শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, ২০২২-২৩ অর্থ-বছরের বৈদেশিক ঋণ বা অনুদানের মাত্র ১ শতাংশের মতো ছিল খাদ্য সাহায্য, আর বাকি ৯৯ শতাংশই ছিল প্রকল্প ঋণ। এখন বাংলাদেশ আর পণ্য সাহায্য নেয় না। এর তাৎপর্য হলো, বৈদেশিক ঋণ-অনুদানের ওপর বাংলাদেশের অর্থনীতির টিকে থাকা না থাকা এখন আর নির্ভর করে না। বাংলাদেশ এখন আর খয়রাত-নির্ভর দেশ নয়; এটা এখন একটি বাণিজ্য-নির্ভর দেশে পরিণত হয়েছে।
৩। বাংলাদেশ এখন তার আমদানি ব্যয় আর রফতানি আয়ের ব্যবধানটা প্রায়ই বছর মেটাতে সক্ষম হচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশীদের বৈধ পথে প্রেরিত রেমিট্যান্সের চমকপ্রদ প্রবৃদ্ধির হার এবং বাংলাদেশের রফতানি আয়ের বছরের পর বছর অব্যাহত চলমান প্রবৃদ্ধি দেশের লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে স্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে। (
৪। জনসংখ্যার অত্যন্ত অধিক ঘনত্ব, জমি-জন অনুপাতের অত্যল্পতা এবং চাষযোগ্য জমির ক্রম-সংকোচন সত্ত্বেও বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে এখন ধান-উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়েেেছ। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের ধান উৎপাদন ছিল মাত্র এক কোটি দশ লাখ টন। ২০২২ সালে তা সাড়ে তিন গুণেরও বেশি বেড়ে তিন কোটি বিরান্নব্বই লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। ধান, গম ও ভুট্টা মিলে ২০২২ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল চার কোটি ষাট লাখ টন। ২০২২ সালে বাংলাদেশে এক কোটি পাঁচ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। (এখনো আমরা অবশ্য প্রায় ৫৫ থেকে ৬০ লাখ টন গম আমদানি করি।)

মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশে^ দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে। তরিতরকারি, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশে^ চতুর্থ। খাদ্যশস্য, মাছ, তরিতরকারি উৎপাদনের এই সাফল্য বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠির খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি ও পুষ্টিমান উন্নয়নে সহায়তা করেছে। এটাও খুবই গুরুত্ববহ যে, আকস্মিক খাদ্য সঙ্কট মোকাবেলার জন্যে ১৫ লাখ টন খাদ্যশস্যের বিশাল মজুতও গড়ে তোলা হয়েছে।

৫। গত দুই দশক ধরে গড়ে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৮ শতাংশের মত। করোনা ভাইরাস মহামারি আঘাত হানার আগের বছর ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হয়েছিল ৮.১৩ শতাংশ। করোনা ভাইরাস মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক অভিঘাত সত্ত্বেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির হার আবার ৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশে^র অন্যতম গতিশীল অর্থনীতি।

৬। ২০২২-২৩ অর্থ-বছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিল ৫৫.৫৬ বিলিয়ন ডলার (৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলার)। অথচ ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে রফতানি আয় ছিল মাত্র ৭৫২ মিলিয়ন ডলার, মানে ৭৫.২ কোটি ডলার। চীনের পর বাংলাদেশ পোষাক রফতানিতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। চামড়াজাত পণ্য, ঔষধ, সিরামিক পণ্য, জাহাজ নির্মাণ, ডিজিটাল পণ্য ও কৃষি-ভিত্তিক খাদ্যপণ্য রফতানি বাজারে ভালই সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।

৭। বাংলাদেশের এক কোটি পঞ্চান্ন লাখেরও বেশি মানুষ বিদেশে কাজ করছেন ও বসবাস করছেন। গত চার দশক ধরে প্রতি বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েই চলেছে এবং ২০২২-২৩ অর্থ-বছরে ফর্মাল চ্যানেলে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহ ২১.৬১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, হুন্ডির মত অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে প্রেরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণও ২০ থেকে ২৫ বিলিয়ন ডলারের মতো।

৮। ড. ইউনূস উদ্ভাবিত ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের সাফল্য গ্রামের ভূমিহীন নারীদের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেওয়ার একটা অত্যন্ত কার্যকর হাতিয়ার বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতাদের জীবন ও জীবিকাকে এই ক্ষুদ্রঋণ বেশ খানিকটা সহজ করে দিয়েছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ২৮ শতাংশ ঋণগ্রহীতা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সাফল্য অর্জন করেছেন। অবশ্য ক্ষুদ্রতর সংখ্যক ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা সাফল্যের সাথে দারিদ্র্য থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে পেরেছেন। দেশের দরিদ্র নারীদের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেওয়ার এই সফল উদ্ভাবনটিকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক দিক উন্মোচনের কৃতিত্ব দিতেই হবে।

৯। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মোতাবেক দেশের দ্রুত বিকাশমান পোশাক শিল্পে ৪০ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর এই শ্রমিকদের ৬০ শতাংশেরও বেশি নারী। সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক অবস্থানের এসব নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পখাতে কাজের ব্যবস্থা করাটা তাদের বঞ্চনা ও চরম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে একটি তাৎপর্যপূর্ণ নিরোধক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে বলতেই হবে, তৈরি পোশাক শিল্পখাত বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের একটি অত্যন্ত ইতিবাচক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

১০। উপরন্তু ডিজিটাল অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায়ও বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। দেশে ১৮ কোটি মোবাইল টেলিফোন ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দশ কোটি ছাড়িয়েছে।

এহেন সাফল্যগুলোর ধারাবাহিকতায় বর্তমানে অর্থনীতি যে স্বস্তিকর অবস্থানে থাকার কথা তার পরিবর্তে অর্থনীতিতে সঙ্কট জটিল আকার ধারণ করা অস্বাভাবিক হলেও এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার জো নেই। জিডিপি প্রবৃদ্ধি বর্তমান ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫.৮ শতাংশে নেমে যাবে বলে বিশ^ ব্যাংক প্রক্ষেপণ ঘোষণা করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ২০২৩ সালের দুর্নীতির র‌্যাংকিং অনুযায়ী বাংলাদেশ আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের র‌্যাংকিং অনুসারে ২০২৩ সালে বিশে^র সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল খারাপের দিক থেকে ১০ নম্বরে।

২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করলেও সরকার এই অঙ্গীকার পূরণকে ‘বাত কা বাতে’ পর্যবসিত করেছে। হুন্ডি ডলারের চাহিদার দিক বিবেচনা করলে হুন্ডি প্রক্রিয়ায় বিদেশে পুঁজি পাচারের সাথে দুর্নীতির ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকারভাবে কঠোর না হলে পুঁজি পাচার দমন অসম্ভব। পুঁজি পাচার দমন না করলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থামানো যাবে না।

অর্থনীতি বিপদে পড়ার আরেকটি বড় কারণ প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তে একের পর এক মেগা-প্রজেক্ট গ্রহণের খামখেয়ালি বাতিক ও হিড়িক। বাংলাদেশে গত এক দশকে অনেকগুলো মেগা-প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হয়েছে কিংবা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে যেগুলোর কয়েকটিকে স্বল্প-প্রয়োজনীয় অথবা অপ্রয়োজনীয় বলা চলে। ভাল ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ ছাড়াই এসব প্রকল্প গৃহীত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। চলমান প্রকল্পের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা থেকে পদ্মাসেতু হয়ে যশোর এবং পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প, ঢাকা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাস্তবায়নাধীন বিআরটি প্রকল্প এবং চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প ‘সাদা হাতি’ প্রকল্পের নিকৃষ্ট উদাহরণ। এখন আবার রূপপুরে দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্প গ্রহণের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণের পরিবর্তে যদি এহেন চটকদার ও স্বল্প-প্রয়োজনীয় প্রকল্প গৃহীত হতে থাকে তাহলে কয়েক বছরের মধ্যে শ্রীলংকার মত ঋণগ্রস্ততার ফাঁদে বাংলাদেশও পড়তে পারে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

এহেন ‘সাদা হাতি’ প্রকল্পগুলো যে ইতোমধ্যেই দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধকে বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে গেছে সেটা ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বৈদেশিক ঋণের সুদাসল পরিশোধ খাতে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তার চাইতে এ-বছর প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বেশি খরচ হবে এই খাতে। মেগা-প্রজেক্টগুলোর ঋণ পরিশোধের ‘গ্রেস-পিরিয়ড’ শেষ হলে আগামী অর্থ-বছরগুলোতে এই খাতে বরাদ্দ আরো অনেক দ্রুতগতিতে বাড়বে ২০৩০ সাল পর্যন্ত। সরকারের কর-জিডিপি’র অনুপাত যেখানে ৮ শতাংশে নেমে গেছে সেখানে ঋণ পরিশোধের জন্য দ্রুতবর্ধমান বাজেট-বরাদ্দ অশনি সংকেতের শামিল।

বাজেটকে সামনে রেখে আরেকটি বিষয়কে গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করতেই হবে, সেটা হলো ক্রমহ্রাসমান কর-জিডিপি অনুপাত। কর-জিডিপি অনুপাত কমতে কমতে ৮ শতাংশের কাছাকাছি এসে গেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনি¤œ। কর-জিডিপি’র অনুপাত কমতে থাকায় বাজেটের ব্যয়-সংকুলানের জন্য সরকারি ঋণের বোঝা বাড়ছে। প্রত্যক্ষ করের অবদান কর-রাজস্বের এক-তৃতীয়াংশ, বাকি দুই-তৃতীয়াংশ আসে পরোক্ষ কর থেকে। এর মানে দেশে করের মূল বোঝা বহন করে চলেছে সাধারণ জনগণ। সমাজের উচ্চবিত্ত গোষ্ঠি এদেশে দুর্নীতির মাধ্যমে কর ফাঁকি দেওয়ায় এতখানি পারঙ্গম রয়ে গেছে যে তারা ‘ন্যায্য করের বোঝা’ থেকে রেহাই পেয়েই চলেছে।

আরেকটি দুঃখজনক ব্যাপারে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা অগ্রহণযোগ্য। মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে যদি দেশে আয়বন্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে তাহলে নি¤œবিত্ত ও নি¤œ-মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পরিমাপ করার জন্য গিনি সহগ (বা জিনি সহগ) সবচেয়ে বহুল-ব্যবহৃত পরিমাপক। কোন অর্থনীতির গিনি সহগ যখন বেড়ে ০.৫ এর কাছাকাছি পৌঁছে যায় বা ০.৫ অতিক্রম করে তখন ওই দেশকে ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ’ অভিহিত করা হয়। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের গিনি সহগ ছিল মাত্র ০.৩২, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ মোতাবেক সেটা বেড়ে ০.৪৯৯ এ পৌঁছে গেছে। এর মানে বাংলাদেশ বর্তমানে একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হয়েছে।

সবশেষে বর্তমান মারাত্মক রাজনৈতিক সঙ্কটের কথা বলতেই হবে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোটের গণতন্ত্র পুরোপুরি লাইনচ্যুত হয়ে গেছে। ওই নির্বাচনে আগের রাতে ব্যালট জবরদখলের মোটেও প্রয়োজন ছিল না, মহাজোট এমনিতেই সুষ্ঠু নির্বাচনে জিতে আসত। কিন্তু আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব জনগণের নাড়িস্পন্দন বুঝতে পারেননি। এদেশে অদূর ভবিষ্যতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরত আসবে না। দেশে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আরেকটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবারের নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৪টি আসনে জয়ী হয়েছে। কিন্তু ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী যাঁরা জয়ী হয়েছেন তাঁদের মধ্যে ৬ জন ছাড়া ৫৬ জন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী হওয়ায় ২৮০টি আসনে আওয়ামী লীগই বিজয়ী হয়েছে বলা চলে। (জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ এবং কল্যাণ পার্টির বিজয়ী প্রার্থীরাও আওয়ামী লীগ-সমর্থিত)। নির্বাচনের দিন বিকেল তিনটায় নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছিল তখন পর্যন্ত ২৭.১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে, যেটাকে বিশ^াসযোগ্য মনে হয়নি। ভোটের পর এখন তারা বলছে, নির্বাচনে ৪১.৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। শেষের এক ঘন্টায় ১৪.৮৪ শতাংশ বৈধ ভোট পড়ার বিষয়টি একেবারেই অবিশ^াস্য! গণতন্ত্রের এই সঙ্কট অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে বড়সড় বাধা হিসেবেই থেকে যাচ্ছে।

লেখক : ড. মইনুল ইসলাম, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ, বিশিষ্ট লেখক-কলামিস্ট, সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর অর্থনীতি বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা