ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

কোরবানির গরু কিনতে সতর্ক হতে হবে

Daily Inqilab মো. বশিরুল ইসলাম

১৫ জুন ২০২৪, ১২:১৪ এএম | আপডেট: ১৫ জুন ২০২৪, ১২:১৪ এএম

১৭ জুন সোমবার উদযাপিত হবে ঈদুল আজহা। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভে সামর্থবান মুসলমানরা এ দিন পশু কোরবানি দেবে। কোরবানির জন্য আমাদের দেশে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পশু হলো গরু। কেউ কেউ আবার ছাগল, মহিষ, ভেড়া, উট, দুম্বাও কোরবানি দিয়ে থাকে। তাইতো, যারা কোরবানি দেবে, তাদের বেশির ভাগই এখন হাটমুখী। তবে ঈদের দুই থেকে তিন দিন আগ থেকে গরু সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হয়। প্রতিবারের মত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গরু-ছাগল আসতে শুরু করেছে রাজধানীর বিভিন্ন কোরবানীর পশুর হাটে। হাটে গিয়ে পছন্দের পশু ও দামের খোঁজখবরও নিতে শুরু করেছে ক্রেতারাও।

ছোটবেলা বাবার হাত ধরে কিংবা দল বেঁধে পশুর হাটে যাওয়ার আনন্দটাই যেন ভিন্ন। তরুণ থেকে মধ্যবয়সীদের তো নিয়মিতই হাটে আনাগোনা থাকে। এক হাট থেকে অন্য হাটে ঘুরে বেড়ানো, বড় গরুর সাজসজ্জা দেখা, রাস্তায় যেতে যেতে অন্যের কেনা পশুর দাম জিজ্ঞেস করা -এমন অনেক মুহূর্তই আনন্দ দেয়। তবে ডিজিটাল যুগে এই চিত্রের বদল এসেছে। অনেকেই এখন কোরবানির পশুও কিনে রাখছে অনলাইনে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির পর থেকে অনলাইনে গরু কেনা-বেচার সাইটগুলোও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এখানে গরু-ছাগলের ছবির পাশাপাশি থাকে পশুর ওজন, উচ্চতাসহ বিস্তারিত তথ্য। আর দরদাম পছন্দ হলেই বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ারও দায়িত্ব নেয় এসব সাইট।

আমাদের মনে রাখা উচিত কোরবানি মানে যে শুধু একটি পশু জবাই, তা কিন্তু নয়। এই পশুর উপর শুধু নিজেদের হকই নয় আছে গরীবদের হকও। তাইতো কোরবানির জন্য যে পশুটি আমরা কিনছি, সেটা কি সুস্থ ও নিরাপদ কি না, তার মাংস খাওয়া নিরাপদ হবে কি না- এসব বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। কারণ, এসময় পশু কেনা হলেও তা যাচাই-বাছাই করার পারদর্শিতা থাকে হাতে গোনা কিছু মানুষের। এ সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অল্পদিনের মধ্যে গরু মোটাতাজা করতে গো-খাদ্যের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ট্যাবলেট ব্যবহার করে। মাংসপেশিতে প্রয়োগ করে নিষিদ্ধ ইনজেকশন, যা গরু ও জনস্বাস্থ্য উভয়ের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই পশু নির্বাচনের কিছু মৌলিক বিষয় আমাদের জানা থাকলে নির্বাচনের ভুল-ভ্রান্তি কম হবে এবং একটি উৎকৃষ্টমানের পশু ক্রয় করা সম্ভব হবে।

সুস্থ গরুর প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো গরুটি সক্রিয় থাকবে। লেজ দিয়ে মশা-মাছি তাড়াবে। গায়ে হাত দিলে বা চিমটি দিলে গরু প্রতিক্রিয়া দেখাবে, সহজেই রেগে যাবে। নাকের নিচে লোমবিহীন অংশে (মাজল) ভেজা ভাব থাকবে। সুস্থ গরুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো পান চিবানোর মতো সব সময় জাবর কাটতে থাকবে। অনেকক্ষণ জাবর না-কাটলে সেই গরুর নানান সমস্যা আছে ধরে নিতে হবে। যেমন পেটে গ্যাস জমতে পারে। স্বাভাবিকভাবে গরু শ্বাস-প্রশ্বাস নেবে, মিনিটে ১৫ থেকে ১৬ বার। গোবর স্বাভাবিক থাকবে, পাতলা না। এছাড়া গরুর মুখের সামনে খাবার ধরলে যদি সঙ্গে সঙ্গে জিহ্বা দিয়ে টেনে নেয় তাহলেও বোঝা যায় গরুটি সুস্থ কারণ অসুস্থ পশু খাবার খেতে চায় না।

স্টেরয়েড দিয়ে মোটাতাজা করা গরু স্বাস্থ্যবান দেখাবে কিন্তু এরা তেমন চটপটে হবে না। খুব বেশি নড়াচড়া করতে দেখা যাবে না।স্বাভাবিকভাবেই গরুর গায়ে আঙুল দিয়ে চাপ দিলে মাংস একটু দেবে যায়। সুস্থ গরুর ক্ষেত্রে এই চাপ ছেড়ে দিলেই মাংস স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তবে কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা গরুর গায়ে আঙুলের চাপ দিলে তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে বেশি সময় নেয়। ক্ষত থাকলে, খাদ্যের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হলে মুখ দিয়ে লালা পড়ে, মাথা নিচের দিকে রেখে ঝিমায় এবং কান নিচের দিকে ঝুলে থাকে। এসব লক্ষণ দেখেও কোরবানির পশুর হাটে ভালো গরু পরখ করে নেওয়া যায়।

তবে সব গরুই অবৈধভাবে মোটাতাজা করা নয়। গরু মোটাতাজা করার বৈজ্ঞানিক ও বৈধ পদ্ধতিও আছে। তা হচ্ছে ‘ইউরিয়া মোলাসেস’ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে গরু প্রাকৃতিকভাবেই মোটাতাজা হয়ে ওঠে। অনেক খামারিই এ পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে। এবার প্রশ্ন হলো, গরুকে ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়েছে কি না তা নিশ্চিত হবে কিভাবে? এ জন্য গরুর শ্বাস-প্রশ্বাস দেখতে হবে। ট্যাবলেট খাওয়ানো গরুর শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়, মনে হয় যেন হাঁপাচ্ছে আর প্রচ- ক্লান্ত দেখাবে এটিকে। রোগাক্রান্ত হলে তার কানের গোঁড়ায় হাত দিয়ে স্পর্শ করলে জ্বরের মতো অস্বাভাবিক গরম অনুভূত হতে পারে।

হাট থেকে গরু কিনে বাড়ি নেওয়ার পর বেশির ভাগ গরু একবার বসলে আর দাঁড়াতে চায় না। কোনো কিছু খেতে চায় না। তখন অনেকেই মনে করে, পশুটি অসুস্থ। প্রকৃত অর্থে পশুটি তখন বেশ ক্লান্ত। তাই তাকে বিরক্ত না করে অথবা খাবার খাওয়ানোর জন্য জোর না করে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা বিশ্রাম দিতে হবে। এ সময় পশুর সামনে ঘাস ও পানি রাখা যেতে পারে। নিজের প্রয়োজনে পশু সেটি খাবে। তবে পশু কেনার সময় বিক্রেতার কাছ থেকে পশুর পছন্দের খাবার সম্পর্কে জেনে নেওয়া যেতে পারে। কোরবানির ১২ ঘণ্টা আগে পশুকে শুধু পানি ছাড়া অন্য কোনোই খাদ্য না দেওয়া ভালো। এতে করে চামড়া ছাড়ানো সহজ হবে।

পশু ক্রয় থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। পশুকে ভাতের মাড় বা কাঠাঁলের চোবড়া বেশি খাওয়ানো ঠিক না। এতে করে পশুর পেটে গ্যাস জমা হয়ে পেট ফুলে যেতে পারে।

পশু জবাইয়ের আগে অবশ্যই ছুরিতে ধার দিয়ে নিতে হবে। এছাড়াও কোরবানির পশুর আরও বিশেষ কিছু যতœ নেওয়া চাই। যেমন পশু কেনার পর জবাইয়ের আগ পর্যন্ত পশুটিকে পরিষ্কার স্থানে রাখা। সম্ভব হলে গোসল করানো। আবহাওয়া গরম থাকলে পানির সঙ্গে স্যালাইনও খাওয়ানো যেতে পারে। রাসয়নিক খাবার না দিয়ে স্বাভাবিক খাবার দেওয়া উচিত। খাবার জোর করে বেশি খাওয়ানোর চেষ্টা না করা ভালো।

কোরবানির পশুর ক্ষেত্রে বয়স গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। গরুর ক্ষেত্রে বয়স কমপক্ষে দুই বছর হতে হবে। গরুটির দাঁত দেখে বয়স বোঝা যায়। সুস্থ, পূর্ণবয়স্ক গরুর দাঁত দেখে ৫ বছর পর্যন্ত বয়স শনাক্ত করা যায় নিখুঁতভাবে। দুই বছর বয়সী একটি সুস্থ গরুর দুইটি স্থায়ী কর্তন দাঁত থাকে। ৩ বছর বয়সে চারটি, ৪ বছর বয়সে ছয়টি ও ৫ বছর বয়সে পুরো মুখে সর্বমোট আটটি স্থায়ী কর্তন দাঁত থাকে। দাঁতগুলো অক্ষত এবং দেখতে সুন্দর হয়। ছাগলের ক্ষেত্রে বয়স কমপক্ষে এক বছর হওয়া উচিত। উটের ক্ষেত্রে কমপক্ষে পাঁচ বছর, ভেড়ার ক্ষেত্রে কমপক্ষে এক বছর বয়স হতে হবে। তবে ছয় মাস বয়সী ভেড়া যদি বড়সড় হয়, অর্থাৎ যদি দেখতে এক বছর বয়সের মতো দেখায় তাহলে সেই ভেড়া কোরবানি করা যাবে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর কোরবানির জন্য এক কোটি ৩০ লাখের বেশি পশু রয়েছে। আর দেশে চাহিদা রয়েছে এক কোটি ১০ লাখের মতো। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় ২০ লাখ পশু বেশি আছে। চাহিদার চেয়ে দেশে কোরবানির পশুর সংখ্যা বেশি হওয়ায় এ বছরও পশু আমদানির অনুমতি দেবে না সরকার। একটা সময় দেখা যেত কুরবানির ঈদের সময় এলে সীমান্ত পথ দিয়ে দলে দলে গরু আসত দেশে। এখন আর সে দৃশ্য দেখা যায় না। কারণ ভারত সরকার বাংলাদেশে গরু রফতানি বন্ধ করেছে। এ সিদ্ধান্তের পর দেশের আনাচে-কানাচে যেমন ক্ষুদ্র মাঝারি খামারি গড়ে উঠেছে, তেমনই অনেক বড় বড় উদ্যোক্তা শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে এ খাতে। গত এক দশকে দেশে অসংখ্য গরু-ছাগলের খামার গড়ে উঠেছে। তার সুফল আমরা এখন পাচ্ছি। আমরা এখন গবাদিপশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। এটা অবশ্যই এখন বড় অর্জন।

লেখক: উপ-পরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা