ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

দুর্নীতি নির্মূলে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

২২ জুন ২০২৪, ১২:২৩ এএম | আপডেট: ২২ জুন ২০২৪, ১২:২৩ এএম

দেশে দুর্নীতি কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, সাবেক ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান এবং সর্বশেষ এনবিআরের সদস্য, কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট এবং সোনালী ব্যাংকের পরিচালক মতিউর রহমানের অঢেল সম্পদের পাহাড় এখন দেশের সবমহলে আলোচনার প্রধান বিষয়। পর্যবেক্ষকদের মতে, প্রশাসনের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা এ ধরনের ঘটনা দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের ‘টিপস অফ আইসবার্গ’ বা হিমশৈলীর চূড়া মাত্র। আরও অনেক দুর্নীতিবাজ অপ্রকাশিত অবস্থায় রয়েছে। এদিকে, গতকাল সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছর থেকে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো থেকে বাংলাদেশিরা দ্রুত অর্থ সরিয়ে নিচ্ছে। গত বছর ব্যাংকগুলোতে আমানতের পরিমান ছিল সাড়ে ৫ কোটি সুইস ফ্রাঁ, যা কমে হয়েছে ১ কোটি ৮০ লাখ ফ্রাঁ। বাংলাদেশিদের অর্থ তুলে নেয়ার এই গতিকে প্রতিবেদনে ‘তীব্র’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা প্রয়োজন, বিগত কয়েক বছর ধরে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের বিপুল অর্থ জমা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। কারা এসব অর্থের মালিক তা সুইস ব্যাংক প্রকাশ করে না। তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, এসব অর্থের বেশিরভাগই দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ।

দেশের অর্থনীতি এখন গভীর খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। রিজার্ভ ক্রমেই তলানির দিকে যাচ্ছে। ডলার সংকটের কারণে আমদানি-রপ্তানি, ব্যবসা-বাণিজ্য চরমভাবে ব্যহত হচ্ছে। সরকার তো বটেই অর্থ সংকটে সাধারণ মানুষেরও নাভিশ্বাস চলছে। এই তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেই একের পর এক দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের বিপুল অর্থ ও সম্পদের খবর বের হয়ে আসছে। দুর্নীতিবাজদের বিপুল অর্থ-সম্পদের বিবরণ দেখে সাধারণ মানুষের বিস্ময় সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যেই সাবেক কয়েক মন্ত্রী দুর্নীতির নানা ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন। সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, দেশ থেকে বছরে প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, আমলাদের একটি অংশ দুর্নীতিপরায়ন হয়ে উঠেছে। তার মতে, দুর্নীতিই সরকারের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার প্রধান অন্তরায়। দুর্নীতির কারণে সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হচ্ছে। প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শেষ হয় না। বলা বাহুল্য, তারা যখন মন্ত্রী ছিলেন, তখন এ নিয়ে টুঁ শব্দ করেননি। দায়িত্বে থাকা অবস্থায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিছু করার থাকলেও তা না করে এখন দায়িত্বহারা হয়ে দুর্নীতির কথা বলছেন। দেশে যে দুর্নীতি ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে, তা অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থা বহুদিন ধরেই বলে আসছে। আবুল বারাকাত, সালেহ উদ্দিন আহমেদ, মইনুল ইসলাম প্রমুখের মতো প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন সময়ে দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে প্রধান অন্তরায় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সিপিডি, টিআইবি’র মতো প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় নিয়মিত দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরছে। তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজরা দুর্দমনীয় হয়ে রয়েছে এবং উঠছে। কয়েক বছর আগে ক্যাসিনো কা-ে সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করে। দেখা যাচ্ছে, তা ঘোষণার মধ্যেই থেকে গেছে। বরং দুর্নীতি আরও বেগবান হয়েছে। তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে, উল্লেখিত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের দুর্নীতির খবর। প্রশাসন ও বাহিনীর সর্বোচ্চ পদে থেকে তারা যে দুর্নীতি করেছেন এবং করছেন, তা অকল্পনীয়। আলাদীনের চেরাগকেও হার মানিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা যে দুর্নীতি করেছে, তাদের পেছনে কারা মদদ দিয়েছে, কারা সহযোগী? কীভাবে তারা বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হলেন? এই দুর্নীতির নেপথ্য কারণ এবং নেপথ্যের শক্তিকে খুঁজে বের করা জরুরি। দুর্নীতি যে লাগামহীন হয়ে পড়েছে, তার বড় উদাহরণ হচ্ছে, দেশ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়া। এর বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ করা যায়নি। এখানে সরকারের ঘোষিত ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি কাজ করেনি। সুইস ব্যাংক থেকে যারা অর্থ সরিয়ে নিচ্ছে, সে অর্থ যে দেশে আসছে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ অর্থ তারা সেখান থেকে দুবাইসহ অন্যান্য দেশে সরিয়ে নিচ্ছে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না। দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) দুর্নীতি প্রতিরোধে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এটি যে ‘নখদন্তহীন বাঘ’, তা সংস্থাটির সাবেক এক চেয়ারম্যান বলে গেছেন। এখন পর্যন্ত সেই অবস্থায়ই রয়েছে। দুদককে শুধু ছোটো-খাটো দুর্নীতিবাজদের ক্ষেত্রে বেশি সোচ্চার হতে দেখা যায়। বিরোধীদলের শীর্ষ নেতাসহ অন্যদের বেলায় অধিক তৎপর হয়ে সরকারের বাহবা নিতেও দেখা যায়। ক্ষমতাসীনদলের কেউ হলে তাকে নামকাওয়াস্তে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়া হয়। এমনকি, তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত ছাড়াই মুক্ত করে দেয়া হয়। এতে সংস্থাটিকে ক্ষমতাসীন দল ও প্রভাবশালীদের দুর্নীতিমুক্ত ঘোষণার সংস্থা হিসেবেও পর্যবেক্ষকদের আখ্যায়িত করতে দেখা গেছে। পত্রপত্রিকায় যে, বড় বড় দুর্নীতিবাজের খবর প্রকাশিত হয়, তাদের বেলায় সংস্থাটিকে স্বপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত করতে দেখা যায় না। কেউ অভিযোগ দিলে, তা খতিয়ে দেখা হবে বলে দায় সারে। দেখা যাচ্ছে, বড় ও প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সরকার ও দুদক যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ পত্রপত্রিকায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হলেও লোক দেখানো কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়, যা দুর্নীতি দমন ও নির্মূল দূরে থাক, বরং দায়মুক্তির পথ প্রশস্ত করে।

প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বত্র দুর্নীতির শেখড় এতটাই বিস্তার লাভ করেছে এবং আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছে যে, তা এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। অথচ দেশের অর্থনৈতিক সংকটের এ সময়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান ও জিরো টলারেন্স অবস্থান নেয়া জরুরি। আর্থিক যে টানাপড়েন চলছে, তার মূলে রয়েছে বেশুমার দুর্নীতি। এতে দেশের উন্নয়ন চরমভাবে ব্যহত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশের দেউলিয়া হতে বেশি সময় লাগবে না। এমতাবস্থায়, সরকারকে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরাসহ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। ‘আইওয়াশ’ ধরনের উদ্যোগ নিলে হবে না। এখন সরকারের এক নম্বর এজেন্ডা হওয়া উচিৎ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা। প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বনি¤œ পর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। প্রত্যেককে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। দুর্নীতিবাজ যেই হোক এবং যত প্রভাবশালী হোক না কেন, তাকে কোনোভাবেই ছাড় দেয়া কিংবা তাকে নিয়ে সাফাই গাওয়া যাবে না। দেশ থেকে অর্থপাচার কিভাবে হয় এবং এর সাথে কারা জড়িত, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের অজানা থাকার কথা নয়। এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংককে জিরো টলারেন্স অবস্থান নিতে হবে। পাচারকৃত অর্থ কিভাবে ফিরিয়ে আনা যায়, সে পদক্ষেপ নিতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা