ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

উদ্বাস্তু জীবন : যুদ্ধ-সংঘাতই যার প্রধান কারণ

Daily Inqilab জালাল উদ্দিন ওমর

২৩ জুন ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৩ জুন ২০২৪, ১২:০৪ এএম

জাতিসংঘের শরনার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড নেশসন হাইকমিশনার ফর রিফিউজির ১৩ জুন প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে বর্তমানে বিশ্বে ১২ কোটির বেশি মানুষ শরনার্থী, আশ্রয়প্রার্থী এবং আভ্যন্তরীণ বাস্তচ্যুত। ২০২৩ এর শেষে এ সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ৭৩ লাখ। দিন দিন এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সবচেয়ে বেশি উদ্বাস্তু হয়েছে সিরিয়ার লোকজন। গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত সিরিয়ার ১ কোটি ৩৮ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এর মধ্যে ৬০ লাখ মানুষ শরনার্থী হিসাবে দেশ ছেড়েছে। আর ৭৮ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে দেশের ভিতরেই বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করছে। আফগানিস্তানে উদ্বাস্তু হয়েছে ২৫ লাখ মানুষ। দক্ষিণ সুদানে উদ্বাস্তুর সংখ্যা ১৪ লাখ। আর ৬০ লাখ ফিলিস্তিনি বর্তমানে শরনার্থী হিসাবে বসবাস করছে। এসব উদ্বাস্তু বিভিন্ন দেশে বসবাস করছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরাইলি আগ্রাসনে গাজার ১৭ লাখ মানুষ বাস্তচ্যুত হয়েছে। সুদানে ২০২৩ সালে শুরু হওয়া দুই জেনারেলের দ্বন্দ্বে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ বাস্তচ্যুত হয়েছে, তম্মধ্যে ৬ লাখ প্রতিবেশি চাদে আশ্রয় নিয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে ৩৭ লাখ মানুষ বাস্তচ্যুত হয়েছে। কঙ্গো এবং মিয়ানমারে নতুন করে সৃষ্ট গৃহযুদ্ধে কয়েক লক্ষ মানুষ নতুন করে বাস্তচ্যুত হয়েছে। উদ্বাস্তুদেরকে আশ্রয় প্রদানকারী শীর্ষ দশটি দেশ হচ্ছে: তুরস্ক, জর্ডান, কলম্বিয়া, লেবানন, উগান্ডা, জার্মানি, পাকিস্তান, ইরান, সুদান এবং বাংলাদেশ। বর্তমানে তুরস্কের আশ্রয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বাস্তু রয়েছে। উদ্বাস্তুদের মধ্যে তুরস্কে ৩০ লাখ, জর্ডানে ২৩ লাখ, কলম্বিয়ায় ১৭ লাখ, লেবাননে ১৫ লাখ, উগান্ডায় ১৪ লাখ, জার্মানিতে ১২ লাখ, পাকিস্তানে ১৪ লাখ, ইরানে ১০ লাখ, সুদানে ১০ লাখ এবং বাংলাদেশে ১২ লাখ বসবাস করছে। বর্তমান বিশে^ প্রতি ৬৭ জন মানুষের একজন আজ এই পরিস্থিতির শিকার এবং ওরা আজ উদ্বাস্তু। যুদ্ধ-সংঘাতই মানুষকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করেছে। এসব উদ্বাস্তু আজ গোটা মানবজাতির জন্য একটা লজ্জা ছাড়া আর কিছুই নয়।
নিজেদের ঘরবাড়ি হারিয়ে, নিজ দেশ ছেড়ে অনেক মানুষ আজ ভিন দেশের রাস্তায় বাঁচার জন্য হাঁটছে। ভিন দেশে প্রবেশের জন্য এসব মানুষ কখনো পাড়ি দিয়েছে সাগরের উত্তাল জলরাশি, কখনো পাড়ি দিয়েছে পাহাড়ি জঙ্গলের কণ্টকাকীর্ণ পথ আবার কখনো পাড়ি দিয়েছে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া। আর যারা দেশের ভিতরে বাস্তুচ্যুত তারাও এক এলাকা হতে অন্য এলাকায় যেতে পাড়ি দিয়েছে কষ্টকর এক পরিক্রমা। তারা রোদে-গরমে পুড়ছে, বৃষ্টিতে ভিজছে আর রাত্রে খোলা আকাশের নিচে ঘুমাচ্ছে। ভয়ংকর এবং বিপদসংকুল এই যাত্রাপথে প্রাণ হারিয়েছে হাজারো মানুষ। বাঁচার তাগিদে নৌকায় করে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়ে সাগর তীরে পড়ে থাকা সিরিয়ার শিশু আয়লানের লাশ তার জ¦লন্ত প্রতিচ্ছবি। যাদের এক সময় অর্থ বিত্ত আভিজাত্য সবই ছিল, তাদের আজ কিছুই নেই। তারা আজ তাবুর ঘরে বাস করছে। কারো কারো দিন কাটছে সম্পূর্ণ খোলা আকাশের নিচে। বেঁচে থাকার মৌলিক কোনো উপাদানই এদের জীবনে বিদ্যমান নেই। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাÑ কিছুই নেই। এদের জীবনে কোনো বিনোদন নেই, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন নেই। একজনের জায়গায় দশজন বাস করছে। তাদের জীবনে আজ সুখ, আনন্দ আর শান্তি বলতে কিছুই নেই। কোনো স্বপ্ন এবং সুন্দর ভবিষ্যতের হাতছানি নেই। সন্তানদের পড়াশোনার জন্য স্কুল নেই, প্রার্থনার জন্য জায়গা নেই। প্রাণ আছে বলেই বেঁচে আছে। যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা আজ কোটি মানুষের জীবনকে শেষ করে দিয়েছে। সর্বনাশা যুদ্ধ এদের সবকিছুই কেড়ে নিয়েছে। এসব মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে আজ সবাই ব্যর্থ। জাতিসংঘ, ওআইসি, আরবলীগ, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, আসিয়ান, সার্ক, আফ্রিকান ইউনিয়ন, জি-৭ সবাই ব্যর্থ। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, বৃটেন, ফ্রান্স, চীন ব্যর্থ। ব্যর্থ পুরো মানবজাতি এবং ব্যর্থ মানবাধিকারের প্রবক্তারা।
প্রায় ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলের হাতে নির্যাতিত হয়ে আসছে। অর্ধকোটিরও বেশি ফিলিস্তিনি বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন দেশের শরনার্থী শিবিরে জীবনযাপন করছে। অনেক ফিলিস্তিনি শরনার্থী শিবিরেই জন্মগ্রহণ করেছে, শরনার্থী শিবিরেই বড় হয়েছে এবং শরনার্থী শিবিরেই মৃত্যুবরণ করেছে। কিন্তু বিশ^ নেতারা এই সমস্যার সমাধান করেনি। আফগানিস্তানে ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধ চলেছে। কয়েক লাখ আফগান দীর্ঘদিন থেকেই শরনার্থী। তারাও শরনার্থী শিবিরে জীবনযাপন করছেন। তাদের সমস্যা সমাধানেও বিশ^ নেতারা এগিয়ে আসেনি। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ^ কর্তৃক ইরাকে হামলা, প্রেসিডেন্ট সাদ্দামকে ক্ষমতাচ্যুত করে হত্যা করা এবং পরবর্তীতে সেখানে বিভিন্ন গ্রপের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে অনেক ইরাকি বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। প্রেসিডেন্ট আসাদের পক্ষে আছে রাশিয়া, চীন, ইরানসহ পশ্চিমা বিরোধী শক্তি। আর আসাদ বিরোধী পক্ষকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ফ্রান্স, সৌদি আরব, তুরস্ক, কুয়েত, কাতারসহ পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন শক্তি। আর এই দুই জোটের স্বার্থ হাসিলের দ্বন্দ্বে পিষ্ট হচ্ছে সিরিয়ার নিরাপরাধ মানুষ। যুদ্ধে যুদ্ধে সিরিয়া আজ শেষ। রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো বলতে কিছুই নেই। এ যুদ্ধে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ মারা গেছে আর ৬০ লাখ সিরিয়ান বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তু হয়েছে। আর নিজ দেশে উদ্বাস্তু হিসাবে বসবাস করছে ৭৮ লাখ মানুষ। বাঁচার প্রয়োজনে হাজার হাজার সিরিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন দেশের পথে পথে ঘুরছে। সাহায্যের আশায় অন্যের কাছে হাত পাঁতছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধুর স্বপ্ন দেখিয়ে লিবিয়ার ক্ষমতা থেকে মোহাম্মদ গাদ্দাফীকে উৎখাতে পশ্চিমারা বিমান হামলা করে। ছয় মাস ধরে অবিরাম বিমান হামলা করে লিবিয়ার ক্ষমতা থেকে গাদ্দাফীকে উৎখাত করে এবং হত্যা করে। কিন্তু লিবিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়নি বরং গৃহযুদ্ধে লিবিয়া আজ কয়েক খ-ে বিভক্ত। লিবিয়া আজ একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশ। সেখানেও রাষ্ট্রের কোনো অবকাঠামো আর বিদ্যমান নেই। বাঁচার তাগিদে লিবিয়ার মানুষেরা আজ নৌকায় সাগর পাড়ি দিচ্ছে আর অন্য দেশে গিয়ে উদ্বাস্তুর জীবন যাপন করছে। ইয়েমেনেও দীর্ঘদিন ধরে গৃহযুদ্ধ চলেছে। সেদেশের হাজারো মানুষ আজ বাঁচার তাগিদে অন্য দেশে পাড়ি দিয়েছে এবং অনেক মানুষ আভ্যন্তরীণভাবে বাস্তচ্যুত হয়েছে। তারাও শরনার্থী হয়েছে। মিয়ানমারের শাসকদের নির্যাতন থেকে বাঁচতে বহু রোহিংগা মুসলমানরা বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছে। কয়েক লাখ রোহিংগা বাংলাদেশের উদ্বাস্তু শিবিরে বছরের পর বছর ধরে বসবাস করে আসছে। বর্তমানে চলমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে এবং হচ্ছে। এই হচ্ছে বিশে^ উদ্বাস্তু সমস্যার সংক্ষিপ্ত চিত্র।
এই যে মানুষের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরা হলো তা সবই শিক্ষিত এবং সভ্য লোকদেরই অর্জন। কারণ, শিক্ষিত এবং সভ্য লোকেরাই পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এসব যুদ্ধে কেবলই মানবজাতির ক্ষতি হচ্ছে। অস্ত্রব্যবসায়ীরা যুদ্ধরত দুই পক্ষকে অস্ত্র দিয়ে লাভবান হচ্ছে। বিশে^র শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান না করে, যুদ্ধরত দুই পক্ষকেই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। আর যুদ্ধরত দেশসমূহ হয়ে পড়েছে তাদের দাবার গুঁটি। তাই আত্মঘাতী এই যুদ্ধ বন্ধ না হয়ে অবিরাম গতিতে এগিয়ে চলছে। যুদ্ধ সবকিছুকে কেবল ধ্বংস করছে। যুদ্ধ অনিঃশেষ। এতে কেউ জিতছে না, জিতবে না। কেবল মানুষ ও মানবতা বিপর্যস্ত। তাই যুদ্ধ বন্ধের বিকল্প নেই।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা