ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

প্রত্যয় স্কিমে শুভঙ্করের ফাঁকি

Daily Inqilab সাইফুল ইসলাম

২৪ জুলাই ২০২৪, ১২:১০ এএম | আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৪, ১২:১০ এএম

দেশের ১৮ বছরের বেশি বয়সী সব নাগরিককে পেনশন সুবিধার আওতায় আনার লক্ষ্যে সর্বজনীন পেনশন প্রকল্পটি চালু করা হয়েছে। প্রাথমিক উদ্দেশ্য দেশের চার শ্রেণির প্রায় ১০ কোটি মানুষকে পেনশন ব্যবস্থায় যুক্ত করা। কিন্তু হঠাৎ করে ১৩ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়েয় এক পরিপত্রে বলা হয়, ‘সব স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং এর অধীনস্থ অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোর চাকরিতে যেসব কর্মকর্তা বা কর্মচারী, তারা যে নামেই অভিহিত হোন না কেন, আগামী ১ জুলাই ও তার পরে নতুন যোগদান করবেন, তাদেরকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত হতে হবে।’ এ ঘোষণার পর থেকেই ‘প্রত্যয় স্কিম’ বাতিলের দাবিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক একযোগে আন্দোলন করছেন। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছেন, প্রত্যয় স্কিম পূর্বের অবস্থা থেকে ১২/১৫ গুণ লাভজনক হবে। অবশ্য আন্দোলনের মুখে পেনশন কর্তৃপক্ষ প্রত্যয় স্কিম নিয়ে কিছু বিষয় স্পষ্ট করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইনে ৬০ বছর বয়স থেকে পেনশন প্রাপ্তির উল্লেখ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ৬৫ বছর থেকে অবসরে যাবেন। ৬৫ বছর থেকে তাঁরা আজীবন পেনশন প্রাপ্ত হবেন। এ ক্ষেত্রে সরকার আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করবে। লাম্পগ্রান্ট ও পিআরএল অর্জিত ছুটি প্রাপ্যতার ভিত্তিতে প্রদান করা হয়। ছুটি জমা থাকা সাপেক্ষে তা বহাল থাকবে। এ বিষয়গুলো ছাড়াও শিক্ষকরা মনে করেন যে, সর্বজনীন পেনশান ব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করে তাদের পূর্বের সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে নেয়া হয়েছে। এবার বিশ্লেষণে দেখা যাক নতুন স্কিম আসলেই কী?

পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, স্বায়ত্বশাসিত ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা প্রতি মাসে মূল বেতনের ১০% বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা প্রতি মাসে জমা করে স্কিমে যুক্ত হবেন। কেউ যদি ত্রিশ বছর সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা করে জমা করেন তাহলে অবসরের পর প্রতি মাসে ১,২৪,৬৬০ টাকা হারে প্রাপ্য হবেন। এটা সর্বোচ্চ চাঁদা প্রদানকারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। একটা প্রতিষ্ঠানে সবাই দশ হাজার টাকা চাঁদা দিতে পারবে না। কারণ, একটি প্রতিষ্ঠানের সবাই সমান বেতন পান না। তাই বেতনের ভিন্নতায় চাঁদার হারও ভিন্ন ভিন্ন হবে। এবার ধরা যাক, সর্বনিম্ন যিনি ২ হাজার টাকা চাঁদা প্রদান করবেন, সর্বনিম্ন দশ বছর প্রদান করলে তিনি পাবেন প্রতিমাসে ৩ হাজার ৬০ টাকা। আর ত্রিশ বছর চাঁদা প্রদান করলে পাবেন ২৪ হাজার ৯৩২ টাকা। এবার ধরুন, যে সকল কর্মকর্তা বা শিক্ষক পহেলা জুলাইয়ের পরে যোগদান করবেন তারা গড়ে ৩০ বছর চাকরি করে ২০৫৪ সালের পরে অবসর গ্রহণ করবেন। তার মানে দাঁড়ায় বেতনের ভিন্নতা ও চাঁদা দানের ভিন্নতার কারণে ২০৫৪ সালের পর থেকে সর্বনিম্ন ২৪ হাজার থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ ২৪ হাজার টাকা পর্যন্ত পেনশন পেতে পারেন। চাকরিতে অবসরের বয়স সীমা এবং বিভিন্ন দিক বিবেচনায় এর চাইতে বেশি করে পেনশন পাওয়ার সুযোগ প্রত্যয় স্কিমে বলা নেই। এবার একটু ত্রিশ বছর পেছনে ফেরা যাক, ১৯৯৫ সালে ১ কেজি মিনিকেট চালের দাম ছিল সতেরো টাকা আর বর্তমানে এক কেজি মিনিকেট চালের দাম ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। ত্রিশ বছরে শুধু চালের দামই ৩০০ গুণেরও বেশি বেড়েছে। অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের কথা বাদই দিলাম। আর গত এক দশকে জীবনাযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১১২.২১ শতাংশ। এ সময়ে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে ৩৫০ শতাংশ। বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ১৪৯.৭৫ শতাংশ। দফায় দফায় বেড়েছে বিদ্যুৎ ও সিএনজির দাম। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ১০ শতাংশের কাছাকাছি। সেই হিসেবে বলাই যায় টাকার মান প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে।

গড়ে ৫% হারে মূল্যস্ফীতি হিসাব করলেও বর্তমানের ১০০ টাকার আগামী ৩০ বছর পরে মূল্যমান দাঁড়াবে মাত্র ২৩ টাকা। আর ১ লক্ষ ২৪ হাজার টাকার ৩০ বছর পরে মূল্য দাঁড়াবে ২৮ হাজার টাকা। ২৪ হাজার টাকার মূল্য দাঁড়াবে মাত্র ৫ হাজার টাকা। তাহলে বর্তমানে ১ লক্ষ ২৪ হাজার টাকা অনেক অনেক বড় অংক মনে হলেও আসলে ৩০ বছর পরে একজন পেনশন প্রাপক পাবেন মাত্র ২৮ হাজার টাকা। পেনশন কর্তৃপক্ষ খুব সুন্দরভাবে তাদের ওয়েবসাইটে চাদার পরিমাণ এবং প্রদেয় টাকার পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তাই সে অংক আর পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এবার আমরা বাংলাদেশের সরকারি বেতন কাঠামোর দিকে নজর দিলে বৈষম্য আরো ভালোমতো বুঝতে পারবো। ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই ৪২ বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৮টি জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষণা করা হয়। প্রায় প্রতিবছরই ৫০ শতাংশ হারে বেতন গড়ে বৃদ্ধি করা হয়েছিলো। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সালে বেতন বৃদ্ধির হার প্রায় ৯৫ শতাংশ। তাহলে আগামী ৩০ বছরে, পূর্ববর্তী হিসেবে কমপক্ষে আরো অন্তত পাঁচ থেকে ছয়টি পে স্কেল আসবে। আর প্রতিবার ৫০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি ধরলেও সর্বোচ্চ বেতন দাঁড়াবে প্রায় ৫ লক্ষ টাকা, যা বর্তমানে ৭৮ হাজার টাকা। এক লক্ষ টাকা বাদ দিলে তাও ৪ লক্ষ টাকা হবে। সেই হিসেবে বর্তমান পেনশান ব্যবস্থায় একজন অধ্যাপক ২০৫৪ সালে অবসরকালীন আনুতোষিক পাবেন ৫ কোটি টাকারও বেশি। আর ত্রিশ বছর পর ৫টি পে স্কেলের পরে সর্বোচ্চ বেতন যদি ৩ লক্ষ টাকাও ধরা হয় তাহলেও প্রতি মাসে একজন শিক্ষক পেনশান পাবেন প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। সাথে দুটি ঈদ বোনাস, বৈশাখী ভাতা এবং প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধিতো থাকছেই। এর কোনো সুবিধাই প্রত্যয়ে রাখা হয়নি।

প্রত্যয় স্কিমের হিসাবে একজন শিক্ষক প্রতি মাসে ১ লক্ষ ২৪ হাজার টাকা হিসাবে ৬৫ বছরে অবসর গ্রহণ করলে ৭৫ বছর পর্যন্ত পাবেন মাত্র ১.৫ কোটি টাকা। আর যদি আরো দশ বছর জীবিত থাকেন অর্থাৎ ৮৫ বছর পর্যন্ত তাহলে ৩ কোটি টাকা পাবেন। বর্তমান গড় বয়স ৭৩ বছর, সে হিসেবে ৮৫ বছর পর্যন্ত খুব কমই লোক বেঁচে থাকবেন। আর ৭৫ বছর পর মারা গেলে পরিবারের আর কেউই এই সুবিধা পাবেন না। তাহলে এই দুই বিশ্লেষণে চরম বৈষম্য ফুটে উঠে। একই প্রতিষ্ঠানে দুই রকম নিয়ম কীভাবে চলবে? যেখানে একজন আনুতোষিক পাবে কয়েক কোটি টাকা, ঈদ বোনাস, বৈশাখী ভাতা পাবে, পরিবারের সদস্য মৃত্যু পরবর্তী পেনশন পাবেন। আর একই প্রতিষ্ঠানের পহেলা জুলাইয়ের পরে যোগদানের জন্য তিনি মাত্র ১ লক্ষ ২৪ হাজার টাকা প্রতি মাসে পাবেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এত বড় ক্ষতি কোনভাবেই কাম্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা সরকারের কাছে দামী গাড়ি সুবিধা চায় না, মাসিক অর্ধ লক্ষ টাকা জ্বালানি খরচও চায় না। তারা বাড়তি সুযোগ-সুবিধাও চায় না। সরকারের উপর বাড়তি ব্যয়ের চাপ কমানোর অনেক উপায় আছে। দুর্নীতি, প্রকল্পগুলোতে পুকুরচুরি, সরকারি টাকায় অযাচিত বিদেশ ভ্রমণ, কর ফাঁকিসহ নানা অনিয়ম বন্ধ করলেই ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্ত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব। শিক্ষকরা প্রত্যয় মেনে নিলে জেনে শুনে আগুনে ঝাঁপ দেয়া হবে।

লেখক: প্রভাষক, লোক প্রশাসন বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা