ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

রাষ্ট্র কি তার নাগরিকদের এভাবে মারতে পারে?

Daily Inqilab কামরুল হাসান দর্পণ

২৬ জুলাই ২০২৪, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১২:০৮ এএম

চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগের সামনে রাজনৈতিক কোনো চ্যালেঞ্জ ছিল না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। মূল চ্যালেঞ্জ ছিল খাদের কিনারে থাকা অর্থনীতি। বিগত প্রায় দুই বছরের অধিক সময় ধরে দেশের অর্থনীতি অত্যন্ত শোচনীয় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মানুষের আয় কমে যাওয়া, রিজার্ভ তলানিমুখী হওয়া, ডলার সংকট, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে স্থবিরতা, ব্যাংকে তীব্র তারল্য সংকট, বেকারত্ব, বিনিয়োগে খরা ইত্যাদি কারণে অর্থনীতি বিপর্যয়কর পরিস্থিতে রয়েছে। অর্থনীতির প্রায় সবসূচক নি¤œগামী হলেও এর মধ্যে বড় বড় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যর অকল্পনীয় দুর্নীতির খবর সরকারকে বেশ বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলেছে। রাষ্ট্র চালানোর মতো অর্থ না থাকায় সরকারকে অনেকটা ব্যাংকনির্ভর হয়ে পড়তে হয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণ করা এবং তারল্য সংকট কাটাতে টাকা ছাপিয়ে জোগান দেয়ার প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হয়েছে। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছে ঋণ নেয়ার জন্য ধর্ণা দিতে হয়েছে। আইএমএফ থেকে ঋণ নেয়ার পর চীন থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে হয়েছে। গত ৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের অন্যতম লক্ষ্য ছিল, এই পাঁচ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়া নিশ্চিত করা। শেষ পর্যন্ত চীন ঋণ দেয়নি। এ ঋণ না পাওয়া ছিল অত্যন্ত হতাশার। চীনের ঋণ পেলে অর্থনীতির নি¤œগামিতা হয়ত কোনো রকমে ঠেকা দেয়া যেত। আশা পূরণ না হলে, স্বাভাবিকভাবেই হতাশা ও দুশ্চিন্তা গ্রাস করে। সরকারের মধ্যেও এ চিত্র ফুটে উঠেছে। শেষ মুহূর্তে চীন কেন ঋণ দিল না, তা নিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্লেষকরা নানা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এর সঙ্গে ভূরাজনৈতিক বিষয়টি জড়িয়ে আছে বলে তারা বলেছেন। চীন সফরের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেছিলেন। সেখানে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছে, তাতে চীন একটা বিষয়ে নাখোশ হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। সেটি হচ্ছে, চীনের বহুল প্রত্যাশিত ও প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প না দেয়া। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে চীন স্পষ্ট করেই বলেছিল, আশা করছি, নির্বাচনের পর তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারব। কয়েক মাস আগে ভারত তিস্তা প্রকল্পে নিজেকে যুক্ত করতে চায় বলার পর চীনের সে আশায় গুঁড়ে বালি পড়ে। এতে সে অসন্তুষ্ট এবং বাংলাদেশকে ঋণ দেয়ার বিষয় থেকে সরে আসে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। অর্থনৈতিক শোচনীয় অবস্থা এবং এ থেকে কিছুটা উত্তরণে চীনের ঋণ খুবই জরুরি ছিল। তিস্তা প্রকল্পে ভারতের বাগড়া দেয়ার কারণে তা পাওয়া গেল না। চীন বাংলাদেশের শীর্ষ উন্নয়ন সহযোগী। এতদিন সে বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সহযোগিতার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিল। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা ব্যক্ত করে। চীন এ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছে, ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কারণে। যুক্তরাষ্ট্র-ভারতসহ অন্যদেশগুলোর সমন্বয়ে যে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলছে, চীনের জন্য তা হুমকি হয়ে রয়েছে। এটি চীন করতে দিতে চায় না। কারণ, ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইন্দো-প্যাসিফিক ঠেকাতে হলে বাংলাদেশকে চীনের প্রয়োজন। ইতোমধ্যে সে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তান, মালদ্বীপকে নিজের প্রভাব বলয়ে নিয়েছে। মায়ানমার অনেক আগে থেকেই ছিল। এখন বাংলাদেশকে নেয়ার চেষ্টায় রয়েছে। বাংলাদেশকে তার প্রভাব বলয়ে নিতে পারলে ইন্দো-প্যাসিফিক ঠেকিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তার ষোলকলা পূর্ণ হয়। ফলে চীন বাংলাদেশের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। তবে ভারত এটা করতে দিতে নারাজ। সরকারও চায় না। সরকার চায়, চীনের সাথে শুধু অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকুক। আর ভারতের সাথে অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকুক। কারণ, বিগত দেড় দশক ধরে সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে ভারত প্রত্যক্ষ সহযোগিতা দিয়ে আসছে এবং সম্পর্ককে তার দিকে একতরফা করে ফেলেছে। ভারত যা চেয়েছে, সরকার তাই বিনাবাক্যে দিয়ে দিয়েছে। এদিকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট দিন দিন তীব্র হচ্ছে। ত্রাহি দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকার মুখে মুখে সব ঠিক আছে বললেও অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে পত্রপত্রিকায় যে তথ্য ও পরিসংখ্যান উঠে আসছে, তা খুবই শঙ্কার। এ তথ্য সরকারও অস্বীকার করতে পারছে না। এ পরিস্থিতির মধ্যে সরকারের সামনে বড় সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন। বিগত দেড় দশকে সরকার অনেক কঠিন পরিস্থিতি সহজে মোকাবেলা ও সামাল দিতে পারলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন মোকাবেলা করতে গিয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বলপ্রয়োগসহ ইন্টারনেট বন্ধ এবং কারফিউ দিতে হয়েছে। সেনা মোতায়েনও করতে হয়েছে। এর আগে সর্বশেষ কবে কারফিউ দেয়া হয়েছিল, তা অনেকের পক্ষেই স্মরণ করা সম্ভব নয়।

দুই.
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন এমনই এক আন্দোলন, যা কোনো রাজনৈতিক ইস্যু তো নয়ই, তার সঙ্গে বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতাও নেই। যদিও সরকার নানাভাবে এতে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে বলেছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তাদের হাতে নেই বলে বলেছে। বিএনপি-জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে, এমন অভিযোগ করেছে। তবে এটা ঠিক, শেষের দিকে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের দাবির প্রতি বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল সমর্থন দিয়েছে। আবার এ আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার কাজটি সরকারি দলই প্রথম শুরু করেছে। ছাত্রলীগকে মাঠে নামিয়ে শিক্ষার্থীদের মারপিট এবং হত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। বলা যায়, আওয়ামী লীগই আন্দোলনটিকে রাজনৈতিক রূপ দিয়েছে। বিরোধীদলগুলো অনেক পরে আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছে। এত কিছুর পরও আন্দোলন ছাত্র আন্দোলনের চরিত্রহারা হয়নি। কারণ, এতে সাধারণ মানুষসহ যে দুশ’র মতো মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই শিক্ষার্থী। স্বাধীনতার পর কোনো আন্দোলনে এতো শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার নজির নেই। এতে অভিভাবকসহ দেশের সচেতন মহল এবং সাধারণ মানুষ ব্যথিত ও ক্ষুদ্ধ হয়েছে। ফলে তারাও আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের কমপ্লিট শাটডাউনের দিন এক রিকসাওয়ালার সাথে কথা হচ্ছিল। এক পায়ে খোড়ার মতো দাঁড়িয়েছিল। উঠতে গিয়েও উঠলাম না। সে বলল, উঠেন। পুলিশের পিটুনিতে পা ফুলে গেছে। দৃঢ়ভাবে বলল, আমার ছোট ভাইকে কলেজে পড়াচ্ছি। ওকে একটা চাকরি পেতে হবে। ওর খরচ জোগাতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যেও রিকসা চালাচ্ছি। শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছে, তা ন্যায্য। তারা যদি আমাকে মেরেও ফেলে, তাতে কোনো অসুবিধা নেই। ওরা সঠিক আন্দোলন করছে। এক সিএনজি চালকও একই ধরনের কথা বললো। তার দুই ছেলেকে স্কুলে পড়াচ্ছে। বললো, শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের মাঝেও সিএনজি নিয়ে বের হয়েছি ছেলেদের খরচ জোগাতে। শিক্ষার্থীরা যদি আমার সিএনজি ভেঙ্গেও ফেলে, তাতে কোনো আফসোস নাই। ওদের সাথে আছি। এক আত্মীয়র বাসায় গিয়েছিলাম। তিনি সরকারি কর্মকর্তা। তার এক মেয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। মেয়েকে নিয়ে তার মা পেরেশান। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করায় বললেন, দুইদিন ধরে পাহারা দিয়ে রাখছি। দেখলাম, মেয়েটিও মোবাইল নিয়ে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। তার মা বললেন, তার ক্লাসমেট ও বান্ধু-বান্ধব কোটা সংস্কার আন্দোলনে গেছে। এখন সেও যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে। দুই দিন ধরে বোঝাচ্ছি। বুঝতে চাইছে না। এখন বলছে, আমার সহপাঠীদের মেরে ফেলেছে। এ থেকে বুঝেছি, যেকোনো সময় ও বাসা থেকে বের হয়ে যাবে। এখন দরজায় তালা মারব। ওর ক্লাসমেটদের মায়েদেরও একই অবস্থা। ফোন করে বলছে, ওদের একটু বোঝান। ওদের কী করে বুঝাব! ওদের সেন্টিমেন্ট তো আটকে রাখা যাচ্ছে না। কতক্ষণ আটকে রাখব! বুঝতে বাকি থাকে না, শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনে কতটা আবেগ ও তারুণ্যের শক্তি জড়িয়ে আছে। যুগে যুগে শিক্ষার্থীরা ন্যায্য দাবি নিয়ে পথে নেমেছে। তাদের দমিয়ে রাখা যায়নি। কোনো শক্তিই তাদের দমাতে পারেনি। অকাতরে জীবন দিয়েছে। জীবন দিয়ে দাবি আদায় করে ফিরেছে। কেউ ভাবতে পারেনি, এ প্রজন্মের তরুণ ও শিক্ষার্থীরা তাদের পূর্বসুরীদের মন ও মানসিকতা ধরে রেখেছে। ন্যায্য অধিকার আদায়ের ইতিহাস তাদের মন ও মগজে পরম্পরা হয়ে রয়েছে। কারণ, এ প্রজন্মের তরুণদের সম্পর্কে সাধারণ ধারণা হচ্ছে, তারা সবসময়ই মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে। বাস্তব জীবন সম্পর্কে তাদের ধারণা কম। কোটা সংস্কার আন্দোলন করে এবং দৃপ্ত ও তেজী মনোভাব নিয়ে অকাতরে জীবন দিয়ে তারা প্রমাণ করে দিয়েছে, তাদের সম্পর্কে তাদের আগের প্রজন্মের ধারণা ভুল। এ প্রজন্মের তরুণদের ‘জেনারেশন জি’ (ইংরেজি শেষ অক্ষর ‘জেড’) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে (’৯৬-’৯৭) ২০১০ সালের মধ্যে তাদের জন্ম। তাদেরকে ‘জেনারেশন জি’ বলার কারণ হচ্ছে, তারা বেড়ে উঠেছে প্রযুক্তির সাথে। জন্মের পর থেকেই মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব, ইন্টারনেটসহ নানা ধরনের অত্যাধুনিক অ্যাপস তাদের নিত্যসঙ্গী। ফলে তাদের জানার পরিধি অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। তাদের আগের জেনারেশনের চেয়ে তাদের প্রযুক্তিগত চিন্তা-ভাবনা ও বোধ এগিয়ে। আগের প্রজন্ম তথ্যপ্রযুক্তিগত কোনো কিছু জানতে চাইলে জেনারেশন জি’র কাছেই ধর্ণা দেয়। বাবা-মা প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে সন্তানের কাছেই যায়। তারা দেখিয়ে দেয়। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছে তাদের তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান দিয়ে। এর মাধ্যমেই তারা কর্মসূচি থেকে শুরু করে কোথায় সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করবে, নির্ধারণ করেছে। প্রয়োজনে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে সংবাদমাধ্যকে জানিয়েছে। কোথায় কোন শিক্ষার্থী আহত-নিহত হয়েছে, তা তুলে ধরেছে। ফলে তাদের আন্দোলন স্তিমিত করতে সরকারকে ইন্টারনেট বন্ধ করতে হয়েছে। সরকার হয়ত মনে করেছে, এতে আন্দোলনকারিদের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হবে এবং আন্দোলনে ভাটা পড়বে। এ ধারণা যে ভুল, তা অতীত ইতিহাস বলে। যখন ইন্টারনেট এবং এ যুগের মতো অবাধ তথ্যপ্রবাহ ছিল না, তখন যে আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, তা বিফল হয়নি। তখন সুনির্দিষ্ট ইস্যু নিয়ে যে আন্দোলন হয়েছে, তাতে দৃঢ় থেকে তা নিয়েই আন্দোলন চালিয়ে গেছে এবং সফল হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। তাদের মূল দাবীতে অটল থেকে আন্দোলন করছে এবং তা সাধারণ মানুষ ধারন করে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছে। এর মধ্যে তৃতীয় পক্ষ বা বিরোধীদল যুক্ত হলো কি হলো না, তা খুব বেশি ম্যাটার করে না। যখন কমন বা একদফা ইস্যুতে আন্দোলন হয়, তখন নতুন ইস্যুর প্রয়োজন হয় না। সেই ইস্যুতেই আন্দোলন অব্যাহত থাকে। এটা ব্যাহত করা যায় না। যেমনটি হয়েছে, নব্বইয়ে এরশাদের পতনের একদফা আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সরকার বিরোধীদলের উপর দায় চাপালেও শিক্ষার্থীদের মূল ইস্যু ঠিকই রয়ে গেছে। বিরোধীদলও এ আন্দোলনকে তাদের আন্দোলন, এমন দাবি করেনি। তারা শিক্ষার্থীদের দাবিকে সমর্থন দিয়েছে। সরকারও তো তাদের দাবিকে যৌক্তিক বলেছে। গত রবিবার সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি পুনর্বহাল করা নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল করেছেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। মেধায় নিয়োগে ৯৩ শতাংশ করে, ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ নির্ধারণ করে আদালত আদেশ দিয়েছেন। এই রায়েও যে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তা বলা যাচ্ছে না। কারণ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিবৃতি দিয়ে বলেছে, এ রায় কিছুটা ইতিবাচক। তবে এক সপ্তাহের মধ্যে জাতীয় সংসদে বিশেষ অধিবেশন ডেকে আইন পাশ করতে হবে। আবার তাদেরই এক অংশ বলেছে সর্বোচ্চ আদালতের রায় আমাদের কাছে অস্পষ্ট মনে হয়েছে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, সংকট পুরোপুরি কেটে যায়নি।

তিন.
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে এত শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ নিহত হওয়া নিয়ে কেবল মনে হচ্ছিল, রাষ্ট্র কি তার নাগরিককে এভাবে মারতে পারে! মানুষই তো রাষ্ট্র নির্মাণ করে, তার কল্যাণের জন্য এবং তা পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচিত করে তার সেবা করার জন্য। নাগরিকের সমস্যা হলে এবং অধিকারের প্রয়োজন হলে, তারা রাষ্ট্রের কাছেই দাবি জানাবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে, নাগরিকের যৌক্তিক দাবি পূরণ করে তাদের অধিকার নিশ্চিত করা। যদি এমন দাবি হয়, যা রাষ্ট্রের পক্ষে পূরণ করার যৌক্তিক কোনো উপায় না থাকে, তখন নাগরিকদের বুঝিয়ে বলা। সভ্য দেশে তাই করা হয়। এর পরিবর্তে দাবি যৌক্তিক বা অযৌক্তিক হোক রাষ্ট্রযন্ত্র কখনোই অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে দাবিকারিদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে না। হত্যা ও নির্যাতন করে না। দাবি নিয়ে যদি মানুষ আন্দোলন করে এবং তাতে সংঘর্ষ বাঁধে, তা কিভাবে মোকাবেলা করা যায়, রাষ্ট্র পরিচালকদের তা নিয়ে সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পনা থাকতে হয়। বল প্রয়োগ বা দমনের চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেয়ার আগে সহনশীল ও মানবিক হতে হয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সরকার সহনশীলতার পরিচয় দিতে পারেনি। ছাত্রলীগ দিয়ে আক্রমণ করিয়ে তাদের নিপীড়ন-নির্যাতনের পথ রচনা করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে, দেশের পরিস্থিতি কী হয়েছে, তা সকলেরই জানা। যে দাবি সহজেই রাষ্ট্র পরিচালকরা পূরণ করতে পারত, তা না করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনে শক্তি প্রয়োগ করল এবং সরকারের এক ভুলের কারণে আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করে অসংখ্য প্রাণ ঝরিয়ে দিয়েছে। এর দায় কি রাষ্ট্র পরিচালকরা এড়াতে পারে? আমাদের দেশে রাজনৈতিক আন্দোলন কখনোই সহিংসতা এবং প্রাণহানি ছাড়া হয়নি। এতে হয় সরকারের পতন হয়েছে, নতুবা আন্দোলনকারিরা পরাজিত হয়েছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র পরিচালকরা নিপীড়ক হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। অথচ সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্র পরিচালকরা নিপীড়ক হয় না। তারা হয় মানবিক এবং নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা স্বীকারকারি। ব্যর্থতা স্বীকার করে স্বেচ্ছায় রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে সরে যায়। বিশ্বে এমন অসংখ্য নজির রয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলন ছিল না। তাদের যৌক্তিক দাবি পূরণের আন্দোলন ছিল। এটাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সরকার দেখেছে এবং দমনের প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছে। এক্ষেত্রে সরকারের অদূরদর্শিতা এবং শিক্ষার্থীদের পালস্ বুঝতে অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। বলা বাহুল্য, দাবি যখন যৌক্তিক হয়, সরকারও তা মনে করে এবং পূরণে সমস্যা থাকে না, তখন রাষ্ট্র পরিচালকদের কোনো অধিকার নেই, রাষ্ট্র নির্মাণকারিদের হত্যা করার। রংপুরে কোটা আন্দোলনকারিদের অন্যতম সমন্বয়ক আবু সাঈদ পুলিশের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য। যে অধিকারের প্রতি সাধারণ মানুষসহ পুরো সাধারণ ছাত্র সমাজের সমর্থন ছিল, রাষ্ট্রেরও ছিল এবং তা পূরণের সামর্থ্য তার ছিল। তাহলে, রাষ্ট্রের পুলিশের কি অধিকার ছিল, নিরস্ত্র সাঈদের বুকে গুলি চালানোর? কি অধিকার ছিল, অসংখ্য শিক্ষার্থী এবং তাদের সমর্থকদের গুলি করে হত্যা করে অধিকারের আকাক্সক্ষা নিভিয়ে দেয়া? রাষ্ট্রের নাগরিকরা তাদের নির্মিত রাষ্ট্রের কাছে অধিকার না চেয়ে কি অন্য রাষ্ট্রের কাছে চাইবে? শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণের বিষয়টি তো রাষ্ট্র পরিচালকরা শুরুতেই সহজে পূরণ করে দিতে পারত! তাহলে তো এতো শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের প্রাণ যেত না। যে শিক্ষার্থীদের প্রাণ কেড়ে নেয়া হলো, তারা তো দেশের অমূল্য সম্পদ ও উজ্জ্বল সন্তান ছিল। রাষ্ট্র পরিচালকদের তো দায়িত্ব ছিল, এই সম্পদ রক্ষা করা। তা না করে, তাদের হত্যা করা হলো কেন?। হত্যা করে বলছে, তাদের দাবি মেনে নিয়েছে। মানবেই যদি, তাহলে আগে কেন মানল না? সরকার যতই বলুক, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে রাজনীতি ঢুকে গেছে, শুরুতে তো তা ছিল না। রাজনীতি যদি ঢুকেও থাকে, তাহলে তার জন্য সরকারই দায়ী। সে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণা দিতে বিলম্ব করার মধ্যেই রাজনীতি ঢুকেছে। এ সুযোগ তো সরকারই করে দিয়েছে। সরকারের তো উচিৎ ছিল, শুরুতেই বিবেচনা করা, কারা আন্দোলন করছে, তাদের দাবি কি? আগের আন্দোলনগুলোতে কারা প্রতিপক্ষ ছিল, আন্দোলনের কারণ কি ছিল, এখন কারা আন্দোলন করছে, আন্দোলনের কারণ কি? সব আন্দোলনকেই যদি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের আন্দোলন হিসেবে ধরে নিয়ে হত্যা, নিপীড়ন, নির্যাতন করা হয়, তাহলে তো রাষ্ট্র স্বাভাবিক চরিত্র নিয়ে চলছে, তা বলা যায় না। রাষ্ট্র যদি তার নাগরিকদেরই শত্রুজ্ঞান করে, তাহলে সে রাষ্ট্রের নাগরিকদের নিরাপত্তা বলে কি কিছু থাকে? সরকারের কেউ কেউ এখন বলছে, সরকার হটানোর জন্য আন্দোলন এবং ধ্বংসাত্মক কর্মকা- করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কি সরকার হটানোর আন্দোলন ছিল? এখন তাদের কথা মতো যদি তা হয়েও থাকে, তার জন্য দায়ী কে? শঙ্কার এ পরিস্থিতি কে সৃষ্টি করল?

চার.
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুধু এই সরকারই নয়, ভবিষ্যতে যত সরকার আসবে প্রত্যেকের জন্যই সতর্কতা অবলম্বন ও শেখার বিষয় রয়েছে। জনসমর্থিত ও যৌক্তিক যেকোনো ইস্যু দ্রুত মেনে নেয়াই সরকারের কাজ। দেশের অর্থনীতি এখন খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষ অত্যন্ত কষ্টে আছে। নাগরিক অসন্তোষও চরমে। সংবেদনশীল এ সময়ে সরকারকে আরও বেশি সচেতন ও সতর্ক হওয়া উচিৎ ছিল। অহং ও জেদ নিয়ে সরকার পরিচালনা করা যায় না। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সরকারের অহং ও অনমনীয়তা এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমানোর প্রক্রিয়ার কারণেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন জোরদার এবং শেষ পর্যন্ত তা সহিংস রূপ লাভ করেছে। শুধুমাত্র একটি যৌক্তিক ও পূরণ করা যোগ্য দাবির কারণে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। অসংখ্য মেধাবী হত্যা ও অর্থনীতিতে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি সহসা পূরণ হবার নয়। এর জন্য দায়ী সরকারের নীতিনির্ধারকদের অবিমৃষ্যকারি সিদ্ধান্ত। হাইটেক প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন শেষ হবে। তবে সহপাঠীদের গুলি করে হত্যার বেদনা তাদের মনে যুগ যুগান্তরে থেকে যাবে। তাদের পরবর্তী প্রজন্মও এ ঘটনা মনে করে বর্তমান সরকার এবং রাষ্ট্র পরিচালকদের মূল্যায়ন করবে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা