সরকার কি পারবে তরুণ প্রজন্মের মনের ক্ষোভ ও ক্ষত মুছে দিতে?
০২ আগস্ট ২০২৪, ১২:২০ এএম | আপডেট: ০২ আগস্ট ২০২৪, ১২:২০ এএম
একটি ঘটনা কিভাবে দেশ থেকে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে, ২০২০ সালের ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের মিনোপোলিসে পুলিশ হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকা-। এ ঘটনার প্রতিবাদ যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই সারাবিশ্বে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার নিয়ে দেশে দেশে হাজার হাজার মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে। দেয়ালে দেয়ালে ফ্লয়েডের গ্রাফিতি আঁকা হয়। কৃষ্ণাঙ্গরা ফ্লয়েডের এ মৃত্যুকে যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সরকারের অসিহষ্ণু আচরণ এবং অবিচারের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। এর দায় পড়ে সরকারের ওপর। সরকারও সে দায় মাথা পেতে নেয়। অন্যায় ও অবিচারের মাধ্যমে যেকোনো হত্যাকা- মনুষত্ববোধসম্পন্ন কেউ মেনে নিতে পারে না।ফ্লয়েডের হত্যাকা-ও কেউ মেনে নিতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ বা মানুষ হত্যা প্রায়ই ঘটে। কিন্তু ফ্লয়েডের হত্যা কেন বিশ্বকে নাড়া দেয়? এর কারণ হচ্ছে, হত্যাকা-টি ঘটে পুলিশের হেফাজতে, যেখানে মানুষের নিরাপত্তা পাওয়ার কথা। পাশাপাশি এর সাথে জড়িয়ে ছিল বর্ণবিদ্বেষ। এই দুইয়ে মিলে ঘটনাটি পুরো বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন ফ্লয়েডের মেয়ের সাথে দেখা করতে যান, তখন তার মেয়ে বলে, ‘ড্যাডি চ্যাঞ্জড দ্য ওয়ার্ল্ড।’ আক্ষরিক অর্থেই সেসময় বিশ্বে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মানুষের সোচ্চার হওয়া এবং বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবনার খোরাক জোগায়। ফ্লয়েডের হত্যাকা-ের প্রভাব মুসলমানদের উপরও পড়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্য এবং নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ‘মুসলিম লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনও ছড়িয়ে পড়ে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে মুসলমানরা ‘মুসলিম লাইভস ম্যাটার’ ব্যানার-পোস্টার নিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করে। পুলিশ কাস্টডিতে এক কৃষ্ণাঙ্গ হত্যা নিয়ে বিশ্বে যে তোলপাড় হয়, সাম্প্রতিক ইতিহাসে তার নজির খুব কম। হয়ত, ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তির দেশে হওয়ায় এমনটি হয়, যেখানে মানুষের গণতান্ত্রিক এবং মৌলিক অধিকারকে মূল্য দেয়া হয়। অথচ আমাদের দেশে পুলিশ কাস্টডিতে নিযার্তন ও নিহতের ঘটনা মামুলি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যেকোনো আন্দোলনে, সেটা হোক রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক, নির্বিচারে পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারার ঘটনা সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষ কিংবা আন্দোলনকারিদের তুলে নিয়ে গুম করে দেয়ার মতো ভয়াবহ ঘটনাও ঘটছে। এই যে কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীসহ দুই শতাধিক মানুষ হত্যা এবং হাজার হাজার মানুষকে আহত করা হলো, তাতে কি কোনো বাছবিচার ছিল? কেউ কি বলতে পারবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সত্যিকারের দাগী কোনো আসামী বা সন্ত্রাসীকে গুলি করে মেরেছে? দাগী বা সন্ত্রাসী হলেও কি এভাবে বিচারহীনভাবে গুলি করে হত্যা করতে পারে? কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমরা কি দেখেছি? দেখেছি, শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি করে হত্যা করছে। গুলি থেকে বাসায় থাকা শিশুও রেহাই পায়নি। কোনো সভ্য দেশে কি এভাবে গুলি চালানো হয়? নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, যেকোনো সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রচলিত কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। পরিস্থিতিকে বিভিন্ন লেবেলে বিবেচনায় নিতে হয়। লেভেল-১, ২, ৩, ৪ ইত্যাদি। সংঘাতের ইনটেনসিটি বা তীব্রতা অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লেবেল অনুযায়ী শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। দেখা যাচ্ছে, যেখানে লেভেল-১ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব, সেখানে এক লাফে চরম ব্যবস্থা হিসেবে লেবেল-৪ এ উঠে যাচ্ছে। এটা যে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
দুই.
কোটা সংস্কার আন্দোলন দমাতে সরকার সর্বোচ্চ পদক্ষেপ হিসেবে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার ব্যবহারসহ কারফিউ দিয়ে সেনাবাহিনী নামিয়ে ‘শুট টু কিল’-এর নির্দেশনা দেয়। আন্দোলনকারিদের দমাতে স্থলের পাশাপাশি আকাশ পথও বেছে নেয়া হয়। হেলিকপ্টার থেকে গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ইত্যাদি ছোঁড়ার অভিযোগ উঠেছে (যদিও সরকারের তরফ থেকে তা অস্বীকার করা হয়েছে)। এসব পদক্ষেপ এবং ইন্টারনেটসহ প্রায় সব ধরনের যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করার কারণে জনমনে এ ধরণা জন্ম নেয়, দেশ কোনো শত্রু পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নেমেছে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেমনটি হয়, শত্রুকে চারদিক থেকে ঘিরে অবরুদ্ধ করে হত্যা-নির্যাতন, গ্রেফতার করে পরাস্ত করা হয়, তেমন। নিরস্ত্র শিক্ষার্থী আন্দোলন মোকাবেলায় কোনো সভ্য দেশে এমন সশস্ত্র পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কিংবা হয় কিনা, জানা নেই। জেনারেল এরশাদকে স্বৈরাচার বলা হয়, তার বিরুদ্ধেও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করার সময় এমন তীব্র পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এরশাদের ৯ বছরের শাসনামলে যত আন্দোলন হয়েছে, তার কোনোটিতেই এতো শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষ নিহত ও আহত হয়নি। কি অপরাধ ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের? তারা কি এমন কোনো দাবি করেছিল, যা রাষ্ট্র পূরণ করতে অক্ষম ছিল? আদালতের রায় এবং সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে তো শেষ পর্যন্ত তাদের দাবি অনেকাংশে মেনে নেয়াই হলো। দাবি শুরুতেই মেনে নেয়া হলে এতো প্রাণ, এতো রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস হতো না! সরকার আদালতের রায়ের অপেক্ষা করে কালক্ষেপণ করার কারণেই তো আন্দোলন জোরালো হয়ে উঠে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে চরম পন্থা অবলম্বন করতে হয়। এ ভুল সরকারের এবং তার ভুলে শত শত নিহত হলো। বলার অপেক্ষা রাখে না, জরুরি প্রয়োজনে যেকোনো যুক্তিসঙ্গত দাবি মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে আইন কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। তা নাহলে, ‘ন্যাসেসিটি নৌজ নো ল’, কথাটি উচ্চারিত হতো না। শিক্ষার্থীরাও চেয়েছিল, আদালতের অপেক্ষায় না থেকে সরকার যাতে নির্বাহী আদেশে কিংবা জরুরি ভিত্তিতে সংসদ অধিবেশন ডেকে আইন পাস করে দাবি মেনে নেয়। এটা সরকারের জন্য এমন কোনো কঠিন কাজ ছিল না। এমন একাধিক নজির আমাদের দেশে রয়েছে। জরুরি পরিস্থিতিতে ’৯৬ সালে বিরোধীদলের দাবির মুখে ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার স্বল্প সময়ে নির্বাচন করে সংসদ অধিবেশন ডেকে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি যুক্ত করেছিল। তার আগে ’৯১ সালে বিরোধীদলের দাবি মেনে সংবিধান সংশোধন করে দেশের প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি পরিবর্তন করে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি চালু করেছিল। উভয় ক্ষেত্রে তো সে সময়ের সরকার না মেনে এ সময়ের মতো সর্বোচ্চ বল প্রয়োগ করতে পারত! কারফিউ জারি করে আন্দোলনকারিদের ‘শুট টু কিল’র নির্দেশনা দিতে পারত এবং মামলা দিয়ে অজ্ঞাত আসামীর কথা উল্লেখ করে গণহারে গ্রেফতার করতে পারত। বিরোধীদলের শীর্ষ নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে মামলায় সাজা দিয়ে জেলে ভরে রাখতে পারত। ‘টাইরেনি’ বা স্বৈরশাসনের ভূমিকা নিতে পারত। তা তো করা হয়নি। যতটুকু করা হয়েছে, তা প্রয়োজনের সীমা ছাড়িয়ে যায়নি। এ সময়ের মতো ব্যারিকেড দিয়ে আন্দোলন দমানোর প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়নি। যা করা হয়েছে, তা ছিল আন্দোলন ও সহিংসতা মোকাবেলায় দেশের ট্র্যাডিশনাল প্রক্রিয়া। আন্দোলন দমাতে সর্বোচ্চ বলপ্রয়োগ বা কারফিউ দিয়ে দমন প্রক্রিয়া অবলম্বন না করে যুক্তিসঙ্গত দাবি, যা জনসমর্থিত, তা মেনে নিয়েছে। কোটা আন্দোলনকারিদের দাবি অযৌক্তিক ছিল, এমন দাবি কেউই করেনি। সরকারও করেনি। তাহলে, সরকার এ দাবি মেনে না নিয়ে আন্দোলন দমাতে গেল কেন? সময়ক্ষেপণ করে সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী, তৃতীয় পক্ষকে ঢুকে পড়ার সুযোগ কেন দেয়া হলো? সচেতন মানুষ মনে করছে, সরকার শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার ক্ষমতা দেখাতে গেছে। ক্ষমতা দেখিয়ে যেভাবে বিরোধীদলের আন্দোলন দমিয়েছে, সে প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছে। সরকারের মধ্যে এমন প্রবণতা শেকড় গেঁড়ে বসেছে যে, তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই তা যৌক্তিক না অযৌক্তিক তা বিবেচনা করার প্রয়োজন নেই। ‘ডান্ডা মেরে ঠান্ডা’ করে দিতে হবে। টুঁ শব্দ করা যাবে না। সরকারের এমন আচরণকে জনগণের সাথে ক্ষমতা দেখানো বা ক্ষমতান্ধ বলা হয়, যেখানে যুক্তি নয়, শক্তিই মূল কথা। অথচ রাষ্ট্র পরিচালকদের কাজ নাগরিকদের সাথে শক্তি বা ক্ষমতা দেখানো নয়, তাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখা। যে জনগণ ক্ষমতার উৎস, রাষ্ট্রের অস্তিত্বের শক্তি, সেই জনগণের বিরুদ্ধে যখন ক্ষমতা দেখানো হয় এবং তাদের হত্যা-নির্যাতন করা হয়, সে রাষ্ট্র এবং তার পরিচালক কখনোই জনগণের হতে পারে না।
তিন.
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র যে দমননীতি ও হত্যার মতো অবলম্বন করেছে, তা কি দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হয়েছে? হয়নি। বরং একে শিক্ষাবিদরা ‘জুলাই হত্যাকা-’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্ল্যাটফর্ম ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশ’ গত সোমবার সমাবেশ করে আন্দোলনে হত্যাকা-কে ‘জুলাই হত্যাকা-’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এ নামে ডাকার আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদিকে, জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ইত্যাদি দেশ, মানবাধিকার সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে একের পর এক নেতিবাচক ও কঠোর ভাষায় বক্তব্য-বিবৃতি ও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থক ভারতের পত্র-পত্রিকাও তা সমর্থন করেনি। গত সোমবার জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে যে কথা বলেছেন, তা খুবই শঙ্কার। তিনি বলেছেন, মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরাঁ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণ পেয়েছেন। যেকোনো পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বেশ কয়েকটি ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশে সংঘটিত সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতায় বাধাগ্রস্থ করার নিন্দা জানিয়েছে। বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা এক সাক্ষাৎকারে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, নৃশংসতার জন্য দায়ী নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যর বিরুদ্ধে সম্ভবত নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে পারে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটতে পারে। তিনি বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করে বলেছেন, ভারতের সীমান্তের কাছে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র তার স্বার্থ রক্ষা করবে না। তিনি এ কথাও বলেছেন, সমস্যার সমাধান বাংলাদেশকেই করতে হবে। দেশকে পুনরেকত্রীকরণের কাজটি তাকেই করতে হবে। সরকারপন্থী হিসেবে পরিচিত অনেক বুদ্ধিজীবীসহ সর্বজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বরা এক বিবৃতিতে বলেছেন, কোটা সংস্কারের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর গত ১৬ জুলাই থেকে পুলিশসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনীর পাশাপাশি সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল মন্ত্রীর প্ররোচনায় তাদের আশীর্বাদপুষ্ট ছাত্র সংগঠনের সহিংস কর্মীরা নজিরবিহীন দমন-পীড়নের তা-ব চালিয়েছে। শুরু থেকেই সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও অরাজনৈতিক ছাত্র আন্দোলনকে সরকারি দল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেতে চেয়েছে। তারা দাবি উত্থাপন করে বলেছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকালে পুলিশ, র্যাব, অন্যান্য বাহিনী কিংবা সরকারের মদদপুষ্ট বেসরকারি অস্ত্রধারীদের হাতে সাধারণ শিক্ষার্থী, শান্তিপ্রিয় নাগরিক, কিশোর-কিশোরী এমনকি শিশু নিহত, নির্যাতিত ও আহত হওয়ার প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হতে হবে। স্বচ্ছ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে এ তদন্ত জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ দলের তত্ত্বাবধানে হওয়া জরুরি। আমরা জাতিসংঘকে এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার আহ্বান জানাচ্ছি। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা যে ভাষায় বিবৃতি দিয়েছে, তা কোনোভাবেই দেশের ভাবমর্যাদাকে উজ্জ্বল করে না। সংস্থাটির প্রধান ভলকার তুর্ক এক বিবৃতিতে বলেছেন, অনেক লোক সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর সহিংস আক্রমণের শিকার হয়েছে এবং তাদের সুরক্ষার কোনো প্রচেষ্টা চালানো হয়নি। ইচ্ছাকৃতভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করার মতো ভোঁতা পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে, যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারকে সম্মান করার জন্য রাষ্ট্রের সক্ষমতার অভাবের পরিচায়ক। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সরাসরি ক্ষমতাসীন দলকে দায়ী করে বলেছে, যৌক্তিক দাবিকে কেন্দ্র করে একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্বশীল নেতৃত্বের একাংশের অপরিনামদর্শী উসকানির ফলে অযৌক্তিক, অপ্রয়োজনীয় ও অবৈধ বলপ্রয়োগের কারণে এমন রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তিন বৃটিশ এমপি রুশনারা আলী, অপসানা বেগম ও রুপা হক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনজনই বৃটেনের সরকার দলীয় এমপি। তারা বাংলাদেশ প্রসঙ্গ বৃটিশ পার্লামেন্টে তুলে ধরেছেন। রুশনারা আলী বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং প্রতিবাদ করার স্বাধীনতার অধিকারকে সম্মান করাকে গুরুত্ব দিতে বলেছেন। আপসানা বেগম বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাত, প্রাণহানির ঘটনায় যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে ‘আর্লি ডে মোশন’ উত্থাপন করেছেন। এতে সাবেক লেবার নেতা ও বর্তমান স্বতন্ত্র এমপি জেরেমি করবিনসহ অন্তত ২২ জন বৃটিশ এমপি স্বাক্ষর করেছেন। রুপা হক বৃটিশ পার্লামেন্টের অধিবেশনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাজ্য সরকারের অবস্থান জানতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে যা চলছে, তা নিয়ে সম্প্রতি রোম, প্যারিস, ম্যানচেস্টার ও লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে বিক্ষোভ দেখা গেছে। বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক ছাত্র ও বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ মন্তব্য করেছে, কোটা বিক্ষোভ দমনের পর প্রান্তসীমায় বাংলাদেশ। বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন ফোর্বস-এর এক জরিপে পর্যটকদের ভ্রমণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষ দশের মধ্যে রয়েছে। তালিকার ৬ নম্বরে বাংলাদেশ। উচ্চ অপরাধের হার, সহিংসতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জকে মাথায় রেখে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। বৃটেনের ইকোনোমিস্ট পত্রিকায় শিক্ষার্থী হত্যা ও আন্দোলন দমানোর সরকারের পদক্ষেপের কথা তুলে ধরা হয়েছে। আল জাজিরাসহ বিশ্বের আরও অনেক গণমাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও দমন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বলা বাহুল্য, এসব প্রতিবেদন ও বক্তব্য-বিবৃতি কোনোটাই দেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করেনি। বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার সংকোচন, সুশাসনের অভাব, বিরোধীদল ও সাধারণ মানুষের ওপর দমন-পীড়ন, নির্বিচারে মানুষ হত্যা, গণগ্রেফতার, নাগরিক অধিকার সংকুচিত এবং সরকারের কর্তৃত্ববাদী আচরণকে তুলে ধরা হয়েছে। বিগত পনের বছরের বেশি সময় ধরে এসব বিষয় নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তা নতুন করে সামনে এসেছে, যা দেশের সম্মানকে ক্ষুণœ করেছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বে নেতিবাচক ধরাণাকে বদ্ধমূল করেছে। এর ফলে দেশের অর্থনীতি বিপুল ক্ষতির শিকার হবে। ইমেজ সংকটের কারণে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য, উন্নয়ন সহযোগিতা, দান-অনুদান, ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ইতোমধ্যে তা পড়তে শুরু করেছে। রফতানির অন্যতম প্রধান খাত গার্মেন্ট শিল্পের নতুন অর্ডার কমে গেছে। অনেক অর্ডার স্থগিত করা হয়েছে। অন্যান্য রফতানি খাতেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রেমিট্যান্স আসা অনেক কমে গেছে। কোটা আন্দোলনকে সমর্থন করে অনেক প্রবাসী দেশে রেমিট্যান্স না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং অন্যরাও যাতে না পাঠায় তার প্রচারণা চালাচ্ছে। পাঠালেও সরকার যাতে রাজস্ব না পায়, সেভাবে পাঠাচ্ছে। অর্থাৎ তারা সরকারকে সহযোগিতা করতে চায় না। দেশের অর্থনীতি যখন খাদের কিনারে, সরকারকে যেখানে অত্যন্ত সতর্ক হয়ে পা ফেলার কথা এবং কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয়, সে সময়ে কোটা আন্দোলন দমনের মতো অদূরদর্শী পদক্ষেপ নিয়েছে। তরুণ প্রজন্মের সেন্টিমেন্ট আমলে না নিয়ে নিজের অহম দিয়ে দমনের পথে হেঁটেছে। এ কথাটি বেমালুম হয়ে গেছে যে, জনগণের দাবি মানার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো পরাজয় নেই বরং বিজয় রয়েছে। সরকারের কাজই তো জনগণের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করা।
চার.
সরকারের মধ্যে এমন প্রবণতা বিরাজমান, কোনো কিছু ঘটলেই তাতে ষড়যন্ত্রের গন্ধ শোঁকা। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আবিস্কার করা। মানুষ কোনো যৌক্তিক অধিকার নিয়ে সংগঠিত হয়ে দাবি তুললেই তাকে প্রতিপক্ষ হিসেবে এবং সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে। এই ষড়যন্ত্র খুঁজতে গিয়ে সে নিজের ভুল-ত্রুটি দেখতে পাচ্ছে না। আত্মান্ধ হয়ে পড়েছে। অথচ সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, আত্মান্ধ না হয়ে আত্মানুসন্ধানী হওয়া। সত্য শোনা এবং মেনে নেওয়ার মানসিকতা ধারণ করে তা প্রতিষ্ঠা করা। সরকারই ঠিক, বাকি সবাই বেঠিক, এ মানসিকতা পরিহার করে তার শাসন ব্যবস্থায় কি গলদ রয়েছে, কোথায় দুর্বলতা, কি করলে সুশাসন নিশ্চিত করা যায়, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামত কি, গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার কোন পর্যায়ে রয়েছে ইত্যাদি মৌলিক উপাদানগুলো ধারন করতে পারছে কিনা, ঘাটতি রয়েছে কিনা, তা পর্যালোচনা করা। বিগত পনের বছরের অধিক সময় ধরে আমরা যা দেখছি, তাতে এটাই প্রতীয়মান হয়, সরকার এসব উপেক্ষা করে নিজের ক্ষমতাকে কীভাবে পাকাপোক্ত করা যায়, তাতে বেশি মনোযোগী। সরকারের কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে তার তৈরি ইট-পাথরের স্থাপনার মূল্য বেশি। অথচ সরকার উন্নয়নের যে কথা বলছে, এক কোটা আন্দোলনে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে, অর্থহীন হয়ে পড়েছে। এর প্রকাশ ঘটেছে, গত রবিবার সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা যে দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতি অঙ্কন কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে। তারা লিখেছে, ‘আমি মেট্রোরেল হতে চেয়েছিলাম, খোদা আমাকে ছাত্র বানাল।’ শুধু তাই নয়, তরুণ প্রজন্মের মনে সরকারের প্রতি কি ধারণা জন্মেছে, তারও প্রকাশ ঘটেছে দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতিতে। তারা লিখেছে, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি, গুলি কর’, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও রাষ্ট্র কারও বাপের না’, ‘ছাত্র যদি ভয় পাইত বন্দুকের গুলি, উর্দু থাকত রাষ্ট্রভাষা, উর্দু থাকত বুলি’, ‘দেশ স্বাধীন হলে আমরা আবার ছাদে উঠব’, ‘লোহার টুপি মানুষের মগজ খায়’ ইত্যাদি। জর্জ ফ্লয়েডের মেয়ে যেমন জো বাইডেনকে বলেছিল, ‘ড্যাডি চেঞ্জড দ্য ওয়ার্ল্ড’, একইভাবে কোটা আন্দোলনে সরকারের দমন প্রক্রিয়া তরুণ প্রজন্মের মেধাবীদের মন ও মনন পরিবর্তন করে দিয়েছে। এই পরিবর্তন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে থেকে যাবে। তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় তাদের কথায়। মনের কথা দেয়ালে লিখতে লিখতে বলেছে, ‘আমরা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন দেখিনি, একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতের গণহত্যা দেখিনি। এগুলো সবসময় আমাদের প্রতিবাদী চেতনার জন্ম দেয়। এবার আমরাও ইতিহাসের সাক্ষী হলাম। আমরা চব্বিশ (২০২৪) দেখেছি। দেয়ালে, সড়কে গ্রাফিতির মাধ্যমে চব্বিশকে পৃথিবীকে জানিয়ে দিতে চাই।’ সরকার কি পারবে তরুণ প্রজন্মের মনে ও চেতনায় যে ক্ষোভ ও ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, তা মুছে দিতে?
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
নাসিরনগর উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি অসিম কুমার পাল গ্রেফতার।
জাল স্টাম্প-কোর্ট ফি তৈরি করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করতো চক্রটি
উত্তরায় শিকলে বেঁধে মধ্যযুগীয় কায়দায় ২ কিশোরকে নির্যাতন, আটক ২
শৈলকুপায় চাঞ্চল্যকর ‘ফাইভ মার্ডার’ মামলায় দুইজনের যাবজ্জীবন
চাঁবিপ্রবি’র ভূমি অধিগ্রহণ বাতিল হলেও দীপু মনির চাপে গোপন রাখা হয়
ঢাকায় মানবাধিকার অফিস খুলতে চায় জাতিসংঘ : সমকামিতা প্রসারের আশঙ্কা
কুড়িগ্রামে নারী প্রতারক আটক
গণঅভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থীদের বেতন-টিউশন ফি মওকুফের সিদ্ধান্ত
জর্জির ১০০, দ. আফ্রিকার ২০০
আশুলিয়ায় স্বামী-স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে হত্যার ঘটনায় দুইজনকে গ্রেপ্তার
ভারতীয় সেনাবাহিনীর গুলিতে কাশ্মিরে গেরিলা যোদ্ধা নিহত ১
দুদকের চেয়ারম্যান মইনুউদ্দীনসহ দুই কমিশনারের পদত্যাগ
সৎ ছেলেকে হত্যার পরিকল্পনা, সৎ মা নিজেই হত্যার শিকার হয়
ফিলিপাইনের মাদকবিরোধী অভিযানে ‘ডেথ স্কোয়াড’, দুতার্তের স্বীকারোক্তি
হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস র্যাগিং ও মাদক মুক্ত ঘোষনা
রাজবাড়ীতে অস্ত্র মামলায় এক সন্ত্রাসীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
জর্জি-স্টাবসের শতরানের জুটিতে বড় সংগ্রহের পথে দক্ষিণ আফ্রিকা
মহেশপুরে অসুস্থ্য গরুর মাংস বিক্রয়ের অপরাধে কসাই আটক, জেল-জরিমানা
ব্যবসা নয় ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কাজ হচ্ছে হাজীদের সেবা করা
কিশোরগঞ্জ সেন্ট্রাল প্রেস ক্লাবের আহ্বায়ক কমিটি গঠিত