শিশু-কিশোর হত্যা ও নির্যাতন বন্ধ করতে হবে
০২ আগস্ট ২০২৪, ১২:২০ এএম | আপডেট: ০২ আগস্ট ২০২৪, ১২:২০ এএম
শিশু-কিশোররা জাতির ভবিষ্যত। আমরা আজকে যা কিছু করছি তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যই করছি। জাতির এই ক্রান্তিকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রাণঘাতী অস্ত্রে হত্যাও গ্রেফতার-নিপীড়ন থেকে শিশু-কিশোররাও রেহাই পাচ্ছে না। এ এক চরম বিভীষিকাময় বাস্তবতা। স্বাধীন দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জনগণের সেবক বা চাকর। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের পোশাক, অস্ত্র-গুলি, বেতন-ভাতা ও সুযোগ সুবিধার যোগান দেয়া হয়। সাংবিধানিকভাবে প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ আর সরকারি কর্মচারী, মন্ত্রী-আমলা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জনগণের সেবক তথা চাকর। দেশে গণতন্ত্রহীনতার কারণে জনগণের চাকররা এখন দেশের মালিক বনে গেছেন। বৈষম্যনীতি নিরসন করে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকারের অংশ। সেই আন্দোলন দমন করতে গিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শুধু নিরপরাধ মানুষের উপরই গুলি চালাচ্ছে না, নিষ্পাপ শিশু-কিশোরদেরও প্রাণহরণ করছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবি শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বন্দুকের ট্রিগার চেপে গুলি করার দায়ে অভিযুক্ত সেই পুলিশ সদস্যকে এখনো গ্রেফতার করা না হলেও আবু সাঈদ হত্যা মামলায় রংপুর পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ১৬ বছর ১০ মাস বয়েসী এক কিশোরকে ১৮ জুলাই গ্রেফতার করে ১২ দিন ধরে কারাগারে রাখা হয়েছে। এমন অসংখ্য শিশু-কিশোর পুলিশি হামলা, গ্রেফতার-নির্যাতন ও গুমের শিকার হয়েছে। পুলিশের গুলিতে নিহত ও আহতের প্রকৃত সংখ্যা জানা না গেলেও এ পর্যন্ত প্রকাশিত ২ শতাধিক নিহতের মধ্যে কয়েক ডজন শিশু-কিশোর রয়েছে।
বায়ান্নর ভাষা শহীদদের স্মরণে লেখা সেই অমর কবিতায় আব্দুল গাফফার চৌধুরী লিখেছেন,‘শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাপুক বসুন্ধরা’। ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে এদেশের লাখ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। বৈষম্য মুক্ত স্বাধীন দেশে সাম্য, শান্তি, নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক সহাবস্থানের মূল্যবোধকে জাগ্রত রেখে প্রতিটি নাগরিকের মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার স্বপ্নই আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে এসেও দেশের মানুষকে বৈষম্য-নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন দিতে হচ্ছে! আমরা আমাদের শিশুদের জন্য ন্যুনতম নিরাপদ বাসভূমি গড়ে তুলতে পারিনি। রাজনৈতিক আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে শুধু রাজপথেই নয়, নিজ বাড়ির জানালায়, বারান্দায়-ছাদে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া বেশ কিছু শিশু-কিশোরের নাম ও ছবি গণমাধ্যমে উঠে আসলেও তাদের প্রকৃত সংখ্যা এখনো অজানাই রয়ে গেছে। গুলিবিদ্ধ শিশুদের নিয়েও সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে দায় এাড়ানো এবং ব্লেইম গেম করতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু শিশু-কিশোরদের পায়ে গুলি করার পর গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো, কিশোর ফাইয়াজকে গ্রেফতারের পর হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে কারাগারে নেয়ার অমানবিক আচরণের দায় তারা কিভাবে এড়াবে? নিহতের আংশিক তালিকায় ছবিসহ চার বছরের শিশু আহাদ, ৬ বছরের রিয়া গোপ, সাফকাত সামির(১১), তাহমিদ (১৪), হোসাইন মিয়া(১০), নাইমা(১৬), মোবারক(১৩), ইফাত(১৬), সিয়াম(১৫), সাদ(১৩), মাহফুজ(১৫), ইমরান, আরাফাত আকাশের(১৬) নাম দেখা যাচ্ছে। এদের বয়েস ৪ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। শিশু হত্যার এই বেদনার ছায়া ও সংক্ষোভ এখন পুরো দেশকে আচ্ছন্ন ও বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
দেশে গণতন্ত্রের বদলে স্বৈরতন্ত্র এবং আইনের শাসনের বদলে পুলিশি শাসন চলছে। এত মৃত্যু, এত রক্তক্ষরণ এবং হাজার হাজার মানুষকে নির্বিচারভাবে গ্রেফতার-হয়রানির এক বিভীষিকাময় বাস্তবতায় শিক্ষার্থীদের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন এখন গণআন্দোলনে পরিণত হয়েছে। শিশু-কিশোর, যুবক সন্তান হারানো মায়েরা, হাজার হাজার গুলিবিদ্ধ, পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্বের ঝুঁকিতে থাকা সন্তানের অভিভাবকরা, শিক্ষক সমাজ, আইনজীবী, পেশাজীবী, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ ক্রমেই অবিচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে। ন্যায়বিচারের দাবিতে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচী থেকেও অনেক শিক্ষার্থীকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ উঠেছে। অথচ আবু সাঈদ হত্যাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে সব সদস্যের গুলিতে শিক্ষার্থী ও শিশু-কিশোররা নিহত-আহত হল তাদের কাউকে বিচারের আওতায় আনা হয়নি। মানবাধিকারের বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তিদের কয়েকজন আগে থেকেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও পশ্চিমা দেশগুলো বিভিন্ন সময়ে এসব বিষয়ে কথা বলেছে। চলমান আন্দোলনে সহিংসতার অভিযোগে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তরফ থেকে আরো কঠোর পদক্ষেপের আশঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি রেমিটেন্স যোদ্ধারা মানবাধিকার লঙ্ঘণের অভিযোগে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নির্বাচিত প্রতিনিধি ও আইন প্রণেতারা বাংলাদেশে নির্বিচার হত্যাকান্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি অংশীদারিত্ব চুক্তির আলোচনা বাতিল করেছে। এতকিছুর পরও পুলিশের মাইন্ডসেট তথা আচরণ ও মনোভাবে কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। রাজপথে বেপরোয়া বলপ্রয়োগের পাশাপাশি ঘরে ঘরে গিয়ে শিক্ষার্থীসহ নিরপরাধ মানুষকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। অনেকের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। আন্দোলনে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও হতাহতের ঘটনার জন্য দায়ীদের বিচারের সম্মুখীন করার গণদাবী উপেক্ষিত হচ্ছে। গুরুতর অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ও সমালোচিত পুলিশ কর্মকর্তাদের বরখাস্ত বা কোনো লঘুদ-েরও সম্মুখীন হতে হচ্ছে না। ডিবি হারুন ও বিপ্লব কুমারদের বদলি করেই দায় এড়াচ্ছে সরকার। এসব বদলিকে লোক দেখানো আইওয়াশ বলেই মনে করছে দেশের মানুষ। এমনকি সরকারি দলের অভ্যন্তরেও সরকারের সংশ্লিষ্টদের এমন অপরিণামদর্শী ভূমিকা সমর্থন পাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলীয় কার্যালয়ে দলের নেতাকর্মীদের তিরস্কারের সম্মুখীন হয়েছেন, এ থেকেই পরিস্থিতি আঁচ করা যায়। মানুষের অন্যতম প্রধান দাবি হচ্ছে, শিশু-কিশোর হত্যা-নির্যাতনের সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করে দোষিদের বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বেপরোয়া মনোভাব ও মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের নীতি পরিহার করে আচরণের বিশ্বাসযোগ্য পরিবর্তন নিশ্চিত করতে হবে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
নাসিরনগর উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি অসিম কুমার পাল গ্রেফতার।
জাল স্টাম্প-কোর্ট ফি তৈরি করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করতো চক্রটি
উত্তরায় শিকলে বেঁধে মধ্যযুগীয় কায়দায় ২ কিশোরকে নির্যাতন, আটক ২
শৈলকুপায় চাঞ্চল্যকর ‘ফাইভ মার্ডার’ মামলায় দুইজনের যাবজ্জীবন
চাঁবিপ্রবি’র ভূমি অধিগ্রহণ বাতিল হলেও দীপু মনির চাপে গোপন রাখা হয়
ঢাকায় মানবাধিকার অফিস খুলতে চায় জাতিসংঘ : সমকামিতা প্রসারের আশঙ্কা
কুড়িগ্রামে নারী প্রতারক আটক
গণঅভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থীদের বেতন-টিউশন ফি মওকুফের সিদ্ধান্ত
জর্জির ১০০, দ. আফ্রিকার ২০০
আশুলিয়ায় স্বামী-স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে হত্যার ঘটনায় দুইজনকে গ্রেপ্তার
ভারতীয় সেনাবাহিনীর গুলিতে কাশ্মিরে গেরিলা যোদ্ধা নিহত ১
দুদকের চেয়ারম্যান মইনুউদ্দীনসহ দুই কমিশনারের পদত্যাগ
সৎ ছেলেকে হত্যার পরিকল্পনা, সৎ মা নিজেই হত্যার শিকার হয়
ফিলিপাইনের মাদকবিরোধী অভিযানে ‘ডেথ স্কোয়াড’, দুতার্তের স্বীকারোক্তি
হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস র্যাগিং ও মাদক মুক্ত ঘোষনা
রাজবাড়ীতে অস্ত্র মামলায় এক সন্ত্রাসীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
জর্জি-স্টাবসের শতরানের জুটিতে বড় সংগ্রহের পথে দক্ষিণ আফ্রিকা
মহেশপুরে অসুস্থ্য গরুর মাংস বিক্রয়ের অপরাধে কসাই আটক, জেল-জরিমানা
ব্যবসা নয় ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কাজ হচ্ছে হাজীদের সেবা করা
কিশোরগঞ্জ সেন্ট্রাল প্রেস ক্লাবের আহ্বায়ক কমিটি গঠিত