মাধ্যমিকে কোডিং ও এআই প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ এএম
প্রযুক্তির দুনিয়ায় বর্তমানে চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। শুধু চর্চা নয় বেড়েছে ব্যবহারও। মানব সভ্যতার উন্নয়নে এই প্রযুক্তি কীভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে চলছে গবেষণা। আর সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারই প্রবেশ ঘটেছে শিক্ষাক্ষেত্রেও। সেটা ভালো হবে কি মন্দ হবে তা নিয়ে চলছে অনেক বিতর্ক। তবুও এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর একটি বিশ্ব আমাদের তৈরি হবে। আর সেই বিশ্বে পদচারণা করবে আজকের দিনের নতুন প্রজন্ম; আপনার আমার সন্তানরা। সেই বিশ্বে আমাদের সন্তানরা কেমন করবে তা অনেকখানিই নির্ভর করবে তার ডিজিটাল প্রযুক্তি জ্ঞানের উপর। তাই বর্তমান বিশ্বের অভিভাবকরা চাচ্ছেন তাদের সন্তানরা ছোট থেকেই ডিজিটাল প্রযুক্তির উপর বেসিক কিছু জ্ঞান অর্জন করুক।
আজকের দিনে মানুষ বেশিরভাগ সময় মোবাইল এবং কম্পিউটার ব্যবহার করে, কম্পিউটার ও মোবাইলের মধ্যে অ্যাপ্লিকেশন এবং ওয়েবসাইট চালিয়ে থাকে। কিন্তু কীভাবে এই অ্যাপ্লিকেশন এবং ওয়েবসাইটগুলি তৈরি হয় তা অনেকেরই অজানা। তাই আপনাদের জানিয়ে রাখি, এগুলির সমস্ত কিছু কোডিংয়ের সাহায্যে তৈরি করা হয়ে থাকে। কিন্তু কোডিং সম্পর্কে অনেক ব্যক্তিরই ধারণা খুবই কম।
কম্পিউটার কোডিং হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার সাহায্যে কম্পিউটারের প্রোগ্রামগুলো ডিজাইন করা হয়। কম্পিউটারে যে অপারেশনগুলো করা হয়, সেগুলো কম্পিউটার কোডিংয়ের মাধ্যমে বুঝতে পারে। এর কারণ কম্পিউটার শুধুমাত্র কোডিংয়ের ভাষা বোঝে। আমরা যদি কম্পিউটারকে দিয়ে কোনো কাজ করাতে চাই, তাহলে কোডিংয়ের মাধ্যমে কম্পিউটারকে সেটি জানাতে হবে। আজকের দিনে আধুনিক কম্পিউটার, ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, সফ্টওয়্যার, গেমস, অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, মেশিন লার্নিং, আইওটি, ওয়েবসাইট, অ্যাপস ইত্যাদি সব কিছুর মধ্যেই কোডিং ব্যবহার করা হয়। কোডিংয়ের সাহায্যে নির্দিষ্ট একটি প্রোগ্রাম তৈরি করা হয়। এই প্রোগ্রামগুলির সাহায্যে কম্পিউটার নির্দিষ্ট কাজগুলো সম্পন্ন করে থাকে।
কোডিং কেন শিখতে হবে তার অনেক কারণ আছে, যার কয়েকটি উল্লেখ করা হলো: ১। কোডিং সমস্যা-সমাধানে দক্ষ করে তুলে, ২। কোডিং চিন্তা করতে শেখায়, ৩। একাডেমিক কর্মক্ষমতা উন্নত করে, ৪। কোডিং সৃজনশীলতা বাড়ায়, ৫। কম্পিউটার প্রোগ্রামার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়, ৬। সফটওয়্যার শিল্পে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি, ৭। কোডিং শিশুদের গণিত শেখা আনন্দদায়ক করে তুলে, ৮। কোডিং শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করে, ৯। কোডিং শিখলে পরবর্তী সময়ে কর্মজীবনে দক্ষতার নতুন মাত্রা যোগ করা যায় এবং ১০। কোডিং শিখলে পেশাদারদের কাজগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা যায়, যার ফলে কাজের দক্ষতা উন্নত হয়।
বিশ্বে ৭০০টিরও বেশি প্রোগ্রামিং বা কোডিং ভাষা রয়েছে, যেগুলি বিভিন্ন প্রযুক্তি ও কাজের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে জনপ্রিয় কিছু প্রোগ্রামিং ভাষা হলো: C, C++, Java, Python, JavaScript, FORTRAN, R, Go, Ruby, HTML, CSS, PHP, MYSQL, NET ইত্যাদি। তবে কোডিং শেখার জন্য, প্রথমে সহজ ও বহুমুখী ভাষা দিয়ে শুরু করা ভালো।
অন্যদিকে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) হলো, মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তিকে কম্পিউটারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা। এটি বিজ্ঞানের জগতে এক অনন্য আবিষ্কার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে, যন্ত্র বা অ্যাপ্লিকেশনকে মানুষের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তির আদলে কাজের উপযোগী করা যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন আমেরিকান কম্পিউটার বিজ্ঞানী জন ম্যাকার্থি। এজন্য তাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক বলা হয়। তারও আগে ১৯৫০ সালে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ অ্যালান টুরিং কোনো যন্ত্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যাচাই করার জন্য একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যা ‘টুরিং টেস্ট’ নামে পরিচিত। বর্তমান পৃথিবীতে এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ নেই। তবে উল্লেখযোগ্য কিছু ক্ষেত্র হচ্ছে শিক্ষা, চিকিৎসা বিজ্ঞান, শিল্প-কলকারখানা, রেস্টুরেন্ট ব্যবসা, যুদ্ধক্ষেত্র, কৃষিকাজ, পণ্য পরিবহন, দৈহিক শ্রম, চালকবিহীন বিমান বা গাড়ি চালানো, কোডিং লিখা ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে মাইক্রোসফটের সিইও মোস্তফা সুলেমান জানিয়েছেন যে, এবার শুধু কাজই নয়, এআই মানুষের মতোই কথা বলবে এবং আচরণ করবে। সম্প্রতি জাপান তার দেশের স্যাটেলাইট টিভিতে সংবাদ উপস্থাপনের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবটের প্রয়োগ ঘটিয়েছে, যা বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। এ দিকে টেক জায়ান্ট গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সুন্দর পিচাই জানিয়েছেন, গুগলের নতুন সব সফটওয়্যার ডেভেলপে ২৫ শতাংশেরও বেশি কোড তৈরি করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)।
বাংলাদেশে কিছু কিছু খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার শুরু করলেও বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর জন্য দরকার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও দক্ষ জনশক্তি। বর্তমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে ডিজিটাল প্রযুক্তির অন্যতম নিয়ামক হচ্ছে ইন্টারনেট স্পিড। মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। ওয়েব সার্ভিস প্রতিষ্ঠান স্পিডটেস্টের মার্চ ২০২৪-এর সূচকে এমন চিত্র উঠে এসেছে। এদিকে মোবাইল ইন্টারনেটের পাশাপাশি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১০৮তম, যেটি এআই টুলস ব্যবহারের অন্তরায়।
দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, নিউজিল্যান্ডসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও তাদের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা কারিকুলামে কোডিং ও এআই প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করেছে। অতিসম্প্রতি চীন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয় তার এক নির্দেশনায় বলেছে, দেশের ‘উদ্ভাবনী প্রতিভার চাহিদা মেটাতে’ এবং শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল দক্ষতা ও সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা বাড়াতে স্কুলগুলোর মধ্যে এআই শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। নির্দেশনায় বলা হয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম ধাপে শিক্ষার্থীদের এআই প্রযুক্তির প্রাথমিক ধারণা ও অভিজ্ঞতা দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। প্রাথমিকের শেষ ধাপে এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের এআই সম্পর্কিত বিষয়গুলো বোঝা এবং সেগুলো প্রয়োগের দিকে মনোযোগ দেওয়া হবে। উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা এআই কেন্দ্রিক উদ্ভাবনী প্রকল্প তৈরি এবং এর উচ্চতর প্রয়োগের দিকে ফোকাস করবে। এর আগে চীন ২০১৭ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে একটি জাতীয় পরিকল্পনা প্রকাশ করে। এর পর ২০১৮ সালে চীনের পাঁচ শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে এআই বিষয়ে স্নাতক প্রোগ্রাম চালু করা হয়।
যুগের সংগে তাল মিলিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে আমাদের দেশের শিক্ষা কারিকুলামেও নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ে কোডিং, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট এআই টুলস ও ওয়েব ডেভেলপিং ভাষা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। প্রযুক্তি-জ্ঞানে আমরা আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে আর পিছনে দেখতে চাই না। ফলে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান থাকবে, আমাদের দেশের শিক্ষা কারিকুলামে নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ে কোডিং, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট এআই টুলস ও ওয়েব ডেভেলপিং ভাষা অন্তর্ভুক্ত করে আমাদের নতুন প্রজন্মকে বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করা। পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিতে বিশ্বে প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত করা, যাতে তারা ডিজিটাল দক্ষতা ও উদ্ভাবনী চিন্তাধারায় শক্তিশালী হতে পারে।
প্রতি বছর সরকারিভাবে উপজেলা পর্যায় হতে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত স্কুল প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করা প্রয়োজন। এছাড়াও দেশের সকল মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলগুলোতে হাইস্পিড ইন্টারনেট সংযোগসহ আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করে শিক্ষকদের প্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ করে কোডিং ও এআই টুলস সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। অধিকন্তু, স্কুলগুলোর লাইব্রেরিতে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি বিষয়ক বইয়ের পর্যাপ্ত সরবরাহ করতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও শিক্ষক।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
সিংগাইরে শীতার্তদের মাঝে ইউএনও’র কম্বল বিতরণ
বিস্ফোরক মামলায় নিক্সন চৌধুরীর অন্যতম সহযোগী জব্বার মাস্টার গ্রেপ্তার
সাবেক এমপি কবির উদ্দিন আহমেদ আর নেই
রেকর্ড ৫,৬৩৪ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা সোনালী ব্যাংকের
১৪৮ চিকিৎসককে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বদলি
৭ উইকেট ছেলেকে দিলেন তাসকিন
প্রধান উপদেষ্টার রাজবাড়ী সফর স্থগিত
ভিসা সত্যায়নের বেড়াজালে বিপুল সংখ্যক সউদীগামী কর্মী বায়রা নেতৃবৃন্দের সাথে বিএমইটির ডিজি
মোবাইলের ব্যাককভারে প্রিন্ট করা ছবি লাগানো প্রসঙ্গে
প্রেমিকাকে বিয়ে করলেন জনপ্রিয় গায়ক আরমান মালিক
সরকারি দপ্তরে তদবির বন্ধে সচিবদের উদ্দেশে পত্র দিয়ে তথ্য উপদেষ্টার অনন্য দৃষ্টান্ত
ফুলপুরে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান, ৫ পরিবহনকে জরিমানা
গরুর গাড়ির দৌড় প্রতিযোগিতায় উৎসবের আমেজ
সাইবার আক্রমণ: আসিফ-সাদিক-হান্নানের ফেসবুক আইডি সচল
গোয়ালন্দে শিক্ষার্থীদের মাঝে স্কুল ব্যাগ উপহার
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিসহ ২৩৪ অবৈধ অভিবাসী আটক
১৫% ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাতিল করুন মাওলানা মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী
প্লাস্টিক দূষণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হচ্ছে : পরিবেশ উপদেষ্টা
ঝিনাইদহে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনজন নিহত
নোয়াখালীতে কৃষি জমির মাটি কাটায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানা