জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র জারির আল্টিমেটাম

Daily Inqilab ইনকিলাব

০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৪ এএম | আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৪ এএম

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৯ দফা থেকে ১ দফার ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর ছাত্র-জনতা ৫৩ বছরের প্রত্যাশা ও বঞ্চনার চিরস্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করতে চায়। অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্র এবং ঐক্যবদ্ধভাবে গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহনকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ-বিভাজনের যে সব আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে স্বৈরাচারের দুর্নীতি ও গুম-খুনের বিচার, রাষ্ট্র সংস্কার, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনসহ গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট থেকে পুরনো গতানুগতিক বন্দোবস্তে ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র, ভারতীয় হুমকি ও অপপ্রচার, নাশকতাসহ দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার ধারাবাহিক তৎপরতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ার বাস্তবতায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও কর্মীরা ছাত্র-জনতাকে আবারো রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর তাড়াহুড়া, সংষ্কার প্রশ্নে মতানৈক্য এবং অর্ন্তবর্তী সরকারের নানাবিধ বিচ্যুতি ও ব্যর্থতার কারণে জুলাই অভুত্থান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার আশঙ্কায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা জুলাই বিপ্লবের অপ্রকাশিত ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছে। একত্রিশ ডিসেম্বরে পূর্ব নির্ধারিত জুলাই বিপ্লবের প্রোক্ল্যামেশন বা ঘোষণাপত্র প্রকাশের দিন হিসেবে ঘোষণা করেছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফসল অর্ন্তবর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ভিন্ন বার্তা প্রকাশিত হলে তারা মাত্র ১২ ঘন্টা আগে কর্মসূচি পরিবর্তন করে ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মার্চ ফর ইউনিটি সমাবেশের ঘোষণা দেয়। লাখো ছাত্র-জনতার সেই সমাবেশে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক ও প্রতিনিধিরা জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র জারির জন্য অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রতি ১৫ দিনের আল্টিমেটাম বেঁধে দিয়েছে।

ঐক্যের সমাবেশে জুলাই অভ্যুত্থানের শত শত শহীদ পরিবারের সদস্য, হাজার হাজার আহত, পঙ্গু ও অন্ধ সহযোদ্ধার অংশগ্রহনে এক অনির্বচনীয় দৃশ্যের অবতারনা হয়। তারা সম্মিলিত কণ্ঠে জানিয়েছে, হাসিনার বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচন হবে না। ইনকিলাব জিন্দাবাদ, মুজিববাদ মূর্দাবাদ শ্লোগানে প্রকম্পিত শহীদ মিনার চত্বরের লাখো জনতা রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্য দিয়ে পুরনো বন্দোবস্তের আমূল পরিবর্তনের পক্ষে আবারো সোচ্চার হওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। ছাত্র-জনতার এসব দাবির সাথে আপাত দৃশ্যে অর্ন্তবর্তী সরকারের সাথে কোনো দ্বিমত দেখা না গেলেও তাদের কর্মতৎপরতায় অনেকটা শৈথিল্য ও গতানুগতিক আবহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কোনো কোনো উপদেষ্টা যেন ক্ষমতা উপভোগ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করছেন। কাজের গতি এবং লক্ষ্য অনুসরণে তাদের মধ্যে অভ্যুত্থান বা বিপ্লবের স্পিরিট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সংস্কারের দাবির সাথে সকলে একমত হলেও এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। ন্যুনতম সংস্কার শেষে নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য টাইমলাইনও ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে যে সব বক্তব্য ও মন্তব্য দেখা যাচ্ছে, তাকে পতিত স্বৈরাচারের বিচারের দাবির চেয়ে একটি আপসমূলক নমনীয়তার ইঙ্গিত হিসেবে মনে করছেন অনেকে। ষোল বছরের নির্মম দু:শাসন-নিপীড়ন, গুম-খুন, গণহত্যার বিচার ছাড়াই পতিত স্বৈরাচারের রাজনৈতিক পুর্নবাসন কেউ মেনে নিবে না। তবে সরকারের নানা রকম ব্যর্থতা জনগণের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে পারে। সংস্কার ও গণতন্ত্রে উত্তরণ খুব জরুরি ইস্যু হলেও জনজীবনে স্বস্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা সবচেয়ে বেশি জরুরি। অর্ন্তবর্তী সরকারকে যথাশীঘ্র রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংস্কার, নির্বাচন এবং নিরাপত্তা ও স্বস্তিদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

স্বৈরাচারি শাসনের পরিসমাপ্তির প্রায় ৫ মাস অতিক্রান্ত হলেও এখনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকটাই অস্থিতিশীল। রেমিটেন্স প্রবাহের হাত ধরে ফরেক্স রির্জাভে কিছুটা উন্নতি ঘটলেও বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে প্রত্যাশিত পরির্বনের সূচনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। বিনিয়োগের মূল চালিকা শক্তি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, জননিরাপত্তা এবং গ্যাস-বিদ্যুত ও জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়গুলো এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। আইন উপদেষ্টাকে নিয়ে নানা বিতর্ক, পরিবেশ উপদেষ্টার কণ্ঠে অপ্রাসঙ্গিক বাগাড়ম্বরতা শোনা গেলেও তাদের কর্মক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কার্যকর ও দৃশ্যমান উদ্যোগ ছাড়া রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট নিরসন সম্ভব নয়। ছাত্র-জনতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যুনতম ঐক্যই হচ্ছে জাতীয় ঐক্যের মূল ভিত্তি। গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে জাতীয় ঐক্য ছাড়া রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার ও পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। পতিত স্বৈরাচারের দোসর ও সুবিধাভোগিরা সর্বত্র সক্রিয় রয়েছে। নানা ধরণের ইস্যু খাড়া করে তারা অর্ন্তবর্তী সরকারের কর্মকান্ড ব্যহত করার চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। সচিবালয়ের অগ্নিকান্ডের সাথে নাশকতা বা সাবোট্যাজের সন্দেহ তদন্ত কমিটির রিপোর্টেই দূর হয়ে যাবে না। সচিবালয়ে বিভিন্ন ক্যাডারদের নানা দাবিদাওয়া ও আন্দোলনের হুমকি থেকে বুঝা যায়, তারা কেন, কাদের ইঙ্গিতে মাঠে নামতে চাইছেন। হাজার মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত নতুন স্বাধীনতাকে যারা ব্যর্থ করে দিয়ে পুরনো বন্দোবস্তে ফিরিয়ে নিতে চাইবে তারাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। ইতিমধ্যে ঘোষিত টাইমলাইনের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ চুড়ান্ত করতে হবে। তার আগে জরুরি প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং স্বৈরাচারের দোসরদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিএনপি-জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যুনতম ঐক্য ও সমঝোতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। এ কারণেই পতিত স্বৈরাচারের দোসররা রাজনৈতিক দল, সরকার ও প্রশাসনের অভ্যন্তরে বিভক্তি ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে অর্ন্তবর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে চাইছে। ছাত্র-জনতা এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন রয়েছে। ১৫ দিনের মধ্যে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র জারির আল্টিমেটাম অর্ন্তবর্তী সরকারের জন্য একটি বড় পরীক্ষা। সরকারের ভূমিকা ও পদক্ষেপই নির্ধারণ করবে আগামি দিনের রাজনৈতিক গতিপথ।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

শীতে পশু-পাখিদের যত্ন
মানব পাচার রোধ করতে হবে
মজলুমের বিজয় ও জালেমের পরাজয় অবধারিত
বিনিয়োগ বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে
ছাত্র সংসদ এখন সময়ের দাবি
আরও

আরও পড়ুন

আশুলিয়ায় ছাত্র হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার

আশুলিয়ায় ছাত্র হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার

আটঘরিয়ায় প্রভাষকের বাড়িতে দুর্ধর্ষ চুরি

আটঘরিয়ায় প্রভাষকের বাড়িতে দুর্ধর্ষ চুরি

আরব বসন্ত থেকে বাংলাদেশ: স্বৈরাচার মুক্ত নতুন ব্যবস্থার সন্ধানে

আরব বসন্ত থেকে বাংলাদেশ: স্বৈরাচার মুক্ত নতুন ব্যবস্থার সন্ধানে

৫০০ হজ কোটা বহাল রাখতে প্রধান উপদেষ্টার সহায়তা কামনা

৫০০ হজ কোটা বহাল রাখতে প্রধান উপদেষ্টার সহায়তা কামনা

ফেব্রুয়ারিতে আয়ারল্যান্ড-জিম্বাবুয়ে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ

ফেব্রুয়ারিতে আয়ারল্যান্ড-জিম্বাবুয়ে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ

পাওনা টাকা ফেরত দিতে বিলম্ব যাওয়ায় পাওনাদার টাকা ফেরত নিতে না চাওয়া প্রসঙ্গে।

পাওনা টাকা ফেরত দিতে বিলম্ব যাওয়ায় পাওনাদার টাকা ফেরত নিতে না চাওয়া প্রসঙ্গে।

‘রাষ্ট্র সংস্কার শেষ করে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন দিতে হবে’

‘রাষ্ট্র সংস্কার শেষ করে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন দিতে হবে’

শীতে পশু-পাখিদের যত্ন

শীতে পশু-পাখিদের যত্ন

মানব পাচার রোধ করতে হবে

মানব পাচার রোধ করতে হবে

মজলুমের বিজয় ও জালেমের পরাজয় অবধারিত

মজলুমের বিজয় ও জালেমের পরাজয় অবধারিত

বিনিয়োগ বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

বিনিয়োগ বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

১১৬ বছর বয়সে বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যু

১১৬ বছর বয়সে বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যু

লাদাখে দুই প্রশাসনিক অঞ্চল তৈরী চীনের

লাদাখে দুই প্রশাসনিক অঞ্চল তৈরী চীনের

চিনির নিম্নমুখী বাজারে বিশ্বে কমেছে খাদ্যপণ্যের দাম

চিনির নিম্নমুখী বাজারে বিশ্বে কমেছে খাদ্যপণ্যের দাম

মার্কিন শপিং সেন্টারে প্রাণ গেল ৫ শতাধিক প্রাণীর

মার্কিন শপিং সেন্টারে প্রাণ গেল ৫ শতাধিক প্রাণীর

জাতীয় ঐক্য এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন: মির্জা ফখরুল

জাতীয় ঐক্য এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন: মির্জা ফখরুল

গাজায় ইসরাইলি বিমান হামলায় দুইদিনে নিহত ১৫০

গাজায় ইসরাইলি বিমান হামলায় দুইদিনে নিহত ১৫০

কালো টাকায় ভাসছে শীর্ষস্থানীয় মার্কিন ৩৬% থিংক ট্যাংক

কালো টাকায় ভাসছে শীর্ষস্থানীয় মার্কিন ৩৬% থিংক ট্যাংক

পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অনেক হতাহত, ফের উত্তপ্ত মণিপুর

পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অনেক হতাহত, ফের উত্তপ্ত মণিপুর

মাছের লড়াইয়ে শ্রীলঙ্কার সীমায় বন্দি হচ্ছেন ভারতীয় জেলেরা

মাছের লড়াইয়ে শ্রীলঙ্কার সীমায় বন্দি হচ্ছেন ভারতীয় জেলেরা