গাজায় ইসরাইলের পরাজয়
২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬ এএম
অবশেষে ইসরাইল এবং হামাসের মধ্যে বহুল প্রতিক্ষিত এবং প্রত্যাশিত যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। গত ১৯ জানুয়ারি রোববার সকাল আটটা থেকে এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এর মাধ্যমে গাজাবাসীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১৫ মাসের ও বেশি সময় ধরে পরিচালিত ইসরাইলের গণহত্যার অবসান হল। যুদ্ধবিরতির খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ইসরাইলি হামলায় সব হারানো গাজা বাসী আনন্দ-উল্লাস শুরু করে। তারা একে ইসরাইলের পরাজয় এবং ফিলিস্তিনিদের বিজয় হিসাবে অভিহিত করে। আশা করব, এই যুদ্ধবিরতি দীর্ঘমেয়াদে ¯’ায়ী হবে এবং গাজায় শান্তি ফিরিয়ে আসবে। ইসরাইল গাজাবাসীর বিরুদ্ধে পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে এবং ফিলিস্তিনীদের নির্বিচারে হত্যা করে। ইসরাইলের হামলায় ফিলিস্তিনিরা সবই হারিয়েছে। কিš‘ তারপর ও তারা গাজা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যায়নি। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও তারা গাজাতেই রয়ে গেছে। তারা হাসি মুখে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে কিš‘ ইসরাইলের অবৈধ দখলদারিত্ব , আগ্রাসন এবং নির্যাতনের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। ইসরাইল গাজাবাসীর বিরুদ্ধে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। সামরিক শক্তির জোরে ইসরাইল যা খুশি তা করলেও, শেষ পর্যন্ত হামাসের সাথেই তাদের যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে হয়েছে । এতে ইসরাইলের লজ্জ্বাজনক পরাজয় হয়েছে। কিছু নিরাপরাধ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা এবং তাদের অবকাঠামো ধ্বংস করা ছাড়া ইসরাইল আর কিছুই অর্জন করেনি । ইসরাইল তার সব নৈতিক অধিকার ও সমর্থন হারিয়েছে। ইসরাইল গাজায় যে গণহত্যা চালিয়েছে, তার প্রায়শ্চিত্ত তাকে একদিন করতেই হবে। কারণ মানুষের ওপর জুলুম , নির্যাতন এবং অবিচার করে পার পাবার কোন সুযোগ নাই ।
ইসরাইলি বর্বরতায় ফিলিস্তিনের গাজা বিধ্বস্ত একটি জনপদে পরিণত হয়েছে। ইসরাইলি দীর্ঘ আগ্রাসন এবং অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা থেকে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলে রকেট হামলা চালায়। এতে কিছু ইসরাইলি মারা যায় এবং কিছু ইসরাইলিকে বন্দি করা হয়। এর পর থেকেই ইসরাইল নির্বিচারে গাজায় হামলা চালিয়েছে এবং এসব হামলায় নিহত হয়েছে ৪৭ হাজারেরও বেশি নিরাপরাধ মানুষ, আর আহত হয়েছে লক্ষাধিক আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। ইসরাইলের হামলায় শিশু , নারী এবং বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারিয়েছে । অনেক মানুষ বিভিন্ন অংগ হারিয়ে চিরতরে পংগু হয়েছে । নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ কেউই এই হামলা থেকে রেহাই পায়নি। ইসরাইলী হামলায় নিহত হয়েছে হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়া, পরবর্তী প্রধান ইয়াহিয়া সিনাওয়ার সহ অসংখ্য শীর্ষ নেতা। ইসরাইলি বোমায় গাজার মানুষেরা অকাতরে মারা গেছে। বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ধূলোয় মিশে গেছে হাজারো বাড়িঘর, অফিস-আদালত,স্কুল-কলেজ, বিশ্বদ্যিালয়, মসজিদ-গির্জা এবং হাসপাতাল। গাজার বেশির ভাগ মানুষই আজ উদ্বা¯‘। সেখানকার মানুষদের আজ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা কিছুই নেই। চাকুরি, ব্যবসা বাণিজ্য এবং আয়ের কোনো পথ খোলা নেই। সেখানকার বিদ্যুত সরবারহ এবং পয়নিস্কাশন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে। মানুষেরা আজ খোলা আকাশের নীচে বসবাস করছে এবং ত্রাণের খাবার খেয়েই দিন কাটাচ্ছে। খাবারের অভাবে না খেয়েই অনেক গাজাবাসী মারা গেছে । ইসরাইলের হামলা অব্যাহত থাকায় এতদিন সর্বহারা এসব মানুষের কাছে ত্রাণের খাবার এবং চিকিৎসাসামগ্রী ও ঠিকমত পৌছানো যায়নি। গাজায় মানবতার চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। ত্রাণের জন্য অপেক্ষারত ক্ষুধার্ত মানুষদের ওপরও ইসরাইল হামলা চালিয়ে অনেক মানুষকে হত্যা করেছে। রোজা এবং ঈদের দিনে ও ইসরাইল হামলা চালিয়ে অসংখ্য ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। হাসপাতালেও নির্বিচারে হামলা চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে । ইসরাইল যেভাবে নিরাপরাধ ও নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের নির্বিচারে হত্যা করেছে, তা কোন সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না। এসব হামলার সময় ইসরাইল কোন ধরনের আইন-কানুন, আন্তর্জাতিক বিধিবিধান ও যুদ্ধের নিয়ম মানেনি। যখন যেখানে ই”ছা বোমা হামলা চালিয়েছে। এক্ষেত্রে বাধা দেয়ার কেউ ছিল না। গাজাবাসীর বিরুদ্ধে আগ্রাসন বন্ধে জাতিসংঘের সিদ্ধান্তকে ইসরাইল মানেনি। ইসরাইলের নির্যাতন থেকে ফিলিস্তিনের নিরাপরাধ জনগনকে বাঁচাতে পশ্চিমাবিশ্ব ও এগিয়ে আসেনি। বরং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশ যেমন বৃটেন, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বরাবরই ইসরাইলকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক সাহায্য দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র , ইউরোপসহ সারা দুনিয়ার সাধারণ মানুষেরা ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবং ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বিক্ষোভ করলেও, তা পশ্চিমা দেশের নেতারা গ্রহণ করেনি। ইসরাইলের অন্যায় ও অপকর্মের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে উল্ডাপিত প্রস্তাবসমুহকে যুক্তরাষ্ট্র বরাবরের মতই ভেটো প্রয়োগ করে নাকচ করে দিয়েছে। ইসরাইল ভাল করেই জানে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমাবিশ্ব শেষ পর্যন্ত তার পাশেই থাকবে। তাই ইসরাইল এত বেপরোয়া ছিল। গাজায় আজ মানবতার মৃত্যু হয়েছে। একই সাথে পশ্চিমাদের সুনাম, আ¯’া, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতাও মারা গেছে। এত মানুষকে হত্যা এবং প্রায় সবকিছুকে ধ্বংস করার পরও গাজাবাসী আত্মসমর্পণ করেনি। তাই ইসরাইল বাধ্য হয়ে হামাসের সাথে যুদ্ধ বিরতি করেছে । ইসরাইল এবং পশ্চিমাদের মুখ রক্ষার আর কোন উপায় নাই।
গাজা এখন একটি মৃত্যুপুরি এবং পুরো গাজাই কবর¯’ানে পরিণত হয়েছে । ইসরাইলের আগ্রাসন এবং বিমান হামলায় গাজার সব কিছুই শেষ হয়ে গেছে। সেখানে স্বাভাবিক জীবনযাপন বলতে কিছুই ছিল না। সব সময় মৃত্যুকে সাথী করে জীবন কাটিয়েছে গাজাবাসী। ইসরাইলী আগ্রাসনে যারা প্রাণ হারিয়েছে তারা কেউ ফিরে আসবে না। যারা আহত হয়েছে এবং সব হারিয়ে এখনো বেচেঁ আছে, তাদেরকে সাহায্য করাটা আমাদের সবারই নৈতিক দায়িত্ব। সেখানকার সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। এ অব¯’ায় গাজাকে পুনর্গঠন করতে পুরো বিশ্বকে এগিয়ে আসতে হবে । বর্তমানে গাজাবাসীরা তাবুতেই বসবাস করছে। তাই প্রথমেই ধ্বংসে পড়া ভবনের ¯‘পসমূহ অপসারণ করতে হবে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া সকল ভবন পুনঃনির্মাণ করতে হবে এবং সকলকে তাদের নিজ নিজ বাসভবনে বসবাসের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। এই যুদ্ধে কয়েক হাজার শিশু তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এসব শিশুদেরকে তাদের পরিবারের কাছে পৌছে দিতে হবে। জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতাল পুনঃনির্মাণ করে চিকিৎসা সেবা চালু করতে হবে। বিভিন্ন দেশ হতে চিকিৎসকের টিম, ঔষধপত্র এবং চিকিৎসা সামগ্রী পাঠাতে হবে। দীর্ঘদিন থেকেই সেখানকানে পড়ালেখা বন্ধ । এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ দ্রুত পুনঃনির্মাণ করে পুনরায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে হবে। গাজাবাসীকে সকল প্রকার সাহায্য প্রদান করার জন্য বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। এখানে কালক্ষেপণের কোন সুযোগ নাই ।
বলার অপেক্ষা রাখে না যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমাবিশ্ব সবসময় নিঃশর্তভাবে ইসরাইলকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছে। পশ্চিমাদের অব্যাহত সমর্থনের কারণেই ইসরাইল বছরের পর বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করে রেখেছে এবং ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ ও দমননীতি চালিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমাদের এই নীতি তাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বর্বরতা এবং এই ইস্যুতে পশ্চিমাদের নীতিরও একটা প্রতিক্রিয়া আছে এবং থাকবেই। এর প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানরা অধিক হারে পাশ্চাত্যবিরোধী এবং শক্তিশালী হবে। পশ্চিমাদের নীতির কারনে বিশ্বজুড়ে পশ্চিমাদের ওপর মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে এবং আস্থাহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে। এই আস্থাহীনতা পশ্চিমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করবে। ক্ষমতার দাপট আর সামরিক শক্তির জোরে পৃথিবীকে বেশীদিন শাসন করা যায় না। সম্ভব হলে গ্রীক, রোমান, ব্রিটিশ, জার্মান এবং সোভিয়েতরা চিরদিনই পৃথিবীকে শাসন করত এবং এসব সাম্রাজ্যের কোনদিনই পতন হত না। ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র অপরাজেয় কোন শক্তি নয়। ইসরাইল এখন অনেক দেশের ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায়, যা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সে গণহত্যা চালিয়েছে, তার প্রায়শ্চিত্ত একদিন তাকে ভোগ করতেই হবে। তাই ইসরাইলের উচিত, তার আগ্রাসন, দখলদারিত্ব ও বর্বরতা বন্ধ করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করা এবং পাশাপাশি শান্তিতে বসবাস করা। পশ্চিমাদের উচিত তাদের এই পক্ষপাতিত্ব এখনই পরিহার করা এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করা ।
লেখক : প্রকৌশলী এবং উন্নয়ন গবেষক।
ইমেইল : [email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ভারতকে ছেড়ে কেন চীনের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে শ্রীলঙ্কা?
রাজনৈতিক উত্তরণে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন করবে জাপান
প্রবাসী উপদেষ্টার আশ্বাসে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের আন্দোলন স্থগিত
মহার্ঘভাতার সঙ্গে ভ্যাট বাড়ানোর কোনো সম্পর্ক নেই: অর্থ উপদেষ্টা
পুরো বইমেলা মনিটরিং হবে ড্রোনে-ডিএমপি কমিশনার
যানবাহন চালক-পথচারীদের জন্য ডিএমপির বিশেষ নির্দেশনা
মাস্ক বা অন্য কেউ টিকটক কিনলে বিনিয়োগ করবে প্রিন্স তালালের কোম্পানি
মৃত বাবার রেখে যাওয়া ঋণ পাওনাদার নিতে না চাওয়া প্রসঙ্গে?
খেলাধুলার মাধ্যমে তরুণদের শারীরিক ও মানসিক বিকশিত হয় -ডিসি তৌফিকুর রহমান
চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিজিবি বিএসএফ বৈঠক
জিয়াউল হক মাইজভা-ারী ট্রাস্টের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান
অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তে সিলেটজুড়ে স্বস্তি
৪ দিনের রিমান্ডে সাবেক এমপি আবু রেজা নদভী
মাদারীপুরে জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবপাচারের আন্তঃসম্পর্কবিষয়ক কর্মশালা
রাজশাহীতে ছাত্রাবাসে ঢুকে সমন্বয়ককে মারধর
মাদারীপুরে হত্যার দায়ে ৫ জনের যাবজ্জীবন
এক বছরে উখিয়া-টেকনাফে ১৯২ জন অপহরণ
‘সমন্বয়ক মরার জন্য প্রস্তুত হ’ দেয়ালে লিখে হত্যার হুমকি
বিমানের এই কর্মকা- সহ্য করার মতো নয় -সিলেট সুধীজন
বাণিজ্যমেলায় শেষ মুহূর্তে নিত্যপণ্য কেনাকাটার ধুম