ঢাকা   মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫ | ১৬ বৈশাখ ১৪৩২

সাম্রাজ্যবাদ এবং জয়নবাদীদের নোংরা খেলা

Daily Inqilab ইলিয়াজ হোসেন রানা

২৫ মার্চ ২০২৫, ০১:০৬ এএম | আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৫, ০১:০৬ এএম

মুসলিম বিশ্বের একেবারে কেন্দ্রে ইহুদিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পিছনে যে সুদূরপ্রসারী অশুভ লক্ষ্য কাজ করেছে, তা উপলব্ধি করা যায় ইতিহাসের পাতা উল্টালে। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আধিপত্যের বলয় বাড়ানো নিয়ে তিন ইউরোপীয় দেশ ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছিলো। বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তারা নানা অপকৌশল অবলম্বন করছিলো। ফিলিস্তিন ভূখ-ের উপরও ছিল তাদের লোলুপ দৃষ্টি। ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে এই ফিলিস্তিন। ভৌগোলিক দিক থেকে এটি একটি কৌশলগত অঞ্চল। সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের শাসনামলে ফিলিস্তিনকে নিজেদের উপনিবেশে পরিণত করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালায় ফ্রান্স। ফ্রান্সের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি টের পেয়ে ব্রিটেনও গ্রহণ করে এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার আওতায় সাম্রাজ্যবাদ ও ইহুদিবাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় ঘনিষ্ঠতা। এরই ফলে দখল হয়ে যায় কয়েক হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারক ফিলিস্তিন।

ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর বিশ্ব ইহুদিবাদ নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে। ইহুদিবাদের প্রতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনের ফলে ফিলিস্তিনে প্রথম ইহুদিবাদের সরকার গঠনের ক্ষেত্র তৈরি হয়। ইতিহাস এ কথারই সাক্ষ্য দেয় যে, নিজেদের হীনস্বার্থ ও বর্ণবাদী চেতনার কারণেই ইউরোপ তথা পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ফিলিস্তিন ভূখ-ে সৃষ্টি হয় অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল। যে শক্তি তাদের সৃষ্টি করেছে সেই শক্তিরই আশ্রয়-প্রশ্রয় ও সাহায্যে এখনো তারা টিকে আছে। ফলে ভূমিপুত্র নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের উপর জুলুম নির্যাতন ও হত্যাকান্ড চালিয়ে গেলেও ইসরাইল সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে না কেউ। ফিলিস্তিন বিশ্ব মানচিত্রে একমাত্র জনপদ, যেখানে প্রতি মিনিটে লাশের মিছিলে যোগ হয় কোন না কোন নিরপরাধ শিশু, অসহায়-অবলা নারী কিংবা স্বাধীনতার স্বপ্নে চোখ ঝাপসা হয়ে যাওয়া বৃদ্ধ অথবা বৃদ্ধা। পরাশক্তি এক সময় যে বিষবৃক্ষ নামের কৃত্রিম ও বর্ণবাদী ইসরাইল রাষ্ট্রের নাম দিয়েছিলো, সেটাই এখন বর্ধিত পরাশক্তি। ইউরোপ নেতৃত্ব দিয়েছে ইসরাইল প্রতিষ্ঠায়, সেই ইসরাইলকে লালন-পালন করে আরব বিশ্বের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পরমাণু অস্ত্র, অর্থ ও সব পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে পশ্চিমা পরাশক্তি। এখন ফিলিস্তিনিরা শুধু ইহুদিবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেয়া অসম যুদ্ধ করছে না, তারা যুদ্ধ করছে তাবৎ পশ্চিমা কায়েমি স্বার্থবাদীদের বিরুদ্ধে। তারা যুদ্ধ করছে বর্ণবাদ ও পশ্চিমা তাবেদার রাজা- বাদশাদের বিরুদ্ধে।

মধ্যপ্রাচ্যের সর্বোচ্চ যে রক্তপাত ও অরাজগতা সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে, তার সৃষ্টিকর্তা হল সাম্রাজ্যবাদ। ঔপনিবেশিক আমল থেকেই ইঙ্গ-ফরাসি-জার্মান-মার্কিন-সাম্রাজ্যবাদের শক্তি উপনিবেশগুলোকে, তথা গোটা বিশ্বকে, তাদের নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য “ভাগ করো, শাসন করো” নীতি প্রয়োগ করে এসেছে। উপনিবেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রেখে তারা সেখানকার সহায় সম্পদ অবাধে লুটে নিয়েছে। তাদের শোষণের প্রয়োজনে ও নিজেদের মধ্যে লুটপাটের ভাগ বাটোরা নিয়ে দ্বন্দ্ব সমাধানের স্বার্থে তারা ইচ্ছামত রাষ্ট্র গঠন, রাষ্ট্র বিলুপ্তি, সীমান্ত রেখা অঙ্কন ইত্যাদি করেছে। কিভাবে তারা ঘরে-ঘরে বিবাদ সৃষ্টি করে রেখেছে। উপনিবেশিক যুগের সমাপ্তি ঘটলেও, সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘাটেনি। অর্থনৈতিক তথা নয়া উপনিবেশিক কায়দায় সে তার শোষণ ও আধিপত্য কায়েম রেখেছে। সেজন্য সে সুকৌশলে এসব প্রাক্তন উপনিবেশ তথা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পারিক আঞ্চলিক বিবাদ জিইয়ে রেখেছে। এসব বিবাদ জিইয়ে রাখা ও উসকে দেয়ার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ নানাভাবে তার স্বার্থ আদায় করে নিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাব, গাজায় ১৫ লাখ ফিলিস্তিনিকে জর্ডান বা মিশরে পুনর্বাসিত করা হোক, যাতে অঞ্চলটি একেবারেই পরিষ্কার হয়ে যায়। তাঁর মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এমনকি গাজার কিছু বাসিন্দাকে ইন্দোনেশিয়ায় সরিয়ে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ইসরাইলের সাবেক কট্টর ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী বিন গাভির ট্রাম্পের এই প্রস্তাবের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়ে বলেন, যখন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই এই ধারণা উপস্থাপন করেন, তখন এটি বাস্তবায়ন করা ইসরাইলী সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এখনই অভিবাসনকে উৎসাহিত করা উচিত। ট্রাম্পের এমন মন্তব্যের পর জয়নবাদীরা যুদ্ধবিরতির চুক্তি ভঙ্গ করে গত ১৭ রমজান সেহরির সময় ব্যাপক প্রাণঘাতী বিমান হামলা শুরু করে। ইহুদিদের এই হামলায় এখন পর্যন্ত বহু নিরীহ ফিলিস্তিনের মৃত্যু ঘটেছে, যার মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি নারী এবং শিশু। ডোনাল্ড ট্রাম্পের উসকানিমূলক মন্তব্যের পর ইসরাইলি ইহুদিদের এখন লক্ষ্য যেভাবে হোক গাজার ফিলিস্তিনি আরবদের সরিয়ে দিয়ে গাজা, পশ্চিম তীর, এমনকি সিরিয়ার গোলান মালভূমি এবং লেবাননের লিটানি নদীর দক্ষিণ তীর পর্যন্ত বিস্তৃত একটি নিখুঁত ইহুদী রাষ্ট্র গঠনের বাসনা। যে সহিংসতা ব্যবহার করে গাজার জনসংখ্যাকে না খাইয়ে মারার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পূর্ণ অবকাঠামো পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে এবং উত্তর গাজায় ফিরে আসার সম্ভাবনাও নির্মূল করা হচ্ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে স্বেচ্ছা অভিবাসন কথাটার মত নিষ্ঠুর আর কি হতে পারে!

গাজায় ইসরাইলি ইহুদিদের হামলার প্রতিবাদে বহুদেশে প্রতিবাদের ঝড় শুরু হয়েছে। আমেরিকার প্রসিডেন্টের বাসভবনের সামনে জড়ো হয়েছে বহু মানবতাবাদী মানুষ। খোদ ইসরাইলের রাজধানীতে লাখ লাখ মানুষ এই হামলা বন্ধের জন্য প্রতিবাদ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে উপহার দেওয়া বিশ্বের অন্যতম আইকনিক প্রতীক স্ট্যাচু অফ লিবার্টি ফেরত চাইছে ফ্রান্স। দেশটির এক আইন প্রণেতা রাফায়েল গ্লাকসম্যান দাবি করেন, যে কারণে এটি উপহার দেয়া হয়েছিল সে মূল্যবোধ আর যুক্তরাষ্ট্রের নেই। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয় স্ট্যাচু অফ লিবার্টিকে। ফ্রান্স ১৮৮৫ সালে এই মূর্তিটি উপহার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায়। তখন থেকে এটিকে মানবাধিকার, স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে ধরা হতো। রাফায়েল গ্লাকসম্যান এর মতে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকারের কর্মকা- ফ্রান্সের দেয়া এই স্ট্যাচুর মূল উদ্দেশ্য এবং মূল্যবোধের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, আমরা যারা বৈজ্ঞানিক স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার সমর্থন করি, তাদের উচিত এই মূর্তি ফিরিয়ে আনা। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিন্দা জানিয়ে তিনি আরো বলেন, আমরা জানি না তারা এই মূর্তির মর্যাদা রাখতে পারবে কি-না। তারা যে অত্যাচারীদের পক্ষ নেয় এবং মানবাধিকার লংঘন করছে তাদের উচিত স্টাচু অফ লিবার্টি ফিরিয়ে দেয়া।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

ড. ইউনূসের ডাইনামিক নেতৃত্ব
ইন্দো-মার্কিন প্ল্যানে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন শেখ হাসিনা
বাংলাদেশ-রাখাইন মানবিক করিডোর
এ. কে. ফজলুল হক : কৃষকদের মুক্তির মহানায়ক
দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে
আরও
X

আরও পড়ুন

১৪ বছর বয়সেই রেকর্ড গড়া সেঞ্চুরি সূর্যবংশীর

১৪ বছর বয়সেই রেকর্ড গড়া সেঞ্চুরি সূর্যবংশীর

আগের সরকার চিফ জাস্টিসকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে, আমরা তেমন সরকার নই

আগের সরকার চিফ জাস্টিসকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে, আমরা তেমন সরকার নই

চ্যালেঞ্জ নিয়ে মুখোমুখি

চ্যালেঞ্জ নিয়ে মুখোমুখি

আনিসুল হককে গণধোলাই

আনিসুল হককে গণধোলাই

প্রসঙ্গ : রাষ্ট্রীয় সফর!

প্রসঙ্গ : রাষ্ট্রীয় সফর!

স্টারলিংকের লাইসেন্স অনুমোদন দিলেন প্রধান উপদেষ্টা

স্টারলিংকের লাইসেন্স অনুমোদন দিলেন প্রধান উপদেষ্টা

হজ অ্যাপ ‘লাব্বাইক’ উদ্বোধন করলেন প্রধান উপদেষ্টা

হজ অ্যাপ ‘লাব্বাইক’ উদ্বোধন করলেন প্রধান উপদেষ্টা

তারেক রহমানের নজরদারিতে নেতারা

তারেক রহমানের নজরদারিতে নেতারা

কিশোর গ্যাং, মাদক ও ড্রেজার বন্ধে ব্রাহ্মণপাড়ায় কঠোর থাকবে প্রশাসন

কিশোর গ্যাং, মাদক ও ড্রেজার বন্ধে ব্রাহ্মণপাড়ায় কঠোর থাকবে প্রশাসন

কুমিল্লায় দুই প্রতিষ্ঠান গুনলো লক্ষাধিক টাকা জরিমানা

কুমিল্লায় দুই প্রতিষ্ঠান গুনলো লক্ষাধিক টাকা জরিমানা

মোহাম্মদপুরের সেই ব্যবসায়ীর অফিসে আবারো গুলি

মোহাম্মদপুরের সেই ব্যবসায়ীর অফিসে আবারো গুলি

প্রেমিকাকে দল বেঁধে ধর্ষণ

প্রেমিকাকে দল বেঁধে ধর্ষণ

কেরানীগঞ্জে ট্রিপল মার্ডারের রহস্য উদ্ঘাটন : মূল ঘাতক গ্রেফতার

কেরানীগঞ্জে ট্রিপল মার্ডারের রহস্য উদ্ঘাটন : মূল ঘাতক গ্রেফতার

বিচারক নিয়োগের অধ্যাদেশ রিট পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি

বিচারক নিয়োগের অধ্যাদেশ রিট পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি

শপথ না পড়াতে লিগ্যাল নোটিশ ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ইশরাক

শপথ না পড়াতে লিগ্যাল নোটিশ ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ইশরাক

মূল ধারার শিক্ষার সঙ্গে কারিগরি শিক্ষা সম্পৃক্ত করা দরকার Ñশিক্ষা উপদেষ্টা

মূল ধারার শিক্ষার সঙ্গে কারিগরি শিক্ষা সম্পৃক্ত করা দরকার Ñশিক্ষা উপদেষ্টা

সীমান্তে বিএসএফের হত্যা বন্ধে জোরালো প্রতিবাদ করতে হবে ইসলামী মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ

সীমান্তে বিএসএফের হত্যা বন্ধে জোরালো প্রতিবাদ করতে হবে ইসলামী মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ

স্ত্রীসহ বাগেরহাটের বন বিভাগের ৩ কর্মকর্তার ব্যাংক হিসাব ও সঞ্চয়পত্র অবরুদ্ধ

স্ত্রীসহ বাগেরহাটের বন বিভাগের ৩ কর্মকর্তার ব্যাংক হিসাব ও সঞ্চয়পত্র অবরুদ্ধ

তুরিন-মুরাদ-মশিউর-নজরুল নতুন করে গ্রেফতার

তুরিন-মুরাদ-মশিউর-নজরুল নতুন করে গ্রেফতার

‘পাকিস্তানের পাশে ২ কোটি শিখ’, ভারতকে হুমকি পান্নুনের

‘পাকিস্তানের পাশে ২ কোটি শিখ’, ভারতকে হুমকি পান্নুনের