শুভ নববর্ষ

Daily Inqilab ইনকিলাব

১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১২ এএম | আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১২ এএম

আজ পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের প্রথমদিন। সব চাওয়া-পাওয়া, আশা-নিরাশা পেছনে ফেলে ১৪৩১ সাল কালের স্রোতে লীন। ১৪৩২ সালের শুভাগমনের মধ্য দিয়ে নতুন প্রভাতের সূচনা হলো। বাংলা নববর্ষকে আমরা স্বাগত জানাই। এটা আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অচ্ছেদ্য অংশ। বলাবাহুল্য, বাংলা সন ও নববর্ষ উদযাপন মূলত মুসলিম ঐতিহ্যজাত এবং মুসলিম শাসকরাই তা প্রবর্তন করেন। বাংলা সনের সঙ্গে বাংলার শাসনব্যবস্থার সংস্কারে মুসলমান শাসকদের ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে। দিল্লি সালতানাতের সময়ে হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা হলেও কৃষিভিত্তিক সমাজবাস্তবতায় হিজরি বর্ষপঞ্জিতে কর আদায়ের ক্ষেত্রে কিছু অসামঞ্জস্য দেখা দেয়ায় বাংলার কৃষিভিত্তিক ঋতুচক্রের অনুসরণে একটি নতুন বর্ষপঞ্জির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই প্রেক্ষাপটে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবর হিজরি সনের ভিত্তিতে বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের নির্দেশ দেন। মুঘল রাজদরবারের দার্শনিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেউল্লাহ সিরাজী হিজরি সন ও সৌর সনের সমন্বয় করে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। মুঘল আমলে প্রবর্তিত বাংলা বর্ষপঞ্জিতে কিছু সমস্যা দেখা দেয়ায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাতে কিছু সংস্কার করেন। তার সংস্কার অনুসারে এখন প্রতিবছর ১৪ এপ্রিলে বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণের উৎসব হয়ে থাকে। আমাদের রয়েছে একটি নিজস্ব ক্যালেন্ডার, যা জাতি হিসেবে আমাদের সমৃদ্ধ ও গর্বিত করেছে। এ কারণেই আমাদের জাতীয় জীবনে বাংলা নববর্ষের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি।

বাংলা নববর্ষ পালন এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে গ্রামীণ জনপদে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হালখাতা এবং কৃষকের ঘরে নতুন ফসল উঠার এ সময়ে নববর্ষ উদযাপনে বৈশাখী মেলা হয়ে উঠত সব বয়েসী মানুষের আনন্দ-উৎসব ও অর্থনৈতিক কর্মকা-ের নতুন উপলক্ষ। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ আবাহনে যে সব অনুষঙ্গ যুক্ত হয়েছে তা অতীতে ছিল না। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ওই শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি ঢাকায় বাংলা নববর্ষ পালনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ হিন্দু ঐতিহ্য অনুসরণে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’য় রূপান্তরিত হয়। অতঃপর মুখে উল্কি আঁকা, বিভিন্ন জীবজন্ত বিশেষ করে হুতুম পেঁচা, হাতি, কুমির, সাপ, বিচ্ছু ও ঘোড়ার মুখোশ পরা, প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষদের একসঙ্গে অশালীন পোশাক পরে শোভাযাত্রা করা, শোভাযাত্রায় বাদ্য-বাজনার সঙ্গে আপত্তিজনক ভঙ্গিমায় নৃত্য করা ইত্যাদি মঙ্গল শোভাযাত্রার বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। এটা বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠির আচরিত সংস্কৃতি হতে পারে, তবে এদেশের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জন্য এসব সংস্কৃতি নয়। এগুলো তাদের আচরিত সংস্কৃতির পরিপন্থী, ধর্মীয় মূল্যবোধের খেলাফ। সার্বজনীন সংস্কৃতির নামে এসব অনৈসলামিক আচারকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠির ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। ভারতের দাসস্য দাস স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের বিদায়ের পর এবার মুক্ত পরিবেশে নববর্ষ পালিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তক্রমে মঙ্গল শোভাযাত্রার স্থলে আনন্দ শোভাযাত্রা ফিরে এসেছে। এবার নববর্ষ পালনে ব্যাপক উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটা আনন্দের কথা। দুঃখের কথাও আছে। স্বৈরাচার যা করতে সাহস দেখায়নি, অন্তর্বর্তী সরকারের মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতর তা দেখানোর দুঃসাহস করেছে। এক অফিস আদেশে চৈত্র সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর নববর্ষ উপলক্ষে সব মাদরাসায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উৎসবমুখর পরিবেশে ও সাড়ম্বরে এ উৎসব পালন করতে বলেছে। লক্ষ করার বিষয়, নববর্ষ পালনের সঙ্গে সঙ্গে চৈত্র সংক্রান্তি পালনের নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ দুইদিন উৎসব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। চৈত্র সংক্রান্তি হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব বা পার্বণ। মাদরাসায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব কেন বাধ্যতামূলকভাবে পালন করতে হবে, মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতরকে তার স্পষ্ট জবাব দিতে হবে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। অবিলম্বে এ নির্দেশ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে।

এখানে বিশেষভাবে বলা আবশ্যক যে, স্বৈরাচারের বিদায়ের পর মাদরাসা শিক্ষার সকল পর্যায়ে জামায়াতে ইসলামের লোকজন প্রতিস্থাপিত হয়েছেন, যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে ক্ষোভ বিস্তৃত হয়েছে। আওয়ামী লীগ, সিপিবি, ছায়ানট, উদীচি ইত্যাদি এদেশের মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতির স্থলে ভিন্ন সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার যে অপচেষ্টা চালিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বা বিভিন্ন দফতর-অধিদফতর যদি সেটাই করে তবে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? সবাই আশা করে, মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতরের যারা ওই উদ্দেশ্যবাদী নির্দেশনা দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। একথা প্রসঙ্গক্রমে বলা জরুরি, সার্বজনীন সংস্কৃতি বলে বিশ্বে কিছু নেই। একেক দেশের একেক জনগোষ্ঠির ও সমাজের সংস্কৃতি আলাদা। এ কারণেই বিশ্বজুড়ে সংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আমরা লক্ষ করি। সংস্কৃতি গঠন ও নির্মাণে ধর্মের ভূমিকা প্রধান। ধর্মের যেহেতু বিভিন্নতা আছে, সুতরাং সাংস্কৃতিক বিভিন্নতাও থাকবে। আমাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের স্বার্থেই বহিরাগত ও অপসংস্কৃতির স্থলে নিজস্ব সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশে অনেক ক্ষেত্রেই কাজ হচ্ছে বটে। তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, মানুষের নীতি-নৈতিকতা, ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ও চলছে। মাদক, যৌন হয়রানি, পারিবারিক কলহে খুন-জখম, হত্যা, ধর্ষণ, নৃশংসতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসবের মূলে রয়েছে, আমাদের নিজস্ব হাজার বছরের নীতি-নৈতিকতা, ধর্মীয় আচার-আচরণ এবং সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধকে উপেক্ষা করা এবং এ সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়া, অপসংস্কৃতির গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়া। আমরা যতই উন্নয়ন করিনা কেন, যদি নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় চলতে থাকে, তবে তা অর্থহীন হয়ে পড়তে বাধ্য। নীতি-নৈতিকতা প্রতিষ্ঠায় ধর্মীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ চর্চার বিকল্প নেই। এদিকে আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। পরিশেষে বাংলা নববর্ষে আমাদের পাঠক, শুভানুধ্যায়ী, বিজ্ঞাপনদাতা ও দেশবাসীকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বিশ্ববিবেক নিরব কেন?
নির্বাচনের আগে ভার্চুয়াল মিডিয়ার ঝড় কীভাবে মোকাবেলা করবে বিএনপি
নির্বাচনের টাইম ফ্রেম প্রসঙ্গে
সুন্দরবন রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি করা হোক
ইউনূস-মোদি বৈঠক : একটি পর্যালোচনা
আরও
X

আরও পড়ুন

আইফোন ১৭ এর দাম জানা গেল

আইফোন ১৭ এর দাম জানা গেল

তুরস্কে সুদের হার বাড়িয়ে দিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক

তুরস্কে সুদের হার বাড়িয়ে দিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক

ছুটির দিনেও বায়ুদূষণের ৩ নম্বরে ঢাকা

ছুটির দিনেও বায়ুদূষণের ৩ নম্বরে ঢাকা

হবিগঞ্জে ট্রাক-পিকআপ সংঘর্ষে নিহত ৪

হবিগঞ্জে ট্রাক-পিকআপ সংঘর্ষে নিহত ৪

লক্ষ্মীপুরে চালের বস্তা বদল করে প্রতারণা করায় ব্যবসায়ীর লাখ টাকা জরিমানা

লক্ষ্মীপুরে চালের বস্তা বদল করে প্রতারণা করায় ব্যবসায়ীর লাখ টাকা জরিমানা

ভিনগ্রহে প্রাণের ইঙ্গিত, নাসার টেলিস্কোপে বিস্ময়কর আবিষ্কার

ভিনগ্রহে প্রাণের ইঙ্গিত, নাসার টেলিস্কোপে বিস্ময়কর আবিষ্কার

আজ মার্কিন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে 'বরবাদ'

আজ মার্কিন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে 'বরবাদ'

আমাকে ডেসটিনির এমডি করলে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে

আমাকে ডেসটিনির এমডি করলে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে

গুলি করে হত্যার পর নিহত হাসিবুলের লাশ ফেরত দিলো বিএসএফ

গুলি করে হত্যার পর নিহত হাসিবুলের লাশ ফেরত দিলো বিএসএফ

ভারতে ওয়াক্ফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য নিয়োগ স্থগিত করলো সুপ্রিম কোর্ট

ভারতে ওয়াক্ফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য নিয়োগ স্থগিত করলো সুপ্রিম কোর্ট

ইয়েমেনের তেল বন্দরে মার্কিন বিমান হামলায় নিহত ৩৮, আহত শতাধিক

ইয়েমেনের তেল বন্দরে মার্কিন বিমান হামলায় নিহত ৩৮, আহত শতাধিক

সফর সংক্ষিপ্ত করে যুক্তরাজ্য থেকে ‘পালালেন’ ইসরায়েলি মন্ত্রী

সফর সংক্ষিপ্ত করে যুক্তরাজ্য থেকে ‘পালালেন’ ইসরায়েলি মন্ত্রী

ইতি টানছে 'গঙ্গাবুড়ি' রিভার হেরিটেজ প্রকল্প

ইতি টানছে 'গঙ্গাবুড়ি' রিভার হেরিটেজ প্রকল্প

যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্দুক হামলায় নিহত ২, আহত অন্তত ৫

যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্দুক হামলায় নিহত ২, আহত অন্তত ৫

গাজায় ফের ইসরায়েলি হামলা, ২৪ ঘণ্টায় নিহত ৪০

গাজায় ফের ইসরায়েলি হামলা, ২৪ ঘণ্টায় নিহত ৪০

গফরগাঁওয়ে এক সপ্তাহে প্রতিকেজি ৩৫টাকার স্থলে ৬০ দরে বিক্রি হচ্ছে পেয়াজ

গফরগাঁওয়ে এক সপ্তাহে প্রতিকেজি ৩৫টাকার স্থলে ৬০ দরে বিক্রি হচ্ছে পেয়াজ

ক্যান্সারের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আমেনা বেগমের আত্মহত্যা

ক্যান্সারের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আমেনা বেগমের আত্মহত্যা

স্থায়ী যুদ্ধবিরতির শর্তে সব জিম্মি মুক্তির প্রস্তাব দিল হামাস

স্থায়ী যুদ্ধবিরতির শর্তে সব জিম্মি মুক্তির প্রস্তাব দিল হামাস

ওয়াটসনে ফেডারেল লিবারেল পার্টির প্রার্থী জাকির আলমের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু

ওয়াটসনে ফেডারেল লিবারেল পার্টির প্রার্থী জাকির আলমের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু

বাংলাদেশ-পাকিস্তান বৈঠক, ভারত বলল নজরে রয়েছে

বাংলাদেশ-পাকিস্তান বৈঠক, ভারত বলল নজরে রয়েছে