ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক হুমকি এবং মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের পতন

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

১৭ জুলাই ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২৪, ১২:০২ এএম

ইউক্রেনে এবং গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যবস্থা এক নতুন যুগসন্ধিক্ষণে উপনীত হয়েছে। বিশেষত, পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার আয়ুষ্কাল ক্রমেই নিবু নিবু হয়ে উঠছে। আমরা জানি, প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে শেষবার তার ঔজ্জ্বল্যের চমক দেখাতে চেষ্টা করে। একইভাবে নদী তা নাব্য হারিয়ে আয়ুষ্কালের শেষ প্রান্তে এসে দুইপাড়ে ভাঙ্গনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। যে নদী যত গভীর, তার বয়ে চলার শব্দ ও ভাঙ্গন তত কম। একটি মেকি, যুদ্ধবাদী সা¤্রাজ্য তার গঠনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ ও কনস্পিরেসিকেই টিকে থাকার অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ধনতান্ত্রিক পশ্চিমা পুঁজিবাদী সা¤্রাজ্য টিকে থাকার শেষ চেষ্টা হিসেবে বিশ্বকে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়ার আয়োজন করছে বলে সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন তৎপরতা থেকে বোঝা যাচ্ছে। নিবন্ধের শুরুতে চলমান দুইটি যুদ্ধের ফ্রন্টের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গাজা ও ফিলিস্তিনে হামাস-হিজবুল্লাহবিরোধী যুদ্ধ আপাতদৃষ্টে গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে বলে প্রচারিত হলেও জেরুজালেম দখলের এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের প্রথম থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকেই পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে, ইউরোপের দেশগুলো থেকে হাজার হাজার ইহুদিকে ফিলিস্তিনে পাঠানো হচ্ছিল। বিশ্বযুদ্ধে প্রথমবারের মতো পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ইঙ্গ-মার্কিন মিত্র শক্তির নেতৃত্বাধীন বাহিনীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর যে নতুন বিশ্বব্যবস্থার ব্লু প্রিন্ট করা হয়েছিল, তার অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ অংশ হচ্ছে, হাজার হাজার ইহুদিকে সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে জাহাজে ভরে ফিলিস্তিনে পাঠিয়ে জোরপূর্বক সেখানকার মুসলমানদের জমি-জিরাত দখল করতে একটি নাকবা বা বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে প্রথম নাকবার মধ্য দিয়ে ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার থেকে নাকবার সম্প্রসারণবাদী এজেন্ডা থেকে ফিলিস্তিনিরা একদিনের জন্যও নিরাপত্তার গ্যারান্টি পায়নি। প্রতি দশক অন্তর একেকটি নতুন আগ্রাসি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আরব মুসলমানদের নতুন নতুন ভূখ- দখলের মধ্য দিয়ে ইসরাইলের নিরাপত্তা এবং গ্রেটার ইসরাইল বা প্রমিজড ল্যান্ড গঠনের দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়েছে। গাজা নিয়ন্ত্রণকারী ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক গোষ্ঠি হামাসের সামরিক শাখা আল কাস্সাম ব্রিগেড ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলের বিরুদ্ধে অপারেশন আল আকসা ফ্লাড শুরুর মাত্র ২ সপ্তাহ আগে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়ে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তার সাথে আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক বাস্তবতা ও প্রত্যাশার কোনোই মিল নেই। তিনি তার বক্তব্য শুরু করেছিলেন এভাবে, ‘আজ থেকে প্রায় ৩ হাজার বছর আগে আমাদের নেতা মোজেস (মূসা) যে দুই পাহাড় ও সমুদ্রের মধ্যবর্তী স্থানের প্রমিজ্ড ল্যান্ডের কথা বলেছিলেন, এখন আমরা সেই অর্জনের পথে এগিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সেই সাথে ইরানের হুমকি এবং আব্রাহাম অ্যাকর্ডের মধ্য দিয়ে ইসরাইলের সাথে আরবদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার অগ্রযাত্রার বর্ণনা দিতে গিয়ে ফিলিস্তিনকে কোনো পক্ষ হিসেবে ধতর্ব্যে নিতেও রাজি নন বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ প্রমিজড ল্যান্ড বা গ্রেটার ইসরাইল গঠনের ক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতে কোনো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেনে নিতে নেতানিয়াহু রাজি নন। বক্তব্যে তিনি ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগ্রামকে ফ্যান্টাসি বলে উপহাস করেন। জাতিসংঘ সম্মেলনে নেতানিয়াহু বিশ্ববাসির সামনে অত্যন্ত দাম্ভিকতার সাথে নতুন গ্রেটার ইসরাইলের মানচিত্র তুলে ধরার সাথে সাথে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পারমানবিক শক্তিধর ইরানকে ধ্বংসের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

ইউক্রেন ও গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির পরাজয়ের আশঙ্কা যতই গভীর হচ্ছে, যুদ্ধের রাজনৈতিক-কূটনৈতিক সমাধানের চেষ্টা না করে একটি আঞ্চলিক তথা বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত এবারের ন্যাটো সম্মেলনের মূল ইস্যু ছিল ইউক্রেনের হাতে আরো ধ্বংসাত্মক সমরান্ত্র ও হাজার হাজার কোটি ডলারের বাজেট তুলে দিয়ে রাশিয়ার সাথে ইউরোপের দ্বন্দ্বকে একটি সর্বাত্মক বিশ্বযুদ্ধে পরিনত করা। গাজা যুদ্ধে ইসরাইলিদের ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা ও নির্মূলীকরণের জায়নবাদী যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে ন্যাটো জোটের দ্বিমুখী নীতি বিশ্ববাসির কাছে পশ্চিমাদের কথিত শান্তি ও নিরাপত্তার প্রপাগান্ডার অসারতা অনেকটা প্রকাশিত হয়ে গেছে। ন্যাটোর ৩৮ দফা ওয়াশিংটন ঘোষণার বেশিরভাগ অংশ জুড়ে ছিল ইউক্রেনে রাশিয়াকে পরাস্ত করার নানামুখী উদ্যোগের কথা। চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ জর্ডান, বাহরাইন, সউদী আরবের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ও ৩৮ দফা ঘোষণায় উঠে আসলেও এ সময়ের সবচেয়ে গুরুতর ভূরাজনৈতিক ট্রাজেডি গাজা যুদ্ধ বন্ধ কিংবা ফিলিস্তিনের প্রসঙ্গে একটি শব্দও না থাকা বিস্ময়কর। গাজার শরনার্থী শিবিরগুলোতে বোমা মেরে প্রতিদিন শত শত নিরস্ত্র নিরীহ মানুষ ও শিশুদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, হিজবুল্লাহর সাথে যুদ্ধ শুরুর আয়োজন করছে আইডিএফ। সেই আয়োজনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অংশগ্রহণের আয়োজনের কথাও শোনা যাচ্ছে। গাজা ধ্বংসের পর লেবানন ধ্বংস করে গ্রেটার ইসরাইল গঠনের জায়নবাদী নীলনকশা বাস্তবায়নের আঞ্জাম দিচ্ছে বিশ্বমোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে ন্যাটোর অন্যতম সদস্য স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেড্রো সানচেজ হাটে হাড়ি ভেঙ্গে দিয়েছেন। তিনি দ্বিচারিতা পরিহার করে ইউক্রেনের মত গাজায় ইসরাইলি গণহত্যার বিরুদ্ধেও ন্যাটোকে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। গাজায় জায়ানবাদী গণহত্যার বিরুদ্ধে ইউরোপ-আমেরিকার প্রতিটি শহরে ব্যাপক গণবিক্ষাভ হয়েছে। স্পেনসহ ইউরোপের চারটি দেশ স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে তাদের অবস্থান ঘোষণা করেছে। এতেও ফিলিস্তিন নিয়ে ন্যাটো প্রকাশ্য কোনো ভূমিকা নেয়ার বদলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে ইসরাইলকে গোপণে অস্ত্র ও সামরিক-কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে গণহত্যার পক্ষেই তাদের অবস্থান নিশ্চিত করছে। যুদ্ধের সব নিয়ম-কানুন, আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও মানবিক দায়বদ্ধতাকে অগ্রাহ্য করে গাজায় ইসরাইলের গণহত্যার পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ও মদত ইতিমধ্যে বিশ্বের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছে। ইউক্রেনে প্রকাশ্য উস্কানি ও হাজার হাজার কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা ব্যর্থ হয়েছে। নিরস্ত্র গাজাবাসির উপর নির্বিচার-নৃসংশ গণহত্যা চালিয়েও হামাস-হিজবুল্লাহর অকুতোভয় অগ্রযাত্রা দমন করতে না পারার ব্যর্থতা আরো নির্মম গণহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। সবকিছু দেখেও গণতন্ত্রের ধ্বজাধারি ন্যাটো, জি-সেভেন দেশগুলোর কর্তারা নির্বিকার। তারা প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে ইসরাইলকে মদত দিয়ে চলেছে।

ইউক্রেনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে সেখানে পশ্চিমা বশংবদ ইহুদি জায়নবাদী-ফ্যাসিবাদী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রাশিয়ার সাথে ইউরোপ ও ন্যাটোর সংঘাত উস্কে দিয়ে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে অবিশ্যম্ভাবী করে তোলা হয়েছিল। কোনো সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বারা কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও অখ-তা লঙ্ঘনের যেকোনো সামরিক পদক্ষেপ সমর্থনযোগ্য নয়। তবে বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক বিভক্তি ও পারমানবিক নিরাপত্তার ইস্যুগুলোও মাথায় রাখতে হবে। জাতিসংঘের গঠণ, ভেটো পাওয়ার ও বিশ্বব্যবস্থায় রাশিয়া ও চীনের সুদূরপ্রসারি প্রভাবকে অগ্রাহ্য করা যায় না। এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়ায় এবং সেখানে রাশিয়ান ভাষাভাষি ও জাতিগোষ্ঠির মানুষের প্রভাব থাকায় ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার একটি ঐতিহাসিক-ভূরাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। এসব বিষয়কে পাশ কাটিয়ে ইউক্রেনে পশ্চিমা বশংবদ শাসক বসানো এবং ন্যাটোভুক্ত করার উদ্যোগের মধ্য দিয়ে রাশিয়াকে ইউক্রেন দখলের উস্কানি দেয়া হয়েছে। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল এবং সেখানে রেফারেন্ডামের মাধ্যমে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ান ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করার রাজনৈতিক প্রয়াসকে পশ্চিমারা ঠেকাতে পারেনি। একটি কৌশলগত কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক সমঝোতার বদলে শিল্পোন্নত দেশগুলোর ইউনিয়ন জি-এইট সম্মেলন থেকে রাশিয়াকে বরখাস্ত করার পাশাপাশি নানা ধরণের হুমকি ও নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক উচ্চাভিলাসের অগ্নিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো ঘৃত সংযোগ ঘটিয়েছে। ন্যাটোর অব্যাহত হুমকির কারণেই ক্রিমিয়া দখলের ১০ বছরের মাথায় রাশিয়া ইউক্রেন দখলের সামরিক অভিযান শুরু করে। রাশিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্রের কারণে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও অখ-তা লঙ্ঘন এবং পশ্চিমাদের সাথে রাশিয়ার একটি পূর্ণমাত্রার করভেনশনাল ও পারমানবিক যুদ্ধের আশঙ্কায় বিশ্বের নিরাপত্তা হুমকির জন্য রাশিয়া এবং পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী চক্র সমানভাবে দায়ী। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন অবশ্যম্ভাবি করে তোলা এবং রাশিয়ার সামরিক পদক্ষেপের পর কূটনৈতিক-রাজনৈতিক সমাধানের সব পথ রুদ্ধ করে দিয়ে রাশিয়ার উপর ক্রমবর্ধমান নিষেধাজ্ঞা আরোপ, হাজার হাজার কোটি ডলারের রাশিয়ান সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এবং ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তার ব্ল্যাঙ্ক-চেক এবং হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র সহায়তা দিয়েও রাশিয়ার ইউক্রেন দখল ঠেকাতে না পেরে এখন একটি পারমানবিক যুদ্ধের হুমকি দিতে শুরু করেছে। পশ্চিমারা ইউক্রেন যুদ্ধকে তাদের পুঁজিবাদী সা¤্রাজ্য রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে গ্রহণ করেছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে। রাশিয়া-চীন এবং ইরানের মধ্যকার ভূরাজনৈতিক কৌশলগত অংশীদারিত্ব এবং নিরাপত্তাচুক্তির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ইঙ্গ-মার্কিন জোট ইতিমধ্যেই ব্যর্থ হয়েছে। আফগানিস্তান, সিরিয়া. ইয়েমেন এবং ফিলিস্তিনি-হিজবুল্লাহর প্রতিরোধের কাছে ইসরাইল, ন্যাটো ও পশ্চিমা মিত্রদের পর্যুদস্তু অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে তারা এখন সম্মিলিত সর্বোচ্চ শক্তি ও পারমানবিক যুদ্ধের আশঙ্কাকে সামনে নিয়ে এসেছে।

কূটনৈতিক রাজনৈতিক সমাধানের পথ বেছে নেয়ার যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও জায়নবাদ প্রভাবিত পশ্চিমাবিশ্ব সে চেষ্টাই করেনি। সেটি সম্ভব হলে প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে কোটি কোটি মানুষের প্রাণহানি ও অভাবনীয় ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বাঁচতে পারত পশ্চিমা বিশ্ব। ইউক্রেন কিংবা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্নেও পশ্চিমা বিশ্বকে একই রকম ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে। প্রায় সাড়ে ৭ দশক ধরে রাষ্ট্রহীন, উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ সংগ্রামকে কনভেনশনাল যুদ্ধকৌশল ও সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের মাধ্যমে স্তব্ধ করে দেয়া যায়নি। উপরন্তু ফিলিস্তিনি হামাস, ইসলামিক জিহাদ, লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুতি এবং তালেবানদের জিহাদি মনোভাব ও আত্মত্যাগের কাছে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের সব শক্তি পরাস্ত হয়েছে। এখন জায়নবাদীদের কল্পিত প্রমিজড ল্যান্ড গঠণের শেষ চেষ্টা হিসেবে বিশ্বকে একটি পারমানবিক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে উদ্ধত হয়েছে। গাজা যুদ্ধের শুরুতেই হোঁচট খাওয়া ইসরাইলি বাহিনীর মুখ রক্ষা করতে তাদের যুদ্ধকালীন মন্ত্রীসভার একজন মন্ত্রী গাজায় পারমানবিক বোমা ফেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। পারমানবিক বোমা না ফেললেও গাজায় যে পরিমান বোমা ফেলা হয়েছে তা অন্তত ৪টি পারমানবিক বোমার সমান ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত করেছে। এ অবস্থায় যুদ্ধ শেষ হলেও গাজার পুর্নগঠনে অন্তত বিশ বছর সময় লেগে যাবে। তবে ব্যাপক সামরিক-বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা, জি-এইট গ্রুপ থেকে খারিজ করেও রাশিয়ার অর্থনীতিতে ধস নামাতে পারেনি পশ্চিমারা। ব্রিক্স দেশগুলোর অর্থনৈতিক সহযোগিতা, ব্রিক্স ব্যাংক গঠন এবং বাণিজ্যিক লেনদেনের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের বিকল্প নিজস্ব মূদ্রা ব্যবহারের উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে বড় অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছে। এ কারণেই পশ্চিমাদের হাতে থাকা রাশিয়ার সম্পদ বাজেয়াপ্তের চেষ্টা করছে তারা। আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোর হাতে থাকা প্রায় ৪০ হাজার কোটি ডলারের বিপুল সম্পদ জব্দ করে রাশিয়াকে ঘায়েল করার পাশাপাশি ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে ন্যাটোর পারমানবিক নিরাপত্তা চুক্তির অধীনে রাশিয়াকে হুমকিমূলক বার্তা দেয়া হচ্ছে। মার্কিন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও লেখক স্কট রিটার সম্প্রতি প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলেছেন, দাগেস্তান ও ক্রিমিয়ার সেভাস্তোপোলে ইউক্রেনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্মিত এটিএসিএমএস বোমা হামলাকে রাশিয়ার ভূখন্ডের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সরাসরি সন্ত্রাসি হামলা বলে উল্লেখ করেছেন। ইতিপূর্বে সিআইএ রাশিয়ান ফেডারেশনে মুসলমান ও অমূসলিমদের মধ্যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিরোধ বাধিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। এবার দাগেস্তানেও ব্যর্থ হবে বলে স্কট রিটার মনে করেন। ইরানের পারমানবিক প্রকল্প ইসরাইলের জন্য চরম উৎকণ্ঠা ও মাথাব্যথার কারণ। ইরান ইতিমধ্যে পারমানবিক সক্ষমতা অর্জন করেছে বলে বিশ্ব সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এ ধরনের আশঙ্কা মাথায় রেখে ইরানে পারমানবিক হামলার চিন্তা ইসরাইলের জন্য আত্মহত্যার সামিল। আর রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকা ও ন্যাটোর পারমানবিক হুমকি এখন বালখিল্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়। পঁচাত্তর বছর আগে শুরু হওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের মূল শক্তি ছিল মার্কিন ডলার ও বাণিজ্যিক মূদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন ও ওয়ারশ’ সামরিক জোট ভেঙ্গে যাওয়ার পর ইউনিপোলার বিশে ন্যাটোর সম্প্রসারণ এবং রাশিয়া-চীনের উপর চাপ বৃদ্ধির পাশাপাশি ভূরাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার খড়গ চাপিয়ে ঘায়েল করার প্রধান অস্ত্র হিসেবে মার্কিন ডলার বিধ্বংসী সমরাস্ত্রের চেয়েও অব্যর্থ হিসেবে প্রমানিত হয়েছিল। চীন, রাশিয়া, ইরান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোসহ সাম্প্রতিক সময়ে সউদি আরবের মত গুরুত্বপূর্ণ পেট্রোডলার পরাশক্তির সাথে চীন-রাশিয়ার কৌশলগত সম্পর্ক একটি নতুন মাল্টিপোলার বিশ্বব্যবস্থার অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাই কেবল ইসরাইলের নিরাপত্তা ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিবেশিদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পারে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা