মশাবাহিত রোগ থেকে মুক্তি চাই
২৪ আগস্ট ২০২৩, ০৮:২৮ পিএম | আপডেট: ২৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৭ এএম
প্রতিবছর ২০ আগস্ট পালিত হয় এই দিবসটি। ২০ আগস্ট ‘মশা দিবস’ পালন করা হয় মূলত চিকিৎসক রোনাল্ড রসের আবিষ্কারকে সম্মান জানানোর জন্য। ১৮৯৭ সালের ২০শে আগস্ট চিকিৎসক রোনাল্ড রস অ্যানোফিলিস মশা বাহিত ম্যালেরিয়া রোগের কারণ আবিষ্কার করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি এই আবিষ্কারের জন্য ‘নোবেল’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। ১৯৩০-এর দশক থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। মানুষের বিভিন্ন ভয়াবহ অসুখের মধ্যে মশা বাহিত ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ফাইলেরিয়া, জিকা ও জাপানিজ এনসেফালাইটিস উল্লেখযোগ্য। তাই মশাবাহিত রোগের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসাধারণকে বিশেষভাবে সচেতন করার জন্য এই দিবস সারা বিশ্ব জুড়ে পালিত হয়। মশাবাহিত রোগ থেকে সাবধান হওয়ার জন্য, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এই দিনে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করা হয়।
মশাবাহিত রোগ হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের ইতিহাসে অসুস্থতা এবং মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। উনিশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত কেউই বুঝতে পারেনি যে মশা রোগের ভেক্টর ছিল। প্রথম সাফল্য আসে ১৮৭৭ সালে যখন ব্রিটিশ ডাক্তার প্যাট্রিক ম্যানসন আবিষ্কার করেছিলেন যে একটি কিউলেক্স প্রজাতির মশা মানুষের ফাইলেরিয়াল রাউন্ডওয়ার্ম বহন করতে পারে। পরবর্তী দুই দশকে তিনি এবং ফ্রান্স, ইতালি, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য গবেষকরা ম্যালেরিয়াতে গবেষণায় মনোনিবেশ করেন, যা গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং নাতিশীতোষ্ণ দেশগুলিতে একটি প্রধান ঘাতক। নিরলস গবেষণার পর রস শেষ পর্যন্ত ১৮৯৭ সালে প্রমাণ করেন যে অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়া পরজীবী বহন করতে পারে। তিনি তার আবিষ্কারের দিন, ২০ অগাস্ট, ১৮৯৭-কে ‹মশা দিবস বলে অভিহিত করেছিলেন। লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন পরে তার আবিষ্কারের তাৎপর্য চিহ্নিত করতে ২০ অগাস্টকে বিশ্ব মশা দিবসের নামকরণ করেন, যা প্রতি বছর পালিত হয়।
অ্যানোফিলিস মশার সাথে এ জটিল যোগসূত্রটিও দেখিয়েছে যে মশার কামড় রোধ এবং মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ– ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১২৩ প্রজাতির মশা শনাক্ত করা হয়েছে তারমধ্যে বর্তমান ঢাকাতে আমরা পাই ১৪ প্রজাতির। উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়া থাকার কারণে বাংলাদেশ মশা ও মশাবাহিত রোগ বিস্তারের জন্য উত্তম জায়গা। বাংলাদেশ মশাবাহিত রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া ও জাপানিজ এনসেফালাইটিস।
১৯৬৪ সালে প্রথম বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্ত হলেও সেটিকে তখন ‹ঢাকা ফিভার› বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ২০০০ সালে প্রথম বাংলাদেশে ডেঙ্গু শনাক্ত হয় এবং সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ আক্রান্ত হন।
২০২২ সালে ডেঙ্গুতে ২৮১ জন মারা যান। ওই বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ডেঙ্গুতে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালে সরকারি হিসাব অনুযায়ী এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ১৭৯ জন মারা যান। আর ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গু সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। একই বছর দেশব্যাপী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল বাংলাদেশে ডেঙ্গু একটি পুনরাবির্ভূত রোগ হিসেবে গণ্য।
২০০৮ সালে বাংলাদেশে প্রথম চিকুনগুনিয়া ধরা পড়ে যেটি ডেঙ্গুর মত একটি রোগ। এ রোগটি চিকুনগুনিয়া ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছর বাংলাদেশে চিকুনগুনিয়া রোগ শনাক্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীব্যাপী মশাবাহিত রোগের মধ্যে অন্যতম হলো ম্যালেরিয়া। অ্যানোফিলিস মশার সাতটি প্রজাতি বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা এবং বর্ডার এরিয়ার মোট ১৩ জেলায় ৭২ টি উপজেলায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। ২০০০ সালের পর সবচাইতে বেশি ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায় ২০০৮ সালে। ২০০৮ সালে ৮৪ হাজার ৬৯০ জন মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রাšয় হয় এবং ১৫৪ জন মারা যান। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে এ সংখ্যাটি কমে রোগী হয় ১৭ হাজার ২২৫ জনে। ম্যালেরিয়া বাহক অ্যানোফিলিস মশা গ্রীষ্ম ও বর্ষায় বেশি জম্মায় এবং এ সময়ে রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়।
ফাইলেরিয়া রোগে মানুষের হাত–পা ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ওঠে। স্থানীয়ভাবে এই রোগটিকে গোদ রোগ বলা হয়। ফাইলেরিয়া বাংলাদেশের উত্তর–পশ্চিম দক্ষিণের প্রায় ৩৪টি জেলাতে কম বেশি পাওয়া যায়। একসময় এরোগের প্রাদুর্ভাব বেশি ছিল তবে বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ফাইলেরিয়া এলিমিনেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে এটিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। ফাইলেরিয়ার কৃমি- ইউচেরিয়া ব্যানক্রফটি মশার দ্বারা সংক্রমিত হয়। কিউলেক্স মশার দুটি প্রজাতি ও ম্যানসোনিয়া মশার একটি প্রজাতির মাধ্যমে বাংলাদেশ এ রোগ ছড়ায়।
জাপানিজ এনসেফালাইটিস নামক মশাবাহিত একটি রোগ বাংলাদেশে হয়ে থাকে। এ রোগটি কিউলেক্স মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এ রোগটি বাংলাদেশের প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৭৭ সালে মধুপুর বন এলাকায়। এরপর বিভিন্ন সময় রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রাম ও খুলনা অঞ্চলে এই রোগটি পাওয়া গেছে।
সারা বিশ্বব্যাপী মশা দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মশা ও মশা বাহিত রোগ সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করে তোলা। মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারি বেসরকারি এবং ব্যক্তি পর্যায়ে সকলের সহযোগিতা প্রযয়োজন। সপ্তাহে একদিন আমরা আমাদের বাড়ির ভেতর এবং বাইরে ঘুরে দেখি কোথাও কোন পাত্রে পানি জমা আছে কিনা, যদি থাকে তাহলে সেটি ফেলে দেই অথবা উল্টিয়ে রাখি অথবা সেখানে মশা নিয়ন্ত্রণে অন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
> মশাবাহিত রোগ থেকে সুস্থ থাকার উপায়:-
মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হবার পর সঠিক সময়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন না হলে মৃত্যুসহ নানা ধরণের জটিলতার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
* ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার এই দুইটি রোগের জন্যই দায়ী এডিস মশা সাধারণত সকালের দিকে এবং সন্ধ্যার আগে এডিস কামড়ায়। ফলে এই দুই সময়ে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ রাখতে হবে।
* ঘুমানোর সময় মশারি খাটিয়ে ঘুমাতে হবে
* বাড়ির ছাদে বা বারান্দার ফুলের টবে, নির্মাণাধীন ভবনে, বাতিল টায়ার কিংবা প্লাস্টিক কন্টেইনার- কোথাও যাতে তিন থেকে পাঁচদিনের বেশি পানি জমা না থাকে, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
* মশার কামড় থেকে বাঁচতে নানা ধরণের রিপেলেন্ট অর্থাৎ মশা তাড়ানোর পণ্য যেমন বিভিন্ন ধরণের কয়েল, স্প্রে, ক্রিম জাতীয় পণ্য ব্যবহার করা, তবে এর মাত্রা ও প্রয়োগ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।
এগুলো সবই মশাবাহিত কোন রোগে আক্রান্ত হবার আগের সতর্কতা। তাই আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসকের শরাণাপন্ন হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।
> মশা নিয়ে কয়েকটি তথ্য
* একটি মশা সেকেন্ডে প্রায় ৩০০-৬০০ বার ডানা ঝাপটায়, মশা ওড়ার সময় এই ডানা ঝাপটানোর শব্দই শুনি আমরা
* কেবলমাত্র স্ত্রী মশাই মানুষকে কামড়ায়, পুরুষ মশা নয়।
* মশা ঘণ্টায় প্রায় দেড় মাইল বেগে উড়তে পারে
* ডিম ফুটে বের হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই মশা মানুষকে কামড়ে রক্ত শুষে নেয়
* মশা স্তন্যপায়ী প্রাণীকে কামড়ানোর পাশাপাশি পাখি ও সরীসৃপের শরীরেও হুল ফোটায়
* মশা তার নিজের ওজনের তিনগুণ রক্ত শুষে নিতে পারে।
মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
ইমেইল: [email protected]
বিভাগ : স্বাস্থ্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নিহত ৩২
আল্লাহকে পেতে হলে রাসুলের পথ অনুসরণ অপরিহার্য: মাওলানা রুহুল আমিন খান
ঢাকাবাসীকে নিরাপদ রাখতে হবে : ডিএমপি কমিশনার
ভোটের মাধ্যমে জনগনের সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আমাদের ঐক্যবন্ধ থাকতে হবে-লুৎফর রহমান আজাদ
গফরগাঁওয়ের বীরমুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবদুছ ছালামের ইন্তেকাল
আওয়ামী দোসররা মানুষের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে: তানভীর হুদা
ফিলিস্তিনিদের জন্য কোটি টাকার সহায়তা নিয়ে মিশরে পৌঁছেছে হাফেজ্জী চ্যারিটেবল
১৭টি বছর শ্রমিকদলের নেতাকর্মীদের উপর নির্যাতন করেছে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা- কেন্দ্রীয় সভাপতি
বিএনপি যতই চাপ দিক, সংস্কারের ওপর ভিত্তি করেই নির্বাচন: উপদেষ্টা নাহিদ
ছয় বছর পর স্বাগতিক জিম্বাবুয়ের মুখোমুখি পাকিস্তান
তারেক রহমান ও কায়কোবাদের মামলা প্রত্যাহার না করলে অনশনসহ কঠোর কর্মসূচির হুশিয়ার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের
টানা তিন সেঞ্চুরিতে তিলাকের বিশ্ব রেকর্ড
সাময়িক বন্ধের পর খুললো যমুনা ফিউচার পার্ক
জ্বালানি খাতে সাশ্রয় হয়েছে ৩৭০ কোটি টাকা: জ্বালানি উপদেষ্টা
গৌরনদীতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দোকান ঘরে বাস নিহত-১ আহত-৬
কুড়িগ্রামের উলিপুরে ২ আ'লীগ নেতা গ্রেপ্তার
লাওসে ভেজাল মদপানে ৬ বিদেশির মৃত্যু
না.গঞ্জে ডেঙ্গু পরীক্ষার টেস্ট কিট সংকট কে কেন্দ্র করে টেস্ট বাণিজ্যের অভিযোগ
ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভের প্রস্তুতি
‘পতনের’ মুখে ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইন