ঢাকা   শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ডেঙ্গু জ্বর : সতর্কতার বিকল্প নেই

Daily Inqilab ইনকিলাব

৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম | আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

দেশের ৬৪ জেলায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। গত বছরের চেয়ে এ বছর প্রায় মাস খানেক আগেই প্রাণঘাতী এই রোগের সংক্রমণ শুরু হয়েছে। যা এখনও চলছে। অক্টোবরের প্রথম ২২ দিনেই মৃত্যু ১০০ ছাড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গুর মতো বাহক নির্ভর রোগ বেশি ছড়াচ্ছে। এতে প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে। এ রোগ যাতে আশঙ্কজনকভাবে বৃদ্ধি পেতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক সচেতনতা সৃষ্টি একান্ত প্রয়োজন। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রনে যারা প্রধান ভূমিকা পালন করে, সেই সিটি কর্পোরেশনেও সে কার্যকর অর্থে কেউ নেই। এ পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আগেই শঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছিলেন, এবারে ডেঙ্গু বাড়বে। বিশেষজ্ঞদের সেই শঙ্কাই প্রমাণিত হচ্ছে। যদিও স্বাস্থ্য সচিব গত ১১ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গু সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। সেদিন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এম এ আকমল হোসেন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ডেঙ্গুর বিষয়ে আমরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছি। ঢাকার বেশিরভাগ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জন্য আলাদা ডেডিকেটেড কর্নার করা হয়েছে। সেখানে তাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতের জনবলকে ডেঙ্গু বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। বর্তমানে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থায় আছে। এডিস নামক এক প্রকার মশার কামড়ে এ জীবাণু মানবদেহে প্রবেশ করে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ালে মশার দেহে জীবাণু প্রবেশ করে এবং পরবর্তীকালে অন্য সুস্থ লোককে কামড়ালে তার দেহে ভাইরাস প্রবেশ করে। এই মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায়। বর্ষায় ও গ্রীষ্মের সময় এ মশা বংশ বিস্তার করে ও এ রোগের দ্রুত বংশ বিস্তার করে। ডেঙ্গু জ¦র ম্যালেরিয়ার মতোই মশাবাহিত জ্বর। ম্যালেরিয়া প্যারাসাইট-জনিত আর ডেঙ্গু ভাইরাস-জনিত।

এডিস মশা প্রথমে আফ্রিকার জঙ্গলের গাছের কোটরে বাস করত। আজ সুদূর আফ্রিকা থেকে ডেঙ্গুজ্বর আমাদের দেশে আমদানি হয়েছে সমুদ্রপথে, আকাশপথে ও সড়কপথে। ডেঙ্গু জ্বরের প্রকার : ডেঙ্গু ভাইরাস -এর ৪ প্রকার সেরো টাইপ আছে। ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। কিন্তু ডেঙ্গু জ্বর প্রধানত ২ প্রকার (১) ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ¦র, (২) হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ¦র। এছাড়া ডেঙ্গুজ¦র তীব্র হয়ে ডেঙ্গু হেমোরেজিক শক সিড্রোম হতে পারে।

কোথায় বংশ বৃদ্ধি করে ও ডিম পাড়ে : এডিস মশা সাধারণত জমে থাকা পানিতে ডিম পাড়ে ও বংশ বৃদ্ধি করতে পারে, যেমন- ফুলের টব, বৃষ্টির জমানো পানি, ফুলদানি, ফ্রিজের নিচে ট্রে, পরিত্যক্ত কাচের বোতল, পরিত্যক্ত টায়ার, ড্রাম, মাটির ভাঙা কলস, ডাবের খোসায় জমানো পানিতে, ছাদের কোনায়, পানির ট্যাংকে এবং কয়েক দিন ব্যবহার না করা বালতি।

কখন কামড়ায় : সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায়। বিশেষ করে সকালের দিকে ও বিকালের শেষ দিকে এই মশা বেশি কামড়ায়।

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ : ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ- তীব্র জ্বর ১০৪-১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। বমি, পেট ব্যথা ও মাথাব্যথা, কোমর, চোখের পেছনে ব্যথা, জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, হাড়ের ব্যথা এতই প্রচ- যে মনে হয় হাড় ভেঙে গেছে। যে কারণে এই জ্বরকে ব্রেকবোন ফিভার বলা হয়। সমস্ত শরীর (হাড়সহ) ব্যথা হতে পারে। শিশুরা অসহ্য কষ্টে কান্নাকাটি করে ও খিটখিটে মেজাজের হয়। চার-পাঁচ দিনের মধ্যে জ্বর ভালো হয়ে যায়। দেহের ত্বকে অ্যালার্জি র‌্যাশের মতো র‌্যাশ দেখা দিতে পারে। দাগগুলোর কারণে চুলকানিও হতে পারে।

হোমোরেজিক বা রক্তক্ষরা ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ : ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলোই এই অবস্থায় অনেক বেশি তীব্র দেখা যায় এবং সঙ্গে রক্তক্ষরণ থাকে। বিশেষ করে রক্তবমি, পায়খানার সাথে কালো রক্ত, দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তপাত হয়, নাক দিয়ে রক্তপাত, ত্বকের নিচে লালাভ চাকার মতো জমটি বাঁধা রক্তের নমুনা ইত্যাদি দেখা যায়। মস্তিস্ক ও হার্টের মধ্যেও রক্তক্ষরণ হতে পরে। এই রক্তক্ষরণের ফলে রোগী হাইপোভলিউমিক শকে অর্থাৎ অজ্ঞান হয়ে গিয়ে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এ অবস্থাকে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম বলে।

চিকিৎসা : সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। তবে জ্বরের লক্ষণগুলো অনুযায়ী চিকিৎসা করাতে হবে। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ¦র সাধারণত সাত দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যাবে। উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা, যেমন- জ্বর-ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল, বমির জন্য এন্টিইমেটিক ওষুধ দেয়া হয়। প্রয়োজনে শিরাপথে স্যালাইন দিতে হয়। এই জ্বরে প্রচুর পানি পান করতে হয়। জ্বর শেষে রোগীর দুর্বলতা, ক্ষুধামন্দা, বিষণœতা দেখা দিলেও পরে আবার সেগুলো ভালো হয়ে যায়।

হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বর হলে রোগীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। প্রতিদিন রক্ত পরীক্ষা করে বিশেষ করে রক্তের হেমাটোক্রিট ও প্লাটিলেট পরীক্ষা করে ডেঙ্গু জ্বরের তীব্রতা দেখতে হয়। কারণ, এই জ্বরে হেমাটোক্রিট বাড়ে ও প্লাটিলেট অনেক সময় কমে যায়। যদি ১০ হাজারের নিচে হয় তখন প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন করতে হয়। আর বেশি রক্তক্ষরণ হলে রক্ত দিত হয়। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য এনএসএইড দিলে রক্তক্ষরণের প্রবণতা বেড়ে যায়। ঠিক সময়মতো চিকিৎসা করলে জ্বর ভালো হয়ে যায়।

প্রতিরোধ : এডিস মশার উৎস নির্মূল করাই এর প্রতিরোধের একমাত্র উপায়। যেসব জায়গায় ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশা বংশ বৃদ্ধি করে সেসব জায়গা পরিষ্কার করতে হবে। গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ ছাড়া নেট, স্প্রে ব্যবহার করতে হবে এবং মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হবে দিনের বেলায়ও। মনে রাখুন- আক্রান্ত হলে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন। প্রচুর পানি ও তরল খাবার গ্রহণ করুণ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন। মশারির ভেতর থাকুন, যাতে আপনার থেকে মশার মাধ্যমে অন্যজন আক্রান্ত না হন।

মো: লোকমান হেকিম
চিকিৎসক ও কলামিস্ট,
মোবাইল- ০১৭১৬-২৭০১২০।


বিভাগ : স্বাস্থ্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

কাঁচকলার উপকারিতা
অপরিণত নবজাতকরাও ফিরবে স্বাভাবিক জীবনে
বিমান ভ্রমণে জেট ল্যাগ
চোখ ওঠা রোগের কারণ ও প্রতিকার
ডায়াবেটিস রোগীর হৃদরোগের ঝুঁকি
আরও

আরও পড়ুন

কালীগঞ্জে বিএনপি'র মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে ফুলের শুভেচ্ছা জানালেন হামিদ

কালীগঞ্জে বিএনপি'র মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে ফুলের শুভেচ্ছা জানালেন হামিদ

পর্ন তারকা স্টর্মিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘুষ প্রদান মামলার রায় স্থগিত করলো আদালত

পর্ন তারকা স্টর্মিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘুষ প্রদান মামলার রায় স্থগিত করলো আদালত

দৌলতপুরে মাদকাসক্ত যুবকের হাতে মাছ ব্যবসায়ী খুন : যুবক আটক

দৌলতপুরে মাদকাসক্ত যুবকের হাতে মাছ ব্যবসায়ী খুন : যুবক আটক

রাস্তা আটকে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে বিক্ষোভ, অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা

রাস্তা আটকে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে বিক্ষোভ, অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা

পবিত্র কোরআন শরীফের পরে সত্য হিসেবে মানুষ সংবাদপত্রকে মনে করতো-বিটিভি মহা পরিচালক

পবিত্র কোরআন শরীফের পরে সত্য হিসেবে মানুষ সংবাদপত্রকে মনে করতো-বিটিভি মহা পরিচালক

লালমোহনে বিদ্যুৎ স্পৃষ্টে ৭০ বছরের বৃদ্ধ নিহত

লালমোহনে বিদ্যুৎ স্পৃষ্টে ৭০ বছরের বৃদ্ধ নিহত

বিচারের আগে ফ্যাসিস্ট আ. লীগের রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ নেই : নাহিদ

বিচারের আগে ফ্যাসিস্ট আ. লীগের রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ নেই : নাহিদ

ড. ইউনূসকে নিয়ে এক দশক আগে যা বলেছিলেন নরেন্দ্র মোদি

ড. ইউনূসকে নিয়ে এক দশক আগে যা বলেছিলেন নরেন্দ্র মোদি

গাজীপুরে পিকনিকের বাসে বিদ্যুতের তারের স্পর্শে ৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু

গাজীপুরে পিকনিকের বাসে বিদ্যুতের তারের স্পর্শে ৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু

লেবাননে জাতিসংঘ মিশনে হামলা, চার ইতালীয় সেনা আহত

লেবাননে জাতিসংঘ মিশনে হামলা, চার ইতালীয় সেনা আহত

এ আর রহমানের নামে মিথ্যাচার রটানোর অভিযোগে তীব্র ক্ষোভ ঝাড়লেন ছেলে এ আর আমিন

এ আর রহমানের নামে মিথ্যাচার রটানোর অভিযোগে তীব্র ক্ষোভ ঝাড়লেন ছেলে এ আর আমিন

ধর্মদ্রোহী সরকারের সময় কোন ধর্মই নিরাপদ ছিল না-এড.আহমেদ আযম খান

ধর্মদ্রোহী সরকারের সময় কোন ধর্মই নিরাপদ ছিল না-এড.আহমেদ আযম খান

শব্দের চেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন বাধ মানে না এমন ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত আছে : পুতিন

শব্দের চেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন বাধ মানে না এমন ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত আছে : পুতিন

ঢাকা আজ বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় চতুর্থ

ঢাকা আজ বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় চতুর্থ

পলাতক পুলিশ সদস্যদের বেতন বন্ধ, হচ্ছে মামলা

পলাতক পুলিশ সদস্যদের বেতন বন্ধ, হচ্ছে মামলা

ছয়-সাত মাসেই টিয়ার কাবিখার ২০০ কোটি লুটেছিলেন হাসিনা দোসর মহিবুর

ছয়-সাত মাসেই টিয়ার কাবিখার ২০০ কোটি লুটেছিলেন হাসিনা দোসর মহিবুর

আদানির দুই চুক্তি বাতিল করলো কেনিয়া

আদানির দুই চুক্তি বাতিল করলো কেনিয়া

হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে ক্ষতবিক্ষত বাবুকে থাইল্যান্ড নেয়া হচ্ছে

হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে ক্ষতবিক্ষত বাবুকে থাইল্যান্ড নেয়া হচ্ছে

দীর্ঘ ১৭ বছর পর মানিকগঞ্জে জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত

দীর্ঘ ১৭ বছর পর মানিকগঞ্জে জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত

কলাপাড়ায় নিম্নবিত্তদের স্বস্থি দিতে স্থাপন করা হলো সরাসরি কৃষকদের সবজি বাজার

কলাপাড়ায় নিম্নবিত্তদের স্বস্থি দিতে স্থাপন করা হলো সরাসরি কৃষকদের সবজি বাজার