রমযানে মুনাফাখোররা কেন খুশি হয়

Daily Inqilab জাফর আহমাদ

০৯ মার্চ ২০২৩, ০৭:৫১ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৪:৫০ এএম

মাহে রমযান যখন আসে, তখন আমাদের মধ্যে দুই শ্রেণির মানুষ খুব খুশি হয়। এক, মু’মিন-মুসলমান। যারা আল্লাহর বিশেষ রহমত দ্বারা নিজেদের সিক্ত করার জন্য রমযানের জন্য অপেক্ষা করে। দুই, অবৈধ মজুতদার, মুনাফাখোর ও কালোবাজারী। তাদের মুনাফা লুটার অপার সুযোগ নিয়ে আসে রমাযান।
ঈমানদার বান্দারা এ মাসে মানবতার প্রতি আরো বেশি করে দায়িত্বশীলতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তারা ভুল কর্মনীতি পরিহার করে সঠিক কর্মনীতি অবলম্বনের করে। রমযানের অবারিত রহমতের বারিধারায় নিজেদের সিক্ত করতে কোনো ভুল করে না। তারা নিজেদের এ মাসে মানবতার উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত করে। প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা সংযম প্রদর্শনের অনুশীলনে ব্যস্ত সময় পার করে।

পক্ষান্তরে মানবরূপী লোভী মানুষগুলোর লোভের জিভটি এ মাসে এসে আরো লম্বা হয়। তারা দুনিয়ার স্বার্থ, স্বাদ ও আরাম আয়েশের কারণে রমযানকে এক বিরাট সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। দু’হাতে মুনাফা লুটার জন্য রমযানে বেপরোয়া হয়ে উঠে। মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লুণ্ঠনের জন্য কালোবাজারী ও খাদ্যে ভেজাল মিশ্রিত করে। প্রবৃত্তির লালসার সামনে তারা নতজানু হয়। পার্থিব লোভ-লালসার জন্য আল্লাহর দেয়া অপার রহমতের সুযোগ-সুবিধাকে পরিত্যাগ করে দুনিয়ার লালসাকে চরিতার্থ করার জন্য সম্মানিত রোযাদারদের কষ্ট দেয়। এ ধরনের লোভ-লালসার অধিকারী ব্যক্তিদের আল্লাহ তা’আলা অত্যন্ত ঘৃণিত প্রাণীর সাথে তুলনা করেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘আমি চাইলে ঐ আয়াতগুলোর সাহায্যে তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করতাম, কিন্তু সে তো দুনিয়ার প্রতিই ঝুঁকে রইল এবং নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করলো। কাজেই তার অবস্থা হয়ে গেলো কুকুরের মতো, তার উপর আক্রমণ করলেও সে জিভ ঝুলিয়ে রাখে আর আক্রমণ না করলেও জিভ ঝুলিয়ে রাখে। যারা আমার আয়াতকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে তাদের দৃষ্টান্ত এটাই। তুমি এ কাহিনী তাদের শুনাতে থাকো, হয়তো তারা কিছু চিন্তা-ভাবনা করবে।’ (আরাফ-১৭৬)

কুকুর হলো, উগ্র লালসা ও অতৃপ্ত কামনার এক প্রাণী। তার এই লালসা ও কামনার জন্য জিভটি সর্বদা ঝুলে থাকে এবং এ ঝুলন্ত জিভ থেকে অনবরত লালসার লালা পড়তে থাকে। চলাফেরার পথে তার নাক সব সময় মাটি শুকতে থাকে, হয়তো কোথাও কোনো খাবারের গন্ধ পাওয়া যাবে এ আশায়। তার গায়ে কেউ কোনো পাথর ছুঁড়ে মারলেও তার ভুল ভাঙ্গবে না। বরং তার মনে সন্দেহ জাগে, যে জিনিসটি তাকে মারা হয়েছে সেটি হয়তো কোনো হাড় বা রুটির টুকরা হবে। পেট পূজারী লোভী কুকুর একবার লাফিয়ে দৌড়ে গিয়ে সেই নিক্ষিপ্ত পাথরটিও কামড়ে ধরে। পথিক তার দিকে দৃষ্টি না দিলেও দেখা যাবে সে লোভ-লালসার প্রতিমূর্তি হয়ে বিরাট আশায় বুক বেঁধে জিভ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। সে তার পেটের দৃষ্টি দিয়ে সারা দুনিয়াকে দেখে। কোথাও যদি কোনো বড় ধরনের মরা গরু পড়ে থাকে, কয়েকটি কুকুরের পেট ভরার জন্য সেটি যথেষ্ট হলেও একটি কুকুর তার মধ্যে থেকে কেবলমাত্র তার নিজের অংশটি নিয়েও ক্ষান্ত হবে না, বরং সেই সম্পূর্ণ গরু নিজের একার জন্য আগলে রাখার চেষ্টা করবে এবং অন্য কাউকে তাঁর ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেবে না। শকুন বা অন্য যে কোনো প্রাণী কাছে এলে, সেগুলোর প্রতি সে তেড়ে যায়। পেটের লালসার পর যদি দ্বিতীয় কোনো বস্তু তার উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে তাহলে সেটি হচ্ছে যৌন লালসা। কাজেই এখানে এ উপমা দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে এ কথাটি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা যে, দুনিয়া পূজারী ব্যক্তি যখন জ্ঞান ও ঈমানের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে প্রবৃত্তির অন্ধ লালসার কাছে আত্মসমর্পণ করে এগিয়ে চলতে থাকে তার অবস্থা পেট ও যৌনাঙ্গ সর্বস্ব কুকুরের মতো হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।

সত্যিই আমাদের কিছু কিছু মুনাফাখোর ও কালোবাজারীর অবস্থা ঠিক এই নিকৃষ্ট জীবটির মতোই। তার লোভের জিভটি সবসময় ঝুলে থাকে এবং ঝুলন্ত জিভ থেকে অনবরত লালসার লালা ঝরে পড়তে থাকে। এদের উগ্র লালসার আগুন ও অতৃপ্ত কামনার কারণে সাধারণ মানুষকে সবসময় চরম যন্ত্রণা পোহাতে হয়। তাদের ন্যূনতম মানবিক বিবেক যদি থাকতো তাহলে সারা বছর কামনা-বাসনা চরিতার্থ করলেও, অন্তত রমযান মাস এলে রোযাদারদের সম্মানে, রমযানের সম্মানে তারা দ্রব্যমূল্যের দাম স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখতে পারতো। এই ন্যূনতম মানবিক মূল্যবোধটুকুও তার উগ্র লালসার কাছে পরাজিত হয়।

যে কোনো অবস্থায় যে কোনো মানুষকে কষ্ট দেয়া হারাম। রোযাদারকে কষ্ট দেয়া আরো মারাত্মক। এসমস্ত দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধিকারী কালোবাজারী, খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণকারী ও অবৈধ মজুতদার যদি রোযাদার হয় তাহলে তাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন, রোযা তোমাদের কী শিখায়? প্রকৃত রোযাদার তার কোনো ভাইকে কখনো কষ্ট দিতে পারে না। তার ভেতরে সকলের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হওয়ার কথা। কিন্তু এরপরও যদি কোনো মুসলিম ভাই কালোবাজারী, মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা ও খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণ করে, তবে বুঝতে হবে তার রোযা শুধু শুধুই ক্ষুধা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি। আর যারা রোযা রাখেন না তাদের ব্যাপারটি আল্লাহর হাতে সোপর্দ করা ছাড়া আর কি-ই বা থাকতে পারে।

পৃথিবীর দেশে দেশে দেখা যায় যে, রমযান মাস এলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর বিশেষ মূল্যহ্রাস করা হয়। তারা সারা বছর মুনাফা করলেও এ মাসে এসে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখে অথবা কমিয়ে দেয়। তারা এ-ও জানে যে, এ মাসে সে যেই পরিমাণ ছাড় দেবে তা ৭০ গুণ বাড়িয়ে আল্লাহ তাকে দান করবেন। আল্লাহর এই বিশেষ পুরস্কারের প্রতি সম্মান জানাতে তারা কখনো কার্পণ্য করে না। রমযান তাদের দয়াপরবশ করে তুলে। ব্যতিক্রম শুধু এই উপমহাদেশ।

রোযাদারকে কষ্ট দেয়ার মহা অন্যায় থেকে আমাদের সরকারও রেহাই পাবে না। কারণ, অবৈধ কালোবাজারী, মাত্রাতিরিক্ত মুনাফাখোর ও খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণকারীদের হাত থেকে দেশের মানুষকে উদ্ধার ও রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কোনক্রমেই এ দায়িত্ব থেকে সরকার নিজেকে অব্যাহতি দিতে পারেন না। দায়িত্ব অবহেলার কারণে অবশ্যই অবৈধ কালোবাজারী ও ভেজাল মিশ্রিতকারীদের সাথে আল্লাহর কাঠগড়ায় তাকেও দাঁড়াতে হবে। এই দুষ্কৃতীদের দমন করা ও বিরত রাখা সম্ভব। এ জন্য অবশ্যই আল্লাহর দেয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। মানুষের মধ্যে নৈতিকতার বিকাশ সাধন করতে হবে। সেই সঙ্গে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: নিবন্ধকার

 


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বই আত্মার মহৌষধ
তরুণদের সামরিক প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে
সারবাহী জাহাজে ৭ খুন : দ্রুত তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে
গণতন্ত্র ও সাম্যের পথে এগিয়ে চলা বাংলাদেশ রুখে দেয়া আর সম্ভব নয়
রাষ্ট্র সংস্কারে ইসলামের অনুপম শিক্ষা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে
আরও

আরও পড়ুন

ভূঞাপুরে শিক্ষিকাকে যৌন হয়রানির অভিযোগে প্রধান শিক্ষককে বরখাস্ত

ভূঞাপুরে শিক্ষিকাকে যৌন হয়রানির অভিযোগে প্রধান শিক্ষককে বরখাস্ত

আমরা নির্বাচন নিয়ে ধৈর্য ধরতে প্রস্তুত: জামায়াত আমির

আমরা নির্বাচন নিয়ে ধৈর্য ধরতে প্রস্তুত: জামায়াত আমির

ভূরুঙ্গামারীতে নিজ ভটভটি উল্টে যুবকের মৃত্যু

ভূরুঙ্গামারীতে নিজ ভটভটি উল্টে যুবকের মৃত্যু

মিজানুর রহমান আজাহারীর আগমনে পেকুয়ায় দশ লক্ষ মুসল্লি সমাগমের সম্ভাবনা

মিজানুর রহমান আজাহারীর আগমনে পেকুয়ায় দশ লক্ষ মুসল্লি সমাগমের সম্ভাবনা

ক্ষমতা ছাড়ার আগে রাশিয়ার ওপর আরেক দফা নিষেধাজ্ঞা বাইডেনের

ক্ষমতা ছাড়ার আগে রাশিয়ার ওপর আরেক দফা নিষেধাজ্ঞা বাইডেনের

আব্দুল্লাহ আল মামুন খান রনির উদ্যোগে শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ

আব্দুল্লাহ আল মামুন খান রনির উদ্যোগে শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ

চট্টগ্রাম বোর্ডের নূরানি কেন্দ্রীয় সনদ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ : পাশের হার ৯৭.৮৮%

চট্টগ্রাম বোর্ডের নূরানি কেন্দ্রীয় সনদ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ : পাশের হার ৯৭.৮৮%

বিপিএলের সূচি

বিপিএলের সূচি

পিআইবির উদ্যোগে তিন দিনব্যাপী কর্মশালার উদ্বোধন করেন  ডঃ মানোয়ার হোসেন মোল্লা

পিআইবির উদ্যোগে তিন দিনব্যাপী কর্মশালার উদ্বোধন করেন  ডঃ মানোয়ার হোসেন মোল্লা

বিজয় দিবস হ্যান্ডবল আজ শুরু

বিজয় দিবস হ্যান্ডবল আজ শুরু

শান্তি ও মানবতার জয়গানেই খুলনায় বড়দিন উদযাপন

শান্তি ও মানবতার জয়গানেই খুলনায় বড়দিন উদযাপন

চুয়াডাঙ্গায় সারাবাংলা ৮৮ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সপ্তাহ ব্যাপী কম্বল বিতরণ কার্যক্রম শুরু

চুয়াডাঙ্গায় সারাবাংলা ৮৮ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সপ্তাহ ব্যাপী কম্বল বিতরণ কার্যক্রম শুরু

কালিগঞ্জে বিভিন্ন সড়ক মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অবৈধ ডাম্পার

কালিগঞ্জে বিভিন্ন সড়ক মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অবৈধ ডাম্পার

রাজনৈতিক মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে জামির আলী মার্কেট দখলের পাঁয়তারা

রাজনৈতিক মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে জামির আলী মার্কেট দখলের পাঁয়তারা

দক্ষিণ কোরিয়ায় রাজনৈতিক সংকট ,অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট ইউন আদালতে হাজির হননি

দক্ষিণ কোরিয়ায় রাজনৈতিক সংকট ,অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট ইউন আদালতে হাজির হননি

সালথায় দু'গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ১৫, বাড়ি-ঘর ভাঙচুর

সালথায় দু'গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ১৫, বাড়ি-ঘর ভাঙচুর

শুধু নির্বাচনের জন্য মানুষ জীবন দেয়নি : আসিফ মাহমুদ

শুধু নির্বাচনের জন্য মানুষ জীবন দেয়নি : আসিফ মাহমুদ

নোয়াখালীর কবিরহাটে ১৩ বান্ডেল জাল ডলার ও টাকা জব্দ, গ্রেপ্তার-১

নোয়াখালীর কবিরহাটে ১৩ বান্ডেল জাল ডলার ও টাকা জব্দ, গ্রেপ্তার-১

জম্মু-কাশ্মীরে ৫ ভারতীয় সেনা নিহত

জম্মু-কাশ্মীরে ৫ ভারতীয় সেনা নিহত

অ্যাবারক্রোম্বি সিইও যৌন পাচার মামলায় অভিযুক্ত

অ্যাবারক্রোম্বি সিইও যৌন পাচার মামলায় অভিযুক্ত