ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)

Daily Inqilab ইনকিলাব

১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম

আজ ১২ রবিউল আউয়াল, পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। মানব জাতির মহোত্তম পথপ্রদর্শক, নবীকুলশ্রেষ্ঠ হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর জন্ম ও ওফাত দিবস। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বের কেন্দ্রভূমি পবিত্র মক্কা নগরীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কেবল তাঁর অনুসারীদেরই নন, তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের আদর্শ ও পথপ্রদর্শক। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেছেন, আপনাকে আমি জগৎসমূহের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি। মহানবী (সা.) বিশ্বমানবের সেরা পথপ্রদর্শক, মহান শিক্ষক ও অনুপম আদর্শ। আল্লাহপাক রাসুল (সা.) কে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন। বলেছেন: তিনিই সেই সত্তা যিনি নিরক্ষদের মধ্য থেকে একজন রাসুল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের তার আয়াত পড়ে শুনান, শিক্ষা দেন ও পবিত্র করেন এবং তাদের কিতাব শিক্ষা দেন ও হিকমত তথা জ্ঞা-বিজ্ঞান শিক্ষা দেন। অথচ, ইতোপূর্বে তারা সুষ্পষ্ট গুমরাহিতে নিমজ্জিত ছল। (সুরা জুম্মা)। মানবেতিহাসের এক যুগসন্ধিকালে, অন্ধকারতম সময়ে তিনি মহান আল্লাহর বাণী নিয়ে অবতীর্ণ হন। তার উদাত্ত আহবান, নিষ্ঠাপূর্ণ কর্মসাধনা, উচ্চতম নীতি-আদর্শ ও অমলিন চরিত্র-মাধুর্যের মাধ্যমে তিনি অতি অল্প দিনে এক আলোকোজ্জ্বল ও সর্বোন্নত জীবনব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেন। অজ্ঞানতা, কুসংস্কার এবং অনাচার, পাপাচার ও বিশ্বাসহীনতার কলুষ দূরীভূত করে শান্তি, সভ্যতা, নিরাপত্তা ও মানবিক মর্যাদার এক নতুন পথ রচনা করেন। বিশ্বাস, প্রজ্ঞা ও মানবিক গুণাবলী সমৃদ্ধ নয়া সভ্যতার স্থপতি হিসেবে তিনি কেবল আরবভূমি নয়, গোটা বিশ্বে নন্দিত, প্রসংশিত। মহান আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলামের বাণীবাহক হিসেবে তিনি শুধু মানুষের ধর্মীয় জীবনেই প্রভাব বিস্তার ও সুনির্দিষ্ট করেননি, বরং মানব জীবনের এমন কোনো দিক-বিভাগ পাওয়া যাবে না, যেখানে তাঁর অনিবার্য প্রভাব প্রতিফলিত হয়নি। তিনি একাধারে একটি ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা, একটি জাতির নির্মাতা এবং একটি অতুল্য সভ্যতার স্রষ্টা। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, সাইয়েদুল মুরসালিন ও খাতামুন্নাবিয়ীন।
রাসুল (সা.)-এর যখন আবির্ভাব হয়, তখন পবিত্র মক্কা নগরীসহ সমগ্র আরব জাহেলিয়াতের মধ্যে নিমজ্জিত ছিল। পৌত্তলিকতা, যুদ্ধ, বিরোধ-বিসম্বাদ, হানাহানি, অবিশ্বাস, সামাজিক অনাচার, কুসংস্কার, বৈষম্য, মানবিক অধঃপতন মারাত্মক পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। তিনি অবনত-অধঃপতিত মানব গোষ্ঠিকে অল্প দিনের ব্যবধানে সৎ, সত্যনিষ্ঠ, দায়িত্বশীল, মানবিক ও তৌহিদে বিশ্বাসী জাতিতে রূপান্তর করেন। তিনি কেবল মহান আল্লাহপাকের সর্বশেষ কিতাব আল কোরআনের ধারক ও বাস্তবায়নকারীই নন, তাঁর গোটা জীবন ছিল পবিত্র কোরআনের প্রতিরূপ। বিশ্বমানবের মুক্তি, শান্তি, ইহ-পরকালীন মঙ্গল, বিকাশ, নিরাপত্তা-সবকিছুই আসতে পারে পবিত্র কোরআন ও তাঁর জীবনকর্ম অনুসরণ করার মাধ্যমে। তিনি বলেছেন, আমি দুটি বিষয় রেখে গেলাম। যতদিন এ দুটি আঁকড়ে ধরে থাকবে, ততদিন তোমরা পথচ্যুত হবে না। এ দুটি হলো, আল্লাহর কিতাব এবং আমার সুন্নাহ। মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা, আদর্শ, পদাঙ্ক ও পথনির্দেশনা অনুসরণ করে গত প্রায় দেড় হাজার বছরের অধিক সময় ধরে মুসলিম উম্মাহর অন্তর্গত মানুষ তাদের জীবনসাধনা চালিয়ে আসছে। এ সময়ে মুসলমানরা বহু ভূখণ্ড জয় করেছে, বহু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে, শাসনকার্য পরিচালনা করেছে। অতীতে দীর্ঘ সময় জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, দর্শন-শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে। আজকের বিশ্বসভ্যতা সবচেয়ে বেশি ঋণী ইসলাম ও মুসলমানদের কাছে। এ সভ্যতার যা কিছু সুন্দর, যা কিছু কল্যাণকর, যা কিছু মঙ্গলজনক তার পেছনে রয়েছে মহানবী (সা.)-এর আদর্শ, শিক্ষা, নির্দেশনার অনিবার্য ভূমিকা। শান্তি, নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও মানবিক বিকাশের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের অবদান অনস্বীকার্য। বর্তমান বিশ্বে মানুষ যখন ধর্মবিমুখ বস্তুবাদী দর্শনের কবলে পড়ে যুদ্ধ-সংঘাত-সন্ত্রাস ও অশান্তির অনলে পুড়ছে, যখন ক্ষমতা, স¤পদ ও ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে নিজের সর্বনাশকে দ্রুতায়িত করছে, তখন একমাত্র ইসলাম ও বিশ্বনবী (সা.)-এর শিক্ষাই তাকে সর্বোত্তম সুরক্ষা দিতে পারে। বিশ্বে এখন যে অবস্থা বিরাজ করছে, চৌদ্দশ’ বছর আগের আইয়ামে জাহেলিয়াত থেকে তা খুব দূরে নেই। অশান্তি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, বৈষম্য, অনাচার, অশালীনতা সর্বত্র আসন বিস্তার করে নিয়েছে। রাসুল (সা.) এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে শোষণ, বৈষম্য, অবিচার, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তাচার ছিল না। সেই সমাজ ছিল সহানুভূতিপূর্ণ, সহৃদয় ও মানবিক সমাজ। এ সমাজ আমাদের দেশে কেন, বিশ্বে কোথাও নেই। আমরা রাসুল (সা.) এর সুন্নতের কথা বলি, কিন্তু শান্তিপূর্ণ ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সুন্নতের কথা বলি না। এটা দুঃখজনক। আমরা এমন একটা সময় অতিক্রম করছি, যখন রাসুল (সা.)-এর জীবনাদর্শ থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছি। তাঁর আদর্শ ও জীবন নিয়ে চর্চা প্রায় উঠে গেছে। আগে আমাদের দেশে স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠন ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালন করত। রাসুল (সা.)-এর জীবন ও আদর্শ নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। এতে শিশু-কিশোররা জীবন চলার পথের দিক-নির্দেশনা পেত। এখন এসব আয়োজন প্রায় উঠে গেছে।
গোটা মুসলিম বিশ্ব ও মুসলিম উম্মাহ এখন কঠিন সময় অতিক্রম করছে। ইসলামবিদ্বেষী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ একাট্টা হয়ে মুসলিম দেশ ও মুসলিম উম্মাহর ওপর একের পর এক আগ্রাসন, যুদ্ধ ও সন্ত্রাসের তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। মুসলিম বিশ্ব ও মুসলিম উম্মাহকে দুর্বল, হীনবল ও ধ্বংস করার জন্য এমন কোনো কৌশল নেই, যা তারা অবলম্বন করছে না। এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা মুসলমান নিধন ও ইসলাম উচ্ছেদের প্রক্রিয়া ছাড়া কিছুই নয়। ইসলাম ও রাসুলকে (সা.) অপবাদ দেয়ার প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুসলমান হত্যা, ধর্ম-কর্ম ও ইসলামী জীবনবিধান মেনে চলার ক্ষেত্রে নানাভাবে বাধা দেয়া হচ্ছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও ভারতের দিকে তাকালেই আমরা তা দেখতে পাই। ভারতে প্রতিনিয়ত মুসলমানরা হত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে মুসলমানদের বিতাড়নে আইন পাস করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে বেআইনীভাবে মুসলমানদের শাস্তি দেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এভাবে মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ মুসলমানদের প্রতি বিরূপ আচরণ ও ইসলামকে ঠেকানোর প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে, বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রতি মানুষের ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে এবং ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে তারা আশ্রয় নিচ্ছে। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৫০ সালে মুসলমানরা হবে বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠি। এই প্রেক্ষাপটে, ইসলামবিদ্বেষী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ ইসলাম ও মুসলমানদের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে উঠেপড়ে লেগেছে। বাংলাদেশেও মুসলিম জাতিসত্তা ও ইসলামের বিরুদ্ধে নানা প্রকার অপপ্রচার চলছে। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে ধর্মহীনতা, নাস্তিকতা, অনৈতিকতা ও অপসংস্কৃতি প্রশ্রয় পাচ্ছে। ইসলাম বিদ্বেষীরা বিভিন্নভাবে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর এই দিনে আমরা বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অপপ্রচার, চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ও নির্মূলীকরণ স¤পর্কে মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক ও সচেতন হওয়ার আহবান জানাই। আহবান জানাই রাসুল (সা.)-এর আদর্শ ও শিক্ষা অনুসরণের মাধ্যমে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার। জাতীয় মুক্তি, কল্যাণ, সমৃদ্ধি, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার জন্য রাসুল (সা.)-এর পদাঙ্ক অনুসরণের বিকল্প নেই।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান

ধীর গতিতে নাৎসি-স্টাইলের ফ্যাসিবাদে এগুচ্ছে ভারত

ধীর গতিতে নাৎসি-স্টাইলের ফ্যাসিবাদে এগুচ্ছে ভারত

আতঙ্ক কাটিয়ে আবারও নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প

আতঙ্ক কাটিয়ে আবারও নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প

কোরআনে বর্ণিত স্বৈরশাসকদের করুণ পরিণতি

কোরআনে বর্ণিত স্বৈরশাসকদের করুণ পরিণতি

শোক পালন বা শোক দিবস : প্রেক্ষিত ইসলামের নির্দেশনা-১

শোক পালন বা শোক দিবস : প্রেক্ষিত ইসলামের নির্দেশনা-১