শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামী জ্ঞান-গবেষণার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে
৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০১ এএম
‘আল্লাহ ইসলামের জন্য যার বক্ষ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন এবং যে তার প্রতিপালক প্রদত্ত আলোতে রয়েছে সে কি তার সমান, যে এরূপ নয়? দুর্ভোগ সেই কঠিন হৃদয় ব্যক্তিদের জন্য যারা আল্লাহর স্মরণ হতে বিমুখ হয়।’ (সূরা যুমার, আয়াত-২২)।
ইসলামী গবেষণা পরিভাষাটি শুনতে নতুন ও আধুনিক মনে হলেও এটি ইসলামের সুদীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সমান। কুরআন মজিদের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ পাক চিন্তা অনুধ্যান ও গবেষণার তাকিদ দিয়েছেন এবং চিন্তাশীল ও গবেষক বান্দাদের প্রশংসা করেছেন। যেমন বলা হয়েছে: ‘আমি তো অনুধাবনকারী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করেছি।’ (সূরা আনআম, ৯৮)। ‘তোমরা কি চিন্তাভাবনা কর না।’ (সূরা আনআম, ৫০) ‘তোমরা কি অনুধাবন কর না।’ (সূরা ইয়াসীন ৬৮)। ‘অতএব, হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ! তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।’ (সূরা হাশর-২)। ‘আর তারা আসমানসমূহ ও জমিনের সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা গবেষণা করে।’ (সূরা আলে ইমরান, ১৯১)।
কুরআন মজীদের এসব বাচনভঙ্গি সামনে রাখলে মনে হবে, কেবল চিন্তাশীল লোকদের জন্যই আল্লাহ পাক কুরআন মজীদ নাযিল করেছেন। কুরআনের এই আবেদনে অনুপ্রাণিত হয়ে পূর্বেকার মুসলিম মনীষী-গবেষকগণ অক্লান্ত পরিশ্রম করে কুরআন ও হাদীস নিয়ে গবেষণার সৌধমালা গড়ে তুলেছেন, ফিকাহসহ বিভিন্ন শাস্ত্রের উদ্ভাবন করেছেন এবং কুরআন, হাদীস ও ইসলামী জ্ঞানভান্ডারের ধারাবাহিকতা আমাদের পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্তু তাদের শ্রম সাধনা ও গবেষণাকে মূল্যহীন করার জন্য বর্তমান সময়ে এক কুচক্রি মহল উঠেপড়ে লেগেছে। তাদের ভয়াবহ বক্তব্য হল, কুরআন হাদীসের বাইরে আর কিছু চর্চা করা যাবে না।
অন্যদিকে কুরআন ও হাদীসকে আমরা শুধু তেলাওয়াত ও খতমে বুখারির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। সামনে মাহে রমজান আসছে। রমজানে তারাবীহ নামাজসহ সর্বত্র কুরআন তেলাওয়াতের একটি বেহেশতি পরিবেশ বিরাজমান থাকে। কিন্তু সবাই এ কথা স্বীকার করবেন যে, কুরআন তেলাওয়াত ও শ্রবণকে আমরা যতখানি গুরুত্ব দেই সেই তুলনায় কুরআন বুঝে পড়া, গবেষণা, অধ্যয়ন করা এবং কুরআন মজীদ থেকে যুগজিজ্ঞাসার সমাধান বের করার বিষয়টিকে সামান্যতম গুরুত্বও আমরা দেই না।
শীতের মওসুমে সারাদেশে শহর-গ্রামে ওয়াজ মাহফিল, মিলাদুন্নবী, সিরাতুন্নবী, ইজতেমা, জোড়, তাফসীর মাহফিলের মতো গণমুখী ইসলামী অনুষ্ঠানগুলো যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে অনুষ্ঠিত হয়। জনসমাজে ইসলামী বক্তাদেরও যথেষ্ট সমাদর আছে। সেই তুলনায় একজন লেখক, গবেষককে আমরা যথার্থ সম্মান দেই না। তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে লেখা বইগুলোর কদর আমাদের মাঝে বলতে গেলে একেবারেই নেই। বই পড়ার মানসিকতাই আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এর জন্যে আমাদের চিন্তার দৈন্য ও কুরআনের বাণী অনুধাবনে আমাদের অনীহাকেই দায়ী করতে হবে।
ইহুদি-খ্রিস্টান পন্ডিতরা আজ পশ্চিমা দুনিয়ায় বসে কুরআন নিয়ে গবেষণা করছেন। তারা ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ নিয়ে যেসব মূল্যায়ন পেশ করেন সেগুলোই আমাদের ইসলামী চিন্তাবিদরা গলধকরণ করে গোলকধাঁধায় পড়ে যাচ্ছেন। ফলে তারা না সমাজকে সঠিক পথ দেখাতে পারছেন, আর না সমাজ তাদেরকে বিশ্বাস ও বরণ করে নিতে পারছে।
চিন্তার ক্ষেত্রে আমাদের দৈন্যের একটি কারণ, আমরা কুরআন মজীদের আধ্যাত্মিক ও জাগতিক আবেদনকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছি। তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বা চিন্তাবিদরা কেবল জাগতিক বিষয় নিয়ে মহাব্যস্ত। আর যারা নিজেদেরকে ধর্মের অথরিটি মনে করি তারা জাগতিক বিষয়-আশয় ছেড়ে শরীয়ত কিংবা মারফত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছি। অথচ, আল্লাহর ইচ্ছা হলো, আমাদেরকে অন্তর্জগত ও বহির্জগত উভয়ের মাঝ থেকে আল্লাহর নিদর্শন আবিষ্কার করতে হবে। ‘আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাবলী দেখাবো বিশ্বচরাচরে ও তাদের নিজেদের অভ্যন্তরে, ফলে তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, তিনিই পরম সত্য। তোমার পরিচালক সম্পর্কে এটুকুই কি যথেষ্ট নয় যে, তিনি সর্ববিষয়ে অবহিত।’ (সূরা হা-মীম-আস সাজদা, আয়াত-৫৩)।
কুরআন মজীদের একটি অসাধারণ পরিভাষা এই ‘আয়াত’। আয়াত অর্থ নিদর্শন। এই নিদর্শন ছড়িয়ে আছে সৃষ্টি জগতের পরতে পরতে, আবার মানব সত্তার অভ্যন্তরে। এই নিদর্শন আবিষ্কার ও অনুধাবন করতে হলে বর্তমান দুনিয়ায় প্রচলিত জ্ঞান বিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখায় আমাদেরকে বিচরণ করতে হবে। বিষয়টি আমরা এভাবেও বুঝতে পারি। আলেম সমাজের পরিচয় দিতে গিয়ে আমরা কুরআন মজীদের একটি আয়াতের শেষাংশ উদ্ধৃত করে দাবি করি ‘নিশ্চয়ই আলেমগণই আল্লাহকে ভয় করেন।’ প্রশ্ন করি, এই আলেম কারা? সম্পূর্ণ আয়াতটি সামনে রাখলে আমরা এর জবাব পাব। ‘তুমি কি দেখ না, আল্লাহ আকাশ হতে বৃষ্টিপাত করেন; এবং আমি তা দ্বারা বিচিত্র বর্ণের ফলমূল উদ্গত করি। আর পাহাড়ের মধ্যে আছে বিচিত্র বর্ণের পথÑশুভ্র, লাল ও নিকষ কাল। এভাবে রং বেরং এর মানুষ, জন্তু ও গবাদি পশু রয়েছে। আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী তারাই আল্লাহকে ভয় করে; আল্লাহ পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।’ (সূরা ফাতির-২৭-২৮)।
লক্ষ করুন, আল্লাহ পাক নৃবিজ্ঞান, প্রকৃতিবিজ্ঞান, সৌরবিজ্ঞান, প্রতœতত্ত, ভূতত্ত্ব, কৃষি, প্রাণিবিদ্যা প্রভৃতি অর্থাৎ বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধিত সকল জ্ঞান বিজ্ঞানের দিকে ইঙ্গিত করার পর বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে আলেম (জ্ঞানী ব্যক্তি)-রাই আল্লাহকে ভয় করে।’ পরের আয়াতে এসব জ্ঞানী ব্যক্তির চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলা হয়েছে, আল্লাহর সঠিক পরিচয় লাভে ঋদ্ধ এসব জ্ঞানীর জীবন ও জবান দিয়ে আল্লাহর যিকির ও স্মরণ উদ্ভাসিত হবে।
আল্লাহ তাআলা গোটা সৃষ্টিলোকে দুইভাবে তার নিদর্শন ছড়িয়ে রেখেছেন। একটি আলমে খিলকত সৃষ্টিলোক, অর্থাৎ সৃষ্টিরাজির পরতে পরতে। আরেকটি কুরআন হাদীসের বাণিতে শরীয়া চর্চায়। ভাগ্যের পরিহাস যে, আমরা শরীয়ার জ্ঞানকে নিজস্ব ইসলামী জ্ঞান বলে দাবি করছি। আর সৃষ্টিলোক সম্পর্কিত জ্ঞানচর্চাকে আল্লাহর দুশমনদের হাতে তুলে দেয়ার মধ্যে আখেরাতের মুক্তি ও সওয়াব সন্ধান করছি।
পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো কুরআন হাদীস নির্ভর জ্ঞান-গবেষণার মাধ্যমে সৃষ্টিজগতের সবকিছুকে আল্লাহর ইচ্ছা মাফিক ভোগ ও ব্যবহার করা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেশের প্রচলিত মাদরাসা শিক্ষাকে একমাত্র ইসলামী শিক্ষা বলে গর্ব করা এবং স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চাকে বিজাতীয় জ্ঞান বলে অবজ্ঞা করার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। এ ধরনের চিন্তার কারণে সবসময় মাদরাসা শিক্ষা সংস্কারের কথা বলা হয়। অথচ, সাধারণ শিক্ষার সংস্কারের মাধ্যমে ইসলামী বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি ভুলে যাওয়া হয়। আমাদের চিন্তার এই সংকীর্ণতার সুযোগে তথাকথিত প্রাচ্যবিদরা আজ কুরআন হাদীস চর্চায় অনেক এগিয়ে এবং তাদেরই চিন্তায় আক্রান্ত আহলে কুরআন জাতীয় নানা নামের গোষ্ঠি সৃষ্টি করে আমাদের সমাজে ফিতনার মহামারি ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
উল্লেখিত আয়াতসমূহ প্রমাণ করে ইসলাম, সমাজ, সভ্যতা ও সৃষ্টিজগত নিয়ে চিন্তা গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমান বাস্তবতার দাবি হচ্ছে আমাদের মধ্যে এমন এক সর্বজনীন জাগরণ আসতে হবে, যার মাধ্যমে কুরআন ও হাদীসের উপর ইসলামের শত্রুদের কুশলি আগ্রাসনের মোকাবিলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্য তুলে ধরা যায়। এখানে একটি সমস্যার কথা বলতে চাই। ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা সংক্রান্ত এ জাতীয় বক্তব্য সামনে আনলে সবাই বলে উঠেন, প্রচলিত মাদরাসা শিক্ষায় এগুলো চালু করতে হবে। কিন্তু কেন? এগুলো তো জেনারেল সাব্জেক্টের বিষয়। এসব বিষয় তো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চালু আছে। সেখানে ইসলামী ভাবধারার সংযোজন করলেই তো লক্ষ্য অর্জিত হয়ে যায়। আমাদের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে পড়ে স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিতে। তারা তো মুসলমানের সন্তান। ইসলাম তো কেবল আলেম ইমাম বা মাদরাসা অঙ্গনের জন্য আসেনি। ইসলামের দায়িত্ব প্রতিটি ঈমানদার মুসলমানের উপর অর্পিত। কাজেই আমাদের জেনারেল শিক্ষিতরা মুসলমান হয়ে বেড়ে উঠবে, এটাই তো আমরা চাই। তার সাথে থাকবে মাদরাসা শিক্ষা। মেডিক্যাল, কৃষি ও ক্যাডেট কলেজের জন্য যেমন আলাদা ব্যবস্থাপনা আছে, তেমনি ছোটবেলা থেকে প্রাক্টিসিং মুসলমান হিসেবে বা ঈমান ও আমল সহকারে তালিম ও তাযকিয়ার ছকে গড়ে তোলার শিক্ষালয় হলো মাদরাসা শিক্ষা। দেশে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হওয়ার পরও আলাদা মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা চালু থাকতে হবে। কারণ, জ্ঞানের সাথে চরিত্রের সৌন্দর্যের বিকাশের প্রশ্ন ছাড়াও আরবি ভাষার এমন মারপ্যাঁচ আছে যেগুলো মাদরাসা অঙ্গনে আলাদাভাবে চর্চা না করলে কুরআন ও হাদীসের ভাষা সরাসরি বুঝা ও অর্থ করা সম্ভবপর হবে না। আশা করি, আমাদের চিন্তাশীল লোকেরা বিষয়টি একটু গভীরে গিয়ে চিন্তা করবেন।
লেখক: ইসলামী চিন্তাবিদ।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
লুইস ঝড়ের কবলে ইংল্যান্ড
আজ জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে জাতীয় পার্টি
গাজায় ইসরাইলি হামলায় আরো ১০০ ফিলিস্তিনি নিহত, লেবাননে ৪৫
স্পেনে আকস্মিক বন্যায় নিহত ছাড়িয়েছে দেড়শ
সাবেক মন্ত্রী উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী গ্রেপ্তার
প্রায় ৪ হাজার বছর আগের হারিয়ে যাওয়া শহরের সন্ধান সউদীতে
মার্কিন নির্বাচন ২০২৪ : জয় পরাজয় সমীকরণ পালটে দিতে পারে বিশ্ব পরিস্থিতি
ইসরাইলে প্রতিশোধমূলক হামলার জবাব দিতে খামেনির নির্দেশ
অমিত শাহকে অভিযুক্ত করলেন কানাডার মন্ত্রী, কোনপথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক?
টেকনাফে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন
না.গঞ্জে ২৪ ঘন্টায় ডেঙ্গুতে আরও ৫০ জন আক্রান্ত
উত্তরায় ডেঙ্গু সচেতনতা লিফলেট বিতরণ করেন বিএনপি নেতা মোস্তফা জামান
ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক উত্তেজনার মধ্যে সামরিক বাজেট দ্বিগুণ বাড়াচ্ছে ইরান
ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে সিলেটে প্রথম শহীদ জিলুর মৃত্যু বার্ষিকীতে সিলেট যুবদলের দোয়া মাহফিল
বগুড়ায় স্ত্রী হত্যার দায়ে ১৯ বছর পর স্বামীর মৃত্যুদন্ড
ইসরায়েল-লেবানন যুদ্ধবিরতি চুক্তি শিগগিরই হচ্ছে : লেবাননের প্রধানমন্ত্রী
সাবেক ছাত্রলীগ নেতার মুজেজায় সিলেটে (এক লাফে) অধ্যক্ষ হয়ে যান হাকিম মুহিব বুল্লাহ
আদর্শিক ছাত্র জনতার ভূমিকা রাখতে হবে -মাওলানা ইমতিয়াজ আলম
গাড়িতে অগ্নিসংযোগকারীরা পতিত সরকারের প্রেতাত্মা- মাওলানা ইউনুছ আহমাদ
জকিগঞ্জকে স্বধীন বাংলাদেশের প্রথম মুক্তাঞ্চল হিসেবে ঘোষণার দাবী