ঢাকা   শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

মানব কল্যাণে চাই সকলের একত্রিত প্রচেষ্টা

Daily Inqilab রহমান মৃধা

০১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:১৬ এএম | আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:১৬ এএম

বিশ্ব উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে। অথচ, মানুষ নৈতিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামাজিক বিভাজনের মুখোমুখি। প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি আমাদের জীবনকে উন্নত করেছে বটে, তবে সেই অগ্রগতি অনেক ক্ষেত্রেই মানবিক ও সামাজিক সংকটের পথ প্রশস্ত করেছে। আমরা কেবল রাষ্ট্র বা কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে বসে থাকতে পারি না। পরিবর্তনের জন্য আমাদের সকলের একত্রিত প্রচেষ্টা চালানো প্রয়োজন। ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সার্বিক উন্নয়নের জন্য কাজ করতে হবে, যাতে সমগ্র পৃথিবী একটি মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজে রূপান্তরিত হয়।

প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির কারণে আজকের সমাজ অনেক সুবিধা উপভোগ করছে। আমাদের জীবন সহজ হয়েছে, বিভিন্ন খাতে অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। তবে এই অগ্রগতির কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে, যা মানবিক এবং নৈতিক মূল্যবোধকে আঘাত করছে।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, প্রকৃতির ক্ষতি: আমরা উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরিবেশকে ধ্বংস করছি। জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণের কারণে মানবজীবন হুমকির মুখে। দীর্ঘমেয়াদে উন্নতি তখনই কার্যকর হবে, যখন তা পরিবেশবান্ধব হবে।

সামাজিক অবক্ষয়: উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে সমাজের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। ধনী-গরিবের ফারাক বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সমাজে হিংসা এবং অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে।

এক্ষেত্রে করণীয়: আমাদের অগ্রগতির সাথে সাথে মানবিক মূল্যবোধ এবং পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। উন্নয়ন এমনভাবে করতে হবে, যাতে তা টেকসই হয় এবং সমাজের সকলের উপকারে আসে।

ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীস্বার্থ অনেক সময় সামাজিক অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে। যখন আমরা নিজেদের প্রতিষ্ঠা বা লাভের জন্য অন্যদের দুর্দশা বাড়িয়ে তুলি, তখন তা সামগ্রিক উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সমাজে বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অনিয়মিত ধাপগুলো এই সমস্যা আরও প্রকট করে তোলে।

এর অন্যতম উদাহরণ ইনফ্লেশন এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য, মুদ্রাস্ফীতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র মানুষ। তাদের আয়ের সিংহভাগই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে ব্যয় হয়, যা মুদ্রাস্ফীতির ফলে আরও দামী হয়ে ওঠে। এর বিপরীতে, ধনী শ্রেণির পক্ষে এই মূল্যবৃদ্ধি সহজে সহ্য করা সম্ভব, কারণ তাদের হাতে প্রচুর সম্পদ থাকে। এভাবে মুদ্রাস্ফীতি ধনী ও গরিবের মধ্যকার ব্যবধানকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

গরিব হওয়া আসলে সমাজে একটি বড় সমস্যা। ‘ইব ধ ঢ়ড়ড়ৎ রং সড়ংঃ বীঢ়বহংরাব’ এর অর্থ হলো গরিব থাকা মানে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দুর্বলতা নয়; বরং এটি একটি নিরন্তর সংগ্রামের প্রতীক। গরিবদের জন্য জীবনের প্রতিটি স্তরই ব্যয়বহুল খাবার, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং বাসস্থান সকল সেক্টরেই তাদের জন্য খরচ বেড়ে যায়। এই অবস্থায় তাদের সেবা বা সুযোগ-সুবিধার জন্যও বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়, ফলে তাদের জীবনযাত্রার মান আরও নি¤œমুখী হয়।

যখন গরিবরা সুস্থ থাকতে চান, তাদের নিকটস্থ হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নেওয়ার খরচ তাদের পক্ষে বহন করা কঠিন হয়ে পড়ে। চিকিৎসার জন্য ঋণ নিতে হয় বা কিছু ক্ষেত্রে তারা চিকিৎসা না নিয়ে জীবনযাপন করে, যা তাদের শারীরিক অবস্থাকে আরও খারাপ করে।

এক্ষেত্রে করণীয় হলো সাম্য প্রতিষ্ঠা। অর্থনৈতিক নীতি ও সামাজিক উদ্যোগগুলোকে এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য কমে। সকলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। ব্যক্তি স্বার্থের চেয়ে সমাজের সার্বিক কল্যাণকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।

মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব এবং সামাজিক বৈষম্যকে সমাধান করতে হলে শুধুমাত্র রাষ্ট্র বা বড় প্রতিষ্ঠান নয়, আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। ব্যক্তিস্বার্থের পরিবর্তে সার্বিক কল্যাণের দিকে মনোযোগ দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের প্রতিটি স্তরে সাম্যের প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায্যতা নিশ্চিত করাই হবে একটি উন্নত ও মানবিক সমাজ গঠনের মূল চাবিকাঠি।

একটি সমাজে বা দেশে পরিবর্তন আনতে হলে সবাইকে একত্রিত হতে হবে। শুধুমাত্র রাষ্ট্র বা নীতি প্রণেতাদের দায়ী করে বসে থাকলে কিছুই হবে না। মানুষকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব নিতে হবে এবং মানবতার কল্যাণে কাজ করতে হবে।

স্বেচ্ছাসেবা ও নাগরিক উদ্যোগ এক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হতে পারে। কেননা, আমাদের নিজস্ব প্রচেষ্টায় সমাজের অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। ছোট উদ্যোগ, যেমন দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য টিউশন, অথবা ক্ষুধার্তদের খাদ্য বিতরণ, সমাজে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।

এর জন্য প্রয়োজন মানবিক নেতৃত্ব। আমাদের নেতাদের এমন নেতৃত্ব প্রদর্শন করতে হবে, যা মানবিকতা এবং ন্যায়বিচারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। তাদের সিদ্ধান্তগুলো হবে সমাজের সকলের জন্য কল্যাণকর।

বৈষম্যের প্রসার মানবজাতির উন্নয়নের অন্যতম প্রধান বাধা। যখন অর্থনৈতিক সুবিধা একটি ছোট শ্রেণির হাতে সীমাবদ্ধ থাকে, তখন সমাজের বিশাল অংশ বঞ্চিত থাকে। এই বৈষম্য সমাজে হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়।

ধনী বনাম দরিদ্র: বড়লোকদের আয়ের সঙ্গে সাধারণ মানুষের আয়ের ফারাক ক্রমাগত বাড়ছে। এই বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে।

এ ব্যাপারে করণীয় হচ্ছে সম্পদের সুষম বণ্টন। আমাদের লক্ষ্য হতে হবে সবার জন্য ন্যায্য সুবিধা নিশ্চিত করা। সরকারি নীতি এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলো এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে ধনী-গরিবের ফারাক কমে।

মানবজাতির উন্নয়নের জন্য টেকসই উন্নয়ন এখন সময়ের প্রয়োজন। শুধু আর্থিক বা প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়, আমাদের পরিবেশ, সামাজিক মূল্যবোধ এবং মানবিকতাও সংরক্ষণ করতে হবে।

এর জন্য প্রয়োজন পরিবেশ সংরক্ষণ করা। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য পরিবেশ রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। টেকসই উন্নয়নের জন্য পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি এবং নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।

মানুষের মৌলিক অধিকার: শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং সামাজিক সুরক্ষার জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। এটি একটি সমাজের ভিত্তি তৈরি করবে যেখানে সবাই সমানভাবে উন্নত হতে পারে।

মানবজাতির উন্নয়নের পথে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং একত্রিত উদ্যোগ অপরিহার্য। পরিবর্তনের জন্য শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকা উচিত নয়, আমাদের প্রতিটি মানুষকেই তাদের অবস্থান থেকে অবদান রাখতে হবে। ব্যক্তি স্বার্থ নয়, বরং সার্বিক উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। সকলের জন্য ন্যায়বিচার, সমতা এবং মানবিক মূল্যবোধ নিশ্চিত করে আমরা একটি সুন্দর, শান্তিপূর্ণ এবং সমতাপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলতে পারি।

লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

দেশনেত্রীর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও সম্মান
বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনসহ সরকারের কাজের পরিধি বিশাল
অদক্ষ ফার্মাসিস্ট দ্বারাই চলছে ফার্মেসি
নির্বাচন কমিশন গঠন : গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু
মানসিক সুস্থতায় কর্মবিরতি
আরও

আরও পড়ুন

১৭টি বছর শ্রমিকদলের নেতাকর্মীদের উপর নির্যাতন করেছে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা- কেন্দ্রীয় সভাপতি

১৭টি বছর শ্রমিকদলের নেতাকর্মীদের উপর নির্যাতন করেছে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা- কেন্দ্রীয় সভাপতি

বিএনপি যতই চাপ দিক, সংস্কারের ওপর ভিত্তি করেই নির্বাচন: উপদেষ্টা নাহিদ

বিএনপি যতই চাপ দিক, সংস্কারের ওপর ভিত্তি করেই নির্বাচন: উপদেষ্টা নাহিদ

ছয় বছর পর স্বাগতিক জিম্বাবুয়ের মুখোমুখি পাকিস্তান

ছয় বছর পর স্বাগতিক জিম্বাবুয়ের মুখোমুখি পাকিস্তান

তারেক রহমান ও কায়কোবাদের মামলা প্রত্যাহার না করলে অনশনসহ কঠোর কর্মসূচির হুশিয়ার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের

তারেক রহমান ও কায়কোবাদের মামলা প্রত্যাহার না করলে অনশনসহ কঠোর কর্মসূচির হুশিয়ার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের

টানা তিন সেঞ্চুরিতে তিলাকের বিশ্ব রেকর্ড

টানা তিন সেঞ্চুরিতে তিলাকের বিশ্ব রেকর্ড

সাময়িক বন্ধের পর খুললো যমুনা ফিউচার পার্ক

সাময়িক বন্ধের পর খুললো যমুনা ফিউচার পার্ক

জ্বালানি খাতে সাশ্রয় হয়েছে ৩৭০ কোটি টাকা: জ্বালানি উপদেষ্টা

জ্বালানি খাতে সাশ্রয় হয়েছে ৩৭০ কোটি টাকা: জ্বালানি উপদেষ্টা

গৌরনদীতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দোকান ঘরে বাস নিহত-১ আহত-৬

গৌরনদীতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দোকান ঘরে বাস নিহত-১ আহত-৬

কুড়িগ্রামের উলিপু‌রে ২ আ'লীগ নেতা গ্রেপ্তার

কুড়িগ্রামের উলিপু‌রে ২ আ'লীগ নেতা গ্রেপ্তার

লাওসে ভেজাল মদপানে ৬ বিদেশির মৃত্যু

লাওসে ভেজাল মদপানে ৬ বিদেশির মৃত্যু

না.গঞ্জে ডেঙ্গু পরীক্ষার টেস্ট কিট সংকট কে কেন্দ্র করে টেস্ট বাণিজ্যের অভিযোগ

না.গঞ্জে ডেঙ্গু পরীক্ষার টেস্ট কিট সংকট কে কেন্দ্র করে টেস্ট বাণিজ্যের অভিযোগ

ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভের প্রস্তুতি

ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভের প্রস্তুতি

‘পতনের’ মুখে ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইন

‘পতনের’ মুখে ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইন

বিশ্বব্যাংক আয়োজিত জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতির প্রদর্শনী

বিশ্বব্যাংক আয়োজিত জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতির প্রদর্শনী

আগামীকাল রোববার নারায়ণগঞ্জের যেসব এলাকায় ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না

আগামীকাল রোববার নারায়ণগঞ্জের যেসব এলাকায় ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না

সিলেট সীমান্তে দেড় কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ

সিলেট সীমান্তে দেড় কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ

২ মার্চকে জাতীয় পতাকা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির আহ্বান জানালেন মঈন খান

২ মার্চকে জাতীয় পতাকা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির আহ্বান জানালেন মঈন খান

সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব নিয়ে যা বললেন বদিউল আলম

সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব নিয়ে যা বললেন বদিউল আলম

সিংগাইরে সাংবাদিক মামুনের বাবার ইন্তেকাল

সিংগাইরে সাংবাদিক মামুনের বাবার ইন্তেকাল

বিরামপুরে ধান-ক্ষেত থেকে হাত বাধা আদিবাসী দিনমজুর মহিলার লাশ উদ্ধার!

বিরামপুরে ধান-ক্ষেত থেকে হাত বাধা আদিবাসী দিনমজুর মহিলার লাশ উদ্ধার!