ইসলামে সহমর্মিতা ও সমাজসেবা

Daily Inqilab মুহাম্মাদ শাহাদাত সাকিব

০৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:২১ এএম | আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:২১ এএম

অসহায় ও বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমেই প্রকাশ পায় মানবতা। যে মানুষ অন্যের চোখের পানি মুছে দেয়, যে মানুষ অসহায়ের পাশে দাঁড়ায়, তাদের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে, সেই প্রকৃত মানুষ। মানুষ সামাজিক জীব। সে একা চলতে পারে না। পরস্পর সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। একের বিপদে অন্যে সাহায্যের হাত বাড়াবে, এগিয়ে আসবে সহমর্মিতা নিয়ে; সাহায্য ও সহমর্মিতার এই বোধ আমাদের মাঝে জাগিয়ে তুলেছেন মহানবী (সা.)।

নবীজী উম্মতকে শিখিয়েছেন, সমগ্র মুসলিম জাতি মিলে একটি সত্তা, একটি দেহ। যার কোথাও আঘাত লাগলে প্রতিটি অঙ্গেই সেই ব্যথা অনুভূত হবে। জেগে উঠবে সমস্ত দেহ। তাই মুসলিম সমাজে কোনো পীড়িত কিংবা অসহায় ব্যক্তি সংকটগ্রস্ত হলে একাকিত্ব বোধ করে না। কারণ পাশেই আছে তার ভাই। ভ্রাতৃত্বের টানে যে এগিয়ে আসবে সাহায্যের জন্য। ইসলাম সব মুসলমানকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছেÑ ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই।’ (সূরা হুজুরাত-১০)

তাই অপর ভাইয়ের সাহায্যে এগিয়ে আসা, দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নেয়াই ইসলামের শিক্ষা। এ শিক্ষার সর্বপ্রথম প্রায়োগিক রূপ দিয়েছেন সাহাবায়ে কেরাম (রা.)। মক্কায় নির্যাতিত হয়ে সাহাবায়ে কেরাম যখন মদীনায় হিজরত করেছিলেন, তখন মদীনার আনসারগণ গভীর ভালোবাসা দিয়ে বরণ করে নিয়েছিলেন আপন মুহাজির ভাইদের।
মুহাজিরদের মনে ছিল মাতৃভূমি, বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে আসার দুঃখ, বাড়ি-ঘর, ধন-সম্পদ ছেড়ে আসার কষ্ট। তবে আনসারগণ চেয়েছেন, মুহাজির ভাইদের সব দুঃখ মুছে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে। তাই তো প্রত্যেকে সাধ্যের সবটুকু দিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন মুহাজির ভাইদের সাহায্যে।

নবীজী (সা.) মদীনায় পৌঁছে প্রত্যেক মুহাজিরকে একএকজন আনসারীর সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে দেন। তার সার্বিক খোঁজ-খবর নেয়ার দায়িত্ব থাকে সেই আনসারীর উপর। যেমন, আবু তালহা (রা.) ও আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা.) ছিলেন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। হযরত আনাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা.) ও আবু তালহার মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে দেন। (সহিহ মুসলিম-২৫২৮)

ভ্রাতৃত্বের এই পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর আনসারগণ এটাকে বোঝা কিংবা করুণা মনে করেননি; বরং একে মনে করেছিলেন জীবনের পরম সৌভাগ্য। তাই তো নিজেদের সবকিছু অর্ধেক অর্ধেক ভাগ করে দিতে চেয়েছেন মুহাজির ভাইদের।
হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেনÑ নবী কারীম (সা.) আবদুর রহমান ইবনে আউফ ও সা‘দ ইবনুর রাবী-এর মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে দেন। সা‘দ (রা.) ছিলেন সম্পদশালী। তিনি আবদুর রহমান ইবনে আউফকে বললেন, আনসারগণ জানেন, আমি তাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী, তবে এ সম্পদ এখন আমার আর তোমার মাঝে অর্ধেক অর্ধেক ভাগ করে নিতে চাই। আমার দু’জন স্ত্রী আছে। তাদের যাকে তোমার পছন্দ হয় তাকে আমি তালাক দিয়ে দেব। তুমি তাকে বিয়ে করে নিবে। (সহিহ বুখারী-৩৭৮১)

সুবহানাল্লাহ! কত বড় ত্যাগ! কত বড় কুরবানী! পৃথিবীতে কি খুঁজে পাওয়া যাবে এর নজীর! নিজের অর্ধেক সম্পদ দিতে চাচ্ছেন। প্রিয়তমা স্ত্রীকেও ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন; না নিজের রক্ত সম্পর্কের কোনো আত্মীয়ের জন্য নয়; বরং পরদেশী এক মানুষের জন্য, যার সাথে সম্পর্কের ও পরিচয়ের সূচনা হয়েছে অল্প ক’দিন আগে। তবে ঈমানের বন্ধন তাদের মাঝে হৃদয়ের গভীর বন্ধন গড়ে তুলেছিল।

আনসারদের এই হৃদ্যতা মুহাজিরদের মুগ্ধ করেছিল। হৃদয় থেকে যে রক্ত ঝরছিল তা যেন বন্ধ হয়ে গেছে তাদের উষ্ণ আন্তরিকতা পেয়ে। তাই তো দরবারে নববীতে একদিন মুহাজিরগণ বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা যাদের কাছে এসেছি, প্রাচুর্য-অপ্রাচুর্য সব অবস্থায় তাদের মতো এত ব্যয় করতে এবং এত উত্তম সহমর্মিতা প্রদর্শন করতে আমরা আর কাউকে দেখিনি। তারা আমাদের সব প্রয়োজনে যথেষ্ট হয়েছেন এবং তাদের শ্রমলব্ধ সম্পদে আমাদের অংশীদার বানিয়েছেন। এমনকি আমাদের আশঙ্কা হচ্ছে যে, সব সওয়াব তাঁরাই নিয়ে যাবেন। (জামে তিরমিযী-২৪৮৭)

সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ত্যাগের যে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিলেন, বিপদগ্রস্ত ভাইদের সাহায্যে এগিয়ে আসার যে নজীর স্থাপন করেছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে তা আজও ভাস্বর হয়ে আছে। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) থেকে ত্যাগ, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্বের এই শিক্ষা লাভ করেছেন যুগে যুগে আল্লাহপ্রেমী মুমিনগণ। তাই তো বিপন্ন মানবতার আর্তনাদে সাড়া দিয়ে তারা ছুটে যান। তাদের পাশে এসে দাঁড়ান। নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেন।
মলিন মুখে খুশির হাসি ফোটানোর চেষ্টা করেন। ইসলামের ইতিহাসে প্রতিটি যুগে প্রতিটি জনপদে ভ্রাতৃসেবার এমন দৃষ্টান্ত অসংখ্য। সমাজে যে যখন সমস্যায় পড়েছে অন্যেরা তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। এজন্য মুসলিম সমাজে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য সেবা প্রতিষ্ঠান ও দাতব্য সংস্থা। স্বাস্থ্যসেবা, দারিদ্র্য বিমোচন, রাস্তা-ঘাট উন্নয়ন, সংকটগ্রস্তদের আশ্রয়দান ইত্যাদি কোনো কিছুই এর বাইরে ছিল না।


বিভাগ : শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

দেশ ও দেশবাসীর কল্যাণকামিতা
ইসলামে এসো, শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করবে
নিরাশা নয় আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশা মুমিনের শ্রেষ্ঠ অবলম্বন-২
নিরাশা নয়, আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশা মুমিনের শ্রেষ্ঠ অবলম্বন-১
পিতার কর্তব্য সন্তানকে সময় ও সঙ্গদান-৩
আরও
X

আরও পড়ুন

'মার্চ ফর গাজা'‌ কর্মসূচিতে ঢুকে নাশকতা চালাতে পারে আ'লীগ, গোয়েন্দা তথ্যে আশঙ্কা

'মার্চ ফর গাজা'‌ কর্মসূচিতে ঢুকে নাশকতা চালাতে পারে আ'লীগ, গোয়েন্দা তথ্যে আশঙ্কা

স্ত্রী চলে যাওয়ায় দুধ দিয়ে গোসল করলেন স্বামী, ভিডিও ভাইরাল

স্ত্রী চলে যাওয়ায় দুধ দিয়ে গোসল করলেন স্বামী, ভিডিও ভাইরাল

ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের ডাক মালদ্বীপের ৫৪টি সংগঠনের

ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের ডাক মালদ্বীপের ৫৪টি সংগঠনের

চারুকলায় আগুনে পুড়ল আনন্দ শোভাযাত্রার জন্য বানানো  ফ্যাসিস্ট হাসিনার মোটিফ

চারুকলায় আগুনে পুড়ল আনন্দ শোভাযাত্রার জন্য বানানো ফ্যাসিস্ট হাসিনার মোটিফ

চেন্নাইকে লজ্জার রেকর্ড উপহার দিল কলকাতা

চেন্নাইকে লজ্জার রেকর্ড উপহার দিল কলকাতা

গাজার মানুষ না খেয়ে আছে, চিকিৎসা পাচ্ছে না : ডব্লিউএইচও

গাজার মানুষ না খেয়ে আছে, চিকিৎসা পাচ্ছে না : ডব্লিউএইচও

ট্রাম্পের নতুন নির্বাহী আদেশে গৃহস্থালি পানির বিধিনিষেধ বাতিল

ট্রাম্পের নতুন নির্বাহী আদেশে গৃহস্থালি পানির বিধিনিষেধ বাতিল

পাগলা মসজিদের দানবাক্সে মিললো ২৮ বস্তা টাকা

পাগলা মসজিদের দানবাক্সে মিললো ২৮ বস্তা টাকা

‘মার্চ ফর গাজা’র জন্য প্রস্তুত সোহরাওয়ার্দী, লাখো মানুষের ঢলের অপেক্ষা

‘মার্চ ফর গাজা’র জন্য প্রস্তুত সোহরাওয়ার্দী, লাখো মানুষের ঢলের অপেক্ষা

গাজা-সিরিয়ায় ইসরাইলের আক্রমণ নিয়ে এরদোগানের সতর্কবার্তা

গাজা-সিরিয়ায় ইসরাইলের আক্রমণ নিয়ে এরদোগানের সতর্কবার্তা

বিতর্কিত ওয়াকফ বিল নিয়ে উত্তাল ভারতের মুর্শিদাবাদ

বিতর্কিত ওয়াকফ বিল নিয়ে উত্তাল ভারতের মুর্শিদাবাদ

এশিয়ার তিন দেশ সফর করবেন শি জিনপিং

এশিয়ার তিন দেশ সফর করবেন শি জিনপিং

জুলাই গণঅভ্যুত্থান উজ্জীবিত আশার প্রতীক: মেক্সিকোতে স্বাধীনতা দিবসের বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত মুশফিক

জুলাই গণঅভ্যুত্থান উজ্জীবিত আশার প্রতীক: মেক্সিকোতে স্বাধীনতা দিবসের বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত মুশফিক

গাজা ‘পৃথিবীর দোযখে’ পরিণত হয়েছে, সংকট চরমে

গাজা ‘পৃথিবীর দোযখে’ পরিণত হয়েছে, সংকট চরমে

উত্তাল কলকাতা, মোদি-অমিত শাহের কুশপুত্তলিকা দাহ

উত্তাল কলকাতা, মোদি-অমিত শাহের কুশপুত্তলিকা দাহ

হার দিয়ে পিএসএল শুরু রিশাদের দলের

হার দিয়ে পিএসএল শুরু রিশাদের দলের

শেরাটন ভবনের মালিকানা বিতর্কের অবসান, হিস্যা বুঝে নিল ডিএনসিসি

শেরাটন ভবনের মালিকানা বিতর্কের অবসান, হিস্যা বুঝে নিল ডিএনসিসি

দেশের সাংবিধানিক নামে ‘জনকল্যাণ’ শব্দ চায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ

দেশের সাংবিধানিক নামে ‘জনকল্যাণ’ শব্দ চায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ

ছাগলনাইয়ায় অবৈধভাবে মাটি কাটার অভিযোগে সাতটি পিক-আপ জব্দ ও দুইটি এস্কেভেটর অকেজো

ছাগলনাইয়ায় অবৈধভাবে মাটি কাটার অভিযোগে সাতটি পিক-আপ জব্দ ও দুইটি এস্কেভেটর অকেজো

ভারতের বিতর্কিত ওয়াকফ বিলের বিরুদ্ধে  রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ জানাতে হবে : মাওলানা আহমদ হাসান ফুলতলী

ভারতের বিতর্কিত ওয়াকফ বিলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ জানাতে হবে : মাওলানা আহমদ হাসান ফুলতলী