ইবনূন নাফীস; রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতি সম্বন্ধে সঠিক ধারণাদানকারী মুসলিম মনীষী
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:১৭ পিএম | আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:১৭ পিএম
ইবনুন নাফীস বা ইবনে আল নাফীস (১২১৩–১২৮৮) ছিলেন একজন আরব বহুবিদ্যাবিশারদ। তিনি মুসলিম বিশ্বে ইবনূন নাফীস এবং মুসলিম বিশ্বের বাহিরে ইবনে আল নাফীস নামে অধিক পরিচিত। তার কাজের ক্ষেত্রগুলির মধ্যে যুক্ত ছিল চিকিৎসা, অস্ত্রোপচার, শারীরবিদ্যা, শারীরস্থান, জীববিজ্ঞান, ইসলামিক অধ্যয়ন, আইনশাস্ত্র এবং দর্শন। তিনিই প্রথম ফুসফুসের রক্ত সঞ্চালন বর্ণনা করার জন্য পরিচিত। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি গ্যালেন স্কুলের দীর্ঘকাল ধরে চলা বিতর্কের বাজি ধরেছিলেন যে কার্ডিয়াক ইন্টারভেন্ট্রিকুলার সেপ্টাম দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হতে পারে এবং এর সাথে মিল রেখে তিনি বিশ্বাস রেখেছিলেন যে বাম ভেন্ট্রিকেলে পৌঁছানো সমস্ত রক্ত ফুসফুসের মধ্য দিয়ে যায়। ইবনুন নাফীসের ডান দিকের (পালমোনারি) সঞ্চালন সম্পর্কিত কাজ উইলিয়াম হার্ভে (১৫৭৮-১৬৫৭) এর ৩০০ বৎসর পূর্বে সর্বপ্রথম রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতি সম্বন্ধে সঠিক বর্ণনা করেন এবং উভয় তত্ত্বই সঞ্চালন ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। যা উইলিয়াম হার্ভে প্রমাণ করেছিলেন ১৬২৮ সালে। গ্রীক চিকিৎসক গ্যালেন (১৩০-২০০) এর রক্তসংবহনতন্ত্রের শারীরবিদ্যা সম্বন্ধে তত্ত্বটি ইবনূন নাফীসের কাজ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ছিল। যার জন্য তাকে "সংবহনতন্ত্রের জনক" বা "সংবহন শারীরবৃত্তির জনক" হিসাবে বর্ণনা করা হয়।
ইবনূন নাফীস একজন প্রাথমিক শারীরস্থানবিদ হিসেবে তার কাজের সময় বেশ কিছু মানুষের ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন, শারীরতত্ত্ব এবং শারীরস্থানের ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারও করেছিলেন। ফুসফুসিয় সঞ্চালনের তার বিখ্যাত আবিষ্কারের পাশাপাশি তিনি করোনারি এবং কৈশিক সঞ্চালনের প্রাথমিক অন্তর্দৃষ্টিও দিয়েছিলেন। তিনি সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী (১১৩৮-১১৯৩) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আল-নাসেরি হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন।
ইবনূন নাফীস ১২১৩ সালে একটি আরব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সম্ভবত কারাশিয়া নামের দামেস্কের নিকটবর্তী একটি গ্রামে। যার পরে তার নিসবার উদ্ভূত হয়। জীবনের প্রথম দিকে তিনি ধর্মতত্ত্ব, দর্শন ও সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। এরপর ১৬ বছর বয়সে তিনি দামেস্কের নুরি হাসপাতালে দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ডাক্তারি পড়া শুরু করেন। যা দ্বাদশ শতাব্দীতে তুরস্কের বাদশাহ নুরউদ্দিন মাহমুদ জেনগী (১১১৮-১১৭৪) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি বিখ্যাত দামাসিন চিকিৎসক ইবনে আবি উসাইবিয়ার সমসাময়িক ছিলেন। তারা দুজনেই দামেস্কের একটি মেডিকেল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আল-দাখওয়ার কাছে শিক্ষাগ্ৰহণ করেছিলেন। ইবনে আবি উসাইবিয়া তার জীবনীমূলক অভিধান "লাইভস অফ দ্য ফিজিশিয়ানস"-এ ইবনূন নাফীসের কথা একেবারেই উল্লেখ করেননি। আপাতদৃষ্টিতে ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়া ব্যক্তিগত শত্রুতা বা দুই চিকিৎসকের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীতার কারণে হতে পারে।
১২৩৬ সালে ইবনূন নাফীস তার কয়েকজন সহকর্মীর সাথে আইয়ুবিদ সুলতান আল-কামিলের অনুরোধে মিশরে চলে যান। ইবনূন নাফীস আল-নাসেরি হাসপাতালে প্রধান চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত হন যা সালাহউদ্দিন আইয়ুবী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যেখানে তিনি বেশ কয়েকবছর ধরে চিকিৎসা শিক্ষা ও অনুশীলন করেন। তার অন্যতম উল্লেখযোগ্য ছাত্র ছিলেন বিখ্যাত খ্রীষ্টান চিকিৎসক ইবনে আল-কাফ (১২৩৩-১২৮৬)। ইবনূন নাফীস আল-মাসরুরিয়া মাদরাসায় আইনশাস্ত্রও পড়াতেন। অন্যান্য পণ্ডিতদের মধ্যে তাঁর নাম পাওয়া যায়। যা ধর্মীয় আইনের অধ্যয়ন এবং অনুশীলনে তাকে কতটা ভালভাবে বিবেচনা করা হয়েছিল সে সম্পর্কে স্পষ্ট হয়।
ইবনূন নাফীস তার জীবনের বেশিরভাগ সময় মিশরে বাস করেছেন এবং বাগদাদের পতন ও মামলুকদের উত্থানের মতো বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনারও সাক্ষী ছিলেন। এমনকি তিনি সুলতান বাইবার এবং অন্যান্য বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের ব্যক্তিগত চিকিৎসক হয়েছিলেন। এভাবে তিনি চিকিৎসা অনুশীলনকারীদের মধ্যে একটি কর্তৃত্ব হিসাবে নিজেকে প্রদর্শন করেছিলেন। পরবর্তী জীবনে যখন তার বয়স ৭৪ বছর তখন ইবনূন নাফীসকে নবপ্রতিষ্ঠিত আল-মানসোরি হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। সেখানে তিনি সারাজীবন কাজ করেছিলেন।
ইবনূন নাফীস এরমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে সুস্থ করার সকল চেষ্টা যখন বিফল হচ্ছিল। তখন একজন বাঁচানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে মদ পান করতে বলেন। এর জবাবে ইবনূন নাফীস বলেন- আমি তো সারাজীবন পৃথিবীতে থাকতে আসিনি। আমি আল্লাহর দরবারে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আল্লাহ আমাকে যতটুকু ক্ষমতা দিয়েছেন, আমি চেষ্টা করেছি মানুষের কল্যাণে কাজ করতে। বিদায়ের লগ্নে শরীরে মদ নিয়ে আল্লাহর দরবারে হাজির হতে চাই না। এর পরপরই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তার ছাত্র সাফি আবু আল-ফাতাহ তাকে নিয়ে একটি কবিতা রচনা করেছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার বাড়ি এবং গ্রন্থাগার 'আল-মনসুরি কালাউন' হাসপাতালে দান করেছিলেন। যা হাউস অফ রিকভারি নামেও পরিচিত ছিল।
চিকিৎসা ছাড়াও ইবনূন নাফীস আইনশাস্ত্র, সাহিত্য এবং ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনি শাফিঈ আইনশাস্ত্রের একজন পন্ডিত এবং একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। ইবনূন নাফীস দ্বারা লিখিত চিকিৎসা পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যা ১১০টিরও বেশি খন্ড অনুমান করা হয়। তার বইগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় বই হল আল-শামিল ফি আল-তিব (মেডিসিন)। যা ৩০০টি খন্ড সমন্বিত একটি বিশ্বকোষ হওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু ইবনূন নাফীস মাত্র ৮০টি প্রকাশ করতে সক্ষম হন। এর পরপরই রোগাক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান ফলে কাজটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আল-শামিল ফি আল-তিব্ব ছাড়াও ইবনূন নাফীসের আরও কয়েকটি বইয়ের সন্ধান পাওয়া যায়। সেগুলো হলো : আল মুখতার মিনাল আগজিয়া (মানব দেহের খাদ্য সম্পর্কিত), আল কিতাবুল মুহাজ ফিল কুহল (চক্ষুরোগ সম্পর্কিত), আল রিসালাহ আল কামিলিয়া ফিল আল শিরা আল নাবাইয়াহ (ধর্মতাত্ত্বিক)। তার এই গ্রন্থটি ছিল প্রথম ধর্মতাত্ত্বিক উপন্যাস। এছাড়াও শারহে মাসায়েলে ফিত তিব্ব, তারিকুল ফাসাহ, মুখতাসারুল মানতেখ প্রভৃতি নামের বইয়ের নাম জানা যায়।
তার মৃত্যুর পর কাজটি একজন ব্যক্তির দ্বারা লিখিত সর্ববৃহৎ চিকিৎসাশাস্ত্রে বিশ্বকোষগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয়। এটি তৎকালীন ইসলামী বিশ্বের চিকিৎসাবিজ্ঞানের সম্পূর্ণ সারসংক্ষেপ দেয়। ইবনূন নাফীস তার সমস্ত লাইব্রেরীর সাথে তার বিশ্বকোষ দান করেন মনসুরি হাসপাতালে। যেখানে তিনি তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কাজ করেছিলেন।
সময়ের সাথে সাথে তার বিশ্বকোষের বেশিরভাগ খন্ড হারিয়ে গেছে অথবা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে মাত্র ২টি খণ্ড। যা এখনও মিশরে বিদ্যমান রয়েছে। মিশরীয় পণ্ডিত ইউসেফ জিদান এই কাজের বিদ্যমান পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ ও পরীক্ষা করার একটি প্রকল্প শুরু করেছিলেন যা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার, বডলিয়ান গ্রন্থাগার এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের 'লেন মেডিকেল গ্রন্থাগার' সহ বিশ্বের অনেক গ্রন্থাগারে তালিকাভুক্ত করা আছে।
বিভাগ : ইসলামী জীবন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
না.গঞ্জে ডেঙ্গু পরীক্ষার টেস্ট কিট সংকট কে কেন্দ্র করে টেস্ট বাণিজ্যের অভিযোগ
ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভের প্রস্তুতি
‘পতনের’ মুখে ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইন
বিশ্বব্যাংক আয়োজিত জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতির প্রদর্শনী
আগামীকাল রোববার নারায়ণগঞ্জের যেসব এলাকায় ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না
সিলেট সীমান্তে দেড় কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ
২ মার্চকে জাতীয় পতাকা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির আহ্বান জানালেন মঈন খান
সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব নিয়ে যা বললেন বদিউল আলম
সিংগাইরে সাংবাদিক মামুনের বাবার ইন্তেকাল
বিরামপুরে ধান-ক্ষেত থেকে হাত বাধা আদিবাসী দিনমজুর মহিলার লাশ উদ্ধার!
আওয়ামী সরকার শুধু ফ্যাসিস্ট নয় তাদের আরেকটা নাম দিয়েছি স্যাডিস্ট : অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার
খুবিকে ইমপ্যাক্টফুল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে সকলের সহযোগিতা কামনা
লাল পাহাড়ের দেশকে বিদায় জানিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন অরুণ চক্রবর্তী
বিদেশি প্রভুদের নিয়ে বিতাড়িত স্বৈরাচার ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে: তারেক রহমান
আগামী রোববার-সোমবারও বন্ধ থাকবে ঢাকা সিটি কলেজ
অত্যাধুনিক সব ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালাব ইউক্রেনে: পুতিন
নির্বাচনে যত দেরি ষড়যন্ত্র তত বাড়বে: তারেক রহমান
‘ফিফা ছিল খুবই দুর্বল, আমিই একে বিশাল প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করেছি’
ফ্যাসিস্ট হাসিনা কাউকে রেহাই দেয়নি, জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে পালিয়ে গেছেন: রিজভী
স্বৈরাচার সরকারের দোষররা এখনো মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে: রফিকুল ইসলাম খান