ঢাকা   সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ | ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

আল মাহমুদ : কাল থেকে কালান্তর

Daily Inqilab জসীম উদ্দীন মুহম্মদ

১৩ জুলাই ২০২৩, ০৯:৪১ পিএম | আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৩, ১১:৫৩ পিএম

বাংলা ভাষার প্রধান কবি-লেখকদের নিয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা যতই হাঁকডাক করি না কেন.. এখনও আল মাহমুদ অসংখ্য পাঠকের হৃদয়ে সগৌরবে বেঁচে আছেন। একথা আমার কেবল একার নয়। ইদানিং নানান ব্যস্ততার কারণে তেমন একটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসা হয় না। তবুও গত দুই/তিনদিনে আল মাহমুদের জন্মদিন ঘিরে কবি- লেখক- পাঠক সমাজের যে উন্মাদনা দেখেছি , তা এক কথায় অসাধারণ! কবির প্রতি আত্মিক ভালোবাসার পরম বহি:প্রকাশ।

আমরা যাকে আল মাহমুদ হিসাবে জানি ল, তাঁর প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তিনি ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মীর আবদুর রব ও মাতার নাম রওশন আরা মীর। তার দাদার নাম আব্দুল ওহাব মোল্লা; যিনি হবিগঞ্জ জেলায় জমিদার ছিলেন।

আল মাহমুদ ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দা নাদিরা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে।
কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার সাধনা হাই স্কুল এবং পরে চট্টগ্রামের সীতাকু- হাই স্কুলে পড়ালেখা করেন। মূলত এই সময় থেকেই তার লেখালেখির শুরু। আল মাহমুদ বেড়ে উঠেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি মধ্যযুগীয় প্রণয়োপাখ্যান, বৈষ্ণব পদাবলি, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল প্রমুখের সাহিত্য পাঠ করে ঢাকায় আসার পর কাব্য সাধনা শুরু করেন এবং ষাটের দশকেই স্বীকৃতি ও পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেন।

বরেণ্য ব্যক্তিত্ব আল মাহমুদ একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক ছিলেন। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, নতুন চেতনায় ও বাক্ভঙ্গিতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। প্রবাসী সরকারের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫০-এর দশকে যে কয়েকজন লেখক বাংলা ভাষা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদ, রাজনীতি, অর্থনৈতিক নিপীড়ন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার বিরোধী আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। স্বাধীনতা- পরবর্তীকালে তিনি দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

সংবাদপত্রে লেখালেখির সূত্র ধরে ১৯৫৪ সালে আল মাহমুদ ঢাকা আগমন করেন। সমকালীন বাংলা সাপ্তাহিক পত্র/পত্রিকার মধ্যে কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী সম্পাদিত ও নাজমুল হক প্রকাশিত সাপ্তাহিক কাফেলা পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে সাংবাদিকতা জগতে পদচারণা শুরু করেন। ১৯৫৫ সাল কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী কাফেলা পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দিলে তিনি সেখানে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি গল্প লেখায় মনোযোগী হন।

১৯৫৪ সাল অর্থাৎ ১৮ বছর বয়স থেকে তার কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা এবং কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, ময়ূখ ও কৃত্তিবাস ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা› পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। মূলত তখন থেকোই তাকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত। লোক লোকান্তর কাব্য (১৯৬৩) সর্বপ্রথম তাকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে জায়গা করে দেয়। এরপর কালের কলস (১৯৬৬), সোনালি কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে উঠো (১৯৭৬) কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে।

১৯৭৫ সালে তার প্রথম ছোটগল্প গ্রন্থ পানকৌড়ির রক্ত প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক পদে নিয়োগ দেন। দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের পর তিনি পরিচালক হন। পরিচালক পদ থেকে ১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার নগরকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপটে ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে তার কবিতায় অবলম্বন করেন। নারী ও প্রেমের বিষয়টি তার কবিতায় ব্যাপকভাবে এসেছে। উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী হিসেবে নারীর যৌনতা, আকাক্সক্ষা ও ভোগের লালসাকে তিনি শিল্পের অংশ হিসেবেই দেখিয়েছেন। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ তার এক অনন্য কীর্তি।

সব্যসাচী লেখক আল মাহমুদ লিখেছেন অনেক সমৃদ্ধ গ্রন্থ। সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় রয়েছে তার সুদীপ্ত পদচারণা। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে- লোক লোকান্তর (১৯৬৩), কালের কলস (১৯৬৬) সোনালী কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৭৬), আরব্য রজনীর রাজহাঁস, বখতিয়ারের ঘোড়া, অদৃশ্যবাদীদের রান্নাবান্না, ঝবষবপঃবফ চড়বসং - অষ গধযসঁফ (১৯৮১), দিনযাপন, দ্বিতীয় ভাঙ্গন, একটি পাখি লেজ ঝোলা পাখির কাছে ফুলের কাছে, আল মাহমুদের গল্প, গল্পসমগ্র, প্রেমের গল্প, যেভাবে বেড়ে উঠি, কিশোর সমগ্র, কবির আতœবিশ্বাস কবিতাসমগ্র, কবিতাসমগ্র-২, পানকৌড়ির রক্ত, সৌরভের কাছে পরাজিত, গন্ধ বণিক ময়ূরীর মুখ, না কোন শূন্যতা মানি না, নদীর ভেতরের নদী, পাখির কাছে , ফুলের কাছে, প্রেম ও ভালোবাসার কবিতা, প্রেম প্রকৃতির দ্রোহ আর প্রার্থনা কবিতা, প্রেমের কবিতা সমগ্র, উপমহাদেশ, বিচূর্ণ

আয়নায় কবির মুখ, উপন্যাস সমগ্র-১
উপন্যাস সমগ্র-২, উপন্যাস সমগ্র-৩
তোমার গন্ধে ফুল ফুটেছে (২০১৫),
ছায়ায় ঢাকা মায়ার পাহাড় (রূপকথা),

 

ত্রিশেরা, উড়াল কাব্য, এ গল্পের শেষ নেই শুরুও ছিল না, (মহাকাব্য), একচক্ষু হরিণ প্রভৃতি।
সার্থক লেখক জীবনে তিনি বেশ কিছু পুরষ্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৮), জয় বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), হুমায়ুন কবীর স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭২), জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭২),

কাজী মোতাহার হোসেন সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৬), কবি জসীম উদদীন পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৬), নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯০) ভানুসিংহ সম্মাননা পদক (২০০৪), লালন পুরস্কার (২০১১), বাসাসপ কাব্যরতœ (২০১৭) ইত্যাদি।

২০১৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ৮২ বছর বয়সে ঢাকায় ধানম-ির ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি নিউমোনিয়াসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। আমরা বরেণ্য ব্যক্তিত্ব আল মাহমুদের স্মৃতির প্রতি সতত শ্রদ্ধা জানাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যতদিন বাংলা সাহিত্য থাকবে... ততদিন আল মাহমুদ থাকবেন কাল থেকে কালান্তরে।। অগণিত পাঠকের হৃদয় থেকে হৃদয়ে।


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প
গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪ : সাহিত্য সংস্কৃতি ভাবনা
প্রার্থনার মূল কাজ সংযোগ স্থাপন
গ্রাফিতি বাংলাদেশ
তোমাকে
আরও

আরও পড়ুন

ভিলনিয়াস বিমানবন্দরের কাছাকাছি মালবাহী বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ১

ভিলনিয়াস বিমানবন্দরের কাছাকাছি মালবাহী বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ১

মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের দিকে যাচ্ছে কবি নজরুল-সোহরাওয়ার্দীর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা

মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের দিকে যাচ্ছে কবি নজরুল-সোহরাওয়ার্দীর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা

বড়লেখায় পুত্রের কুড়ালের আঘাতে প্রাণ গেলো বৃদ্ধ পিতার

বড়লেখায় পুত্রের কুড়ালের আঘাতে প্রাণ গেলো বৃদ্ধ পিতার

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি

ঋণের প্রলোভনে শাহবাগে লাখো মানুষের সমাবেশের চেষ্টা, এরা কারা

ঋণের প্রলোভনে শাহবাগে লাখো মানুষের সমাবেশের চেষ্টা, এরা কারা

পাকিস্তানে পুলিশের সাথে ইমরান খানের সমর্থকদের ব্যাপক সংঘর্ষ

পাকিস্তানে পুলিশের সাথে ইমরান খানের সমর্থকদের ব্যাপক সংঘর্ষ

ঢাকায় আসার পথে ৩৬ নারী-পুরুষকে পুলিশ হেফাজতে

ঢাকায় আসার পথে ৩৬ নারী-পুরুষকে পুলিশ হেফাজতে

রামগতি কমলনগরে ১২ যাত্রীবাহী বাস আটকে দিল স্থানীয়রা!

রামগতি কমলনগরে ১২ যাত্রীবাহী বাস আটকে দিল স্থানীয়রা!

দুবাইতে নির্মাণ হচ্ছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টাওয়ার বুর্জ আজিজি

দুবাইতে নির্মাণ হচ্ছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টাওয়ার বুর্জ আজিজি

আজও সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন রিকশাচালকরা

আজও সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন রিকশাচালকরা

প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ে হামলার চেষ্টা

প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ে হামলার চেষ্টা

বুবলির জন্মদিনে অপুর টয়লেটীয় শুভেচ্ছা,সোশ্যাল মিডিয়ায় কটাক্ষের ছড়াছড়ি

বুবলির জন্মদিনে অপুর টয়লেটীয় শুভেচ্ছা,সোশ্যাল মিডিয়ায় কটাক্ষের ছড়াছড়ি

কচুয়ায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে লুন্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

কচুয়ায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে লুন্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

পঞ্চগড়ে মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা

পঞ্চগড়ে মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা

ভারত বাংলাদেশকে কলোনী বানিয়েছিল: আহমেদ আযম খান

ভারত বাংলাদেশকে কলোনী বানিয়েছিল: আহমেদ আযম খান

বিশ্বের দীর্ঘতম চালকবিহীন মেট্রোর যাত্রা শুরু করছে রিয়াদ মেট্রো

বিশ্বের দীর্ঘতম চালকবিহীন মেট্রোর যাত্রা শুরু করছে রিয়াদ মেট্রো

রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্যালিন জর্জেস্কুর অপ্রত্যাশিত সাফল্য

রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্যালিন জর্জেস্কুর অপ্রত্যাশিত সাফল্য

সাবেক আইজিপি মামুন ফের ৩ দিনের রিমান্ডে

সাবেক আইজিপি মামুন ফের ৩ দিনের রিমান্ডে

ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের আদেশ স্থগিত চেয়ে আবেদন

ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের আদেশ স্থগিত চেয়ে আবেদন

ফারাক্কার অভিশাপ : কমে যাচ্ছে নদীর পানি, ভবিষ্যৎ কী?

ফারাক্কার অভিশাপ : কমে যাচ্ছে নদীর পানি, ভবিষ্যৎ কী?