আহমদ ছফা : বৈচিত্র্যময় জীবন ও সাহিত্য
২৪ আগস্ট ২০২৩, ০৯:১৫ পিএম | আপডেট: ২৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৬ এএম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে আমার অবসরের অধিকাংশ সময় কাটতো শাহবাগস্থ কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে। বলা-ই বাহুল্য পাঠ্যবইয়ের বাইরে গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস ইত্যাদি পড়া আমার পারিবারিক ঐতিহ্য। অত:পর ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা। একটা সময় গল্প কিংবা উপন্যাস পড়তে পড়তে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যেতাম। সেই আমি একদিন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে একটি বইয়ের শিরোনাম দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। হ্যা প্রিয় বন্ধুরা... বইটির নামে অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী। লেখক আহমদ ছফা। সাথে সাথেই পড়া শুরু করে দিলাম। বইটি যদিও আত্মজীবনীমূলক, তবুও আমার বিস্ময়ের সীমা পরিসীমা ছিলো না। পুরো বইয়ের গতর জুড়ে জীবন বোধ এবং দশর্ন একাকার হয়ে আছে! এরপরেও বইটি আমি আরও কয়েকবার পড়েছি...যতবার পড়েছি, ততবারই আরও পড়ার আগ্রহ বেড়েছে। কথাসাহিত্যে রূপ, রস, গন্ধ এবং স্পর্শের এ যেন এক দুর্দান্ত মিশেল।
সেই প্রখ্যাত কথাশিল্পী আহমদ ছফার জন্ম ৩০ জুন ১৯৪৩ এবং মৃত্যু ২৮ জুলাই ২০০১। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবী। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ও সলিমুল্লাহ খান সহ আরো অনেকের মতে, মীর মশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলিম লেখক হলেন এই আহমদ ছফা। তার লেখায় বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে।
বাংলা সাহিত্যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পরে এতো স্বাধীনচেতা এবং প্রতিবাদী পুরুষ আর কেউ আছে বলে আমার জানা নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে তাঁর রচিত বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২) প্রবন্ধ গ্রন্থে তিনি বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের মানচিত্র অঙ্কন করেছেন এবং বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদিতার নগ্ন রূপ উন্মোচন করেছেন এবং বুদ্ধিজীবীদের সত্যিকার দায়িত্বের স্বরূপ ও দিকনির্দেশনাসহ বর্ণনাপূর্বক বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের কী দুর্দশা হতে পারে সেই সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন এ ছাড়াও তিনি তার বিখ্যাত বাঙালি মুসলমানের মনগ্ধ (১৯৭৬) প্রবন্ধে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের হাজার বছরের বিবর্তন বিশ্লেষণপূর্বক তাদের পশ্চাদগামিতার কারণ অনুসন্ধান করেছেন। আনিসুজ্জামান ও সলিমুল্লাহ খানসহ আরো অনেকে ছফার বাঙালি মুসলমানের মন প্রবন্ধ সংকলনটিকে বাংলা ভাষায় রচিত গত শতাব্দীর সেরা দশ চিন্তার বইয়ের একটি বলে মনে করেন।
আহমদ ছফা রচিত প্রতিটি উপন্যাসই তার ভাষার সৌকর্য, বিষয়বস্তু ও রচনাশৈলীর অভিনবত্বে অনন্য এবং অতুলনীয়। তিনি মন, মনন, মানসিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিকসহ প্রতিটি বিষয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুষঙ্গসহ চরিত্র সৃষ্টির তথা কাহিনি কথনের অসামান্য পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। আবুল ফজল ও আরো অনেকের মতে, আহমদ ছফার ওঙ্কার (১৯৭৫) বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বোত্তম সাহিত্যিক বহিঃপ্রকাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে রচিত গাভী বিত্তান্ত (১৯৯৫) বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাসগুলোর অন্যতম। পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ-এ (১৯৯৬) ছফা ঢাকা শহরের প্রেক্ষিতে ফুল, পাখি, বৃক্ষ তথা বৃহৎ প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্কের এক নিজস্ব বয়ান হাজির করেছেন। যা অদ্যাবধি অন্য লেখকের লেখায় বিরল।
আহমদ ছফা ও তার সাহিত্যকর্ম অসংখ্য লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার ও বুদ্ধিজীবীদেরকে অনুপ্রাণিত করেছে; তাঁদের মাঝে অন্যতম হলেন হুমায়ূন আহমেদ, ফরহাদ মজহার এবং সলিমুল্লাহ খান প্রমুখ বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ। আহমদ ছফা প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী এবং দার্শনিক হিসাবে বিবেচিত।
যদিও জীবিতকালে আহমদ ছফা তার প্রথাবিরোধিতা, স্পষ্টবাদিতা, স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গির জন্য লেখক ও বুদ্ধিজীবী মহলে বিশেষ আলোচিত ও বিতর্কিত ছিলেন। জীবদ্দশায় অনেকে তাকে বিদ্রোহী, বোহেমিয়ান, উদ্ধত, প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাহীন ও বিতর্কপ্রবণ বলে অভিহিত করেছেন। শুধু এখানেই শেষ নয়, প্রতিষ্ঠান বিরোধী মনোভাবাপন্ন আহমদ ছফা ১৯৭৫ সালে লেখক শিবির পুরস্কার ও ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমির সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।আরও শোনা যায়, তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ডাকেও সাড়া না তার সাথে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তবে ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সাহিত্যে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করেন।
আহমদ ছফার ব্যক্তিগত জীবনও কম বৈচিত্র্যময় নয়। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় পিতার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে নিজের গ্রামের নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় সুধাংশু বিমল দত্তের মাধ্যমে কৃষক সমিতি-ন্যাপ বা তৎকালীন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন। মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অণুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা কয়েকজন বন্ধু মিলে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন উপড়ে ফেলেন। পরে গ্রেপ্তার এড়াতে কিছুকাল পার্বত্য চট্টগ্রামে আত্মগোপন করেন। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন; একই বৎসরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। যদিও পরে বাংলা বিভাগে ক্লাশ করা অব্যাহত রাখেননি। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে এমএ পরীক্ষা দেয়ার আগেই বাংলা একাডেমির পিএইচডি গবেষণা বৃত্তির জন্য আবেদন করেন এবং তিন বছরের ফেলোশিপ পান। গবেষণার বিষয় ছিল ‘১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব, বিকাশ, এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব’। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে পিএইচডি অভিসন্দর্ভের জন্য জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসেন। দীর্ঘকাল তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে প্রাইভেটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষা দেন। ১৯৭১ সালে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ গঠন ও এর বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় অংশ নেন। ৭ই মার্চ ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা’ হিসেবে ্রপ্রতিরোধগ্ধ প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এপ্রিল মাসে কলকাতা চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সেখান থেকে দাবানলগ্ধ নামের পত্রিকা সম্পাদনা করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে ফিরে লেখালেখি করতে থাকেন।
১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সহায়তায় কাঁটাবন বস্তিতে ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র’ চালু করেন। পরে ১৯৮৬-তে জার্মান ভাষার ওপর গ্যেটে ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রিও লাভ করেন তিনি, যা তাঁকে পরবর্তী সময়ে গ্যেটের অমর সাহিত্যকর্ম ফাউস্ট অনুবাদে সহায়তা করেছিল। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জুলাই অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা শেষে মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের পাশে বিশ হাজার টাকা চাঁদা তুলে জায়গায় কিনে তাকে দাফন করা হয়।
সংগ্রামী চেতনা, আপোষহীন মনোভাবর এবং জীবন ঘনিষ্ঠ সাহিত্যের জন্য সারাজীবন অকৃতদার এই মানুষটি আজও অগণিত পাঠকের হৃদয়ে বেঁচে আছেন এবং বেঁচে থাকবেন। আমরা তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্যই তার লেখা বেশি বেশি পাঠের প্রয়োজন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
মানসিক সুস্থতায় কর্মবিরতি