রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ও প্রকৃতি
১০ মে ২০২৪, ১২:১৫ এএম | আপডেট: ১০ মে ২০২৪, ১২:১৫ এএম
হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যে দিগন্ত বিস্তারী হিরন্ময় সৃষ্টি প্রতিভা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির রূপ-বৈচিত্র ও নানা রস রহস্যের কবি। প্রকৃতিকে এত গভীরভাবে অন্তরে ও বাহিরে উপলব্ধি আর কেউ কখনো করেন নি। বাংলা সাহিত্যের যে কয়টি অঙ্গনে রবীন্দ্রনাথের সার্থক পদচারণা রয়েছে তার মধ্যে একটি সফল দিক হল ছোটগল্প। আধুনিক মানব চৈতন্যের সমুদ্র বিস্তৃত বিসঙ্গতি ও বিপর্যয়, অন্তরগূঢ় বেদনা ও উজ্জ্বল আশাবাদ এসব প্রবণতা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে উনবিংশ শতাব্দীতে নতুন শিল্প আঙ্গিক রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে ছোটগল্প। যার রূপকার রবীন্দ্রনাথ নিজেই। মূলত রেনেসাঁস উত্তর কালের উদ্ভূত পুঁজিবাদী সমাজের বহুমাত্রিক জটিলতা গল্পের বিষয় বিন্যাসে স্থান পেয়েছে, পেয়েছে চরিত্র সৃষ্টি ও প্রকৃতির নিবিড় মেলবন্ধন। রবীন্দ্র ছোটগল্প সাধারণ জীবনপ্রধান। মানুষের জীবন জিজ্ঞাসা, আবেগ, অভিমান আত্মবলিদান এবং মানব হৃদয়ের রহস্য উন্মোচন করেছেন নিঁখুতভাবে। তিনি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ গল্পের বিষয়বস্তুতে তুলে ধরেন নি। আঁকেন নি মধ্যবিত্ত জীবনের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং মূল্যবোধের সংকটের ছবি। বরং তিনি প্রকৃতির একান্নবর্তী সংবেদনশীল চরিত্রসমূহের মনোময় অন্তর্জগৎকে উন্মোচনের পাশাপাশি বেদনা ও সংবেদনের রূপ দেখিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথকে নিজেই তার গল্প সম্পর্কে বলেছেন ‘একটু একটু করে লিখছি এবং বাইরের প্রকৃতির সমস্ত ছায়া আলোক বর্ণ ধ্বনি আমার লেখার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। আমি যেসব দৃশ্যলোক ও ঘটনা কল্পনা করছি, তারই চারদিকে এই রৌদ্র-বৃষ্টি, নদীরস্রোত এবং নদীতীরে শরবন, এই বর্ষার আকাশ, এই ছায়া বেষ্টিত গ্রাম, এই জলধারা প্রফুল্ল শস্যের ক্ষেত ঘিরে দাঁড়িয়ে তাদের সত্যে ও সৌন্দর্যে সজীব করে তুলছে।’
রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির নিজস্ব নগ্ন সৌন্দর্য ও অনির্বচনীয় মাধুর্য এমন সুক্ষভাবে তুলে ধরেছেন যে তিনি ছোট গল্পের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রকৃতি দেখেন ।
রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের চরিত্রগুলো প্রকৃতিকে আবেষ্টন করে আছে। এখানে প্রকৃতিই প্রধান চরিত্র। ‘মিট মিট করিয়া প্রদীপ জ্বলিতে লাগিল এবং এক স্থানে ঘরের জীর্ণ চাল ভেদ করিয়া একটি মাটির সরার উপর টপ টপ করিয়া বৃষ্টির জল পড়িতে লাগিল।’ প্রকৃতির এই প্রতীকী উপস্থাপনা যেন রতনের হৃদয়ের রক্তক্ষরণের চিত্র। আবার, পোস্টমাস্টার রতনকে ছেড়ে কলকাতায় যাবার পথে বর্ষার নদীতে বিশেষ পরিবর্তনের আলম্বন বিভাবের চক্র লক্ষ্য করে ‘বর্ষা বিস্ফোরিত নদীধরনীর উচ্ছলিত অশ্রুরাশির মত চারিদিকে ছল ছল করিতে লাগিল, তখন হৃদয়ের মধ্যে অন্তত একটা বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন। একটি সামান্য গ্রাম্য বালিকার করুন মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মকথা প্রকাশ করিতে লাগিল। -- পালে তখন বাতাস পাইয়াছে বর্ষার স্রোত ও খরতর বেগে বহিতেছে, গ্রাম অতিক্রম করে নদী কুলের শ্মশান দেখা যাইতেছে।’
‘জীবিত ও মৃত’ গল্পে কাদম্বিনী যখন শ্মশানে গিয়ে জীবন লাভ করল তখন ইতোমধ্যেই মানবজগতের সবাই তাকে পরিত্যাগ করেছে। কিন্তু প্রকৃতির স্পর্শে সে প্রকৃতির নৈকট্য আত্মীয়তা অনুভব করে যেমনটা রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেলেনথথযমালয়ে বুঝি এইরূপ চির নির্জন ও চিরান্ধকার। তাহার পর যখন মুক্ত দ্বারা দিয়া হঠাৎ একটা ঠান্ডা বাদলার বাতাস এবং বর্ষার ভেকের ডাকের শব্দ কানে প্রবেশ করিল তখন এক মুহূর্তে তাহার এই স্বল্প জীবনের আশৈশব সমস্ত বর্ষার স্মৃতি ঘনীভূতভাবে তাহার মনে উদয় হইল এবং পৃথিবীর সংস্পর্শ সে অনুভব করিতে পারিল। একবার বিদ্যুৎ চমকিয়া উঠিল, সম্মুখে পুষ্করিনী, বটগাছ, বৃহৎ মাঠ এবং তরুশ্রেণী এক পলকে চোখে পড়ে। এটা বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথের প্রায় গল্পই বর্ষার সুরে বাঁধা। তিনি প্রকৃতির খেয়ালে গল্পের দোলাচল গঠিয়েছেন। গল্পে প্রকৃতিই যেন নায়ক।
প্রকৃতির সন্তান রবীন্দ্রনাথ তার জীবন ও বিচিত্র সাধনায় প্রকৃতিকে এক পৃথক স্থান দিয়েছেন। তার ছোটগল্পে বিষয় নির্বাচনেও তা পরিলক্ষিত। কোনো নিছক কিংবা ঠুনকো কিছু তার গল্পে ছিল না।
‘সুভা’ গল্পে আমরা এমনটাই দেখা যায়। সুভা যেন প্রকৃতির অব্যক্ত ভাষা, প্রকৃতি সুভার মধ্যে মানবী রূপ ধারণ করে মানুষের কাছে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তার বর্ণনায় ‘নদীর কলধ্বনি, লোকের কোলাহল, মাঝির গান, পাখির ডাক, তরুর মর্মর - সব মিশিয়া চারিদিকের চলাফেরা আন্দোলন কম্পনের সহিত এক হইয়া সমুদ্রের তরঙ্গ রাশির ন্যায় চিরনিস্তব্ধ হৃদয় উপকূলের নিকট আসিয়া পড়ে। প্রকৃতির এই বিবিধ শব্দ এবং বিচিত্র গতি, ইহাও বোবায় ভাষা।’
‘সমাপ্তি’ গল্পে মৃন্ময়ী প্রকৃতির সহোদরা। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি ও জীবনকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে দেখিয়েছেন । যেখানে মৃন্ময়ী উন্মুক্ত প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠা হরিণ শাবকের মতোই বেগবান। অপূর্বর প্রেম অসফল, ব্যর্থ। তাই সে প্রকৃতির স্পর্শেই যেন তার পূর্ণতা দিতে চাইছে ‘সেই প্রবল প্রেমেরই আগ্রহ কোন এক চাঁদের রাতে রূপকথার মায়ালোকে এনে উত্তীর্ণ করে দিয়েছে এবং তখন বাস্তবের হতাশা বেদনার কবল থেকে অন্তত সাময়িক মুক্তি অর্জন করে অপূর্ব মৃন্ময়ীতে সেই নিন্দ্রিতা রাজকন্যাকে আবিষ্কার করেছে একদিন সে তার প্রেমের স্পর্শে নিশ্চয়ই জাগবে।’
রবীন্দ্রনাথের এই প্রেমের স্পর্শে জেগে ওঠা আরেক গল্প ‘একরাত্রি’। যেখানে প্রেম ও প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আগুনে পতঙ্গ পুড়লেও সে যেমন কেবল আগুনেরই খোঁজ করে তেমনি রাবীন্দ্রিক প্রেমের সর্বৈব প্রকৃতির খোঁজ করে। চিরন্তন সৌন্দর্য আস্বাদনই রবীন্দ্রপ্রকৃতির মূল সুর। প্রেমের নির্যাস এখানে প্রগাঢ়। নিঝুম একটি রাত। প্রকৃতির ওলটপালটে সব কিছু দুমড়েমুচড়ে একাকার। নায়ক আর সুরবালাও একাকার। আমি এই এক রাত্রে মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়াইয়া অনন্ত আনন্দের আস্বাদ পাইয়াছি।
রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির ভাষা বুঝেন। তিনি প্রকৃতির রূপ, সূক্ষ্ম ইঙ্গিত ও অদৃশ্য সংকেতগুলো তার গল্পের উপজীব্য বিষয়। ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পে গিরিবালা ও শশীভূষণের মধ্যে যে আদান-প্রদান, লুকোচুরি খেলা তা যেন মেঘ ও রৌদ্রের ছায়ালোকের মতোই।
নষ্টনীড় গল্পে চারুলতার জীবনের হাহাকার বেদনা আর ক্ষয়িষ্ণু দিনগুলির একমাত্র সখা রূপে প্রকৃতিই এসে পাশে দাঁড়িয়েছে তখন সন্ধ্যা, বারান্দার টপ হইতে জুঁই ফুলের গন্ধ আসিতেছিল। ছিন্ন মেঘের ভিতর দিয়া স্নিগ্ধ আকাশে তারা দেখা যাইতেছিল। আজ চারু চুল বাঁধে নাই, কাপড় ছাড়ে নাই, জানালার কাছে অন্ধকার বসিয়া আছে। মৃদু বাতাসে আস্তে আস্তে তাহার খোলা চুল উড়াইতেছে এবং তাহার চোখ দিয়া এমন ঝরঝর করিয়া কেন জল বহিয়া যাইতেছে তাহা সে নিজেই বুঝতে পারিতেছে না।
‘মধ্যবর্তনী’ গল্পে প্রকৃতির ভূমিকা যেন নিয়তির অমোঘ নির্ণায়ক। হরসুন্দরী যেদিন রোগশয্যা ছেড়ে দুর্বল শরীরে উঠে বসল সেদিন বসন্তকালের দক্ষিণের হাওয়া শুরু হয়। উষ্ণ রাতের চন্দ্রালোকের প্রবেশ হরসুন্দরী আর প্রকৃতির প্রবেশই। শৈলবালার মনের ব্যাথা আর তার সংসার ত্যাগী রিক্ত গোপন বেদনায় অপলক ভাবনাথথ একদিন ঘনঘোর মেঘ আসিয়াছে। এমনি অন্ধকার করিয়াছে যে, ঘরের মধ্যে কাজকর্ম করা অসাধ্য। বাহিরে ঝুপ ঝুপ করিয়া বৃষ্টি হইতেছে। কুলগাছের তলায় লতাগুল্মের জঙ্গলে জলে প্রায় নিমগ্ন হইয়া গিয়াছে এবং প্রাচীরের পার্শ্ববর্তী নালা দিয়া ঘোলা জলস্রোত কলকল শব্দে বহিয়া চলিয়াছে।’
‘ব্যবধান’ গল্পে প্রকৃতি বন্ধুর মত নিরবে পাশে দাঁড়িয়েছে। বনমালীর আনন্দ হিমাংশুর সান্নিধ্য । কোনো একদিন তারা খুব কাছাকাছি একই বেঞ্চে ঠিক তখনই রবীন্দ্রনাথে তুলিতে ‘দক্ষিণের বাতাস গাছে পাতা মর্মরিত করিয়া বহিয়া যাইতো, কোন দিন বা বাতাস বহিত না, গাছপালাগুলো ছবির মত স্থির দাঁড়াইয়া রহিত, মাথার উপরে আকাশ ভরিয়া তারাগুলো জ্বলিতে থাকিত।’
রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টিশীল। তার সৃজনশীল আনন্দের রসসিক্ত সরোবর প্রকৃতির অন্তরীক্ষে ভেসে যায়। রবীন্দ্র ছোটগল্পে প্রকৃতির আবহ এমনভাবে প্রস্ফূটিত মনে হয় তিনি প্রকৃতির আজন্ম লালিত সন্তান। ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পে পাগলা মোহর আলীর চিৎকার ‘তফাৎ যাও’ আকাশে বাতাসে উচ্চকিত হয়ে পাঠকের হৃদয়ে আলম্বন করেছে। রাত্রির নিস্তব্ধতায় অদৃশ সম্মোহনী শক্তিকে পরিব্যাপ্ত করে। গল্পের গভীরে প্রকৃতি আর মানুষের অন্তরতম সংযোগ অতিপ্রাকৃত হিসেবে ধরা দেয়।
প্রকৃতি রহস্যময়। রবীন্দ্রনাথ সে রহস্য উদঘাটনে সফল। তার গল্পগুচ্ছের প্রতিমুহুর্তে প্রকৃতির সেই অজ্ঞাত রূপ, শব্দ, গন্ধ অনির্দেশ্য মাধুরী মিশিয়ে তার রহস্য তুলে ধরেছেন। প্রকৃতির অজানা অংশটুকু জানিয়ে দিয়েছেন। অসম্পূর্ণতাকে সম্পর্ণতা দান করেছেন। প্রকৃতি ও মানবের মাঝে বোধকরি তিনিই প্রঘম সফলভাবে সখ্যতা গড়ে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ সত্যিই এক প্রকৃতিময় বিস্ময়কর নাম।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
নটিংহ্যামকে হারিয়ে চার ম্যাচের জয়খরা কাটালো আর্সেনাল
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের দাবী অত্যন্ত যৌক্তিক
পাঠ্যবই ছাপায় অনিয়মে আনন্দ প্রিন্টার্সকে সতর্কতা
দক্ষিণ লেবাননে ৬ চিকিৎসাকর্মী নিহত
জনগণের সাথে জনসংযোগ বাড়াতে হবে
আমরা যুদ্ধে বিশ্বাসী না কেউ গায়ে পড়লে জবাবের প্রস্তুতি রাখতে হবে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
বাফুফের নতুন সভাপতি তাবিথের কাছে ২৭ রেফারির চিঠি
ফের বাড়লো সোনার দাম, ভরি ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা
বাংলাদেশে খেলা নিয়ে অনিশ্চিয়তায় হামজা!
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই হবে অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফের খেলা
সিলেটে মাজিদের ফিফটি
অ্যাম্বাসেডর কাপ উশুতে সেনাবাহিনী চ্যাম্পিয়ন
মাদক শুধু ব্যক্তিকে নয় পরিবারকেও ধ্বংস করে
সাধারণ মানুষের পেটে লাথি মেরে আ.লীগ নিজেদের ভাগ্য গড়েছে : এমরান সালেহ প্রিন্স
ধর্মদ্রোহী সরকারের সময় কোনো ধর্মই নিরাপদ ছিল না
দৌলতখানে শীতকালীন সবজি পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক
সুন্দরগঞ্জে ছয় পা বিশিষ্ট বাছুরের জন্ম
বৈষম্যের শিকার কুমিল্লার ১৫ হাজার এতিম শিশু
দালালচক্রে জিম্মি রোগীরা
ঝুঁকিপূর্ণ বাঁশের সাঁকোই সাটুরিয়ার শিশু শিক্ষার্থীদের ভরসা