কবিতার বাঁক বদল এবং নতুন ধারা
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১০ এএম | আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১০ এএম
(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
কাল বিবর্তনে আমরা দেখি খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫ সালের দিকে ইংরেজি সাহিত্য অর্থাৎ অ্যাংলো-স্যাক্সন ও অ্যাংলো-নর্ম্যান যুগে স্যাক্সনদের রচিত কিছু কাব্য-কবিতা (যার মাঝে ‘বিউলফ’ অন্যতম) দিয়ে পৃথিবীতে সাহিত্যের যাত্রা শুরু হলেও বাংলা সাহিত্যের শুরু তারও অনেক পরে। হাজার বছরের পুরনো বাংলা সাহিত্যের সূত্রপাত আনুমানিক খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ ৯৫০-১২০০। ড. শহীদুল্লাহর মতে তা ৬৫০-১২০০। ’চর্যাপদ’ এই যুগের প্রথম গ্রন্থ হিসেবে একমাত্র নিদর্শন, যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলে বৌদ্ধ সহজিয়াদের সাধন সঙ্গীত ও গীতিকাব্য। ১২০১-১৩৫০ সময়কালকে অন্ধকার যুগ বলা হয়। এরপর ১৩৫০-১৮০০ এই যুগটিকে মধ্যযুগ (পাঠান-মোঘল যুগ) বলে অভিহিত করা হয়। এ যুগে সাহিত্যের এক বিশিষ্ট শাখা মঙ্গলকাব্য আর এর বিষয় ছিল দেব-দেবীর মহিমাকীর্তন ও পূজা প্রতিষ্ঠার কাহিনিনির্ভর আখ্যান। ১৮০০ সালের পর থেকে কথিত আধুনিক যুগের শুরু। আধুনিক যুগকে আবার তিনটি উপ-যুগ বিভাজন করা হয়, যা বাংলা সাহিত্য যুগ-পুরুষের নামানুসারে রামমোহন-বিদ্যাসাগর যুগ (১৮০০-১৮৫৮), মধুসূদন-বঙ্কিম যুগ (১৮৫৯-১৮৯৩), রবীন্দ্র যুগ (১৮৯৪-১৯৪২) যা হলো আধুনিকতার প্রস্তুতিপর্বকাল বলেই ধরা হয়। এরপরে স্বকীয় দর্শনে, চিন্তা ও মননে স্বমহিমায় আসে নজরুল যুগ। নতুন নতুন শব্দের ব্যবহারে গণমুখী ভাবনায় লৈঙ্গিক বৈষম্য, বিষয়ের ভিন্নতা, ধর্মীয় মিথকে উপজীব্য করে লিখলেন সাড়া জাগানো সব কবিতা, গান, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস। ১ এভাবে আমরা মোটামুটি বাংলা সাহিত্যের যুগ চিন্তা করে থাকি। কতিপয় উদাহরণের মাধ্যমে এসব যুগের কাব্য শৈলী তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো-
শরীরের গাছে পাঁচখানি ডাল-
চঞ্চল মনে ঢুকে পড়ে কাল।
..লুই বলে, ক’রে অনেক ধ্যান
দেখেছি. লভেছি দিব্যজ্ঞান।
(চর্যা-লুই)
কর্মে জন্ম, নাকি সে জন্মে কর্ম?
সরহ বলেন, বড়ই ঘোরালো ধর্ম
(চর্যা- সরহ)
প্রাচীন চর্যাপদকে ডিঙ্গিয়ে মধ্যযুগে এলো অন্নদামঙ্গল কাব্য, সেখানে দেখা যায়-
‘আমারে শঙ্কর দয়া কর হে
শরণ লয়েছি শুনি দয়া কর হে
তুমি দীনদয়াময় আমি দীন অতিশয়
তবে কেন দয়া নয় দেখিয়া কাতর হে।’
এ যুগে সাহিত্য অনেক ব্যাপক এবং বিস্তৃত। এর গতি প্রকৃতিও বিচিত্র ধরনের। মূলে ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বিষয়। যুগসন্ধির কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মৃত্যুর পর মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) উনিশ শতকে এসে সাহিত্যে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগের যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তন ঘটে ঐতিহাসিকগণ একে নবজাগৃতি বা রেনেসাঁ আখ্যা দিয়েছেন। এই শতকের শেষভাগ থেকে বিশ শতকের অনেকটা সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একচ্ছত্র অধিপতি। পরপর সাহিত্যকে নতুনরূপে, নতুন আঙ্গিকে সাজালেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২), মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), জসীম উদদীন (১৯০২-১৯৭৬) প্রমুখ কবিগণ।
বাংলা সাহিত্যে অষ্টাদশ শতকের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর এর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মধ্যযুগীয় প্রভাবের সমাপ্তি ঘটে। তাঁর কাব্য ধারার বৈশিষ্ট্যে ছিল আরবি, ফারসি ও হিন্দুস্তানি ভাষার মিশ্রণে আশ্চর্য নতুন এক বাগভঙ্গি ও প্রাচীন সংস্কৃত ছন্দের অনুকরণে বাংলা কবিতায় ছন্দের প্রয়োগ।
‘হিমালয় মেনকা যদ্যাপি দিলা সায়
লগ্নপত্র করিয়া নারদ মুনি যায়’।
(অন্নদামঙ্গলকাব্য/ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর)
তাঁর সেই প্রাচীন বাগভঙ্গি ভেদ করে উনিশ শতকের মাঝামাঝি বাংলা সাহিত্যে যোগ দিল মাইকেল মধুসূদন। নতুন ধারার প্রতিভায় প্রশস্ত রাজপথ। সনেট, অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক সাহিত্যের মোড় ঘোরালেন একাই।
‘অন্নদা! বহিছে শূন্যে সঙ্গীত-লহরী,
অদৃশ্যে অপ্সরাচয় নাচিছে অম্বরে।’
(অন্নপূর্ণার ঝাঁপি/মাইকেল মধুসূদন)
কিন্তু বলা হয় তিনি যে ফল ফলালেন তাতে বীজ ধরল না বলে বিজ্ঞজনেরা অভিমত দিয়ে থাকেন। যেনো লেখা হলো সন্তুষ্টিহীন, ফলে উপযুক্ত বংশাবলী সৃষ্টি তেমন আর করলো না। মিল্টন, ভার্জিল, হোমার প্রভৃতি পাশ্চাত্য কবিদের কাছ থেকে বাংলা সাহিত্য তার সাধনার উৎসাহ কুড়িয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যেও তা আমরা দেখতে পাই।
‘পর্ব্বতশিখরে নাচি, বিষম তরসে
মাতিয়া মেঘের সনে,’
(বায়ু/বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)।
আমরা দেখি আধুনিক যুগের কবিতা ও সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য মানবতা, বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও বিকাশ, সাধু চলিত রীতির প্রচলন, গদ্য ছন্দ প্রচলন প্রভৃতি। কাজী নজরুল ইসলামের বাকরুদ্ধতার মধ্য দিয়ে কল্লোল যুগের শুরুতে ত্রিশের কবিরা নাস্তিক্যবাদ, অস্থিরতা, নৈরাশ্য, হতাশা, একাকীত্বের মতো স্বতন্ত্র ধ্যান ধারণাপুষ্ট বিষয় নিয়ে যখন তুমুল মাতামাতি করছেন তখন প্রেম ও প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ নিয়ে এলেন এক ভিন্ন বিষয়, আমেজ, চিত্রকল্পময় উপমাসমৃদ্ধ অমায়িক সুন্দর কবিতা।
‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?
তারি রথ নিত্য উধাও।
...সব চেয়ে সত্য মোর সেই মৃত্যুঞ্জয়-
সে আমার প্রেম।
...তোমারে যা দিয়েছি সে তোমারই দান,
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু বিদায়।’
(শেষের কবিতা/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
‘নক্ষত্রের চেয়ে আরো নিঃশব্দ আসনে
কোনো এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে।
...নতুন আকাক্সক্ষা আসে-চ’লে আসে নতুন সময়-
পুরানো সে নক্ষত্রের দিন শেষ হয়
নতুনেরা আসিতেছে ব’লে...
(নির্জন স্বাক্ষর/জীবনানন্দ দাশ)
‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়!
..ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর?-প্রলয় নূতন সৃজন বেদন
আসছে নবীন-জীবন-হারা অ-সুন্দরে করিতে ছেদন!...
(প্রলয়োল্লাস/ কাজী নজরুল ইসলাম) (অসমাপ্ত)
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র বৈঠক, হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে আলোচনা থাকবে
রামু সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত
এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ