শহরের ভাঁজে ভাঁজে
২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৮ এএম
ঢাকার একটি পুরোনো আবাসিক এলাকায় রাহাত সাহেবের বাসা। চারতলার এক কোনার ছোট্ট ভাড়া ফ্ল্যাট। তিনটি ছোট ঘর, একটি রান্নাঘর, আর বারান্দা মিলিয়ে এই বাসায় তার পরিবার থাকে। তাদের জীবন মধ্যবিত্তের পরিচিত ছন্দে বাঁধা-সকালের ব্যস্ততা, বিকেলের হিসাব আর রাতের ক্লান্তি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সবকিছু কেমন যেন বদলে গেছে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জীবনযাত্রার ব্যয়, এবং সামাজিক চাপের কারণে রাহাত সাহেবের জীবন যেন একটা অদৃশ্য ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে গেছে। সংসারের প্রতিটি খুঁটিনাটি সিদ্ধান্ত এখন একেকটা যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।
রাহাত সাহেব একজন স্কুলশিক্ষক। প্রতিদিন সকালে ছিমছাম জামা-কাপড় পরে স্কুলে যান, বাচ্চাদের পড়ান, এবং সন্ধ্যার আগে ঘরে ফেরেন। তার মাসিক বেতন ২৫ হাজার টাকা। এই অর্থ দিয়ে মা, স্ত্রী মুনিয়া, এবং মেয়ে রাইসাকে নিয়ে তাদের চারজনের সংসার কোনোমতে চলে। তবে গত কয়েক মাস ধরে সেই চলাটাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
সকালবেলার সূর্যের আলো জানালা দিয়ে ঢুকছে। মুনিয়া রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে চায়ের পানি গরম করছেন। পাশের স্ল্যাবের ওপর রাখা বাজারের থলে দেখে তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। থলেতে খুব বেশি কিছু নেই-এক কেজি চাল, আধা কেজি ডাল, আর অল্প কিছু শাকসবজি।
রাহাত সাহেব তখনো বারান্দায় দাঁড়িয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই। খবরের শিরোনামে বড় বড় অক্ষরে লেখা, “নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়েই চলেছে”।
মুনিয়া রান্নাঘর থেকে ডেকে বলেন,
রাহাত, বাজারের ব্যাগটা দেখেছ? এটা দিয়েই পুরো সপ্তাহ চলবে?
রাহাত সাহেব মুনিয়ার কথার জবাব দিতে পারেন না। তিনি শুধু মলিন মুখে তাকিয়ে থাকেন। এর কোনো সহজ উত্তর নেই। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতি যেন অদৃশ্য এক দানবের মতো প্রতিনিয়ত তাদের গ্রাস করছে।
রাহাত সাহেবের মেয়ে রাইসা মাত্র ছয় বছরের শিশু। সে জানে না, কেন প্রতিদিনকার খাবারের তালিকা কমে আসছে। সে জানে না, কেন তার পছন্দের চকলেট আর কেনা হয় না। দুপুরের খাবারের সময় মুনিয়া রাইসাকে সামান্য ভাত আর একটুকরো ডিম ভুনা দিতে দিতে বলে,
মা, একটু ভালো করে খেয়ে নাও। আমাদের তো রোজ ভালো কিছু খাওয়ার সুযোগ হয় না।
তখন রাইসা বলল,
‘মা, আজ ডাল নেই কেন?’
মুনিয়া একটু কৌতুকের সুরে বললেন,
‘আজ আমরা নতুন কিছু খাচ্ছি। তুমি খেয়ে নাও, মা।’
রাইসার চোখে বিস্ময়। সে ছোট্ট গলায় জিজ্ঞাসা করে,
‘আমাদের বাড়ি কি গরীব, মা?’
মুনিয়া কোনো উত্তর দিতে পারেন না। এই প্রশ্ন যেন তাকে ছুরির মতো কেটে দেয়। সে শুধু মেয়ের মুখে এক চিলতে হাসি ফোটানোর জন্য বলে,
‘না মা, আমাদের বাড়ি ভালো। শুধু আমরা একটু হিসাব করে চলি, তাই না?’
রাহাত সাহেব পাশের ঘরে বসে এই কথাগুলো শোনেন। মেয়ের সরল প্রশ্ন এবং স্ত্রীর মিথ্যে আশ্বাস তার ভেতরে এক অদ্ভুত যন্ত্রণা সৃষ্টি করে।
সন্ধ্যায় রাহাত সাহেব ফিরে আসেন স্কুল থেকে। মুনিয়া তার হাতে চায়ের কাপ তুলে দেয়। রাহাত সাহেব বলে,
‘তোমাকে বলেছিলাম, আরেকটা টিউশনি নেওয়ার চেষ্টা করবো। কিন্তু এখনো কিছু পাইনি।’
মুনিয়া মুখে কিছু বলেন না। তার চোখেমুখে ক্লান্তি আর হতাশা। তিনি শুধু জানেন, তাদের সংসার চালাতে হলে আরও অর্থ দরকার। কিন্তু সেই অর্থের উৎস কোথায়?
রাহাত সাহেব জানে, মধ্যবিত্ত হওয়া মানে এক অদৃশ্য ভার বহন করা। ধনী হওয়ার সাধ্য নেই, কিন্তু দারিদ্র্যের তলানিতে পড়ে যাওয়া মানেও সামাজিক সম্মান হারানো। মধ্যবিত্তের জন্য সবসময়েই থাকে ‘মানিয়ে নেওয়া’।
রাহাত সাহেবের ছোটবেলা ছিল বেশ আনন্দমুখর। গ্রামে কাটানো সেই দিনগুলো ছিল যতেœ মোড়ানো। তার বাবা ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। ছোট্ট চাকরি, সীমিত আয়, কিন্তু তখনকার দ্রব্যমূল্য এমন ভয়ংকর ছিল না।
তখন ১০ টাকায় পুরো বাজার হয়ে যেত, ‘রাহাত মাঝে মাঝে মুনিয়াকে বলেন।
কিন্তু সময় বদলেছে। এখন আর সেই দিন নেই। এখনকার ১০ টাকার মূল্য যেন ১ টাকার সমান। রাহাত সাহেব জানেন, এই তুলনা শুধুই সংখ্যা নয়; এর ভেতর আছে তাদের পরিবারের সংগ্রামের চিত্র।
সন্ধ্যার আলো ম্লান হয়ে আসছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাহাত সাহেব ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা হাতে নিয়ে দূরে তাকিয়ে আছেন। পাশের বস্তিতে ছোট ছোট ঘরগুলো থেকে মৃদু আলো বের হচ্ছে। সেখানে মানুষগুলোও কষ্ট করে বেঁচে আছে।
রাহাত সাহেব হঠাৎ এক দৃশ্য দেখেন। বস্তির কিশোর রুবেল তার ছোট ভাইয়ের হাত ধরে আছে। এক হাতে বিস্কুটের প্যাকেট। দুজনেই হাসিমুখে বিস্কুট ভাগ করে খাচ্ছে।
রাহাত সাহেব অবাক হন। রুবেলদের জীবন আরও কঠিন। তবুও তারা হাসছে। তাদের মধ্যে কোনো আক্ষেপ নেই।
এই দৃশ্য রাহাত সাহেবের ভেতরে এক অদ্ভুত শক্তি সঞ্চার করে। তিনি ভাবেন,
‘আমাদের যা আছে, তা নিয়ে যদি সন্তুষ্ট হতে পারি, তাহলে জীবনের ভারটা একটু হলেও হালকা হবে।’
রাতের খাবার খাওয়ার সময় মুনিয়া রাহাত সাহেবকে বলে,
‘চিন্তা বাদ দাও। যা আছে, তাই দিয়ে আমাদের সুখী থাকতে হবে। বাজারের চাপে যদি আমরা ভেঙে পড়ি, তাহলে তো মেয়েটার ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে যাবে।’
রাহাত সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসেন। সেই হাসির পেছনে লুকিয়ে থাকে দিনের পর দিনের সংগ্রামের ক্লান্তি। কিন্তু সেই সঙ্গে থাকে এক নতুন আশার আলো।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ব্রাজিলে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৩২
নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ সিরিয়ায়
ঘনকুয়াশায় ৩ ঘন্টা পর আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালু
গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে
কনসার্ট মঞ্চে স্বৈরাচার হাসিনার বিচার দাবি
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত আরও ১৪ ফিলিস্তিনি
ঘনকুয়াশায় আরিচা-কাজিরহাট, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ
আওয়ামী লীগ যা করেছে, বিএনপি তার বিপরীত কাজ করে সুন্দর সমাজ গড়বে: ইয়াকুব চৌধুরী
রোমাঞ্চকর ম্যাচে বার্সাকে হারিয়ে শীর্ষে আতলেটিকো
জেসুসের জোড়া গোলের রাতে আর্সেনালের বড় জয়
বিলুপ্তির পথে মাটির ঘর
চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ
প্রতিবন্ধী স্কুল শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ
কেরু চিনিকলে আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন
বিহারিরা কেমন আছে
লক্ষ্মীপুরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি
আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
মেটলাইফ বাংলাদেশের গ্রাহকরা ডিসকাউন্ট পাবেন ওশান প্যারাডাইস হোটেলস ও রিসোর্টে
১৫ নারী ও শিশুকে হস্তান্তর
আবাসন ও গার্মেন্ট খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে