‘ময়মনসিংহের চাঁদ লালকুঠি পাক দরবার
১৫ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৫ এএম
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত সাধক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সাহিত্য বিশারদ শাহ্সুফি মাওলানা খাজা ছাইফুদ্দীন (র.) প্রসঙ্গে। তিনি শায়িত আছেন, ময়মনসিংহ সদরের অদূর শম্ভূগঞ্জ এলাকায়। ময়মনসিংহ ঢাকা বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা। এ জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হিমালয় পবর্ত হতে বয়ে আসা নদ-নদী; তন্মধ্যে- পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র নদ, যমুনা অন্যতম। তৎকালীন সময়ে নদীপথের দাঁড় টানা নৌকা আর পালতোলা নৌকা ছিলো যাতায়াত, পণ্য পরিবহণ, জেলেদের মাছ ধরা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম মাধ্যম। ব্রিটিশ কোম্পানী গুলো এ নদের তীরে গড়ে তুলেছিলো নানান ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তন্মধ্যে, লালকুঠি ছিলো পাট শিল্পের প্রধান কার্যালয়; এটি ১৯২২ সালে বৃটিশ ডেভিড কোম্পানী কর্তৃক নির্মিত। প্রায় একচল্লিশ বছরের মাথায় এ দালানটি রূপ নেয়, অধ্যাত্মিক শরাফতের রাজধানীতে। পরবর্তীতে এখান থেকে আল্লাহ তা’আলার নূরের নূরানিয়াত ছড়িয়ে পড়ে বিশ^ব্রহ্মান্ডে। যে মানুষটি ধর্মের আলোর মশাল নিয়ে এ অসাধারণ কাজটি নিপুণতার সাথে সমাধা করেছেন; তিনি বিংশ শতাব্দীর চিন্তাবিদ, বিশ্লেষক, দার্শনিক, গবেষক, প্রথিতযশা লেখক, প্রবন্ধকার, গাউছুল জীনসে ওয়াল ইনসে, শাহেন শাহে তরিক্বত শাহ্সুফি মাওলানা খাজা ছাইফুদ্দীন নক্সবন্দি-মুজাদ্দেদি। মারেফত জগতের এ কিংবদন্তি ৭ জানুয়ারী ১৯২০ ইং, বুধবার, বিকেল ৪-৫ ঘটিকায়; যমুনা নদীর তীরবর্তী এনায়েতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা খাজা মাওলানা শাহ্সুফি ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী; তিনি বাংলা ও ভারতের মারেফত জগতের মহাসূর্য। মা গোলেনূর ছিলেন গৃহিণী। শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের প্রথম সময় কাটান নিজ গ্রামে। অবকাশ যাপনে মাঝেমাঝে বেড়াতে যেতেন কলকতার নিজ বাড়ীতে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং বি.এ পাশ করেন সিরাজগঞ্জে। ধর্মীয় পাঠ শিক্ষা নেন, মাও. নেয়ামত উল্লাহ (রহ.)’র কাছ থেকে। তরিক্বতের তালিম নেন, পরম মমতার আশ্রয়স্থল বাবা শাহ্সুফি খাজা মাওলানা ইউনুস আলী এনায়েতপুরী (র.)’র নিকট থেকে। এ দুই ধারার জ্ঞান ছাড়া-ও তিনি ছিলেন ইলমে আ’তায়ি বা ইলমে লাদুন্নির অধিকারী। এজন্য জ্ঞানীরা তাঁকে ‘বাহরুল উলুম’ হিসেবে সম্বোধন করতেন। তিনি বেলায়াতের অফুরন্ত নিয়ামত অর্জন করে আল্লাহ প্রদত্ত আরো অধিক ঐশী জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত হয়ে পিতার যাবতীয় অধ্যাত্মিক মূল্যবান সম্পদের অধিকারী হয়ে খেলাফত লাভ পূর্বক কামেল মোকাম্মেল পীরের উচ্চাসনে সমাসীন হন। তিনি পড়াশুনা, অধ্যবসায়, চাকুরী, ব্যবসা; সর্বোপরি ধর্ম প্রচারসহ মানবতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে নিজকে প্রতিষ্ঠা করেছন এ জগৎ সংসারে। তাঁর অনুকরণীয় চরিত্র সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- যুহুদ, তওবা, তাক্বওয়া, শোকর, ছবর, তাওয়াক্কুল, খওফ, রেজ¦া, ইয়াক্বীন, ইবাদাত, জিকিরে এলাহি, জিকিরে রাসূল (দ.), এখলাছ, তাছলীম, তাকমীলুল ইয়াক্বীন, আযিযি, ইন্তেজারি, আদব, সাধনা, ন¤্রতা, ভদ্রতা, পরোপকারিতা, বিনয়ীতা, শ্রদ্ধা, ভক্তি, মেহমানদারিতা, মুহাব্বত, দান-খয়রাত, মানবতা, সৃষ্টির প্রতি প্রেম। প্রকৃত অর্থে- আল্লাহর জিকির এবং নবীয়ে পাক (দ.)’র দরুদ; মুমিনের রূহের খোরাক। এ জিকিরদ্বয়ে অবিশ্রান্ত থাকত তাঁর জবান এবং ক্বলব। তাঁর লিখিত বই ‘আদর্শ মুর্শিদ’র পান্ডুলিপি দেখে, পিতা বলেছিলেন, ‘খাজা ছাইফুদ্দীন ইলমে মারিফতের দরিয়া মন্থন করে আউলিয়া হয়ে গেছে; তাঁর আত্মা আর রাসূলুল্লাহ (দ.)’র আত্মা একাত্মা হয়ে মিশে গেছে’। সুন্নতে নববীর এ মহান প্রতিচ্ছবি ১৯৪৮ সালে ২১ ই এপ্রিল সৌভাগ্যবতী রমণী জীবন্নেছা বেগমের সাথে শুভ পরিণয়ে আবদ্ধ হন। এ গুণবতী রমনীর পবিত্র কোল আলোকিত করে জন্ম নেয়, জগৎ সেরা ছয়জন স্ব-শিক্ষিত ও সাধক পুরুষ আর দুইজন মহীয়সী কন্যা। তাঁরা স্ব-স্ব স্থানে সুপ্রতিষ্ঠিত ও আলোকিত। ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর, রাত ২ টার সময় ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে পৈত্তিক জন্ম ভিটা ছেড়ে স্ব-পরিবারে ময়মনসিংহ সদরের অদূর শম্ভূগঞ্জের লালকুঠিতে চলে আসেন। তিনি ছিলেন ধৈর্য ও ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত মহাপুরুষ। সেকালে ময়মনসিংহ জেলার- ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থা ছিলো খুবই নাজুক। এ মহাত্মার আগমনে চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ নানা জায়গার মানুষের উপচে পড়া ভীড় জমে শম্ভুগঞ্জে। তরিকত বিদ্বেষীদের নির্যাতন আর সমালোচনাকে শক্তিতে রূপ দিয়ে মারিফতের সত্য নিগূঢ় দর্শন কে ছড়িয়ে দেন বিশ^ দরবারে। তরিকত প্রচারের জন্য তিনি চষে বেড়িয়েছেন বাংলা ও ভারতের নানান স্থানে। তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে শতশত নর-নারী জ¦ীন-ইনসান পেয়েছে সিরাতুল মুস্তাকিমের দিশা। আল্লাহর অলিরা ভয় কে জয় করে। কারণ কোরানে বলা হয়েছে, ‘‘আল্লাহ তা’আলা মুমিনদের অভিভাবক’’। মহান মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশলক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পাওয়া লাল-সবুজের পতাকা। এ স্বাধীনতার সাথে জড়িয়ে আছে হাজারো পীর-আউলিয়ার রক্ত ঝড়া ইতিহাস। তন্মধ্যে খাজা ছাইফুদ্দীন (র.)’র অবদান অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য দিন-রাত আল্লাহর দরবারে তাঁর ফরিয়াদ ছিলো নিরন্তর। তিনি মুক্তিকামী মানুষদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরার নির্দেশ দেন এবং সংগঠিত করেন। এ সংবাদ পাক-হানাদার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর কানে পৌঁছলে; তারা আক্রমণাত্মকভাবে ১৯৭১ সালে ১৭ ই এপ্রিল লালকুঠি দরবারের চারিপার্শ্বে গোলাবর্ষণ শুরু করে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে পুরো দরবার শরীফ এলাকা ছিলো রক্ষিত। ১৯৬৪ সাল। লালকুঠি দরবার শরীফের ওরছ মাহফিল। অসংখ্য জাকেরানের পদচারণায় মুখরিত দরবার শরীফ। একই দিনে ময়মনসিংহ শহরের সার্কিট হাউজ মাঠে ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খানের জনসভা। জনসভায় লোক কম হওয়র কারণ হিসেবে খাজা হুজুর কে অভিযুক্ত করলে; আইয়ুব খান, সি.আই.ডি পরিদর্শককে ঘটনা তদন্ত করতে নির্দেশ দেন। সি.আই.ডি পরিদর্শক হুজুর কেবলার সাথে সাক্ষাৎ করে ঘটনার সত্যতা যাচাই পূর্বক; হুজুর কেবলা ও পবিত্র অনুষ্ঠানের কথা জানালে আইয়ুব খান বলেন, আমাদের দেশ অলি-আল্লাহদের দোয়া-ই স্বাধীন হয়েছে। আমরা এখনো তাঁদের দোয়া কামনা করি। বই মানুষের আয়না স্বরূপ। লেখনী বলে দেয় তিনি কে? তাঁর দর্শন কী? অনুরূপে ছাইফুদ্দীন (র.) কে চিনতে হলে, বুঝতে হলে, জানতে হলে পড়তে হবে তাঁর লিখিত বই গুলো। তাঁর সাহিত্য ভান্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী। তিনি (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পুরষ্কার এবং একুশে পদক পুরষ্কার পাওয়ার যোগ্য। এজন্য সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি। শৈল্পিক ও নান্দনিক শব্দের গাঁথুনি দিয়ে লিখেছেন একাধিক অনবদ্য রচনা। এরই স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৪ সালের ১৯ ই অক্টোবর ‘বাংলাদেশ লেখক সমিতি’ এবং ‘আন্তজার্তিক সাহিত্য সমাজ’ কর্তৃক সংবর্ধনা ও স্বর্ণপদক সম্মাননায় ভূষিত হন। রচনা সমগ্র- (১) সূফী দর্শন ও সূফী দার্শনিক, (২) হযরত মোজাদ্দেদ আলফেছানী, (৩) হযরত সৈয়দ ওয়াজেদ আলী, (৪) ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) বা মৌলুদে খায়রুল বারিয়াহ্, (৫) সঙ্গীত ও সঙ্গীত মোহ, (৬) মৌলুদে মোস্তফা (দ.), (৭) নসীহত নামা, (৮) বাতেল ফেরকা, (৯) ছেমা ও ওজ্দ্, (১০) সিজরায়ে মুবারক, (১১) রাজনৈতিক কোন্দলে আবর্তিত নবী বংশ, (১২) কাফের ফতোয়ার সমালোচনা, (১৩) গায়েবী এলেম ও ওয়াছিলা অন্বেষণ, (১৪) তাসাওউফের ওজিফা বা মারেফাত তত্ত্ব ১ম খন্ড, (১৫) তাসাওউফের ওজিফা বা মারেফাত তত্ত্ব ২য় খন্ড, (১৬) আদর্শ মুর্শিদ ১ম খন্ড ও ২য় খ-, (১৭) ইসলামে তাসাওউফ, (১৮) আহলে বাইত ও শহীদে কারবালা, (১৯) ফাজায়েলে জেয়ারতে মাযার, (২০) ওরস প্রসঙ্গ।
এ মহাত্মা ১৯৯৫ সালের ১৫ ই অক্টোবর, রবিবার ১:৪৫ মিনিটে বেছালে হক্ব লাভ করেন। সেসময়ে দরবারের সমস্ত পশু-পাখি একই সুরে আর্তনাতের কান্নার রোল তুলে। এ ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে, তাঁর হৃদয়ে কতই না প্রেম ছিলো জীবাত্মার প্রতি। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন,
‘জীবে প্রেম করে যেই জন
সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’
বিশে^র বহু জ্ঞানীগুণী, রাজনীতিবিদ, অধ্যাত্মবিদ নানা প্রান্ত থেকে শোকবার্তা জ্ঞাপন করেছেন। বেছারে হক্বের পরও শরীর তুলতুলে নরম ও গরম ছিলো। চেহারা ছিলো পূর্ণিমার চাঁদের মত সমুজ্জ্বল। ওফাতের পরবর্তী সময়ে ভক্তবৃন্দরা খুবই নান্দনিকভাবে রওজা নির্মাণ করে।
লেখক: ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, যাত্রাবাড়ী শাখা, ঢাকা।
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রোমাঞ্চকর ম্যাচে বার্সাকে হারিয়ে শীর্ষে আতলেটিকো
জেসুসের জোড়া গোলের রাতে আর্সেনালের বড় জয়
বিলুপ্তির পথে মাটির ঘর
চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ
প্রতিবন্ধী স্কুল শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ
কেরু চিনিকলে আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন
বিহারিরা কেমন আছে
লক্ষ্মীপুরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি
আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
মেটলাইফ বাংলাদেশের গ্রাহকরা ডিসকাউন্ট পাবেন ওশান প্যারাডাইস হোটেলস ও রিসোর্টে
১৫ নারী ও শিশুকে হস্তান্তর
আবাসন ও গার্মেন্ট খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে
মেহেরপুরে বেড়েছে গরম কাপড় বিক্রি
কাশিয়ানীর হাট-বাজার নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব
অ্যানুয়াল বিজনেস কন্টিনিউয়িটি প্ল্যান ড্রিল ২০২৪ আয়োজন করলো ব্র্যাক ব্যাংক
সমস্যায় জর্জরিত আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
সবুজ গালিচায় হলুদের সমারোহ
আখাউড়ায় ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মেধা বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত
নিউ ইয়র্কের আদালতে অভিযুক্ত লুইজি
কিউবায় সমাবেশ