সিরাতচর্চায় ভাষা-সাহিত্যের গুরুত্ব
০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম
কবি ও কবিতার জন্য ভূবনখ্যাত এক জনপদ মক্কার শ্রেষ্ঠ গোত্র কুরাইশে (৫৭১ খ্রিস্টাব্দে) জন্মেছিলেন মহানবি সা.। সময়টা ছিল খুব অ¯ি’র কিš‘ তিনি ছিলেন পাপ-পঙ্কিল অন্ধকার পৃথিবীতে আলোক বি”ছুরিত এক দ্যুতিময় ব্যক্তিত্ব। কি মেধায়, কি মননে, কি ভাষায়, কি আচরণে, সর্বত্র অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। ফলে যেখানে সুন্দরের উপ¯ি’তি সেখানে তাঁর উৎকৃষ্টতা। যেখানে সভ্যতার বাহাদুরি সেখানে তাঁর উত্তমত্তা। যেখানে ভাষার উন্নিত করণে বছর কে বছর চলত কাব্যযুদ্ধ সেখানে তাঁকে ঘিরেই ভাষা রূপ নেয় আধুনিক সাহিত্যে। ভাষার উন্নত রূপকে যে সাহিত্য বলে এ কথাটি প্রথম তাঁর মুখ থেকেই উ”চারিত হয়। তার আগে ভাষার উন্নতরূপকে ভিন্ন ভিন্ন শব্দে-বাক্যে বুঝানো হত। বিশ^নবি সা.’র অনুপম কথামালা, বাচনভঙ্গি, শব্দচয়ন, উৎকর্ষ আচরণ, উন্নত ভাষাশৈলী দেখে সাহাবিরা অবাক বিস্ময়ে জানতে চাইলেন, আপনি এসব কোথা থেকে লাভ করেছেন? উত্তরে রাসুল সা. বলে ওঠেনÑ‘আদ্দাবানি রাব্বি ফা-আহসানা তাদিবি’ (আমার প্রভু আমাকে এ আদব শিখিয়েছেন, এবং তিনি আমাকে সুন্দরভাবেই শিখিয়েছেন।) আরবি আদব শব্দকে বাংলায় সাহিত্য বলে। তাছাড়া আদব শব্দরে মধ্যেÑশিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, আচার, নৈতিকতার মতো অতিরিক্ত কিছু ভাব আছে। যে যুগে বিখ্যাত ওকাজের মেলাকে কেন্দ্র করে কবিদের মধ্যে চলত বড়ত্বের লড়াই বা কবিতাযুদ্ধ সে যুগেই জন্ম গ্রহণ করেন বিশ্বনবি সা.‘র। মানবিক মূল্যবোধের এক ঐশ্বর্যময় উপমা তিনি। ছিলেন মানবতার মহান বন্ধু, তাই তো তিনি মহানবি মুহাম্মাদ সা.। যেভাবেই দেখি তিনি এক ধরনের বিস্ময়। এক আশ্চর্য ভঙ্গির অবয়ব। এক রহস্যময় ব্যক্তিত্ব। এত কথা, এত বাণী, এত ব্যথা, এত প্রাণ তাঁর! এত আনন্দ, এত বিষাদ! বিস্মিত না হয়ে উপায় কি? বিস্মিত হতে হতেই তাকাই তাঁর দিকে। তাঁর সৃষ্টির ঐশ্বর্যের দিকে। মহানবির বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা দশ লক্ষেরও বেশি। হাদিস মানে সময় উপযোগী একেকটি আধুনিক কবিতা। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও ছিলেন আরবি সাহিত্য মাধুরীমার ধারক-বাহক। ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ কথা সাহিত্যক। রহস্যঘেরা এত কথা-কবিতা, এত ভাবনা কিভাবে জাগল তিনার? তাঁর ভাবনার জগৎ কি বিশাল! তিনি দেখতেন। দেখতে দেখতেই চলতেন। চলতে চলতেই আবিষ্কার করতেন জীবনের নানা বাক। নানা সন্ধি। নানা আটঘাট। যেখানে মানুষেরা কাঁদে। হাসে। বিমর্ষ হয়। বসে থাকে মৌনতার ভেতর। জাগে উৎসবের আনন্দে। জ্বলে একাকিত্বের দহনে। আশা জাগায় মানুষের বুকের ভেতর। মানুষের জীবনে যত গোপন রহস্য! লুকায়িত যত বেদনা! তার সবকিছু জীবন্ত তাঁর হাদিসে। এটাই তাঁর বড় মোজেযা। শ্রেষ্ঠ অলৌকিক ঘটনা।
মহানবি সা.‘র পিতা-প্রপিতামহসহ উর্দ্ধতন ১৭জন পুরুষ সমকালিন শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী-গুণী কবি ছিলেন। ইতিহাস ও সিরাত গ্রšে’ যার দালিলিক বিস্তারিত আলোচনা আছে। মহানবি সা.‘র মাতা হযরত আমেনা ছিলেন একজন স্বভাব কবি। রাসুলের পিতা আব্দুল্লাহ এর মৃত্যুর পর তিনি কয়েকটি শোকগাঁথা গেয়েছিলেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। তেমন একটি কাব্যানুবাদ হলোÑ হায়রে হাশেমি বংশ হতে এদিন/ খালি হয়ে গেল এই মক্কার জমিন/ হায়রে দুনিয়া ছাড়িয়া কার মাঝার/ চলিয়া গেলনে আজ সহায় আমার।
সিরাতচর্চায় ভাষা-সাহিত্যর গুরুত: নবিচরিত বা সিরাতচর্চায় ভাষা-সাহিত্যর গুরুত্ব কতুটুকু তা নতুন করে বোঝাবার কিছু নেই। কারণ মহান আল্লাহ সাড়ে চৌদ্দশত বছর আগে ঘোষণা করেছেন: ‘আমি সকল নবিকেই স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিস্কার বোঝাতে পারেন।’ বিশ^নবি সা. উম্মি ছিলেন সত্য, কিš‘ জ্ঞানের জগতে ছিলেন এক স¤্রাট। তার এই জ্ঞানের উৎসÑসৃষ্টির যিনি মহান কর্তা, বিশ্বজগতের পরিচালক, নিয়ন্ত্রণকারী, অন্নদাতা, বিধানদাতা, বিশ্ব প্রতিপালক মহান রাব্বুল আলামিন স্বয়ং নিজে। মানুষের প্রতি ভালোবাসা, জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা, সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা এবং সত্যের প্রতি ভালোবাসায় তিনি তার হাবিবের অন্তরের বিপুল বিস্তারকে দীর্ঘ রেখেছেন অষ্টপ্রহর। মানবতার এ মহান শিক্ষক ছিলেন সর্বদা সত্য ও সুন্দরের উপমা। তিনি নিজে ছিলেন সুন্দর, তাই সুন্দরকে আঁকড়ে ধরেছেন সযতেœ। যেখানে সুন্দরের আনাগোনা সেখানেই তাঁর পদচারণা ছিল চোখে পড়ার মতো। এই প্রেক্ষিতে কাব্য এবং সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা তাঁর এক অনন্য সৃজনশীল রুচির পরিচয় বহন করে। কারণ সাহিত্য মানুষের সৃজনী প্রতিভার সরব প্রকাশ। ভাব যখন ভাষা পায় তখনই তা সাহিত্য হয়ে উঠে আসে।
প্রতিভার এই বিকাশ এবং প্রকাশ সাহিত্যের নানা মাধ্যমে হতে পারে। গদ্য, পদ্য, কবিতা-ছড়া, গল্প, উপন্যাস সব বিষয়ে। অবশ্য পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষার ‘সাহিত্য’ কবিতা তথা কাব্যকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। আরবি সাহিত্যও এর ব্যতিক্রম নয়। আর নয় বলেই রাসুল সা. এর উত্থানের সময়কালে আরবে কাব্য ধারাটি ছিল প্রবল। ওই সময়ে বেশির ভাগ কাব্যের প্রধান বিষয় ছিল যুদ্ধবিগ্রহ, অশ্লীলতা, কাম, ক্রোধ, সম্পদ লুণ্ঠন, অন্যের বিরুদ্ধে উসকানি, গোলযোগ সৃষ্টি, বিপদে ফেলা ইত্যাদি। সে যুগে কাব্যচর্চা এমন এক রূপ পরিগ্রহ করেছিল যে, খ্যাত-বিখ্যাত ওকাজের মেলাকে কেন্দ্র করে কবিদের মধ্যে চলত বড়ত্বের লড়াই বা কবিতাযুদ্ধ। প্রতি বছর যে সাতজন কবির কবিতা শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় উন্নিত হতো, সেই সাত কবির কবিতা মিসরের মিহি কাপড়ে সোনার হরফে লিখে কাবার দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হতো এবং এর সংকলনের নামকরণ করা হতো ‘আস সাবউল মুয়াল্লাকা’। সাবউুল মুয়াল্লাকার সাতজন শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন- ইমরাউল কায়েস, তুরফা, জুহায়ের ইবনু আবু সালমা, লবিদ, আমর ইবনু কুলসুম, আনতারা ইবনু শাদ্দাদ, নাবিগা ইবনু জুবিয়ানি প্রমুখ।
কবিতায় যখন আরবের কাব্যবাজার রমরমা, যুবসমাজ কবিতায় প্লাবিত, তখনই রাসুলে করিম সা. লাভ করেন নবুওত-রেসালত, নবি হিসেবে হয় তাঁর আবির্ভাব। নাজিল হতে থাকে মহাগ্রš’ পবিত্র কুরআনুল কারিম। যা ছিল মানবের বোধের উৎস, অন্ধকারে আলোর ঔজ্জ্বল্য এবং কাব্যরীতির এক অনুপম উপমা। আরবের ভিনধর্মি কবি-সাহিত্যিকরা শুরু করেন চেঁচামেচি। নবিয়ে উম্মির ওপর প্রশ্নের পর প্রশ্ন! হাজার হাজার প্রশ্ন! তিনি নিরক্ষর, কবি-সাহিত্যিক কিছুই নয়, তাঁর মুখনিঃসৃত মহাসাহিত্যের কুরআনিক কথাগুলো কোথায় পান? একথাগুলোর সামনে আমাদের উ”চ মার্গের কবিতাগুলো তুলে ধরাই যা”েছ না! ঘোর আপত্তি! এরই মাঝে কিয়ামত পর্যন্ত কুরআনের চ্যালেঞ্জÑ‘শুধু তোমরা কেন, সমগ্র পৃথিবী থেকে তোমাদের সহযোগিতার জন্য কবি-সাহিত্যিকদের একত্রিত করে দেখ! কুরআনের মতো ছোট একটি সুরা লিখতে পার কি না?’ তখনও পৃথিবী পারেনি, এখনও না, ভবিষ্যতেও পারবে না! অথচ ওই সময়ে আরবের কবিসমাজের প্রভাব প্রতিপত্তি এত তীক্ষè ও প্রখর ছিল যে, তারা যা বলতেন সাধারণ মানুষ তাই আ¯’ার সাথে গ্রহণ করত।
শিল্পসাহিত্যের প্রতি রাসুল সা.’র সহজাত আকর্ষণ: শিল্পসাহিত্যের প্রতি বিশেষ করে কবিতার প্রতি আল্লাহর রাসুল সা. এর ছিল এক সহজাত আকর্ষণ। ওহুদ যুদ্ধের প্রথম দিকে মহানবি সা. হাতের একটি আঙুলে ব্যথা পেলে হঠাৎ গেয়ে ওঠেনÑ‘হাল আনতে ইল্লা ইসবাউন দামিতে/ ওয়া ফি সাবিলিল্লাহি মা লাকিতে’। অর্থ: ‘হে আঙুলি! তুমি তো একটি আঙুল বৈ কিছুই নও।/ সুতরাং যা কিছু হয়েছে তা আল্লাহর রাস্তায় হয়েছে। (অনুশোচনা ও দুঃখ কিসের?)
খন্দক যুদ্ধে সাহাবিরা যখন পেটে পাথর বেধে আতœরক্ষার জন্য পরিখা খনন করছিলেন, তখন তাদের কষ্ট দূর করত শান্তনা প্রদানে মহানবি সা. আবৃত্তি করতে থাকেনÑ‘আল্লাহুম্মা লা আয়শা ইল্লা আইশুল আখিরাহ/ ফাগফিরিল আনসারা ওয়াল মুহাজিরাহ/ আল্লাহুম্মা লা খায়রা ইল্লা খাইরুল আখিরাহ/ ফাবারিক লি ফিল আনসারে ওয়াল মুহাজিরাহ।’ হুনায়েনের যুদ্ধ ময়দানে সৈন্যদের উদ্দেশে আবৃত্তি করতে থাকেনÑ‘আনা নাবিউন লা কাজিব/ আনা ইবনু আবদুল মুত্তালিব।’ এছাড়াও সহিহ বুখারিতে মহানবির আওড়ানো অনেকগুলো কবিতার কথা উল্লেখ আছে। এ কবিতাগুলো ছিল মহানবি সা.‘র স্বরচিত কবিতা। কবি হাসসান ইবনু সাবিত ছিলেন রাসুল সা.-এর সভাকবি। মহানবি সা. যখন গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন যে, জাহেলি যুগের ওইসব কবির মোকাবেলা একমাত্র কবিতা দিয়েই সম্ভব, তখনই তিনি কাব্য এবং সাহিত্যচর্চার প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা দিতে শুরু করেন। সুরা আশ শুয়ারা নাজিল হওয়ার পর হাসসান ইবনু সাবিতসহ সাহাবি কবিরা কাঁদতে শুরু করেন। (চলবে)
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক।
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
জানা গেল ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে ব্রাজিলের একাদশ
বাংলাদেশে ন্যায্য রুপান্তরে অর্থায়নের জন্য ধনী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান
গোপালগঞ্জে কারাগারে থাকা বাবার অবশেষে জামিন মঞ্জর
ওসমানী বিমান বন্দরে বিদেশী বিমান উঠা-নামার ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী- প্রধান উপদেষ্টা বরাবরে সিলেটে স্মারকলিপি
ময়মনসিংহে ফিলিং স্টেশনে আগুনের ঘটনায় মৃত্যু বেড়ে ৬
জানুয়ারি পর্যন্ত ছিটকে গেলেন এনগিডি
দুবাইয়ে নবনিযুক্ত কনসাল জেনারেলের সাথে বাংলাদেশ রেডিমেড গার্মেন্টস ট্রেডার্স আজমানের নেতৃবৃন্দের সৌজন্য সাক্ষাৎ
গণঅভ্যুত্থানে আহতদের সুবিধা নিশ্চিতে দেওয়া হবে ইউনিক আইডি কার্ড
যে কারণে হারপিকে মেতেছে নেটিজেনরা
আ.লীগের মতো পরিবারতন্ত্র করবে না বিএনপি: তারেক রহমান
প্যারাগুয়ে ম্যাচে কেমন হবে আর্জেন্টিনার একাদশ
অর্থাভাবে ব্যক্তিগত বিমান ভাড়া দিয়েছেন শন ডিডি, বিক্রি করবেন বাড়ি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শ্রেনী কক্ষে অসুস্থ ১০ শিক্ষার্থী
ভারতীয় গণমাধ্যম আমাদের সম্পর্কে অপপ্রচার চালাচ্ছে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
নরসিংদীতে ট্রেনের নীচে ঝাঁপ দিয়ে যুবকের আত্মহত্যা
পুলিশ সংস্কার ও একটি কৌশলপত্র
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে কেন উপদেষ্টা করতে হবে?
শ্যামনগরে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল চালক নিহত
অভ্যুত্থানে আহতদের প্রতি এই অবহেলা অমার্জনীয়
নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ