রোজা: স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের আলোকে

Daily Inqilab এ.বি.এম.রবিউল ইসলাম

২০ মার্চ ২০২৫, ১২:২৫ এএম | আপডেট: ২০ মার্চ ২০২৫, ০১:০৩ এএম

“নিশ্চয় প্রত্যেক জিনিসের জন্য যাকাত আছে, শরীরের যাকাত রোজা (ইবনে মাজা)”। চাঁদের বার মাসের মধ্যে নবম মাসের নাম রমজান। এই রমজান মাসের রোজা প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজ। রমজান শব্দটি আরবী “রমজ” ধাতু থেকে উদ্ভূত। ‘‘রমজ’’ শব্দের অর্থ পোড়ান, জ্বালান বা দহন করা। মানুষের দেহকে পোড়ান দরকার কেন? এ পোড়ান অর্থ কি দেহকে আগুন দিয়ে জ্বালানো? না, এ অর্থে ‘‘রমজ’’ বা রমজান শব্দ ব্যবহৃত হয়নি। হয়েছে ভাবগত অর্থে। প্রবৃত্তির তাড়নায় মানব মনে সঞ্চিত পঙ্কিলতা, পাশবিকতা ও কুপ্রবৃত্তির দাহন। খাঁটি সোনা পেতে হলে তাকে আগুনে পুড়িয়ে খাদ মুক্ত করতে হয। সোনার প্রকৃত রং তখনি হয়, যখন আগুনে নানাভাবে জ্বালিয়ে তামা, সিসা ইত্যাদি খাদ মুক্ত করা হয়। মানব দেহ মাটি হতে সৃষ্টি। মাটির বৈশিষ্ট্যই এতে বিদ্যমান। মাটিকে উত্তপ্ত করে যদি এতে সোনা ফলান যায়, দহন ক্রিয়ার ফলে যদি একে সারে রুপান্তরিত করা যায় তবে মাটির দেহকে উত্তপ্ত করে, দহন প্রক্রিয়ায় এর ইন্দ্রিয়সমূহকে দমন করে, কেন এতে সৃষ্টি বৈচিত্রের রূপ দেখানো যাবে না। “যাবে” নিশ্চয়ই যাবে। এরই পরীক্ষা মহা মনীষীরা তাদের জীবনে করেছেন বলেই ধন্য হয়েছেন তাঁরা। মাটির দেহ খাঁটি সোনায় রূপান্তরিত করে জগৎকে মুগ্ধ করেছেন। এজন্যই হযরত (সঃ) বলেছেন: শরীরের যাকাত ‘রোজা’। দেহকে পোড়াতে হলে দহন ক্রিয়ায় এর ইন্দ্রিয় শক্তি গুলোকে ধারাল ও শক্তিশালী করতে হলে প্রয়োজন রোজা বা উপস।

কেউ যদি প্রশ্ন করেন-- রোজার এ বিধান কি নিছক বিধানই, না, এর পেছনে বিজ্ঞান সম্মত কোন যুক্তি আছে? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজার আগে অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে রোজা বিশ্লেষণ করতে হলে প্রথমে একথা বলে রাখা দরকার যে- রোজায় নানাবিধ শরীরবৃত্তীয় উপকার থাকতে পারে, কিন্তু রোজা একটি ফরজ ইবাদত, যার মাধ্যমে মু’মিনগণ তাক্কওয়ার গুণাবলী অর্জন করে থাকে। আর তাক্কওয়ার অর্থ বিরত থাকা, বেঁচে থাকা। অর্থাৎ আল্লাহর ভয় এবং তার সন্তুষ্টি লাভের আশায় সর্ব প্রকার অন্যায় ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন করা। রোজা পালন করতে গিয়ে যদি কারো মনে এ ধারণার জন্ম দেয় যে, দিনে রোজা রেখে, দিনে যা যা খাওয়া হত, রাত্রে সেগুলো বা তার চাইতে বেশী খাওয়া হবে। অর্থাৎ খাওয়ার দিক দিয়ে দিনকে রাত আর রাতকে দিন হিসেবে গণ্য করা হবে। তবে এ ধরনের কোন ফজিলত আশা করা যায় না এবং তা রাখা মোটেই বিজ্ঞান সম্মত হবে না। প্রচলিত ‘রোজা’ শব্দটি আরবী সিয়ামের স্থান দখল করলেও নিছক উপবাস বা রোজা সিয়ামের প্রতিশব্দ নয়।

রোজা মানুষকে যে সংযমিতা শিক্ষা দেয়, তা তার শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধনে সহায়ক। রোজা শরীরের ঙৎফবৎ ও উরংপরঢ়ষরহব অর্থাৎ নিয়ম শৃঙ্খলাকে ফিরিয়ে এনে শরীরকে কার্যক্ষম করে তোলে। আমাদের শরীর একটা ইঞ্জিনের মত। খাবার হচ্ছে এই ইঞ্জিনের ফুয়েল বা জ্বালানী। পাকস্থলীতে যতক্ষণ খাবার থাকে ততক্ষণ ইঞ্জিন চলতেই থাকবে। যখন খাবার ফুরিয়ে যাবে তখন শরীরের মধ্যে যে খাবার জমা থাকে মেদ বা চর্বি হিসেবে তা খাবার হিসেবে কাজ করে ইঞ্জিনকে চালিয়ে নিতে; অনেকটা রিজার্ভ ট্যাংকির মত। চর্বি ফুরিয়ে গেলে টান পড়ে মজুদ প্রোটিনের। আবার অত্যধিক খাবার গ্রহণের ফলে শরীরে যে বাড়তি মেদ বা কোলেস্টেরল (ঈযড়ষবংঃবৎড়ষ) জন্মে তা থেকে শরীরে নানাবিধ রোগ জন্মে। তাই শরীরের এই অবাঞ্চিত মেদকে জ্বালানী হিসেবে পুড়িয়ে ফেলাই বাঞ্চনীয়। রোজা এ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। শরীরে বেশী কোলেস্টেরল জমা হলে শিরা উপশিরার ভিতরের প্রশস্ততা কমে যায়। তখন এরা পর্যাপ্ত রক্ত বহন করতে পারে না। ফলে এক দিকে রক্তের চাপ (ইষড়ড়ফ চৎবংংঁৎব) বৃদ্ধি পায়, অন্য দিকে হৃৎপিন্ডের প্রধান রক্ত বহনকারী করোনারী আর্টারী পর্যাপ্ত রক্ত বহনে অক্ষম হয়ে পড়ে। তখন হৃৎপিন্ডের কাজ বন্ধ হয়ে আসে; যার ফলে বুকে দারুন ব্যাথার সৃষ্টি হয় এবং হঠাৎ করেই মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে। এক মাস রোজা রাখার ফলে
শরীরে নতুন করে কোলেস্টেরল জমতে পারে না, বরং জমাকৃত কোলেস্টেরল ক্ষয় হয়ে শরীরের বাড়তি ওজন ও উচ্চ রক্ত চাপ কমে আসে। এই সময় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে থাকে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনের মূলমন্ত্র সুশৃঙ্খল জীবন পদ্ধতি। সঠিক নির্দেশনা অনুযায়ী সিয়াম সাধনা করলে এই সময় রক্তে গ্লুকোজ ও চর্বির পরিমাণ হ্রাস পায়। রোজাদার ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে এক ধরনের চর্বি, যা লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (খড়ি ফবহংরঃু খুঢ়ড়ঢ়ৎড়ঃরহ) (ক্ষতিকারক চর্বি) নামে পরিচিত, কমে যায় এবং হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (ঐরময ফবহংরঃু খুঢ়ড়ঢ়ৎড়ঃরহ) (উপকারী চর্বি) বৃদ্ধি পায়। ফলে হৃদরোগের আশঙ্কা অনেক কমে যায়। একই সাথে শরীরে ডি-টক্সিফিকেশন ঘটে। অর্থাৎ এই সময়ে শরীরে জমে থাকা কিছু ক্ষতিকর পদার্থ - প্রস্রাব, পায়খানা, ঘাম ইত্যাদি বডি ফ্লুইডের সাথেই দ্রবীভূত হয়ে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। অনেকের ধারনা রোজা রেখে সারাদিন উপবাস থাকলে শরীরের গ্লুকোজ বা চিনির পরিমাণ কমে গিয়ে শরীর দূর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা শরীরে রিজার্ভ ট্যাংকির মত চিনি জমা রাখার ব্যবস্থা করেছেন। শরীরে চিনির পরিমাণ কমে গেলে মেদ থেকে এমনকি আমিষ জাতীয় খাবার থেকেও শরীরে চিনি সরবরাহ হতে পারে। অর্থাৎ যে চিনি আমাদের মস্তিস্ক ও শরীরের জন্য অতি প্রয়োজন তা জমাকৃত মেদ থেকে ক’একদিন নয়, ক’এক সপ্তাহ শরীরকে চালিয়ে নিতে পারে।
অনেকের ধারনা রমজান মাস ডায়াবেটিস ও আলসার রোগীদের জন্য অনেক সমস্যা, কারণ এসব রোগীদের ঘন ঘন ঔষধ খেতে হয। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে ঘন ঘন খাবার খেলে আলসার সারার চেয়ে বেড়ে যায়। বরং নিয়মিত এবং পরিমিত খাবার খেলে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় এবং আলসারও বৃদ্ধি পায় না। যাদের গ্যাষ্ট্রিক আলসার (এধংঃৎরপ টষপবৎ) আছে, তাদের জন্য রোজা উপকারী, কেননা খাওয়ার পর গ্যাষ্ট্রিক আলসারের ব্যাথা বেড়ে যায়। রোজা রেখে সারাদিন না খেয়ে থাকলে পাকস্থলী একটু বিশ্রাম পায় তাতে ব্যাথা কমে যায় অর্থাৎ রোগীর উপকার হয়।
আমাদের দেশে আমরা বড় অনিয়ম করি খাওয়া-দাওয়ায়। কোন সময় খাব, কতটুকু খাব, কি কি খাবার উপকারী, কি কি খাবার অপকারী এসব ব্যাপারে আমরা বড়ই উদাসীন। রমজান মাসে কারো জন্য ইফতারী ও সেহেরী আলাদা আলাদা সময়ে হয় না। কাজেই খাবারের মধ্যে আমরা যদি নিয়ম মানতে চেষ্টা করি তাহলে, এই রমজানকেই আমাদের অনুসরণ করতে হবে। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও রমজান মাস একটা নেয়ামত ও বরকতের মাস। কারণ এতে শরীর সুস্থ রাখার নানান উপায় অনুশীলন আছে। এই উপায়, অনুশীলন গুলো আমরা সব সময় চর্চা করতে পারি না। অথচ, এই রমজান মাস আমাদের সেই সুযোগ এনে দেয়। আমাদের দেশে কেউ না খেয়ে মরে না। বেশি খেয়ে মরে, অপরিমিত খেয়ে মরে। রোজা খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে একটা শৃঙ্খলা এনে দেয়। যা শারীরিক উৎকর্ষ সাধনে বিশেষ সহায়ক। সব ব্যাপারে রোজা মানুষকে সংযমি হতে শিক্ষা দেয় খাদ্যে সংযমি হওয়া তার মধ্যে অন্যতম। রমজান মাসে খাদ্যের ওহঃধশব কম হলে অর্থাৎ শরীরে খাদ্য নামক জ্বালানী কম প্রবেশ করলে ক’একটা পার্টস একটু বিশাম পায়। বিশেষ করে ঐ সব পার্টস যাদের সাথে পাকস্থলীর সম্পর্ক রয়েছে। তাছাড়া সারা বছর দেহে যে ঞড়ীরহ বা জৈব বিষ জমা হয় এক মাস রোজা রাখার ফলে তা দূরীভূত হয়ে দেহ কোষ নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে।
রাশিয়ার একজন বিজ্ঞানী প্রফেসর নাটিকন বলেন- তিনটি নিয়ম পালন করলে শরীরের বিষাক্ত জীবাণু বের হয়ে যাবে এবং বার্ধক্য কমিয়ে দেবে। (ক) শারীরিক পরিশ্রম দেহের শিরা উপশিরার সতেজতা ও সজীবতা বজায় রাখে। (খ) প্রতিদিন কিছু সময় ব্যায়াম করা ও (গ) প্রত্যেক মাসে অন্ততঃ একদিন অভুক্ত থাকা। মহানবী (সঃ) রমজান মাস ছাড়াও প্রতি মাসে ৩/৪টি রোজা রাখতেন এবং বলতেন, রোজা রাখ এবং সুস্থ থাক। রক্ত সঞ্চালন এবং দেহের গ্রন্থি সমূহের উপর রোজার সুফল ও প্রতিক্রিয়া সর্বাধিক। রোজা মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রকে উজ্জীবিত করে। বহুল আলোচিত ক্রনিক আমাশয় যাকে চিকিৎসা শাস্ত্রে ইরিটেবল বাউল সিন্ডোম (ওৎৎবঃধনষব নড়বিষ ংুহফৎড়সব) বলে। এ রোগটা পেটের মধ্যে হলেও আসল কারণ কিন্তু মনের মধ্যে। রোজাদার যখন মনের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে রোজা রাখে তখন মানসিক চাপ যন্ত্রণা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকে। তাই এসব রোগী রোজা রাখা অবস্থায় সম্পূর্ণ উপসর্গ মুক্ত থাকে।
দীর্ঘ উপবাসের বিষয়টি আলোচনায় আসায় আমরা জানতে পারি - এই সময় গুরুত্বপূর্ণ আরেকটা ব্যাপার ঘটে থাকে আমাদের শরীরের কোষের মধ্যে, সেটা হচ্ছে, প্রতিনিয়ত আমাদের শরীরের মধ্যে বিপাকীয় ক্রিয়া সম্পাদনের ক্ষেত্রে (অ্যানাবলিজম ও ক্যাটাবলিজম প্রক্রিয়ায়) ভাঙা - গড়ার কাজ চলতে থাকায় অনেক কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা মরে যায়। মৃত বা ক্ষতিগ্রস্ত এ কোষগুলো কোষের অভ্যন্তরে বর্জ্য হিসাবে লাইসোসোম নামক একটি বিশেষ কোষাঙ্গে জমা হতে থাকে। একই ভাবে শরীরের মধ্যে মৃত ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসও জমা হয় এই লাইসোসোমে। বলা যেতে পারে লাইসোসোম হচ্ছে কোষের রিসাইকেল সেন্টার। শরীর যখন কোন ক্রাইসেস বা প্রতিকূল অবস্থায় পড়ে তখন সঞ্চিত মৃত কোষ গুলো থেকে শরীর শক্তি সঞ্চয় করে এবং নতুন কোষ তৈরি করে। যার ফলে শরীরের বর্জ্য ব্যবহৃত হয়ে শরীরকে করে দূষণমুক্ত। শরীরের এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় অটোফেজি, যার অর্থ হলো সেলফ ইটিং বা ‘আত্মভক্ষণ’ বা শরীরকে প্রাকৃতিকভাবে দূষণমুক্ত করার পদ্ধতি। কোন কারণে এই অটোফেজি প্রক্রিয়া ব্যহত হলে শরীরে বিষাক্ত পর্দাথের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারেরও সৃষ্টি করতে পারে। কারণ হয়ে উঠতে পারে অন্যান্য রোগ ও উপসর্গের। অটোফেজি প্রক্রিয়ায় দেহ কোষকে পুনরুজ্জীবিত ক’রে বাড়িয়ে দেয় কোষের আয়ু যা এন্টিএজিং বা বার্ধক্য রোধক হিসাবে কাজ করে। তার মানে ‘অটোফেজি’ শরীরকে ভাঙ্গে না বরং গড়ে তোলে। আর এই পদ্ধতিটি চালু করতে প্রয়োজন কিছুটা দীর্ঘ তবে সবিরাম উপশম। আর রমজান মাসে এই সুযোগটি ঘটে থাকে। রোজা পালনের ফলে মানুষের শরীরে নানাবিধ কল্যাণ সাধিত হয়। পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত চিকিৎসকগণ একবাক্যে স্বীকার করেছেন “ঞযব ঢ়ড়বিৎ ধহফ বহফঁৎধহপব ড়ভ ঃযব নড়ফু ঁহফবৎ ভধংঃরহম পড়হফরঃরড়হং ধৎব ৎবসধৎশধনষব ধভঃবৎ ধ ভধংঃ ঢ়ৎড়ঢ়বৎষু ঃধশবহ ঃযব নড়ফু রং ষরঃবৎধষষু নড়ৎহ ধ ভৎবংয” রোজা একই সাথে দেহের রোগ প্রতিষেধক ও প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করে। রোজা রাখার ফলে দেহে ইউরিক এসিড বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়। শরীরের ইউরিক এসিডের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে নানা প্রকার নার্ভ সংক্রান্ত রোগ সৃষ্টি হয়। রোজাদারের শরীরে পানির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার ফলে চর্ম রোগ (ঝশরহ ফরংবধংব) বৃদ্ধি পায় না। রোজাদার সারাদিন রোজা রেখে বেলা শেষে যখন ইফতার সামগ্রী সামনে নিয়ে সূর্যাস্তের অপেক্ষা করে তখন তাঁর জিহবা রসে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। জিহবার নিঃসৃত এই রস, খাদ্য পরিপাকের জন্য পাচক রস বা এনজাইম (ঊহুুসব) হিসেবে কাজ করে। যদ্দরুন রোজাদার যতই খানা-পিনা করুক নিমিষেই তা হজম হয়ে যায়।

এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, যারা দৈনিক তিন কিলোমিটার হাটেন বা দৌড়ান তাঁদের মতোই সমান শারীরিক পরিশ্রম হয় ২০ রাকাত তারাবীর নামাজ পড়লে। আবার ফজরের নামাজের সময় শরীরে যে মৃদু ব্যায়াম হয়, তা পেশিগুলোর জীবনীশক্তি অনেক বাড়িয়ে দেয়। রমজান মাসে আমরা যখন অভুক্ত থাকি, তখন গ্রোথ হরমন নিঃসৃত হয়। এই হরমন শরীরে কোলাজেন গঠনে সাহায্য করে, যা চামড়া সতেজ রাখে। এজন্য যাঁরা রমজানে সব রোজা রাখেন, নামাজ ও তারাবী নিয়মিত পড়েন তারা সতেজ থাকতে পারেন। ইসলামে খাদ্যের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। হারাম খাবার পরিত্যাগ করে সেই সব খাবার খেতে হবে যা হালাল করা হয়েছে। এবং তা খেতে হবে পরিমিতভাবে। মানুষ যে খাদ্য গ্রহণ করে, তা তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। খাবার তার আচরণ ও ব্যক্তিত্বের উপর প্রভাব ফেলে। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে: আদম সন্তানেরা যেন জাহাজের মত পেট ভরাট না করে। তার সেটুকুই খাওয়া উচিত যা তার জীবন ধারনের জন্য দরকার। গ্রীক চিকিৎসক হিপোক্রেটিসকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক বলা হয়ে থাকে। উপবাস নিয়ে একটি কথা বলেছেন তিনি। তাঁর ভাষায় ‘‘আমাদের প্রত্যেকের শরীরের মধ্যেই বসবাস করে একজন ডাক্তার। আমাদের উচিত সেই ডাক্তারকে কাজ করতে দেওয়া। এটি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া।’’ তিনি আরও বলেছেন ‘‘খাবারই হওয়া উচিত আমাদের ঔষধ, ঔষধই হওয়া উচিত আমাদের খাবার। কিন্ত আমরা যখনই অসুস্থ হই তখন যদি খাবার গ্রহণ করি তখন তা কিন্তু প্রকারন্তরে সেই অসুস্থতাকেই খাবার যোগান দেওয়া হয়। শরীরের ডাক্তারকে কাজ করতে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন উপবাস, উপবাস করলেই শরীরের সেই ডাক্তার কাজ করতে পারে’’।

বস্তুতঃ আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য এমন কোন বিধান দেন নাই যার মধ্যে অকল্যাণ আছে। আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন নফসকে, তিনিই ভাল জানেন নফসের চাহিদা, গতি, প্রকৃতিকে। রোজার মাধ্যমে আমরা যে তাক্কওয়া বা খোদা ভীতি অর্জন করি তা আমাদের নফসের লাগামহীন খায়েশকে প্রশমিত ক’রে এমন এক অনুভূতি দান করে যদ্বারা আমাদের চরিত্রে সুনীতির সৌন্দর্য প্রকাশ পায়। দেহ মনে ফুটে ওঠে শান্তির আলোকচ্ছটা। সবশেষে এ সত্যটি মাথায় রাখতে হবে যে, রোজা কেবল আল্লাহর জন্য। তাই আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যই তা পালন করতে হবে। তাহলে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পাশাপাশি এই সব উপকারও পাওয়া যাবে। কিন্তু নিছক এই সব উপকারের কথা চিন্তা ক’রে রোজা রাখলে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন নাও হতে পারে। মহান আল্লাহ পাক পবিত্র রমজান মাসে রোজার পরিপূর্ণ হক আদায় করে সহিহ নিয়্যতে সকলকে রোজা রাখার তৌফিক দিন।

লেখক: হোমিও কনসালটেন্ট, উপপরিচালক (অব:) ইসলামিক ফাউন্ডেশন।


বিভাগ : ধর্ম দর্শন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

রোহিঙ্গাসংকট: সমাধানের পথ খুলুক দ্রুত
মাইজভা-ার শরিফ : ঐশ প্রেক্ষিত
রমজানে খাদ্য গ্রহণে সচেতন হোন
রমজানের রহমত-মাগফিরাত-নাজাতের বানে ভেসে যাক পাপ
আল্লাহ ছাড়া কোন আশ্রয়স্থল নাই
আরও
X

আরও পড়ুন

'মার্চ ফর গাজা'‌ কর্মসূচিতে ঢুকে নাশকতা চালাতে পারে আ'লীগ, গোয়েন্দা তথ্যে আশঙ্কা

'মার্চ ফর গাজা'‌ কর্মসূচিতে ঢুকে নাশকতা চালাতে পারে আ'লীগ, গোয়েন্দা তথ্যে আশঙ্কা

স্ত্রী চলে যাওয়ায় দুধ দিয়ে গোসল করলেন স্বামী, ভিডিও ভাইরাল

স্ত্রী চলে যাওয়ায় দুধ দিয়ে গোসল করলেন স্বামী, ভিডিও ভাইরাল

ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের ডাক মালদ্বীপের ৫৪টি সংগঠনের

ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের ডাক মালদ্বীপের ৫৪টি সংগঠনের

চারুকলায় আগুনে পুড়ল আনন্দ শোভাযাত্রার জন্য বানানো  ফ্যাসিস্ট হাসিনার মোটিফ

চারুকলায় আগুনে পুড়ল আনন্দ শোভাযাত্রার জন্য বানানো ফ্যাসিস্ট হাসিনার মোটিফ

চেন্নাইকে লজ্জার রেকর্ড উপহার দিল কলকাতা

চেন্নাইকে লজ্জার রেকর্ড উপহার দিল কলকাতা

গাজার মানুষ না খেয়ে আছে, চিকিৎসা পাচ্ছে না : ডব্লিউএইচও

গাজার মানুষ না খেয়ে আছে, চিকিৎসা পাচ্ছে না : ডব্লিউএইচও

ট্রাম্পের নতুন নির্বাহী আদেশে গৃহস্থালি পানির বিধিনিষেধ বাতিল

ট্রাম্পের নতুন নির্বাহী আদেশে গৃহস্থালি পানির বিধিনিষেধ বাতিল

পাগলা মসজিদের দানবাক্সে মিললো ২৮ বস্তা টাকা

পাগলা মসজিদের দানবাক্সে মিললো ২৮ বস্তা টাকা

‘মার্চ ফর গাজা’র জন্য প্রস্তুত সোহরাওয়ার্দী, লাখো মানুষের ঢলের অপেক্ষা

‘মার্চ ফর গাজা’র জন্য প্রস্তুত সোহরাওয়ার্দী, লাখো মানুষের ঢলের অপেক্ষা

গাজা-সিরিয়ায় ইসরাইলের আক্রমণ নিয়ে এরদোগানের সতর্কবার্তা

গাজা-সিরিয়ায় ইসরাইলের আক্রমণ নিয়ে এরদোগানের সতর্কবার্তা

বিতর্কিত ওয়াকফ বিল নিয়ে উত্তাল ভারতের মুর্শিদাবাদ

বিতর্কিত ওয়াকফ বিল নিয়ে উত্তাল ভারতের মুর্শিদাবাদ

এশিয়ার তিন দেশ সফর করবেন শি জিনপিং

এশিয়ার তিন দেশ সফর করবেন শি জিনপিং

জুলাই গণঅভ্যুত্থান উজ্জীবিত আশার প্রতীক: মেক্সিকোতে স্বাধীনতা দিবসের বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত মুশফিক

জুলাই গণঅভ্যুত্থান উজ্জীবিত আশার প্রতীক: মেক্সিকোতে স্বাধীনতা দিবসের বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত মুশফিক

গাজা ‘পৃথিবীর দোযখে’ পরিণত হয়েছে, সংকট চরমে

গাজা ‘পৃথিবীর দোযখে’ পরিণত হয়েছে, সংকট চরমে

উত্তাল কলকাতা, মোদি-অমিত শাহের কুশপুত্তলিকা দাহ

উত্তাল কলকাতা, মোদি-অমিত শাহের কুশপুত্তলিকা দাহ

হার দিয়ে পিএসএল শুরু রিশাদের দলের

হার দিয়ে পিএসএল শুরু রিশাদের দলের

শেরাটন ভবনের মালিকানা বিতর্কের অবসান, হিস্যা বুঝে নিল ডিএনসিসি

শেরাটন ভবনের মালিকানা বিতর্কের অবসান, হিস্যা বুঝে নিল ডিএনসিসি

দেশের সাংবিধানিক নামে ‘জনকল্যাণ’ শব্দ চায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ

দেশের সাংবিধানিক নামে ‘জনকল্যাণ’ শব্দ চায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ

ছাগলনাইয়ায় অবৈধভাবে মাটি কাটার অভিযোগে সাতটি পিক-আপ জব্দ ও দুইটি এস্কেভেটর অকেজো

ছাগলনাইয়ায় অবৈধভাবে মাটি কাটার অভিযোগে সাতটি পিক-আপ জব্দ ও দুইটি এস্কেভেটর অকেজো

ভারতের বিতর্কিত ওয়াকফ বিলের বিরুদ্ধে  রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ জানাতে হবে : মাওলানা আহমদ হাসান ফুলতলী

ভারতের বিতর্কিত ওয়াকফ বিলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ জানাতে হবে : মাওলানা আহমদ হাসান ফুলতলী