বাংলা সন ও সাংস্কৃতিক লড়াই
১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১২ এএম | আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১২ এএম

কয়েকটি কথা বলবো, এ রচনার ভাবনাসূত্র বুঝার জন্য। প্রথম কথাটি হলো, বাংলাসনের জন্মসূত্র। ইতিহাস বলে, বাংলাসন হিজরী সনেরই বিবর্তিত রূপ সবাই জানেন, হিজরী সন চান্দ্রবর্ষ। সৌরবর্ষের চেয়ে চান্দ্রবর্ষ ১১/১২ দিন কম হয়। কারণ, সৌরবর্ষ ৩৬৫ দিনে আর চান্দ্র বর্ষ হয় ৩৫৪ দিনে। চান্দ্রবর্ষে মৌসুম ঠিক থাকে না। অথচ চাষাবাদ, খাজনা আদায়সহ অনেক কাজ মৌসুমের উপর নির্ভরশীল। মুসলিম জাহানজুড়ে চান্দ্রবর্ষের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম চললেও উপমহাদেশে ভূপ্রকৃতির বৈচিত্র্য ও মৌসুমগত সমস্যা সামনে আসে। ফলে প্রয়োজন পড়ে সৌরবর্ষের।
সম্রাট আকবর একারণে হিজরী চান্দ্রবর্ষকে সৌরবর্ষে রূপান্তরের আদেশ দেন। আদেশ পালন করেন তার দরবারের বিজ্ঞানী ফতেউল্লাহ সিরাজী। ৯৯২ হিজরীতে হিজরী চান্দ্রবর্ষ হিজরী সৌরবর্ষরূপে ভারত উপমহাদেশে চালু হলো। তবে আকবর যেহেতু এ ঘটনার ২৯ বছর আগে সিংহাসনে বসেন, অতএব বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হলো ৯৬৩ হিজরী সন থেকে। আকবরের সনের মাসগুলোর ফার্সি ছিল যথাক্রমে ফারওয়ারদীন, আর্দিবিহিশত, খুরদাদ, তীর, মুরদাদ, শাহরীয়ার, মিহির, আবান, আজার, দে, বাহমান ও ইসপন্দর।
এর আগে বাংলায় প্রচলিত ছিলো শকবর্ষ। এর পয়লা মাস ছিলো চৈত্র। কিন্তু ৯৬৩ হিজরীর মুহররম বা ফারওয়ার্দিন মাসে যেহেতু বাংলা মাস ছিলো বৈশাখ, তাই নতুন সনের পয়লা মাস বৈশাখকেই ধরা হয়। এর মানে বাংলা নববর্ষের প্রথম মাস হিসেবে বৈশাখ প্রথমবার স্বীকৃত হলো ৯৬৩ হিজরীর পরে। সে হিসেবে বাংলা নববর্ষ ও বৈশাখের প্রথম মাস হওয়ারই তো হাজার বছর হয়নি।
কিন্তু প্রশ্ন যেটা, সেটা হলো এখন ১৪২৩ বাংলা হয় কীভাবে? হলো, কারণ রাসূল সা. এর হিজরত থেকেই এ পঞ্জিকার শুরু। ১৪৩১ এর মানে হলো হুজুর সা. এর হিজরতের ১৪৩১ বছর। সৌর বছর চান্দ্র বছরের চেয়ে ১১/১২ দিন বেশি। হওয়ায় ৩০ বছরে চান্দ্র বছর এক বছর বেড়ে যায়। এজন্য ১৪৪৬ হিজরী সন মোতাবেক বাংলা ১৪৩১ হয়েছে। এর মানে বাংলাসনের গোটা ঐতিহ্য হচ্ছে মুসলমানী ঐতিহ্য।
এ দেশের প্রাচীন মানুষেরা মূলত ছিলো দ্রাবিড়। দ্রাবিড়দের উপর আগ্রাসন চালায় বহিরাগত আর্যরা। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালের দিকে। এর আগেই তারা ভারতে চালু করে বৈদিক আর্যধর্ম, যা পরে হিন্দুধর্ম বলে বিখ্যাত হয়। আর্যরা সর্বদাই অনার্য ধর্ম ও সভ্যতাকে তাচ্ছিল্য করেছে। তারা ঘৃণা করতো বাংলা ভাষা ও বাঙালিকে। বাংলা ভাষাকে বলতো ইতরদের ভাষা। বৈদিক নানা গ্রন্থে বাংলা ভাষাকে দাসের ও পক্ষীর ভাষা বলা হয়েছে, বাঙালিকে বলা হয়েছে দস্যু।
তারা বাঙালি জাতিসত্তা ও ভাষাকে খুন করার সকল প্রয়াস অব্যাহত রাখে। তারা লক্ষ্য হাসিল করেই ফেলতো। কিন্তু বাধা দিলো মুসলিম বিজয়। বিজয়ী মুসলিমরা বাঙালি ও বাংলা ভাষাকে দিল নবপ্রতিষ্ঠা।
বাংলার প্রাচীন লোকসংস্কৃতি ও মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ে নববিকাশে উজ্জীবিত এ সংস্কৃতিকেই বলা হতো বাংলা সংস্কৃতি। আর্যরা এ বাস্তবতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো বাধ্য হয়েই। কিন্তু ১৭৫৭ সালের পরে তারা ঘুরে দাঁড়ালো। ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির দাসত্ব গ্রহণ করে তারা প্রভাব ও সুযোগ-সুবিধায় বলিয়ান হলো। বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে দিলো নববিন্যাস, যা কিছু হিন্দুয়ানী, তাকে তারা অভিহিত করতে শুরু করলো বাঙালিত্ব বলে। বাঙালিত্বকে করে তুলতে চাইলো হিন্দুত্বের সমার্থক। যার ফলে শরৎচন্দ্রের গল্পে দুই দলের ফুটবল খেলায় এক দল বাঙালি, আরেকদল মুসলমান। শরৎ বাবুর এ বিবরণ বাবু বুদ্ধিজীবিদের মানসিকতার প্রতিফলন মাত্র। তারা বাঙালিত্ব বলতে হিন্দুত্বকেই বাজারজাত করে চললেন। অতএব, বাংলা নববর্ষকে হিন্দুয়ানী রূপ না দিলে তাদের চলছিলো না। আর্য-অনার্যের হাজার বছর পুরানো লড়াই নতুন করে নববর্ষের উদযাপনে প্রতিফলিত হলো।
ধীরে ধীরে পহেলা বৈশাখকে সাজানো হলো পৌত্তলিকতার বিশ্বাসজাত উপাদানে, তাকে পরানো হলো আর্য আধিপত্যবাদী প্রতীকের পোশাক আর একে বলা হতে লাগলো চিরায়ত বাংলা সংস্কৃতি। বাংলাদেশে এটা ঘটলো ভারতে আর এস এসের নতুন রাজনৈতিক হাত বিজেপির প্রতিষ্ঠা ও উত্থানের পরে। বৃষ্টি হয়েছে সেখানে, পানি এসে খেলা করছে এখানে!
তাদের এ প্রয়াস গণজীবনকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়। তবে তা অনেক আগ থেকেই গড়ে তোলে এক তাত্তিক ন্যারেটিভ, যার প্রধান ভাষ্যকার ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ দুজনের বুদ্ধিজীবিতা বাংলাকে করে দুই টুকরা, ভারতকে করে তিন টুকরা। তারা হিন্দুত্ববাদের মহাভারতীয় ভাষ্য তৈরি করেন, যার দাবি হলো ভারতীয় মানেই হিন্দুত্ব। ভারতে বসবাসকারী সকলেই হিন্দু, সে মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ যাই হোক। তার প্রথম ও প্রধান পরিচয় হচ্ছে সে একজন হিন্দু। হিন্দুবাদী সংস্কৃতি হলো ভারতের মূল সংস্কৃতি। একে গ্রহণ না করলে ভারতকে অস্বীকার করা হয়।
এই চিন্তাধারা জন্ম দেয় শিবসেনা, বজরং দল, বিজেপি ইত্যাদি। তারা মুসলিম বিদ্বেষকে হাতিয়ার বানিয়ে ভারতময় লাভ করে প্রতিষ্ঠা। তাদের রাজনীতি স্বতন্ত্র এক মতবাদরূপে জীবন লাভ করে, যার প্রথম ও প্রধান ভাষ্য হলো ভারতের সব ধর্মের মানুষকে হিন্দু ধর্মের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি গ্রহণ করতে হবে, মনুসংহিতায় রয়েছে যার বুনিয়াদ। তাদের এ মতবাদই হচ্ছে মনুবাদ।
নব্য মনুবাদের চোখে বাংলাদেশ স্বতন্ত্র দেশ হবার অধিকার রাখে না। সে বৃহত্তর ভারতেরই অংশবিশেষ। বৈদিক সাহিত্যে বাংলাকে নিন্দা করা হলেও এবং একে তাদের সাংস্কৃতিক সীমানার বাইরে দেখানো হলেও পরবর্তীতে বাংলা হয়ে উঠে তাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রধানতম শিকার। নতুন করে মনুবাদ যখন উপমহাদেশে আপন কর্তৃত্ব কামনা করছে, তখন তার আকাক্সক্ষা হলো বাংলায় সংস্কৃতি থাকলে থাকবে সেটাই, যা হিন্দুবাদের ধারক। ভারতে যেমন ভারতীয় জাতীয়তাবাদ মানেই হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ, তেমনি এ ভূখ-ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ মানেই হবে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ।
মনুবাদের প্রধান হাতিয়ার হলো সংস্কৃতি। সে যেখানে পা রাখতে চায়, আগে তার সংস্কৃতিকে পাঠিয়ে দেয়। সে যেহেতু আগ্রাসী, ফলে তার সংস্কৃতি আগ্রাসী অবয়ব নিয়ে প্রতিষ্ঠা পেতে চায়। সেটা কীভাবে? স্থানীয় সংস্কৃতিকে উচ্ছেদ করো। অস্বীকার করো। অবজ্ঞা করো। মনুবাদের সংস্কৃতিকে বসাও তার জায়গায়। মনুবাদের সংস্কৃতির ভিত্তি হলো হিন্দু ঐতিহ্য ও ধর্মীয় বিশ্বাস। যেমন পেঁচা মঙ্গলের প্রতীক, সে লক্ষ্মীর বাহন। ইঁদুর গণেশের বাহন, হনুমান রামের বাহন, হাঁস বিদ্যাদেবির বাহন, সিংহ দূর্গার বাহন, গাইগরু রামের সঙ্গী। মনুবাদ এদেরকে পূজা দেয় এবং সবার কাছে চায় এদের পূজা। এই পূজার সাংস্কৃতিক রূপ হলো ঘরে ঘরে এদের ছবি, এদের মুখোশ গায়ে জড়ানো, এদের নিয়ে মিছিল-টিছিল ইত্যাদি। মনুবাদ চায়, আপনি ধর্মে যাই হোন, আপনাকে এসব করতে হবে এবং এটাই আপনার সংস্কৃতি। এর বিপরিতে যা আছে, সেটা উচ্ছেদযোগ্য।
মুশকিল হলো মনুবাদ আপনার সামনে সরাসরি আসছে না এবং সম্মোহক বহু উপকরণ হাতে নিয়ে সে সক্রিয়। যায়নবাদ যা করে, সে তাই করছে। কিংবা অবলম্বন করছে সাম্রাজ্যবাদের খাসলতের সবচে বাজে দিকগুলো। সে টার্গেট এলাকায় ঘাটি গাড়ছে প্রধানত গণসংযোগের ক্ষেত্রসমূহে। মিডিয়ায় বিনিয়োগ করছে এবং মিডিয়াসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে গড়ে নিচ্ছে লেনদেনের বিশেষ সম্পর্ক। তার কথাগুলো উচ্চারিত হচ্ছে সিভিল সোসাইটির কণ্ঠে। বাংলাদেশে ক্ষমতার ভারসাম্য বিশেষভাবে তার দিকে হেলে পড়ায় প্রভাবশালীদের দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে এতোটাই, যতটা একদা ছিলো অভাবনীয়।
মনুবাদী রাজনীতি যেহেতু ভারতের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, অতএব বিশ্বরাজনীতির বাস্তবতায় পরাশক্তিগুলো তার প্রতি কম-বেশি প্রসন্ন। ইসলামফোবিয়া সেই প্রসন্নতাকে সহযোগিতার জায়গায় নিয়ে গেছে। ফলে সে পাচ্ছে বৈশ্বিক আনুকূল্য। অতএব, মনুবাদের মিশনকে এগিয়ে নিতে বহুজাতিক কোম্পানির বিনিয়োগ অতিস্বাভাবিক। কাজে কাজেই দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানি, মিডিয়া হাউস এবং সংস্কৃতির ময়দানে পোষ্য ফুট সোলজাররা যখন মনুবাদের প্রতীকসমূহ নিয়ে প্রচারণায় মাতে, তখন মোহিত হয়ো না নওজোয়ান!
লেখক: কবি, ইসলামি চিন্তাবিদ ও গবেষক।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

প্রাথমিক চিকিৎসাসহ নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষার্থীদের পাশে ইবি ছাত্রদল

হাজারীবাগ ভিওআইপি ব্যবসার মূলহোতা গ্রেফতার, দেড় হাজার সিম উদ্ধার

মৌলভীবাজারে বিরল প্রজাতির লজ্জাবতী বানর উদ্ধার

হুইসেল ব্লোয়ার ইন্ডিয়ান আর্মি অফিসারের ভিডিওতে কি আছে?

শেরপুরে ৩০ বছরে ও নিরসন হয়নি মানুষ বন্য হাতির দ্বন্দ্ব!

রায়পুর পৌর এলাকায় একমাস ধরে বিশুদ্ধ পানির সংকট

কালের বিবর্তনে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে গোদাগাড়ীর ঐতিহ্যবাহী মৃৎ শিল্প

দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ নির্বাচনের উভয় কক্ষেই পিআর সিস্টেমে ভোট চান জামায়েত আমীর

জার্মানিতে অস্ত্র-বিস্ফোরক মজুদকারী কিশোরসহ পিতা গ্রেপ্তার

ভ্যাটিকানের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার কাতার ত্যাগ

তারাকান্দায় সড়ক দূর্ঘটনায় পথচারীর মৃত্যু

ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের টাঙ্গাইলে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে মাছ ব্যবসায়ী খুন

দেশের জন্য সততার সঙ্গে কাজ করবে ‘জনতা পার্টি বাংলাদেশ’ : ইলিয়াস কাঞ্চন

গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া হেফাজত নেতা এখন ছাত্র-জনতা হত্যা মামলার আসামী

রাষ্ট্রব্যবস্থা পুনর্গঠনের কার্যকর সূচনা শিক্ষাঙ্গন থেকেই শুরু করা প্রয়োজন- আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী

মাভাবিপ্রবিতে ‘সি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত

পদ্মা পাড়ে ব্যাটারি রিসাইকেলিং কারখানা, লাখ টাকা জরিমানা

ডিমলায় স্কুলের ছাদের বীম ধসে আহত হয়েছেন এক শিক্ষিকা ও তার নয় মাসের ছেলে সন্তান

ফুলগাজীতে আড়াই লাখ টাকার ভারতীয় মালামালসহ যুবক গ্রেফতার

কাশ্মীরে হামলার ঘটনায় ভারতে নিষিদ্ধ পাকিস্তানি সিনেমা