যৌতুক ঠেকাতে ভারতের এক নারীর অভিনব লড়াই
০৬ জুলাই ২০২৩, ০১:১৭ পিএম | আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৩, ০১:১৭ পিএম
ভারতে ১৯৬১ সাল থেকে যৌতুক নিষিদ্ধ, কিন্তু এখনও কনের পরিবারের কাছ থেকে যৌতুক হিসেবে নগদ অর্থ, পোশাক, গহনা ইত্যাদি পাওয়ার আশা করে বরের পরিবার। নিষ্ঠুর এই সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন ভোপালে ২৭ বছর বয়সী এক শিক্ষিকা। এর অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে বিয়ের অনুষ্ঠানে পুলিশ কর্মকর্তাদের উপস্থিতির দাবি জানিয়ে তিনি এক পিটিশন শুরু করেছেন।
গুঞ্জন তিওয়ারি (তার আসল নাম নয়) বিবিসিকে বলেছেন যে তার নিজের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই তার এই পিটিশনের উদ্যোগ। তিনি বলেছেন যৌতুক দিতে রাজি না হওয়ার কারণে বহু পুরুষ শেষ পর্যন্ত তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। তার বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে যাওয়ার সবশেষ ঘটনাটি ঘটেছে এবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে, যখন কন্যার বিয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র খুঁজতে গিয়ে তার পিতা এক তরুণ ও তার পরিবারকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
আগত অতিথিদের সঙ্গে পিতামাতার শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর গুঞ্জনকে বসার ঘরে ডেকে পাঠানো হয়। এর পর একটি ট্রেতে ধোঁয়া ওঠা গরম চা ও কিছু নাস্তা নিয়ে তিনি সেখানে উপস্থিত হন। গুঞ্জন বলছেন ওই মুহূর্তে তিনি বেশ “নার্ভাস” ছিলেন। “প্রত্যেকেই আপনার দিকে তাকিয়ে আছে, তারা সবাই আপনাকে মাপছে,” বাড়ি থেকে টেলিফোনে তিনি আমাকে একথা বলছিলেন।
অতিথিদের সামনে গুঞ্জন কখন ও কিভাবে উপস্থিত হবেন- তার খুঁটিনাটি বিষয়ে বাড়িতে অনেক পরিকল্পনা হয়েছে। মা তার জন্য একটি সবুজ পোশাক পছন্দ করে রেখেছিলেন, কারণ তিনি মনে করেন সবুজ রঙের কাপড়ে তার মেয়েকে বেশ ভাল মানায়। এমনকি তিনি তার মেয়েকে অতিথিদের সামনে হাসতে মানাও করে দিয়েছিলেন। কারণ হাসলে তার অসমান দাঁত তারা দেখে ফেলবে।
এই ধরনের পরিস্থিতি গুঞ্জনকে বহুবারই সামলাতে হয়েছে। গত ছয় বছরে তিনি ছয় ছয়বার পাত্রপক্ষের পরিবারের সামনে হাজির হয়েছেন। তারা যেসব প্রশ্ন করে, সেগুলোও তার ইতোমধ্যে জানা হয়ে গেছে- পড়ালেখা, কাজ, এবং রান্না করতে পারেন কি না। বসার ঘরে ঢোকার আগে গুঞ্জন শুনতে পান যে হবু বরের পিতাকে তার বাবা মা জিজ্ঞেস করছেন তাদের কাছ থেকে তারা কতো যৌতুক আশা করছেন। “আমরা শুনেছি তারা ৫০ থেকে ৬০ লাখ রুপি চেয়েছিল। যখন আমার বাবা ওনার কাছে জানতে চাইলেন, তখন তিনি কৌতুক করে উত্তর দিয়েছিলেন- আপনার কন্যা যদি সুন্দরী হয়, আমরা আপনাকে ডিসকাউন্ট দেব,” গুঞ্জন বলেন।
বিয়ের কথাবার্তা এগিয়ে যেতে থাকলে গুঞ্জন বুঝতে পারলেন যে তাদের পরিবারকে সেই ডিসকাউন্ট আর দেয়া হচ্ছে না। অতিথিরা এক পর্যায়ে তার অসমান দাঁত ও কপালের তিল সম্পর্কে জানতে চাইলেন। নাস্তার পর্ব শেষে গুঞ্জনকে কয়েক মিনিট সময় দেয়া হলো হবু বরের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলার জন্য। সেসময় তিনি তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে যৌতুক দিয়ে তিনি তাকে বিয়ে করবেন না। ‘তিনিও আমার সঙ্গে একমত হলেন যে যৌতুক সমাজের একটি মন্দ প্রথা,’ বলেন গুঞ্জন। তখন তার মনে হয় যে বিয়ের ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত তিনি আরো যেসব পুরুষের মুখোমুখি হয়েছেন, তাদের থেকে তিনি আলাদা।
কিন্তু গুঞ্জনের পরিবার খুব শীঘ্রই জানতে পারে যে ওই পরিবারটি গুঞ্জনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ‘এজন্য আমার মা আমাকে দায়ী করেন। তিনি মনে করেন আমি যে যৌতুক-বিরোধী অবস্থান নিয়েছি তার কারণেই এই সম্বন্ধ ভেঙে গেছে। তিনি আমার ওপর খুব রেগে গেলেন এবং এর পর দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেন নি,’ বলেন গুঞ্জন। গুঞ্জন জানান তার পিতা গত ছয় বছরে “বিয়ের উপযুক্ত ছেলে আছে এরকম ১০০ থেকে ১৫০টি পরিবারের” সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাদের মধ্যে দুই ডজন পরিবারের সঙ্গে তাদের দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। ছয়টি পরিবার তাকে দেখতে এসেছিল যাদের সামনে গুঞ্জন নিজেই উপস্থিত হয়েছেন।
গুঞ্জন বলেন তাদের প্রায় সবাই যৌতুক দাবি করেছে এবং একারণে বিয়ের আলোচনা আর অগ্রসর হয়নি। “এরকম প্রত্যাখ্যানের কারণে আমি আমার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলি,” বলেন গুঞ্জন, যিনি গণিতে মাস্টার্স করেছেন এবং অনলাইনে টিউশনি করেন। “যখন এটা নিয়ে ভাবি, আমি জানি যে আমার কোনো সমস্যা নেই, এই সমস্যা তাদের যারা যৌতুক দাবি করছে। কিন্তু আমার প্রায়শই মনে হয় আমি যেন আমার পিতামাতার কাছে একটা বোঝা হয়ে গেছি।”
ভারতে যৌতুক দেয়া এবং নেয়া- দুটোই ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে বেআইনি। কিন্তু তারপরেও সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে দেশটিতে যতো বিয়ে হয় তার ৯০% ক্ষেত্রেই যৌতুক দেওয়া নেওয়া হয়। ধারণা করা হয় ১৯৫০ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত যতো যৌতুক দেওয়া নেওয়া হয়েছে তার পরিমাণ এক ট্রিলিয়ন ডলারের চার ভাগের এক ভাগ। যৌতুকের দাবি মেটাতে গিয়ে কন্যার বাবা মায়েরা সাধারণত বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে থাকেন, অথবা তাদের বাড়ি ও জমি জমা বিক্রি করে দেন। কিন্তু এই যৌতুকও স্বামীর পরিবারে তাদের কন্যার সুখী জীবন সবসময় নিশ্চিত করতে পারে না।
অপরাধ সংক্রান্ত জাতীয় রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুসারে পর্যাপ্ত পরিমাণে যৌতুক আনতে না পারার কারণে ভারতে ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ৩৫,৪৯৩ জন স্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। এই হিসেবে শুধুমাত্র যৌতুকের কারণে গড়ে প্রতিদিন ২০ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে।
-যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে যারা আন্দোলন করছেন তারা বলছেন ভারতে নারী ও পুরুষের সংখ্যায় ভারসাম্য না থাকার পেছনে এই যৌতুক একটি কারণ। জাতিসংঘের হিসেবে ভারতে প্রতি বছর প্রায় চার লক্ষ নারী ভ্রুণ জন্মের আগেই হত্যা করা হয়। কারণ পরিবারগুলো মনে করে যে কন্যার বিয়ের সময় তাদেরকে যৌতুক দিতে হবে।
ভোপালের পুলিশ প্রধান হরিনারায়নান চারি মিশ্রকে দেওয়া পিটিশনে গুঞ্জন তিওয়ারি বলেছেন এই সমস্যার একমাত্র সমাধান- যেসব ভেন্যুতে বিয়ের অনুষ্ঠান হয় সেখানে পুলিশের অভিযান এবং যদি দেখা যায় যে কেউ যৌতুক দিচ্ছে অথবা নিচ্ছে তাদেরকে গ্রেফতার করা। তিনি মনে করেন “শাস্তি পাওয়ার ভয় এই নিষ্ঠুর প্রথা বন্ধে সাহায্য করবে।”
গত সপ্তাহে মিশ্রর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিনি তার লড়াই-এ সাহায্যের জন্য এই অনুরোধ জানিয়েছেন। “যৌতুক সমাজের একটি মন্দ প্রথা এবং এর অবসান ঘটাতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমি সব পুলিশ স্টেশনকে নির্দেশ দিয়েছি কোনো নারী যদি এবিষয়ে যোগাযোগ করেন, তাকে যেন যথাযথ সাহায্য করা হয়,” মিশ্র আমাকে বলেন। তবে তিনি বলেন, “পুলিশের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, তারা তো সব জায়গায় উপস্থিত থাকতে পারে না এবং এবিষয়ে আমাদের মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।”
নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করেন এরকম একজন কর্মী কভিতা শ্রীভাস্তভা বলেন পুলিশ অবশ্যই সাহায্য করতে পারে, তবে যৌতুক মোকাবেলা করা একটি জটিল বিষয়। “ভারত তো পুলিশি রাষ্ট্র নয়, তবে দেশে যৌতুক নিষিদ্ধ করে একটি আইন আছে এবং এই আইনটিকে আরো ভালোভাবে প্রয়োগ করতে হবে।” তিনি বলেন যৌতুক যে একটি লোভী পরিবারের পক্ষ থেকে চাওয়া শুধুমাত্র এককালীন একটি দাবি তা নয়। দেখা গেছে বিয়ের পরেও কনের পরিবারের কাছ থেকে একের পর পর এক যৌতুক দাবি করা হতে থাকে। কারণ এই অর্থ খুব সহজে পাওয়া যায়, এটা খুব দ্রুত ধনী হওয়ার হওয়ার রাস্তা।”
কভিতা শ্রীভাস্তভা এরকম বেশ কিছু নারীর উদাহরণ দিয়েছেন যারা বিয়ের পরেও যৌতুক দিয়ে যেতে না পারার কারণে আজীবন পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন, এমনকি কাউকে কাউকে শ্বশুর বাড়ি থেকেও বের করে দেওয়া হয়েছে। তিনি মনে করেন তরুণ তরুণীরা যদি যৌতুকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তাহলেই একমাত্র এটিকে মোকাবেলা করা সম্ভব। যৌতুক প্রদান ও গ্রহণের ব্যাপারে তাদেরকে অস্বীকৃতি জানাতে হবে। গুঞ্জন বলেন তিনি বিয়ে করতে চান কারণ “জীবন অনেক দীর্ঘ এবং আমি একা একা এই জীবন কাটাতে পারবো না”, তবে তিনি এটা নিশ্চিতভাবে জানেন যে যৌতুক দিয়ে তিনি বিয়ে করবেন না।
তবে সময়ের সাথে সাথে বিয়ের জন্য তার ওপর পরিবারের চাপ ক্রমশই বাড়ছে। “প্রতিবেশী উত্তর প্রদেশে আমার পৈতৃক গ্রামের বাড়িতে আত্মীয় স্বজনরা মনে করে যে বিয়ের বাজারে ২৫ বছর বয়সী একজন নারী বয়স্ক নারী।” একারণে গুঞ্জনের পিতা পত্রিকার পাতায় পাত্রী চাই বলে যেসব বিজ্ঞাপন ছাপা হয় সেগুলোর দিকে নিয়মিত চোখ রাখেন। এছাড়াও তিনি তার আত্মীয় স্বজনকে বলে রেখেছেন তাদের চোখ ও কান খোলা রাখার জন্য যাতে উপযুক্ত কোনো পাত্রের সন্ধান পেলে তাকে জানানো হয়।
তিনি একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেও যোগ দিয়েছেন। এই গ্রুপে তাদের বর্ণ ও জাতের প্রায় ২০০০ সদস্য আছেন যারা সেখানে তাদের ছেলেমেয়েদের জীবনবৃত্তান্ত বা সিভি শেয়ার করেছেন। “বেশিরভাগই জাঁকজমক বিয়ে প্রত্যাশা করে যেখানে খরচ হবে ৫০ লাখ রুপি বা তার চেয়েও বেশি। আমার পিতা হয়তো তার অর্ধেক খরচ করতে পারবেন,” বলেন তিনি। গুঞ্জন আরো বলেন, তিনি যে যৌতুক না দিয়ে বিয়ে করতে চান একারণে তার পিতামাতার জীবন আরো বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে। “আমার পিতা বলেন যে আমার জন্য পাত্র খোঁজার কাজ মাত্র ছ’বছর হয়েছে। এখন তিনি বলেন যে যৌতুক না দিলে ৬০ বছর ধরে খুঁজেও আমার জন্য উপযুক্ত পাত্র পাওয়া যাবে না।” সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
কালিয়াকৈরে চাঁদাবাজের হামলায় চাঁদাবাজ কালামের মৃত্যু
বিরল উপজেলা শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত- ১
কামালপুর সড়কের ব্রিজ ভেঙ্গে মরণফাঁদ চরম দুর্ভোগে পথচারীরা
মেয়েদের ক্রিকেটে যুক্ত হলো যেসব সুযোগ-সুবিধা
বাড়ছে শীতের প্রকোপ, সাধারণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়
জকিগঞ্জে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে হামলার অভিযোগে যুবলীগ নেতা গ্রেফতার
খালিশপুরে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন
যুব এশিয়া কাপজয়ীরা পাচ্ছেন আর্থিক পুরস্কার
আদমদিঘীতে বিএনপি কার্যালয় উদ্বোধন
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে যা জানালেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
গোপালগঞ্জে বিএনপির বহিস্কৃত ও আ. লীগ কর্মীদের নিয়ে বিএনপির ২ জেলা কার্যালয়
কালীগঞ্জে ভাইরাল চিতাবাঘ হত্যার ঘটনায় দুইজন গ্রেপ্তার বন বিভাগ ও প্রশাসনে তোলপাড়
আশুলিয়ায় স্ট্যান্ডে চাঁদার দাবীতে হামলার অভিযোগ; আহত-১৩
সউদী আরবে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য দুই নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর
শুটিংয়ে গিয়ে আপত্তিকর আচরণ করায় নির্মাতার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মামলা
সালাম মুর্শেদীর ৪ মামলার জামিন নামঞ্জুর
সম্প্রীতির জন্য রাখাইন রাজ্যে টেকসই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অপরিহার্য: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
গবিসাসের নতুন সভাপতি সানজিদা, সম্পাদক ইভা
গাজীপুরের শ্রীপুরে কারখানার গুদামে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৭ ইউনিট