ঢাকা   শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৪ | ১০ কার্তিক ১৪৩১

ভারত থেকে গোমূত্র দিয়ে তৈরি যে রঙ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে

Daily Inqilab ইনকিলাব ডেস্ক

২৬ মার্চ ২০২৪, ০৫:৫৮ পিএম | আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২৪, ০৫:৫৮ পিএম

 

 

 

দুর্লভ নীল খনিজ, মমির দেহাবশেষ এবং গোমূত্র। প্রতিটি জিনিস একে অপরের থেকে একেবারেই আলাদা কিন্তু প্রত্যেকটিকেই এক সময় ব্যবহার করা হত রং তৈরি করতে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও পৃথিবীর বিখ্যাত অনেক চিত্রকর্মই কিন্তু আঁকা এই তিনটে জিনিস থেকে প্রস্তুত করা রঙ থেকে।

 

প্রাচীনকালে, রঙের পছন্দসই ‘শেড’ প্রস্তুত করা আজকের মতো সহজ কাজ ছিল না। সে সময়ে কৃত্রিম রং তৈরির প্রযুক্তি না থাকলেও মানুষ রং ব্যবহার করতেন। তা সে অজন্তার চিত্রকলা হোক, মুঘল আমলের মিনিয়েচার পেন্টিং হোক বা মধ্যযুগের ইউরোপীয় চিত্রকলা। এই রঙগুলোর কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল সে বিষয়টাও কম আকর্ষণীয় নয়।

 

গোমূত্র থেকে তৈরি ইন্ডিয়ান ইয়োলো

‘ইন্ডিয়ান ইয়োলো' হল কমলা ঘেঁষা হলুদ রঙ। উজ্জ্বল সোনালী রঙ আনতে এটা ব্যবহার করা হত। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ভারতে এই রঞ্জক ব্যবহার শুরু হয় এবং সেখান থেকে অচিরেই ইউরোপে পৌঁছায়। মুঘল আমলের অনেক মিনিয়েচার পেন্টিংয়ে এই রঙের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

 

ইউরোপের অনেক চিত্রশিল্পী ম্যুরাল, তৈলচিত্র এবং জলরঙে আঁকা চিত্রে এই রঙের ব্যবহার করেছেন। চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গগের আঁকা ‘দ্য স্টারি নাইটে’ হলুদ চাঁদ এবং জোসেফ ম্যালর্ড উইলিয়াম টার্নারের চিত্রকর্মের সূর্যের আলো দৃশ্যমান হওয়ার কারণ এই ‘ইন্ডিয়ান ইয়োলো’।

 

কিন্তু কীভাবে তৈরি হত এই রঙ?

দাবি করা হয়, গোমূত্র থেকে তৈরি হত ওই রং। যদিও সচরাচর রঙ তৈরির জন্য গোমূত্র ব্যবহার করা হত না। গোমূত্রতে ওই নির্দিষ্ট রং আনার জন্য গরুকে শুধুমাত্র আমের পাতা খাওয়ানো হত বলেও দাবি করা হয়। বিনা সমস্যায় যাতে তারা আমের পাতা খেয়ে নেয় সেই কারণে তাদের ক্ষুধার্থ রাখা হত এমনটাও বলা হয়ে থাকে।

 

‘ইন্ডিয়ান ইয়োলো’ রঙ তৈরির জন্য গোমূত্র মাটির পাত্রে সংগ্রহ করে ফোটানো হত। এরপর তা ছেঁকে নিয়ে, শুকিয়ে ছোট ছোট টুকরো প্রস্তুত করা হত। চিত্রশিল্পীরা এই রং পানি বা তেলের সাথে মিশিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী আঁকার জন্য ব্যবহার করতেন।

 

এই রঙ কীভাবে প্রস্তুত করা হয় সে বিষয়ে একটা প্রতিবেদন ১৮৮৩ সালে লন্ডনের সোসাইটি অফ আর্টসে উপস্থাপন করা হয়েছিল। এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করার জন্য বিখ্যাত লেখক ত্রিলোকীনাথ মুখোপাধ্যায় বর্তমান বিহারের মুঙ্গেরে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ওই রং কীভাবে প্রস্তুত হয় সে বিষয়ে গবেষণা করেন।

 

এই বিশেষ রঙ তৈরির সময় গরুর উপরে যে অত্যাচার করা হত তার বিবরণও তিনি দিয়েছিলেন সেই প্রতিবেদনে। পরে ১৯০৮ সালে নিষিদ্ধ করা হয় এই রঙ এবং পরবর্তী কালে, আধুনিক রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে হলুদ রং প্রস্তুত করা হত।

 

অজন্তার চিত্রকলা

প্রাচীনকালে ভারতীয় চিত্রকলা কতটা সমৃদ্ধ ছিল তার প্রতিফলন মেলে অজন্তার তৈলচিত্রে। লাল ও হলুদ রঙের ব্যবহারের আধিক্য রয়েছে ওই চিত্রকলায়। লালচে-হলুদ রঙ, লাল গিরিমাটি এবং হলুদ গিরিমাটি দিয়ে তৈরি সেই রং। দীপাবলিতে রঙ্গোলি তৈরির আগে মাটিতে যে রং বিছানো হত সেটাও কিন্তু এই গিরিমাটি দিয়েই তৈরি।

 

গিরিমাটি বা গৈরিক মাটি হল লালচে-হলুদ রঙের মাটি। এই ধরনের মাটিতে আয়রন অক্সাইডের পরিমাণ বেশি। মাটিতে লোহা এবং অন্যান্য উপাদানের পরিমাণ অনুযায়ী এই রঙও পরিবর্তিত হয়। পণ্ডিতদের কেউ কেউ মনে করেন গিরিমাটি ছিল মানুষের ব্যবহার করা প্রথম রঞ্জক। সারা বিশ্বে গুহাচিত্রে গিরিমাটিই ব্যবহার হয়েছে। অর্থাৎ এই রঞ্জকের বয়স প্রায় ১০ লক্ষ বছর। আজও আদিবাসী এলাকায় আদিবাসীরা তাদের শরীরে রঙ করার জন্য গিরিমাটি ব্যবহার করে থাকে।

 

‘লাপিজ লাজুলি’ আর ‘হান পার্পল’

অজন্তার চিত্রকলায় আরও এক রঙের দেখা মেলে যা নীল সমুদ্রের মতো গভীর, উজ্জ্বল এবং কিছুটা রহস্যময়ও বটে। বর্তমানে ‘আল্ট্রামেরিন’ নামে পরিচিত নীলের এই নির্দিষ্ট ‘শেড’-এর গল্প বেশ আকর্ষণীয়। আফগানিস্তানের সঙ্গে সরাসরি যোগ রয়েছে এই নীল রঙের।

 

আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলের খনিতে পাওয়া যায় 'লাপিস লাজুলি' নামক খনিজ। হিন্দি ও আরবি ভাষায় লাজবর্ত বা রাজবর্ত নামে পরিচিত ‘লাপিজ লাজুলি’। হরপ্পা সভ্যতার (সিন্ধু সভ্যতা) সময়েও এই খনিজ ব্যবহার করা হয়েছে। মেসোপটেমিয়াতেও ‘লাজুলি বিডস’ পাওয়া গিয়েছে।

 

প্রাচীন মিশরীয়রাও নীল নদ এবং রাজকীয় নীল রঙের প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু সেখানে এই রং আনার ঝুঁকি নিতে পারেননি তারা। এ কারণেই মিশরীয় শিল্পীরা সিলিকা, চুন, তামা এবং ক্ষার ব্যবহার করে রাসায়নিক রঙ তৈরি করেছিলেন। মিশরীয়দের তৈরি এই রঙটাকে বিশ্বের প্রথম রাসায়নিক রঞ্জক হিসাবে মনে করা হয়।

 

চীনেও বেরিয়াম, তামা এবং সিলিকেট রঞ্জক ব্যবহার করে নীল এবং বেগুনি রঙ প্রস্তুত করা হয়েছিল। এই রঙগুলো ‘হান ব্লু’ এবং ‘হান পার্পল’ নামে পরিচিত। এর আগেও অবশ্য ভারতে নীল রঙের ব্যবহার হয়েছে বিশেষত নীল পোশাক তৈরির জন্য। কিন্তু ‘ল্যাপিস লাজুলি’ রঙ তার চাইতেও বেশি চিত্তাকর্ষক।

 

নীল খনিজের সূক্ষ্ম গুঁড়ো গলা মোম, তেল এবং পাইন রজনের সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি এই রঞ্জক। সে সময়ে এই খনিজ খুবই দুর্লভ ছিল। কেবলমাত্র আফগানিস্তানেই পাওয়া যেত রাজবর্ত। এই কারণেই পশ্চিমে নীল খুব বেশি ব্যবহার করা হয়নি এবং কিছু ভাষায় তো নীল বলে কোনও শব্দও ছিল না।

 

তবে প্রায় এক হাজার বছর আগে আরব বণিকদের হাত ধরে ইউরোপে পৌঁছায় রাজবর্ত এবং এরপর সেখানকার ছবি বদলে যায়। সেই সময়ে ইউরোপে সোনার চেয়ে বেশি দামী ছিল রাজবর্ত। তাই শুধুমাত্র কয়েকটি জায়গাতেই ব্যবহার করা হত এটা। যিশু, মেরি এবং কখনও কখনও রাজপরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের চিত্রিত করতে ব্যবহৃত হত এই নীল রঙ ।

 

এমনকি মাইকেলেঞ্জেলো এবং রাফায়েলের মতো শিল্পীরাও এই রঙয়ের ব্যয়ভার বহন করতে পারতেন না। ডাচ শিল্পী জোহানেস ভারমির তার চিত্রকলায় বিপুল ভাবে এই রঙের ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এর ফলে তিনি ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে পড়েন। কৃত্রিম নীল রঞ্জকের ব্যবহার শুরু হয় ১৯ শতক থেকে। তবে ল্যাপিস লাজুলির আকর্ষণ আজও রয়ে গেছে।

 

সিঁদুরে লাল

সিনেবার বা সিঁদুর হল পারদের একটি আকরিক। এটি বিষাক্ত বলেও মনে করা হয়। প্রাচীনকালে উজ্জ্বল লাল রং তৈরির জন্য এই আগ্নেয়গিরির খনিজ ব্যবহার করা হত। সিঁদুরে লাল বলেও পরিচিত এই রঙ। এটা চীন, ভারত ও মায়ায় (মেক্সিকোর মেসো-আমেরিকান সভ্যতা) রঙ তৈরির জন্য ব্যবহার করা হত।

 

ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে মমি ব্রাউন নামক বাদামী রঞ্জক মিশরে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শিল্প ইতিহাসবিদ ভিক্টোরিয়া ফিনলে তার বই ‘কালারস - ট্রাভেলস থ্রু দ্য পেন্টবক্সে’ এ সম্পর্কে লিখেছেন। যেহেতু এই রঙটি কিছুটা স্বচ্ছ, তাই চিত্রে মানবদেহের আকৃতি বা ছায়া বোঝাতে ব্যবহার করা হত। এই রঙ প্রস্তুত করতে ব্যবহার করা হত অত্যন্ত প্রাচীন মমির অবশিষ্টাংশ। সূত্র: বিবিসি।


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

রোহিঙ্গাদের দেশের মাটিতে পা রাখতে দিল না ইন্দোনেশিয়া

রোহিঙ্গাদের দেশের মাটিতে পা রাখতে দিল না ইন্দোনেশিয়া

হাসিনার অবস্থান জানিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন

হাসিনার অবস্থান জানিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন

সুবিদ আলী ভুইয়া ও মৃণাল কান্তির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সুবিদ আলী ভুইয়া ও মৃণাল কান্তির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

তত্ত¡াবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল চায় ইসলামী ফ্রন্ট

তত্ত¡াবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল চায় ইসলামী ফ্রন্ট

যশোর আদ্-দ্বীন নার্সি ইনস্টিটিউটে নবীন বরণ ও গুনিজন সংবর্ধনা

যশোর আদ্-দ্বীন নার্সি ইনস্টিটিউটে নবীন বরণ ও গুনিজন সংবর্ধনা

নোয়াখালীতে মাদরাসা থেকে ফেরার পথে নসিমন চাপায় ছাত্রের মৃত্যু

নোয়াখালীতে মাদরাসা থেকে ফেরার পথে নসিমন চাপায় ছাত্রের মৃত্যু

ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় নারায়ণগঞ্জে আনন্দ মিছিল

ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় নারায়ণগঞ্জে আনন্দ মিছিল

আকিজ বেকারিকে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করলো নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ

আকিজ বেকারিকে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করলো নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ

ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ থেকে বাঁচতে সকলকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার আহŸান পীর সাহেব চরমোনাই’র

ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ থেকে বাঁচতে সকলকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার আহŸান পীর সাহেব চরমোনাই’র

প্রেসিডেন্টের অপসারণ নিয়ে যে সিদ্ধান্ত হলো উপদেষ্টা পরিষদে

প্রেসিডেন্টের অপসারণ নিয়ে যে সিদ্ধান্ত হলো উপদেষ্টা পরিষদে

সাতকানিয়ায় ছাত্র-জনতার ওপর হামলারী আ.লীগ নেতা গ্রেফতার

সাতকানিয়ায় ছাত্র-জনতার ওপর হামলারী আ.লীগ নেতা গ্রেফতার

'কেটে গেছে সকল শংকা, নিশ্চিত হয়েছে ভেন্যু, উন্মুখ দর্শক,আতিফের অপেক্ষা'

'কেটে গেছে সকল শংকা, নিশ্চিত হয়েছে ভেন্যু, উন্মুখ দর্শক,আতিফের অপেক্ষা'

টয়লেটের কাজ সেরে সঙ্গে সঙ্গে অজু করা প্রসঙ্গে।

টয়লেটের কাজ সেরে সঙ্গে সঙ্গে অজু করা প্রসঙ্গে।

বরিশাল অঞ্চলে ‘জরায়ুমুখ ক্যন্সার’ প্রতিরোধে ৫ লাখ কিশোরীকে ‘এইচপিভি’ টিকাদান কর্মসূচী শুরু

বরিশাল অঞ্চলে ‘জরায়ুমুখ ক্যন্সার’ প্রতিরোধে ৫ লাখ কিশোরীকে ‘এইচপিভি’ টিকাদান কর্মসূচী শুরু

সাহিত্যসমাজে অবক্ষয়

সাহিত্যসমাজে অবক্ষয়

যৌতুক

যৌতুক

কবিতার বাঁক বদল এবং নতুন ধারা

কবিতার বাঁক বদল এবং নতুন ধারা

মানুষের বিবর্তন

মানুষের বিবর্তন

বিদ্যুৎ ব্যবহারে অবহেলা

বিদ্যুৎ ব্যবহারে অবহেলা

তারেক রহমানের স্টেট রিফরমেশন : দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ

তারেক রহমানের স্টেট রিফরমেশন : দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ