সাহিত্যসমাজে অবক্ষয়
২৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৯ এএম
কবি-সাহিত্যিকেরা কথাটা কোনভাবে গ্রহণ করবেন জানিনা; কিন্তু কথাটা ঠিক যে বিষবৃক্ষে ফল ধরেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই আমাদের সমাজে এ বিষবৃক্ষ মহীরুহের আকার ধারণ করে। এর নাম অবক্ষয়।
এই বিষবৃক্ষের বিষফল মানুষের নৈতিক চেতনাকে ধ্বংস করে, মানুষকে পরিণত করে মনুষ্যত্ববিবর্জিত প্রাণীতে।
এরই প্রভাবে এদেশের কবি-সাহিত্যিকদের মহলে দেখা দিয়েছে অবক্ষয়, শুরু হয়েছে মানবিক গুণাবলির পঁচন।
মাত্র তিন চার দশককালের মধ্যেই সমগ্র সমাজ-শরীর পরিণত হয়েছে অন্তঃসারশূন্য পঁচনশীল অসার শরীরে। অর্থাৎ বিষবৃক্ষ আজ ফুলে-ফলে পরিপূর্ণ, বিষফলের প্রাচুর্যে আমাদের সমগ্রটা দেশ আজ বিষময়।
অন্য বুদ্ধিজীবীদের কথা স্থগিত রেখে আপাতত সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের প্রসঙ্গেই কথাটা কিছুটা ব্যাখ্যা করতে চাই। দেশের গ্রন্থালয়গুলোতে গ্রন্থসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। পত্র পত্রিকার সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। আর সাহিত্যযশপ্রার্থীদের সংখ্যাও-যে বেড়েছে তার প্রমাণ রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, সংবাদপত্র, সাময়িকপত্র ও পুস্তকপুস্তিকা ইত্যাদিতে প্রতিদিন পাওয়া যায়। অর্থাৎ আমাদের সাহিত্যের পরিমাণগত বিকাশের ধারা-যে অত্যন্ত পরিপুষ্ট, এক বাক্যে তা সকলেই স্বীকার করবেন। তাই বলে এই স্ফীত ধারাটি নিশ্চয়ই এমন কোন সত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না যে, বাংলাদেশে খুব বড় মনীষাসম্পন্ন বিদগ্ধ ও নীতিনিষ্ঠ প-িত-কবি-কথাসাহিত্যিকেরা রয়েছেন।
এই ঢাকা শহরেই আজকাল পাঁচ-দশজন যুবক লিখিয়ে যখন আলোচনায় কিংবা চায়ের আড্ডায় বসেন তখন নির্দ্বিধায় এসব কথা উচ্চারণ করেন যে, অগ্রজ প্রবীণ কবিসাহিত্যিকেরাই তো তাদেরকে নীতিহীন নাম কুড়োবার, স্থিতিহীন খ্যাতি কিনবার এবং চরিত্রহীন পুশিং ড্যাসিং-এর, সাধু বাংলায় তৈল মর্দনের রীতিতে অভ্যস্ত করিয়ে দিচ্ছেন। যদি কেউ উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করতে ও অধিষ্ঠান পেতে চায়, তবে তার অভ্যস্ত হওয়া উচিত ডাহা মিথ্যা কথা বলায়, যথাযোগ্য তদবিরে ও আড়ম্বরপূর্ণ স্বেচ্ছাচারী জীবনের স্বপ্নে।
এই-যে উচ্চশ্রেণিতে আরোহণের কৌশল, সেতো শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই ভাগ্যসন্ধানী শিক্ষিতরা তোয়াজ-তোষামোদ করে একদিকে যেমন ইংরেজ শাসনের প্রতিষ্ঠায় ও স্থায়িত্বে সহায়তা করেছিলেন, তেমনি নিজেদের আখেরও বেশ ভাল রকমেই গুছিয়ে নিয়েছিলেন। তাই দেখা যায়, তৈলমর্দনে, তোষামোদে, বুদ্ধির কারবারে, প্রবঞ্চনামূলক আচরণে, প্রতারক প্রগতিশীলতায় এই বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের দীর্ঘকালের ঐতিহ্য আছে।
মধ্যযুগে কবিরা আর্থিক দিক দিয়ে সাধারণত পরনির্ভর জীবন যাপন করতেন, এবং রাজা-বাদশা-জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় সাহিত্য চর্চা করতেন। কিন্তু ব্রিটিশ রাজত্বে তাঁরা সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটালেন। সাহিত্য-সেবকও অনেকে জমিদার শ্রেণীর, কখনো তারও বড়ো ধনিক-শ্রেণির লোক হয়ে উঠলেন। অল্প কয়েকজন মনীষাসম্পন্ন মহৎ ব্যক্তির কথা বাদ দিলে, মনে হয়, একটা মোহ অতঃপর এই বিদ্যাব্যবসায়ী মসীজীবীদের প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠল। প-িত-কবি-কথাসাহিত্যিকের মেধা পরিণত হল বৈশ্যের পণ্যে, তাঁরা ধাবিত হলেন সোনা-রূপা-কাঁচা টাকার চাকচিক্যে মোহিত হয়ে। মোহ-যে কোন কালেই ভাল ফল দেয়না--একথা অস্বীকার করবেন, এমন একজন ব্যক্তিকেও বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবেনা। তবে এ-ও বক্তব্য নয় যে, অগাধ ধনের মালিক কখনও কালজয়ী কবি সাহিত্যিক হতে পারবেন না, কিংবা কোন ব্যক্তি ধনবান হলেই তাঁর সাহিত্যিক বোধ বা বুদ্ধিমত্তা ক্রমশ নি¤œগামী হতে থাকবে।
আধুনিক কালের সেরা সাহিত্য তো সেগুলিইÑধন-বৈষম্যের বিরুদ্ধে ধনবণ্টন সম্পৃক্ত কথা গণমানুষের পক্ষে যেগুলোতে উচ্চারিত হয়, এবং যারা দরিদ্রের দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে, অশিক্ষিতের অশিক্ষার বিরুদ্ধে আর অবহেলিতের মর্যাদার পক্ষে বক্তব্য প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হয়। এই সেরা সাহিত্যের রচয়িতারা গণসাহিত্যিক এবং তাদের সাহিত্যকর্ম গণসাহিত্য নামে পায় খ্যাতি ও স্বীকৃতি। যারা বিশেষ ধনবান ও ক্ষমতাবান চলচ্চিত্র অভিনেত্রীদের মতো খ্যাতির শীর্ষে অধিষ্ঠিত বাংলাদেশের সেই কবি-সাহিত্যিক-প-িত-বিদূষকেরাই কিছুকাল যাবৎ ‘গণ’-পরিচয় অর্জনে অধিক তৎপর হয়ে উঠেছেন। সাম্প্রতিককালে প্রগতির নামে প্রতারণা যত কার্যকরভাবে চালানো সম্ভব, শ্রমিক-কৃষকের নামে ক্ষমতা ও খ্যাতি অর্জন ও সংরক্ষণ যত সহজে সম্ভব, অন্য কোন উপায়েই তা সম্ভব নয়। খ্যাতিমান, ক্ষমতাবান ও ধনবান হলেই নীতিহীন অধমে পরিণত হতে হবে--এটাই কি মানুষের অনিবার্য নিয়তি?
বাংলাদেশের সাহিত্যসমাজে ‘যে-কোন উপায়েই হোক আর্থিক সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন করতেই হবে;’ এই মানসিকতা দৃঢ়ভাবে শিকড় গেড়ে বসেছে। বাংলাদেশের প্রতিপত্তিশালী কবি-সাহিত্যিকদের মহলে সুস্থ প্রতিযোগিতা আজকাল মন্দ বলেই বিবেচিত হয়। তবু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, অনুশীলন-পরিশীলন-অধ্যবসায়ের, অর্থাৎ সাধনার মধ্যদিয়ে হয় যে প্রতিযোগিতা, এবং তার মধ্যদিয়ে যে-প্রতিষ্ঠা হয়ে আসে। অবধারিত, তার স্থিতিও হয় নিশ্চিত, নন্দিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত, কালের কপোলতলে তার বিলয় সহজে সম্ভব হয়না।
প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে কি এদেশীয় কবি-সাহিত্যিকেরা সাধনা না-করেই প্রতিষ্ঠা পান? অথবা তাদের চেষ্টা কি কেবলই আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও সামাজিক প্রতিপত্তি অর্জনের জন্য? পরিশ্রম ও অধ্যবসায় ব্যতীত কোনদিনই কোন ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠা অর্জনে সক্ষম হয়না। আর কোন কিশোরই শুধুমাত্র আর্থিক বা সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জনের কল্পনায় সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়না। জাগতিক সিদ্ধিলাভের অন্য বহু ক্ষেত্র ও উপায় সমাজে রয়েছে। সেসব উপায় অবলম্বনও তুলনামূলক ভাবে সহজ।
মানব মনের সহজ ও স্বাভাবিক শিল্পানুরাগ থেকেই কোন তরুণ প্রথমে সাহিত্যের রসাস্বাদনে ব্রতী হয়। আপন-মনের আন্তর-আনন্দেই সব লেখক প্রথম সাহিত্য-সৃষ্টিতে মেতে ওঠেন। কিন্তু পারিপার্শ্বিক কারণে ক্রমেই তাকে এই বোধে পেয়ে বসে যে, অর্থস্বাচ্ছন্দ্য ও খ্যাতি তাকে অর্জন করতেই হবে। তখন শুরু হয় ভিন্ন গন্তব্যমুখী প্রচেষ্টা। তাতে সবাই যে জয়ী হন, তা নয়; পরাজিতের সংখ্যাও নেহাত নগণ্য নয়। অতঃপর অপরিণামদর্শী এই অভিযাত্রায় অবক্ষয় তাঁদেরকে পেয়ে বসে। স্বাচ্ছন্দ্য অভিলাষের অর্থচিন্তা ক্রমে বিলাসের কল্পনায় পরিণত হয়। খ্যাতির আকাক্সক্ষা রূপান্তরিত হয় বল্গাহীন নিয়ন্ত্রণহীন এক স্বৈরাচারী অনন্ত আকাক্সক্ষায়।
অথচ লেখক যদি অন্তঃস্থিত শ্রেয়োচেতনা ও বিবেককে ধ্বংস না করে মহৎ সৃষ্টির সাধনায় নিষ্ঠাবান থাকেন, তবে তাঁর রচনা স্বগুণেই একদিন প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে। তখন অর্থ ও খ্যাতিও অবশ্যই লেখকের পদানত হয়। সংশয় নেই, এই অর্থ সৎ-উপার্জন ও খ্যাতি সাধনালব্ধ বলে তা হয় সর্বজননন্দিত। কিন্তু আমাদের লেখকদেরকে তার জন্য তর সইতে দেখা যায় না। রাতারাতিই খ্যাতি ও প্রতিপত্তির শীর্ষে আরোহণ করে তার বিনিময়ে তাঁরা চেষ্টা করেন বিদেশ-ভ্রমণ, আর্থিক-স্বাচ্ছন্দ্য-অর্জন ও ভোগ বিলাসের সকল কামনা পরিতৃপ্ত করতে। অর্থাৎ জেনেশুনেই তাঁরা অধঃপতনের শিকার হন। যেহেতু তাঁরা শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, তাই জেনেশুনেই তাঁরা বিষপান করেন, ধ্বংস-কূপে ঝাঁপ দেন--পতঙ্গ যেমন ঝাঁপিয়ে পড়ে অগ্নিশিখায়।
আধুনিক কালে অবশ্য সম্পদলিপ্সা আর যশোলিপ্সা প্রশংসাই পেয়ে থাকে। কিন্তু প্রশংসার বাহুল্যে সম্পদলিপ্সু ও যশোলিপ্সুুদের প্রচেষ্টার মধ্যে হীনমন্যতা গভীরভাবে প্রবেশিত আজ। অচিরেই তাঁরা হয়ে ওঠেন সীমাহীন লোভী। লোভাতুর ব্যক্তির কৌশলে-অর্জিত খ্যাতি ও অর্থের মধ্যে অনেকটা ফাঁকি থাকে। কিন্তু সে ফাঁকি একদিন না একদিন ধরা পড়ে, এবং ফাঁকির সাহিত্যও হয় অবহেলিত আর তার রচয়িতা হন নিন্দিত। দেখা যায়, একযুগ আগে যিনি দেশবরেণ্য সাহিত্যিক, সামান্য সময়ের ব্যবধানেই তিনি বড় অনাধুনিক, কেউ আর তাঁর রচনা পড়তে আগ্রহী নয়। তরুণ সমাজে তিনি অবহেলিত, পরিত্যক্ত; তিনি প্রতিপত্তিশালী লোক হলে প্রকাশকেরা তার যন্ত্রণায় উত্যক্ত।
অথচ মনে হয়, জ্ঞান-কর্ম ও নীতি-নিষ্ঠ লেখক যদি শ্রেয়োচিন্তার বশবর্তী হয়ে সর্বদা নিরলস নিরপেক্ষ অধিক সংখ্যক লোকের উপযোগী শিল্পোত্তীর্ণ রচনায় মনোনিবেশ অব্যাহত রাখেন, তাহলে, তাঁর রচনা উত্তরোত্তর উন্নত হতে থাকে এবং সব সময়ই তিনি যুগোপযোগী ও আধুনিক থাকেন, কোন সময় কোন জেনারেশন তাঁকে অবহেলা করতে কিংবা দলচ্যুত করতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন যেমন তাঁর যুগের শ্রেষ্ঠ আধুনিক, তেমনি পরবর্তী জেনারেশনে নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন দত্ত প্রমুখ লেখকও শুধু প্রথম যৌবেন নয়, খ্যাতির আলোকোজ্জ্বল মধ্যগগনেও ছিলেন সমান আধুনিক।
বলা যাবে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কজন প্রতিভার তুলনা সম্ভব? তাহলে জীবনানন্দ দাস, সুধীন দত্ত’র কথাই হোক; বিশ-তিরিশের দশকের এই কবিরা কি সত্তর-আশির দশকের তরুণ ও আধুনিক কবিদের সমান আধুনিক নন? কোন নব্য লেখক এঁদের লেখাকে অবহেলা করতে পারেননি। বিব্রতকর অবস্থাতেও পড়তে হয়নি এঁদের লেখা নিয়ে কোন সম্পাদককে।
এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়; খ্যাতি ও অর্থের মোহ আজ সাহিত্যিকদের পেয়ে বসেছে সাংঘাতিক ভাবে। তাই ভাবনা চিন্তার অবকাশ না রেখেই লেখক যে- কোন অবক্ষয়ী পথ গ্রহণ ও বরণ করে নেন, কায়েমী স্বার্থবাদী প্রশাসনযন্ত্রের সহায়ক হয়ে তাৎক্ষণিক ফাঁপা উদারনৈতিক মেকি প্রগতিশীল আধুনিক সাহিত্য রচনায় ব্রতী হন। ক্ষমতা অর্জনের সাহিত্যকর্মের দ্বারা তাঁদের কাক্সিক্ষত ধন ও মান হস্তগত হয়।
কথা উঠতে পারে: যশ-মান-ধন প্রতিটি মানুষের প্রতিটি ক্ষেত্রে একান্ত কামনার বস্তু; আর সব লেখকই মনে করেন তিনিই জগতে একমাত্র উৎকৃষ্ট লেখক এবং তাঁর রচনাই শ্রেষ্ঠ সাহিত্য; অতএব স্বাভাবিকভাবেই রচনা, মুদ্রণ ও প্রকাশের জন্য তিনি ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। সর্বজনবিদিত হবার, খ্যাতিমান হবার কল্পনা তাঁর সকাল-সন্ধ্যার একমাত্র ধ্যান হয়। কর্তব্য-কর্মে নিষ্ঠাবান থেকে খ্যাতি অর্জন সুদূরপরাহত দেখে স্বাভাবিকভাবেই সহজলভ্য প্রচারমাধ্যমে তিনি ভাড়া খাটতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। আর এ আগ্রহে তিনি সাহায্য পান সরকারি প্রচার মাধ্যমের--রেডিও, টেলিভিশন, আর বিভিন্ন দৈনিক ও রম্য সাপ্তাহিক পত্রিকার এবং অর্থগৃধু ব্যবসায়ীদের। তারপর ঐ মেধাবী লেখক ব্যয়িত হন ক্ষমতাসীনদের শৃঙ্খলিত কায়েমী স্বার্থবাদী প্রীতিপদ নিবীর্য রচনায় এবং অর্থলোভী প্রকাশকদের জন্য রম্য, চটুল, ইন্দ্রিয়পরিতৃপ্তিকর গ্রন্থ তৈরিতে। এখানে আমাদের প্রশ্ন: স্বতঃস্ফূর্ততাই কি মনুষ্য জীবনের একমাত্র পথ?
দেশের রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের যেহেতু বই পড়ার, গ্রন্থ জগতের খবর রাখার, বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তাই এসব চলে সবার চোখের উপর। সকলের সাথে রাজনীতিবিদেরাও তাই জাত-পাত নির্বিশেষে সব খ্যাতিমানদের তোষামোদ করেন। সরকারি খরচে যদৃচ্ছ বিদেশ-ভ্রমণে কেউ আপত্তি তোলেন না। নীতি-বিগর্হিত প্রকাশনার বিরুদ্ধে কেউ সোচ্চার হন না। অন্য সকলের ন্যায় অবক্ষয়ী ধারার কবি-সাহিত্যিকদের দ্বারাও সমাজের অধঃপতন এভাবে ত্বরান্বিত হয়। আর কবি সাহিত্যিকেরাও সীমাহীন খ্যাতির আকাক্সক্ষায় নিজেদেরকে বিরল স্রষ্টা ও প্রবক্তা ভেবে মিথ্যা গৌরববোধে আচ্ছন্ন হন। দুনিয়ার সব প্রধান পদ, পুরস্কার ও বিলাসের উপকরণ কেবলমাত্র তাঁদেরই প্রাপ্য বলে তাঁরা মনে করতে থাকেন।
দুঃখের বিষয় এসব প্রাপ্তির সুযোগ ও সমাজই দিয়ে থাকে। তাই দেখা যায়, প্রকাশনা সংস্থা, রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে এঁদের স্থান উচ্চে, পঞ্চমুখে এঁদের খ্যাতি কীর্তিত হয়। তখন উদারনৈতিক রাজনৈতিক সংঘে, স্বার্থবাদী প্রশাসন-যন্ত্রে, প্রগতিশীল প্রতিক্রিয়াশীল সকল সামাজিক সংগঠনে, এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও এঁদের নির্বিচার পদচারণা দেখা যায়। ডানপন্থি বামপন্থি সকল প্রকাশক তাঁদের গ্রন্থ প্রকাশে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন। লেখক তখন আত্মতৃপ্তিতে সিক্ত ও প্রীত হন। কিন্তু মুখে এঁটে রাখেন অটল গাম্ভীর্য। কারণ, তিনি এত দিনে বুঝে নিয়েছেন আমাদের সমাজ, মানুষ ও রাষ্ট্রের কি স্বভাব। এই সুযোগ তাই তিনি প্রত্যাখ্যান করেন না। সমস্ত মনকে তখন কেবল সুযোগের সন্ধানেই নিবিষ্ট রাখেন।
মৌলিক ও মননশীল রচনার জন্য সব সময়ই একটা অখ- সময় ও সাধনার প্রয়োজন। কিন্তু একজন লেখক যদি কেবল অর্থ ও খ্যাতির প্রতিযোগিতায়ই সময় ব্যয় করতে থাকেন, তবে তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হয়না ক্রম-আধুনিক ও মননশীল রচনা। তাই পুরনো লেখাকে মূলধন করে তিনি এই পরিচ্ছন্ন ব্যবসায়ে নিয়োজিত হন। অতএব বিষয়বস্তুর জন্য আর তাঁকে ভাবতে হয় না। কলম ধরলেই বেরিয়ে আসে রচনা। কখনও কমতি দেখা দিলে পুরনো কাসুন্দিতে পানি মিশিয়ে পূর্ণ পাত্রই প্রদান করেন। নিয়মিত ব্যবসায়ী কখনও দোকান খালি রাখেন না। প্রয়োজন পড়লে অন্য দোকান থেকে দ্রব্য এনে খরিদ্দার আপ্যায়ন করেন। তেমনি, লেখকও যদি ব্যবসায়ী হন, তবে তিনিও লেখা থেকে বিরত হননা। আর ব্যবসাতে মুনাফা হয় না এমন ক্বদাচিৎ ঘটে।
ব্যবসায়ীর অর্থচিন্তা প্রয়োজনসীমা অতিক্রম করলে তা অর্থবিলাসিতায় পরিণত হয়। বাংলাদেশী সাহিত্যিকেরা বেশি করে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে খ্যাতির প্রয়াসী হন বলে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়না। তাই কার্যত দেখা যায়, সাহিত্য সৃষ্টিতে ব্রতী হয়ে আর্থিক ও কালিক খ্যাতি অর্জনের পরেই তিনি থেমে যেতে বাধ্য হন। ক্রীড়াবিদের বিজয়ের পরবর্তী শারীরিক ও মানসিক অবসাদের মতো একপ্রকারের আলস্য তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। অতঃপর এই অলস, তৃপ্ত লেখকের লক্ষ্য ও অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায় ইন্দ্রিয় পরায়ণতা। অর্থ ও খ্যাতি তার ইচ্ছা পূরণে সহায়তা করে।
তুষ্ট, তপ্ত লেখক প্রশান্তির আবহে ভুলে যান পূর্বের ক্ষুধা, অতৃপ্তি ও অভাবের অনুভূতি। চতুষ্পদ প্রাণীর জাবর কাটার ন্যায় অতঃপর ইন্দ্রিয়পরায়ণ এই অক্ষম লেখক এককালের বীর্যবত্তার প্রচাপে সৃষ্ট মূলধনকে সম্বল করে উপভোগে মত্ত হন। বীর্যহীন শরীর যেমন সৌন্দর্য- জ্যোতিহীন, নিষ্প্রভ–তেমনি নিবীর্য লেখকের রচনাও প্রভাহীন, জ্যোতিহীন, আলো দানে অক্ষম। পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণে এই ধরনের রচনা কখনও সফল হয় না। আর এরূপ লেখকেরাও হন অদর্শনীয়, অপ্রিয় ও অবহেলিত। অবহেলা ও নিন্দা মানুষকে করে তোলে সঙ্কীর্ণমনা, সাহসহীন ও সম্মুখ-অভিযাত্রায় বিমুখ। অতএব লেখক বস্তুত জীবিত থেকেও অকালমৃত্যু বরণ করেনÑসাহিত্য সংসারে হয়ে পড়েন তিনি বিগত কালের।
এঁদের কেউ যদি বা রচনার ধারা অব্যাহত রাখেন, তবু তাঁর পরবর্তী কালের সাহিত্যপ্রয়াস হয় কেবল নতুনদের অভিসম্পাত করার ও অপরকে হীন প্রতিপন্ন করার জন্য। আর এরই থেকে সৃষ্টি হয় পক্ষপাতদুষ্ট সমালোচনার ও সাহিত্যে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির বৈপরীত্য সৃষ্টিকারী বিভিন্ন ধারার।
দেখা যায়, সমালোচনা সাহিত্য আজকাল এক সঙ্কীর্ণ পথ ধরে এগুচ্ছে। বঙ্কিমপর্বের ও রবীন্দ্র-পর্বের সমালোচকেরা বিচার ও রস বিশ্লেষণে যে অনন্য অনুভবশক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে বাঙালীর মানস প্রকর্ষ ও প্রগতিশীলতার উজ্জ্বল নিদর্শনসমূহ রেখে গেছেন, বর্তমান সমালোচকগোষ্ঠী তার পরিচয় দিতে পারছেন না। নির্মোহ, সংযত, সাহসী ও পরশ্রমী সমালোচকের আজ বড় অভাব। পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের আওতায় কারও সৃষ্টিকে পরখ করে মূল্যায়ন করার কথাও কেউ ভাবেন না; অথচ মানুষের সৃজনসত্তা গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমেই অধিকতর নিখুঁত পরিশীলিত ও সুন্দর রূপে বিকশিত হবার সুযোগ পায়। কিন্তু সেকথা কেউ ভাবেন না। আজকাল আন্তরিকতাহীন, প্ররোচনাদুষ্ট, উচ্ছ্বাসপ্রবণ, পক্ষপাতিতুকারী সমালোচনাই চলছে।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রাষ্ট্র গঠনে তারেক রহমানের ৩১দফা প্রচারে রামপালে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত
বিসিসিএমইএ আগাম নির্বাচনের সিদ্ধান্ত
‘ফিন্যান্স ডিরেক্টর অফ দ্য ইয়ার ২০২৪' হিসেবে স্বীকৃত পেলেন ব্র্যাকের সিএফও তুষার ভৌমিক
টেকনোলজি লিডারশিপে উৎকর্ষের জন্য সি-সুইট অ্যাওয়ার্ড পেলেন বিএটি বাংলাদেশের সারজিল সারওয়ার
আন্তর্জাতিক শিক্ষাক্রমের প্রতি বাংলাদেশি অভিভাবকদের আগ্রহ বাড়ছে
ইবি শিক্ষার্থীকে হেনস্তার অভিযোগে গোল্ডেন লাইনের আটক
গণঅভ্যুত্থানের বিশ্বাসের সঙ্গে বেঈমানি করলে প্রধান উপদেষ্টাকেও ছাড় নয়
সচেতনতা হাজার হাজার শিশুকে বাঁচাতে পারে অন্ধত্ব থেকে: কর্মশালায় বক্তারা
হত্যা মামলার আসামি হয়েও ধরাছোয়ার বাইরে পুলিশ কর্মকর্তারা
৫ আগস্টের পর থেকে আমরা কথা বলার অধিকার ফিরে পেয়েছি -আবুল হোসেন আজাদ
গণ-অভ্যুত্থানের বিশ্বাসের সাথে বেঈমানি করলে কাউকেই ছাড়া দেয়া হবে না - রাজশাহীতে সারজিস আলম
বুদ্ধিজীবী হত্যার রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি- এড. মুয়াযযম হোসাইন হেলাল
মানিকগঞ্জে ডিএফএ'র নতুন কমিটির সভাপতি ইলিয়াস, সম্পাদক আলাউদ্দিন
পশ্চিমবঙ্গের একই জেলায় ‘বাবরি মসজিদ’ ও রাম মন্দির গড়তে চায় তৃণমূল-বিজেপি
মুসলিম উম্মাহর ঐক্য কামনা চেয়ে মৌলভীবাজারে শেষ হলো তাবলীগের তিন দিনের জেলা ইজতেমা
ফুটবলার থেকে জর্জিয়ার প্রেসিডেন্ট, কে এই মিখাইল কাভেলাশভিলি?
তিন খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ, ১৮ বছর বাদে মিথ্যা স্বীকার
রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে সর্বস্তরের মানুষের ঢল
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেভাবে বিশ্বকাপ জিতেছে সউদী
বেনাপোল বন্দর দিয়ে ২৫ দিনে ৩৩২০ টন চাল আমদানি