বিজয়ের মাসে : বিজয় থেকে বিজয়ে

Daily Inqilab মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৬ এএম | আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৬ এএম

আমরা মুসলিম, একটি বিজয়ী জাতির রাজ্য-হারানো, পথহারানো এবং স্মৃতি-হারানো সৈনিক দল। আমরা অনেকেই ভুলে গেছি, আমাদের আছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস, যে ইতিহাসের প্রদীপ্ত অংশ নবী-যুগ ও খিলাফতে রাশিদা।

আমাদের আছে এক সুমহান আদর্শ, যে আদশের মহান সূত্র আল্লাহর শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এবং যে আদর্শের বাহক উম্মাহর সর্বোত্তম অংশ সাহাবায়ে কেরাম। আমরা ভুলে গেছি মানবেতিহাসের ওই প্রোজ্জ্বল অধ্যায়, যখন ‘সত্য’ ও ‘শক্তির’ ঘটেছিল শুভ পরিণয়। শক্তি ছিলো সত্যের বধূ। আর সত্য ছিলো শক্তির অভিভাবক। এই পবিত্র ‘পরিবারে’ অবির্ভাব ঘটেছিল এমন এক মহান-কাফেলার, যারা ছিলেন এই আসমানী সনদের সত্য দৃষ্টান্ত-‘যাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দিবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর সকল কর্মের পরিণাম তো আল্লাহরই ইখতিয়ারে।’ (সূরা হজ্ব : ৪১)।

আমরা ভুলে গেছি আমাদের স্বর্ণ-যুগের সততা ও ন্যায়পরায়ণতা এবং উদারতা ও মহানুভবতা। মনে পড়ে কি, আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর আদর্শ-হিজরতের রাতে রক্ত-পিপাসু শত্রুজাতির আদর্শ আমানত রক্ষা বিজয়ের দিনে পরাজিত শত্রুকে ক্ষমা করা? আমরা হারিয়ে ফেলেছি আদর্শের বিষয়ে আমাদের সেই পবিত্র-সংবেদন, আর আদর্শ-রক্ষায় সেই প্রাণবাজি রাখার প্রেরণা। মনে পড়ে কি, আল্লাহর রাসূলের প্রথম খলীফার সেই বজ্রহুঙ্কার-‘আ-য়ানকুসুদ দীন ওয়া আনা হাই?’ দ্বীনের অঙ্গহানী ঘটবে আর আমি বেঁচে থাকব?

আমরা ভুলে গেছি হযরত ওমরের ‘প্রজাপালন’, হযরত উসমানের এক গিলাফে ‘কুরআন-সংকলন’, এবং হযরত আলীর জ্ঞানের দুয়ার উন্মোচন। ভুলে গেছি হযরত হাসান (রা.)-এর সন্ধি আর হযরত হোসাইন (রা.)-এর অস্ত্রধারণ। মুসলিম-উম্মাহর সেই যুগ ছিলো মানবতারও স্বর্ণযুগ। ওই সময়ে মুসলিম জাহান মুক্ত ছিলো ধর্মহীন রাজ্যের অনাচার আর রাজ্যহীন ধর্মের অসহায়ত্ব থেকে।

এরপর ধীরে ধীরে শুরু হলো পশ্চাৎপসরণ। শুরু হলো সৌভাগ্য থেকে দুর্ভাগ্যের দিকে যাত্রা। ক্রমেই শিথিল হয়ে এলো জীবন ও আদর্শের বন্ধন, বিচ্ছিন্ন হতে লাগল জীবনের ক্ষেত্রগুলো একে অপরের থেকে, ব্যক্তি জীবন ও সমাজজীবনে দেখা দিলো বিরোধ এবং আদর্শের পতাকাবাহী শ্রেণি থেকে পিছিয়ে পড়ল শক্তির অধিকারী শ্রেণি। এভাবে খাইরূল কুরূনের পর থেকে ধীরে ধীরে এক উম্মাহর মাঝে দুটি ধারা সুস্পষ্ট হয়ে উঠল। ‘সত্যে’র ধারা এবং ‘শক্তি’র ধারা। প্রথম ধারাটি ত্যাগ ও সাধনা এবং সাহসিকতা ও মহানুভবতায় ভাস্বর।

আর দ্বিতীয় ধারাটিতে শৌর্য-বীর্যের পাশাপাশি আরম্ভ হলো অন্তর্দন্দ্ব ও ক্ষমতার প্রতিযোগিতাও। কিন্তু ভোগ ও দ্বন্দ্বের ঘুণ এই প্রতিষ্ঠানটিকে সম্পূর্ণ অকেজো করার আগ পর্যন্ত এতেও ছিলো ওই সকল আলোকিত বৈশিষ্ট এবং মানবীয় উচ্চতার ওইসব দৃষ্টান্ত, যা বর্তমান সভ্য-যুগেও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এরপর এলো সেই অন্ধকার যুগ, যখন মুসলিম-জাহান খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেল। আর মুসলিম জনপদগুলোতে বইতে লাগল অশ্রু ও রক্তের স্রোত।

দেশে দেশে প্রবর্তিত হলো আদর্শবিমুখ শিক্ষা ও ভোগ-সর্বস্ব সংস্কৃতি। এরই বিষাক্ত আবহে তৈরি হতে থাকল এমন এক প্রজন্ম, যারা নিজেদের আদর্শের বিষয়ে অজ্ঞ, ঐতিহ্যের বিষয়ে নির্লিপ্ত এবং ধর্ম-পরিচয়ের বিষয়ে চরমভাবে হীনমন্যতাগ্রস্ত। কালের চাকা কখনো থেমে থাকে না। একসময় এরাই উঠে এলো উপরে, চালকের আসনে। এদের হাতে ন্যস্ত হলো ‘শক্তি’, ন্যস্ত হলো ‘শিক্ষা’ এবং ন্যস্ত হলো সমাজ-পরিচালনার গুরুদায়িত্ব।

এদিকে উম্মাহর কফিনে যেন শেষ পেরেকটি ঠোকার হিংস্র ইচ্ছা থেকে তৈরি করা হলো অনেক ধর্মীয় মতবাদ এবং কিছু ধর্মগুরু। সৃষ্টি করা হলো মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদার। প্রাদুর্ভাব ঘটল ‘প্রাচ্যবিদ’ নামক একদল ‘গবেষক’র, যারা ইসলামের ইতিহাসকে বিকৃত করতে এবং ইসলামী আদর্শের সূত্র-কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে ধর্ম-জ্ঞানহীন মানুষকে সংশয়গ্রস্ত করতে অসংখ্য কূটপ্রশ্নের অবতারণা করল।

নবউদ্ভাবিত সমস্যাদির ইসলামী সমাধানের পরিবর্তে স্বতঃসিদ্ধ ও প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় বিষয়ে সংশয় সৃষ্টির প্রয়াস চলতে থাকল। বিভিন্ন নামে ও শিরোনামে উম্মাহর সাচ্চা খাদিমগণকে- সাহাবা-তাবেয়ীনকে, মুহাদ্দিস ও মুজতাহিদগণকে এবং মুজাহিদ ও দায়ীগণকে উম্মাহর শত্রু ও খলনায়ক রূপে উপস্থাপন করা হলো। একই সাথে ইসলাম-বিদ্বেষী পশ্চিমে চলতে থাকল নির্জলা মিথ্যাচার। এভাবে ইসলামের পবিত্র জীবনাদর্শ ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে তমসাচ্ছন্ন করার এবং উম্মাহকে তার অতীত সম্পর্কে বিমুখ, বর্তমান সম্পর্কে অস্থির এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে হতাশ করে তোলার কোনো অপচেষ্টাই বাদ রাখা হলো না।

কিন্তু ইসলাম যে আবে হায়াত। এরই স্পর্শে বারবার জেগে উঠেছে মৃতপ্রায় মুসলিম। কুরআন-সুন্নাহ যে ঐশী আলোক, এরই অনির্বাণ শিখায় বারবার জ্বলে উঠেছে উম্মাহর নিভু নিভু প্রদীপ। মিথ্যুক-জুলুমবাজদের অত্যাচার-মিথ্যাচারে জেগে উঠেছে উম্মাহর প্রাণের স্পন্দন। নির্যাতনের শিল-পাটায় নিস্পেষিত মুসলিম হয়ে উঠেছে মেহেদী-রাঙ্গা। দিকে দিকে তাই বুঝি শোনা যায় সেই পুরানো দিনের ধ্বনি-‘অহুদ পাহাড়ের পাদদেশ থেকে আসছে বেহেশতের সুবাস।’

নিশ্চয়ই এই স্পন্দিত প্রাণ আবার জাগবে নতুন শক্তি ও চেতনায়। এই মরা গাঙ্গে আবার আসবে জোয়ার। সেই জোয়ারে খরকুটোর মতো ভেসে যাবে সকল জঞ্জাল। আবার গড়ে উঠবে জীবন ও আদর্শের মাঝে মেলবন্ধন। যুক্ত হবে উম্মাহর সকল বিচ্ছিন্ন কলকব্জা। ‘সত্যে’র নির্দেশনায় ‘শক্তি’ ধাবিত হবে শান্তির পথে। সেই দিন মানবতার প্রকৃত বিজয় সাধিত হবে। রাজনৈতিক বিজয় থেকে আমাদের যেন আদর্শিক বিজয়ে উত্তরণ ঘটে-এই প্রার্থনা!


বিভাগ : শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

আট গোলের রোমাঞ্চ: ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে রিয়ালের ড্র

আট গোলের রোমাঞ্চ: ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে রিয়ালের ড্র

সহজ জয়ে লা লিগায় রানার্সআপ  বার্সা

সহজ জয়ে লা লিগায় রানার্সআপ  বার্সা

ক্লপকে অশ্রুসিক্ত বিদায় লিভারপুলের

ক্লপকে অশ্রুসিক্ত বিদায় লিভারপুলের

সিটির অমরত্বের রাত...

সিটির অমরত্বের রাত...

বায়ুদূষণে শীর্ষে ঢাকা

বায়ুদূষণে শীর্ষে ঢাকা

ফতুল্লায় হত্যা মামলার আসামি কেরানিগঞ্জে গ্রেপ্তার

ফতুল্লায় হত্যা মামলার আসামি কেরানিগঞ্জে গ্রেপ্তার

যৌথ বাহিনীর অভিযানে বান্দরবানে কেএনএফের ৩ সদস্য নিহত

যৌথ বাহিনীর অভিযানে বান্দরবানে কেএনএফের ৩ সদস্য নিহত

রাজশাহীতে মোটরসাইকেলের কাগজপত্র দেখতে চাওয়ায় পুলিশকে মারপিট, যুবক আটক

রাজশাহীতে মোটরসাইকেলের কাগজপত্র দেখতে চাওয়ায় পুলিশকে মারপিট, যুবক আটক

স্বাচিপ রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি ডা. জাহিদ, সম্পাদক ডা. অর্ণা জামান

স্বাচিপ রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি ডা. জাহিদ, সম্পাদক ডা. অর্ণা জামান

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রগঠনের দাবিতে সারাদেশে জেলা ও মহানগরীতে ইসলামী

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রগঠনের দাবিতে সারাদেশে জেলা ও মহানগরীতে ইসলামী

খালেকুজ্জামানের বাড়ী সরকারিভাবে পুননির্মাণের দাবি - ইসলামী মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ

খালেকুজ্জামানের বাড়ী সরকারিভাবে পুননির্মাণের দাবি - ইসলামী মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ

কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত সাবেক বিজেপি নেতা

কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত সাবেক বিজেপি নেতা

সঠিক ওজন ও পরিমাপ নিশ্চিতকরণে বিএসটিআই নিরলস কাজ করে যাচ্ছে : প্রধানমন্ত্রী

সঠিক ওজন ও পরিমাপ নিশ্চিতকরণে বিএসটিআই নিরলস কাজ করে যাচ্ছে : প্রধানমন্ত্রী

মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে: প্রেসিডেন্ট

মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে: প্রেসিডেন্ট

বিক্ষোভ, গাড়ি ভাঙচুর, অটোরিকশাচালকদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া

বিক্ষোভ, গাড়ি ভাঙচুর, অটোরিকশাচালকদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া

কিরগিজস্তানে আহত বাংলাদেশি ছাত্রদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনুন

কিরগিজস্তানে আহত বাংলাদেশি ছাত্রদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনুন

শিরোপার রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা : শেষ ম্যাচে মাঠে নামছে সিটি-আর্সেনাল

শিরোপার রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা : শেষ ম্যাচে মাঠে নামছে সিটি-আর্সেনাল

কোরবানির গোস্ত দিয়ে কোন অনুষ্ঠান করে টেবিল বসিয়ে টাকা বা উপহার নেওয়া প্রসঙ্গে।

কোরবানির গোস্ত দিয়ে কোন অনুষ্ঠান করে টেবিল বসিয়ে টাকা বা উপহার নেওয়া প্রসঙ্গে।

মানিকগঞ্জ-ঢাকা রেললাইন প্রসঙ্গে

মানিকগঞ্জ-ঢাকা রেললাইন প্রসঙ্গে

কমিউনিটি ক্লিনিক দাঁড়িয়ে আছে দোরগোড়ায়

কমিউনিটি ক্লিনিক দাঁড়িয়ে আছে দোরগোড়ায়