উপার্জনে নৈতিকতার প্রেরণা

Daily Inqilab ড. মুহাম্মাদ জুনাইদ নদভী

২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম

অর্থনীতির প্রধান উপলক্ষ্য উপার্জন। সেই উপার্জনের নীতিতে ইসলামের দিকনির্দেশনা অনেক স্পষ্ট ও পরিষ্কার। দিয়ানতদারি ও সততা হচ্ছে বৈধ উপার্জনের বড় অনুষঙ্গ। ব্যবসা বা উপার্জনের ক্ষেত্রে এই সততা ও নৈতিকতা অবলম্বন মানব-জীবনে উজ্জ্বলতা নিয়ে আসতে পারে। ব্যবসা ও উপার্জন বিষয়ক কয়েকটি হাদিসের ভাষ্যের প্রতি দৃষ্টি দিলে বিষয়টি অনুধাবন করা আমাদের জন্য সহজ হতে পারে। হযরত রাফে ইবনে খাদীজ (রা.) বলেন, কোনো এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলো, হে আল্লাহর রাসূল উপার্জনের মাধ্যমগুলোর মাঝে কোন মাধ্যমটি সবচেয়ে উত্তম এবং পবিত্র? নবীজী (সা.) উত্তর দিলেন, ‘নিজের হাতের কাজ এবং বিশ্বস্ততাপূর্ণ ব্যবসা।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১৭২৬৫)

হযরত কায়েস (রা.) বলেন, আমাদের ব্যবসায়ীদের বলা হতো দালাল। একদিন আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন হযরত রাসূলে কারীম (সা.)। তখন তিনি আমাদেরকে এর চেয়েও সুন্দর একটি নাম দেন। তিনি এরশাদ করেন, হে ব্যবসায়ীরা! পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে অনেক অহেতুক কথা বলা এবং মিথ্যা শপথ করার পরিবেশ তৈরি হয়। এজন্য তোমরা সদকা করো, যেন তোমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতির কাফফারা হয়ে যায়। (সুনানে আবু দাউদ : ৩৩২৬)
রাসূলুল্লাহ (সা.) একবার একজন শস্যব্যবসায়ীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সে সময় তিনি তার শস্যের স্তূপের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিলেন। তখন ভেতরের শস্যগুলোতে তিনি কিছু কিছু আর্দ্রতা অনুভব করলেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কী? সেই ব্যবসায়ী উত্তর দিলেন, বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিল। ‘নবীজী তখন বললেন, ভেজা অংশটা উপরে রাখলে না কেন?’ তারপর নবীজী আরো বললেন, যারা আমাদেরকে ধোঁকা দেয় তারা আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। (সহীহ মুসলিম : ১০২)

উপরে বর্ণিত হাদিসগুলোতে ব্যবসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন নৈতিকতার প্রেরণা পাওয়া যায়। একইসঙ্গে দেখা যায়, ওই যুগের সম্ভাব্য ব্যবসায়িক ধোঁকা বা প্রতারণার বিষয়ে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। সেসব অমোঘ সতর্কবাণীকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করলে স্পষ্টত বোঝা যায় আজকের সিংহভাগ ব্যবসায়ী সমাজের প্রতারণা ও ক্ষতিকর পদক্ষেপ সম্পর্কে হাদিসের ভাষ্য কতো কঠোর হতো। কারণ, আগের যুগে প্রতারণার ক্ষেত্রগুলোতে ক্রেতাকে ঠকিয়ে শুধু কিছু অবৈধ লাভের চিন্তা করা হতো। পক্ষান্তরে, বর্তমানে ক্রেতাকে ঠকিয়ে লাভ হাতানোর জন্য পণ্যের সঙ্গে ফরমালিনসহ নানা ধরনের প্রাণঘাতী বিষেরও সংমিশ্রণ ঘটানো হয়। এভাবে অর্থ ও জীবন দুইয়েরই ক্ষতি সাধন করা হয়। মুসলিম জীবনের সঙ্গে এই ভয়ংকর প্রতারণার কোনো মিল নেই।

আরবিতে ‘ইহতিকার’ কথার বাংলা অর্থ হচ্ছে গুদামজাত করা। ব্যবসায়িক পরিভাষায় বলা হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য আটকে রেখে স্তূপ করা, বাজারে না ছাড়া। এভাবে মূল্যবৃদ্ধির অপেক্ষা করা। এরপর মূল্য বেড়ে গেলে পরে আটকে রাখা পণ্য বাজারে ছাড়া এবং অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করা। নবী কারীম (সা.) এ জাতীয় প্রবণতার প্রতি তীব্র অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন। এমন মানসিকতার প্রতি আঘাত করেছেন। মূলত এমন মানসিকতা ও প্রবণতা হৃদয়বান মানুষকে পাথরদিলের বে-রহম প্রাণীতে পরিণত করে দেয়। এটি ইসলামের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। কারণ ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে মানুষের প্রতি সহৃদয়তা ও সহানুভূতির প্রেরণা জোগানো। রাসূলে কারীম (সা.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যবসায়ী পণ্য আবদ্ধ ও স্তূপ করে সে গোনাহগার। (সহীহ মুসলিম : ১৬০৫)

অপরদিকে নবীজীর এরশাদ রয়েছে, যে ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আবদ্ধ করে না, বরং সময়মতো বাজারে পণ্য নিয়ে আসে, সে আল্লাহর রহমত পাওয়ার অধিকারী; তাকে আল্লাহ রিযিক দেবেন। আর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আবদ্ধকারী হচ্ছে অভিশপ্ত। (সে আল্লাহর রহমত থেকে মাহরূম হবে। কারণ, সে মন্দকাজ করেছে।) (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২১৫৩)

উপরের হাদিসগুলো দ্বারা বোঝা গেল গুদামজাত করা বা স্তূপ করাসহ ভোক্তা-সাধারণকে বিপদে ফেলে পণ্যের দাম বাড়ানো একটি অত্যন্ত বাজে কাজ। একইভাবে পরিকল্পনা করে জোটবদ্ধ হয়ে পণ্যের দাম অযৌক্তিক উপায়ে বাড়িয়ে দেয়াও মারাত্মক অন্যায়। অথচ বিভিন্ন মৌসুমে এ জাতীয় স্তূপিকৃত করা কিংবা পরিকল্পিত জোটবদ্ধতার ভিত্তিতে মূল্যবৃদ্ধি ঘটানোর পরিস্থিতি প্রায়ই আমাদের চোখে পড়ে। বলা বাহুল্য, এ জাতীয় প্রবণতার সঙ্গে ইসলামের সহৃদয়তা ও সহানুভূতিশীল ব্যবসা-নীতির কোনো সম্পর্ক নেই।

মূলত সৎ ব্যবসায় নিয়োজিত থাকা, অসৎ ব্যবসা থেকে বিরত থাকা এবং কায়িক শ্রম দিয়ে উপার্জন ইসলামের অন্যতম উপার্জননীতি। অসততা, অলসতা এবং সক্ষম সচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও অন্যের দুয়ারে হাত পাতা ইসলামের দৃষ্টিতে নিন্দনীয়। ইসলামের এই সৌন্দর্যমণ্ডিত উপার্জননীতি অনুসরণ করে চললে নিঃসন্দেহে যে কোনো মুসলমান দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াব হতে পারবে। একই সঙ্গে মুসলমানদের সমাজে নেমে আসবে সহৃদয়তা ও সাচ্ছন্দ। অপর জাতি-গোষ্ঠির সামনে তাদের নৈতিক চরিত্রের উজ্জ্বল চেহারা প্রশংসিত ও আকর্ষণীয় হবে এবং এ আচরণ দ্বীনী দাওয়াতের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে।


বিভাগ : শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

ভালো কাজে দেরি করা উচিত নয়-২
ভালো কাজে দেরি করা উচিত নয়-১
জালেমের সামনে সত্য প্রকাশে নির্ভীক ছিলেন যারা
জালেমের সহযোগী-সমর্থকও জালেম
আল কুরআনে মানব হত্যার শাস্তি-২
আরও

আরও পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে : তারেক রহমান

মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে : তারেক রহমান

ঋণখেলাপিরা যাতে মনোনয়ন না পায় চেষ্টা করবো : মির্জা ফখরুল

ঋণখেলাপিরা যাতে মনোনয়ন না পায় চেষ্টা করবো : মির্জা ফখরুল

অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর না হলে রাজনৈতিক সংস্কার টেকসই হবে না : বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি

অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর না হলে রাজনৈতিক সংস্কার টেকসই হবে না : বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি

টিসিবি’র এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীর মধ্যে ৩৭ লাখই ভুয়া: বাণিজ্য উপদেষ্টা

টিসিবি’র এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীর মধ্যে ৩৭ লাখই ভুয়া: বাণিজ্য উপদেষ্টা

ভোজ্যতেলের সরবরাহ নিশ্চিতে কারখানা পরিদর্শন ভোক্তা অধিকারের

ভোজ্যতেলের সরবরাহ নিশ্চিতে কারখানা পরিদর্শন ভোক্তা অধিকারের

গণপরিবহনে শৃঙ্খলায় কাউন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা

গণপরিবহনে শৃঙ্খলায় কাউন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা

রাজধানীর তিন পার্কে ভেন্ডারের চুক্তি : শর্ত ভঙ্গের তদন্তে ডিএনসিসি

রাজধানীর তিন পার্কে ভেন্ডারের চুক্তি : শর্ত ভঙ্গের তদন্তে ডিএনসিসি

বাবা-মায়ের পুরোনো বাড়িতে যাই : শফিকুল আলম

বাবা-মায়ের পুরোনো বাড়িতে যাই : শফিকুল আলম

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় ১৫০ কোটি টাকা অনুদান

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় ১৫০ কোটি টাকা অনুদান

২০২৪ সালে ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

২০২৪ সালে ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

ভারতীয় ৭২ গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য প্রচার

ভারতীয় ৭২ গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য প্রচার

লেবানন থেকে দেশে ফিরলেন আরো ৪৭

লেবানন থেকে দেশে ফিরলেন আরো ৪৭

প্লাটফর্ম বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

প্লাটফর্ম বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

শক্তিশালী অর্থনীতি ও গর্বিত জাতি গড়তে শহীদ জিয়ার দর্শন ধারণ করতে হবে : আমির খসরু

শক্তিশালী অর্থনীতি ও গর্বিত জাতি গড়তে শহীদ জিয়ার দর্শন ধারণ করতে হবে : আমির খসরু

কী আছে তৌফিকার লকারে?

কী আছে তৌফিকার লকারে?

ঘটনার তিনদিন পর থানায় মামলা

ঘটনার তিনদিন পর থানায় মামলা

অনিয়ম ঢাকতে তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের পাঁয়তারা

অনিয়ম ঢাকতে তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের পাঁয়তারা

শেবাচিম হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের দুরবস্থা

শেবাচিম হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের দুরবস্থা

৯৬টি সিএনজি ভাঙ্গাড়ি হিসাবে সাড়ে ১১ লাখ টাকায় বিক্রি

৯৬টি সিএনজি ভাঙ্গাড়ি হিসাবে সাড়ে ১১ লাখ টাকায় বিক্রি

৩১ দফা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে রূপগঞ্জে বিএনপির সমাবেশ

৩১ দফা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে রূপগঞ্জে বিএনপির সমাবেশ