ব্যবসায়িক দক্ষতার কারণে ইসলামের যে নারী প্রথম বাজার প্রশাসক হয়েছিলেন

Daily Inqilab অনলাইন ডেস্ক

০৯ জুন ২০২৩, ০২:৫৪ পিএম | আপডেট: ০৯ জুন ২০২৩, ০২:৫৪ পিএম

তার নাম ছিল লায়লা, কিন্তু তিনি চিকিৎসার কাজে বিভিন্ন ভেষজ উপাদান এতটা কার্যকরী উপায়ে ব্যবহার করেছিলেন যে, এ কারণে তিনি ‘শাফা’ নামে পরিচিতি পান। তিনি মক্কার কুরাইশ বংশের আদি গোত্রের সদস্য ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে আবদুস-শামস এবং ফাতিমা বিনতে ওয়াহহাবের এই কন্যা, বিয়ে করেছিলেন হাতমাহ ইবনে হুযায়ফাকে।

তিনি মক্কায় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তাই প্রাথমিক যুগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে অনেককে যে কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল, তা তাকেও সহ্য করতে হয়েছে। তখনকার দিনে, বিদ্যা শেখানো এবং শেখা, বেশিরভাগই মৌখিক উপায়ে হতো। ইতিহাসবিদ এফসি মুরগাটান লিখেছেন যে, ওই সময়ে মক্কার শুধুমাত্র বিশ জন লোক পড়তে এবং লিখতে জানত। তাদের মধ্যে শাফা ছিলেন প্রথম নারী যিনি এই দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। আহমদ বিন জাবির আল-বালদাউরির বই ফাতুহ আল-বুলদান অনুবাদ করার সময় মার্গাটন এই তথ্যটি পান। এই অনুবাদটি ‘দ অরিজিন অব ইসলাম,’ নামে প্রকাশিত হয়েছে।

শাফা একজন ক্যালিগ্রাফারও ছিলেন। তুরস্ক থেকে প্রকাশিত ‘ওমেন ক্যালিগ্রাফারস: পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট’ বই থেকে জানা যায়, তিনি ক্যালিগ্রাফিও শেখাতেন। ইসলামের নবীর সহধর্মিণী হাফসা তাঁর কাছে ক্যালিগ্রাফি শিখেছিলেন। আবু দাউদের মতে, এই দুই নারী সম্পর্কে আত্মীয় ছিলেন, তবে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আদিল সালাহি লিখেছেন, শাফা ছিলেন একজন বুদ্ধিমতী নারী এবং ইসলাম গ্রহণের আগেও রোগীদের চিকিৎসা করতেন। যখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তিনি নবীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তিনি চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারবেন কিনা। ইসলামের নবী তাকে এ ব্যাপারে উৎসাহ দিয়ে যান।

আদিল সালাহির মতে, তিনি শাফাকে বলেছিলেন কীভাবে চর্মরোগের চিকিৎসা করতে হয় তা যেন তার স্ত্রী হাফসাকে তা শিখিয়ে দেন। এ বিউলি লিখেছেন, যে শাফা মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করা প্রথম দিককার মুসলমানদের মধ্যে একজন ছিল। মুহাম্মাদ বিন সাদের ‘আল-তাকাবাত আল-কাবীর’ বইয়ের অনুবাদে ‘মদিনার নারী’ শিরোনামে বিউলি এই তথ্য প্রকাশ করেন। মদিনায়, তাকে নবীর মসজিদ এবং বাজারের মধ্যে একটি বাড়ি দেওয়া হয়েছিল, যেখানে তিনি তার ছেলে সুলাইমানের সাথে থাকতেন।

ইতিহাসের বইগুলোতে, আহমদ বিন হাজার আসকালানির কথা উল্লেখ করে লেখা হয়েছে যে ইসলামের নবী প্রায়শই তার কাছে যেতেন এবং সর্বোত্তম ব্যবসায়িক অনুশীলন সম্পর্কে তার সাথে পরামর্শ করতেন। আদিল সালাহির মতে, এসব সফরে শাফা তাকে ধর্মীয় প্রশ্ন করতেন। যেহেতু তিনি মসজিদে যেতেন, তাই তিনি নিজেও একজন ভালো আলেম হয়ে ওঠেন। ইতিহাসবিদরা একমত যে, শাফা ছিলেন প্রথম দিকের ইসলামী সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত নারীদের একজন।

যখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তিনি ইসলামের নবীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তিনি চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারবেন কিনা। নবী তাকে এ ব্যাপারে উৎসাহ দিয়ে যান। জামাল এ. বাদাউই ‘রোল অফ উইমেন ইন দ্য এইজ অফ দ্য প্রফেট’ বইয়ে লিখেছেন যে শাফা ইসলামী আইনে একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং বাজারের সরকারী পর্যবেক্ষক হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। বাজারে থাকা পণ্যের জন্য ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে কিনা তা তিনি নিশ্চিত করতেন। দায়িত্ব নেয়ার পর খলিফা ওমর শাফার কাছ থেকে অর্থনৈতিক নীতি ও বাণিজ্য বিষয়ে নানা পরামর্শ গ্রহণ করেন এবং তার মতামতকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়।

মদিনার সমাজ বিকাশের সাথে সাথে মনে করা হয়েছিল যে, সেখানকার বাজার ব্যবস্থা তত্ত্বাবধান করা প্রয়োজন, যেখানে মানুষ পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করতেন। তাই শাফাকে মদিনার কাজা আল-সুক (বাজার ব্যবস্থাপনা) এবং কাজা আল-হাসাবা (জবাবদিহিতা) -এর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এ দায়িত্বগুলো তৎকালীন আরব বিশ্বের ঐতিহ্যগত লৈঙ্গিক ভূমিকা থেকে আলাদা ছিল। অর্থাৎ এই কাজে নারী-পুরুষের বৈষম্য ছিল না। বাজারের দায়িত্ব পাওয়ার পর শাফা মূলত নিশ্চিত করতেন যে বাজারে পণ্য লেনদেনে কোনও ধোঁকা বা প্রতারণার সুযোগ নেয়া হচ্ছে না। পণ্যের কেনাবেচা ইসলামী মূল্যবোধ অনুযায়ী হচ্ছে। দোকানদারদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, যদি কোন নির্দিষ্ট লেনদেনের বৈধতা নিয়ে তাদের সন্দেহ হয় তাহলে তারা যেন সে বিষয়ে শাফার পরামর্শ নেন।

বাজারের প্রশাসক হিসাবে, শাফা বৈধ বাণিজ্য নিশ্চিতকরণ এবং জালিয়াতি প্রতিরোধের দায়িত্বে ছিলেন। এজন্য শাফাকে ক্ষমতাধর ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলেও তিনি সততার সাথে ন্যায়বিচার সম্পন্ন করেছেন। তিনি নিশ্চিত করতেন যে, পণ্যের বাণিজ্য ন্যায্যভাবে হচ্ছে, পণ্যে ন্যায়সঙ্গত দাম ধরা হয়েছে এবং ব্যবসায়ীরা নৈতিক ব্যবসায়িক অনুশীলনগুলো অনুসরণ করছেন।

ইভন রিডলি তার ‘মুসলিম উইমেনস পার্টিসিপেশন ইন ইকোনমিক অ্যাকটিভিটিজ: অ্যান অ্যাপ্রোচ’ প্রবন্ধে লিখেছেন যে শাফা একজন আইনবিদ এবং বিচারক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন এবং বিভিন্ন বিরোধ নিষ্পত্তি করতেন। শাফা তার দায়িত্ব পালনে অত্যন্ত সফল ছিলেন। খলিফা উমর, মক্কায় সামরা বিনতে নাহিক নামে এক নারীকে বাজার নিয়ন্ত্রক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। একজন জবাবদিহিতার বিচারক হিসেবে তিনি মানুষের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি করতেন এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেন। ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা অনুসারে, শাফা ইসলামী আইন ও আইনশাস্ত্রে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন এবং তিনি তার ন্যায্য ও নিরপেক্ষ রায়ের জন্য পরিচিত ছিলেন।

শাফার জীবনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল ইসলামী আইন ও ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান। তার কাছে যারা পরামর্শের জন্য আসতেন তাদের তিনি তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে অন্তর্দৃষ্টি-পূর্ণ নির্দেশনা দিতেন। তিনি তার সময়ের সবচেয়ে শিক্ষিত নারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। খলিফা ওমরের শাসনকালে তিনি মারা যান। সামগ্রিকভাবে, শাফার জীবন ছিল সাহস, প্রজ্ঞা এবং ইসলামী ইতিহাসে নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার দলিল। সূত্র: বিবিসি।


বিভাগ : শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

ইসলামে এসো, শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করবে
নিরাশা নয় আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশা মুমিনের শ্রেষ্ঠ অবলম্বন-২
নিরাশা নয়, আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশা মুমিনের শ্রেষ্ঠ অবলম্বন-১
পিতার কর্তব্য সন্তানকে সময় ও সঙ্গদান-৩
পিতার কর্তব্য সন্তানকে সময় ও সঙ্গদান-২
আরও
X

আরও পড়ুন

ফুলপুরে নিচের মাটি সরে গিয়ে ঝুলে আছে সেতু, ঝুঁকি নিয়ে পারাপার

ফুলপুরে নিচের মাটি সরে গিয়ে ঝুলে আছে সেতু, ঝুঁকি নিয়ে পারাপার

যশোর-অভয়নগরে গাছ কাটার সময় গাছের নিচে চাপা পড়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু

যশোর-অভয়নগরে গাছ কাটার সময় গাছের নিচে চাপা পড়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন পারমাণবিক চুক্তির ভাবনায় ইরান

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন পারমাণবিক চুক্তির ভাবনায় ইরান

ফিলিস্তিন স্বীকৃতি ইস্যুতে ম্যাক্রোঁকে এড়িয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্র

ফিলিস্তিন স্বীকৃতি ইস্যুতে ম্যাক্রোঁকে এড়িয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্র

গোয়ালন্দে পদ্মা নদীতে বিষ দিয়ে অবাধে মাছ শিকার

গোয়ালন্দে পদ্মা নদীতে বিষ দিয়ে অবাধে মাছ শিকার

বিহারে ভারী বর্ষণ-বজ্রপাত, ২৫ জনের মৃত্যু

বিহারে ভারী বর্ষণ-বজ্রপাত, ২৫ জনের মৃত্যু

'মেধা'র বিপরীতে 'সুপারিশ' অভ্যুত্থানের শহীদের রক্তের সাথে প্রতারণার নামান্তর: সারজিস

'মেধা'র বিপরীতে 'সুপারিশ' অভ্যুত্থানের শহীদের রক্তের সাথে প্রতারণার নামান্তর: সারজিস

সামনের সপ্তাহে তিন দেশ সফরে যাচ্ছেন শি জিনপিং

সামনের সপ্তাহে তিন দেশ সফরে যাচ্ছেন শি জিনপিং

ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধের শেষ দেখতে চায় চীন

ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধের শেষ দেখতে চায় চীন

গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে সেনাদের বরখাস্তে নেতানিয়াহুর সমর্থন

গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে সেনাদের বরখাস্তে নেতানিয়াহুর সমর্থন

পবিপ্রবিতে কৃষি গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা আজ

পবিপ্রবিতে কৃষি গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা আজ

উদ্ধার তৎপরতার মধ্যেই ফের ভূমিকম্প মিয়ানমারে

উদ্ধার তৎপরতার মধ্যেই ফের ভূমিকম্প মিয়ানমারে

তারাকান্দার ২১ গ্রামে বিশুদ্ধ পানির সংকট

তারাকান্দার ২১ গ্রামে বিশুদ্ধ পানির সংকট

ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে আখাউড়ায় সাংবাদিকদের মানববন্ধন

ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে আখাউড়ায় সাংবাদিকদের মানববন্ধন

মনোহরগঞ্জে পানিতে ডুবে দুই ভাইয়ের মৃত্যু

মনোহরগঞ্জে পানিতে ডুবে দুই ভাইয়ের মৃত্যু

গফরগাঁওয়ে বিএনপির ৪জন নেতাকে কুপিয়ে গুরুতর আহত

গফরগাঁওয়ে বিএনপির ৪জন নেতাকে কুপিয়ে গুরুতর আহত

মুম্বাই হামলার সন্দেহভাজন তাহাউর রানাকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করল যুক্তরাষ্ট্র

মুম্বাই হামলার সন্দেহভাজন তাহাউর রানাকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করল যুক্তরাষ্ট্র

নরসিংদীতে কিশোরী ধর্ষণ মামলার আসামী গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব

নরসিংদীতে কিশোরী ধর্ষণ মামলার আসামী গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব

লিবিয়া থেকে ফিরলেন আরও ১৬৭ বাংলাদেশি অনিয়মিত অভিবাসী

লিবিয়া থেকে ফিরলেন আরও ১৬৭ বাংলাদেশি অনিয়মিত অভিবাসী

সিডি জোনের বিরুদ্ধে মালিকানা জালিয়াতির অভিযোগ তুললেন সোহাগ

সিডি জোনের বিরুদ্ধে মালিকানা জালিয়াতির অভিযোগ তুললেন সোহাগ