পবিত্র জিলহজ মাসের তাৎপর্য ও করণীয় আমলসমূহ
২৩ জুন ২০২৩, ০৭:৩৬ পিএম | আপডেট: ২৪ জুন ২০২৩, ১২:০১ এএম
জিল হজ্জ্ব, আরবি বার মাসের শেষ মাস এবং মসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ফযিলতের মাস। যে মাসে মুসলিম উম্মাহ পবিত্র হজ পালন করে থাকেন জিলহজ মাস মানে হজের মাস।হজের তিনটি মাস শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ। এর মধ্যে প্রধান মাস হলো জিলহজ মাস ১৪৪৪ হিজরি এই মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ—এই ছয় দিনেই হজের মূল কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়। কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হজ সম্পাদন সুবিদিত মাসসমূহে। অতঃপর যে কেউ এই মাসগুলোতে হজ করা স্থির করে, তার জন্য হজের সময়ে স্ত্রীসম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও কলহবিবাদ বিধেয় নহে। তোমরা উত্তম কাজে যা কিছু করো, আল্লাহ তা জানেন এবং তোমরা পাথেয়র ব্যবস্থা করবে, আত্মসংযমই শ্রেষ্ঠ পাথেয়। হে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ, তোমরা আমাকে ভয় করো’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৯৭)।
বছরের বারো মাসের চারটি মাস বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন। এই চার মাসের অন্যতম হলো জিলহজ মাস। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা বারোটি, যা আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী সেই দিন থেকে চালু আছে, যেদিন আল্লাহ তাআলা আকাশম-লী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। এর মধ্যে চারটি মাস মর্যাদাপূর্ণ। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান’ (সুরা-৯ তাওবাহ, আয়াত: ৩৬)। এই চার মাস হলো জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। এসব মাসে যুদ্ধবিগ্রহ, কলহবিবাদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমার প্রতি আজহার দিন (১০ জিলহজ) ঈদ পালন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা আল্লাহ এই উম্মতের জন্য নির্ধারণ করেছেন। তখন এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আপনি বলুন, (যদি আমার কোরবানির পশু কেনার সামর্থ্য না থাকে) কিন্তু আমার কাছে এমন উট বা বকরি থাকে, যার দুধ পান করা বা মাল বহন করার জন্য তা প্রতিপালন করি। আমি কি তা কোরবানি করতে পারি? তিনি বললেন, না। বরং তুমি তোমার মাথার চুল, নখ, গোঁফ কেটে ফেলো এবং নাভির নিচের চুল পরিষ্কার করো। এ-ই আল্লাহর নিকট তোমার কোরবানি’ (আবু দাউদ, নাসাই, ত্বহাবি, খ--২, পৃষ্ঠা: ৩০৫)।
জিলহজ মাসের ১ম ১০ দিনের বিশেষ আমলঃ-জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের আমলের ফজিলত জিহাদের চেয়েও মর্যাদাবান। হাদিসে এসেছে-হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এ দিনগুলোর (জিলহজের প্রথম ১০ দিনের) আমলের তুলনায় কোনো আমল-ই অন্য কোনো সময় উত্তম নয় । তারা বলল : জিহাদও না ? তিনি বললেন : জিহাদও না, তবে যে ব্যক্তি নিজের জানের শঙ্কা ও সম্পদ নিয়ে বের হয়েছে, অতঃপর কিছু নিয়েই ফিরে আসেনি।’ (বুখারি)। আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় জিলহজের প্রথম ১০ দিনের আমল। হাদিসে এসেছে-হজরত ইবনে ওমর রাদিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর কাছে কোনো দিনই প্রিয় নয়, আর না তাতে আমল করা, এ দশ দিনের তুলনায়। সুতরাং তোমরা তাতে (জিলহজের প্রথম ১০ দিন) বেশি বেশি তাহলিল, তাকবির ও তাহমিদ পাঠ কর।’ (তাবারানি)কুরআন ও হাদিসের আলোকে ওলামায়েকেরামও জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের ইবাদতে একনিষ্ঠভাবে নিজেদের নিয়োজিত করতেন। যার প্রমাণ দিয়ে গেছেন যুগশ্রেষ্ঠ ওলামায়েকেরাম।
হজরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের রাহিমাতুল্লাহি আলাইহি জিলহজের প্রথম ১০ দিনের ইবাদতে নিজেকে একনিষ্ঠভাবে নিয়োজিত রাখতেন। যেভাবে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিলহজ মাসে ইবাদত-বন্দেগি করতেন। হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনায় এসেছে, ‘যখন জিলহজ মাসের ১০ দিন প্রবেশ করত, তখন তিনি খুব মুজাহাদা করতেন, যেন তার উপর তিনি শক্তি হারিয়ে ফেলবেন।’ (দারেমি)। হজরত ইবনে হাজার আসকালানি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘জিলহজ মাসের ১০ দিনের ফজিলতের ক্ষেত্রে যা স্পষ্ট তা হচ্ছে- এখানে মূল ইবাদাতগুলোর সমন্বয় ঘটেছে। অর্থাৎ নামাজ, রোজা, সাদকা ও হজ। যা অন্যান্য সময় যথাযথভাবে আদায় করা হয় না।’ (ফতহুল বারি)। পবিত্র রমজান মাসের শেষ ১০ রাত যেমন মর্যাদার ঠিক মুমিন মুসলমানের জন্য জিলহজের প্রথম ১০ দিন ও রাতের ইবাদত-বন্দেগিও অনেক মর্যাদা ও সম্মানের।মুসলিম উম্মাহর উচিত, জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন রোজা পালনের মাধ্যমে অধিক সাওয়াব ও ফজিলত লাভের করা। বিগত জবিনের গোনাহ থেকে নিজেদের মুক্ত করা। আল্লাহর নৈকট্য ও ভয় অর্জন করা।
হজ করা : জিলহজ মাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল হজ। হজ ইসলামের মৌলিক পাঁচ স্তম্ভের একটি। এর মূল কাজগুলো ৮ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজের মধ্যে সম্পন্ন করতে হয়। হজ সামর্থ্যবানদের ওপর জীবনে একবার ফরজ হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ওই গৃহের হজ করা তার জন্য অবশ্যকর্তব্য। আর যে (এই নির্দেশ পালন করতে) অস্বীকার করবে তার জেনে রাখা উচিত যে আল্লাহ দুনিয়াবাসীদের প্রতি সামান্যও মুখাপেক্ষী নন। ’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৯৭)। যেহেতু হজে যেতে হলে আগে নিবন্ধন করতে হয়। নিবন্ধনের পর সিরিয়াল পেতে পেতে দুই-তিন বছর সময় লেগে যায়। তাই যে বছর হজে যাওয়ার দৃঢ়সংকল্প আছে, তার দুই-তিন বছর আগেই নিবন্ধন করতে হবে। সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।
কোরবানি করা : এ মাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আমল কোরবানি, যা ১০, ১১ বা ১২ তারিখে সম্পন্ন করতে হয়। এবং তা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের ওপর ওয়াজিব—যিনি সাবালক ও সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী। মহানবী (সা.) সরাসরি কোরবানির ব্যাপারে নির্দেশিত হয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি তোমার রবের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো এবং কোরবানি করো। ’ (সুরা কাউসার, আয়াত : ২)। রাসুলে করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে। ’ (মুসতাদরাকে হাকেম, হাদিস : ৭৫৬৬)। আর যাদের ওপর ওয়াজিব হয়নি, তারাও চাইলে সুন্নত হিসেবে কোরবানি করতে পারবে।
বেশি বেশি নেক আমল করা : এ মাসের প্রথম ১০ দিনের যেকোনো নেক আমল আল্লাহর অনেক প্রিয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর কাছে জিলহজের ১০ দিনের নেক আমলের চেয়ে অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। ’ (বুখারি, হাদিস : ৯৬৯)। তাই প্রতিটি মুহূর্তে কোনো না কোনো নেক আমল করতে থাকা উচিত। যে কাজই করি তা যেন হয় ইহকালীন বা পরকালীন কোনো কল্যাণে। পাশাপাশি গুনাহ থেকে বিরত থাকাও বিশেষভাবে জরুরি। প্রথম ৯ দিন রোজা রাখা : জিলহজের প্রথম ৯ দিন রোজা রাখা মুস্তাহাব। এর প্রতিটি রোজা এক বছরের রোজার সমতুল্য। এবং প্রথম ১০ রাতে ইবাদত করা উত্তম। এর প্রতিটি রাত লাইলাতুল কদর সমতুল্য।
বিশেষত আরাফার দিন রোজা রাখা : আরাফার দিন তথা ৯ জিলহজ রোজা রাখলে দুই বছরের (সগিরা) গুনাহ মাফ হয়ে যায়। তাই এ দিন রোজা রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা উচিত। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আরাফার দিনের রোজার বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা রাখি যে তিনি আগের এক বছরের এবং পরের এক বছরের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ১১৬২)। অতএব যে এলাকায় যখন জিলহজের ৯ তারিখ হবে সে এলাকায় তখন রোজা রাখলে এ ফজিলত লাভ করবে, ইনশাআল্লাহ। নখ-চুল ইত্যাদি না কাটা : যারা কোরবানি করার ইচ্ছা করবে তাদের জন্য জিলহজ মাসের প্রথম থেকে কোরবানি করা পর্যন্ত নখ-চুল ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকা মুস্তাহাব। তাকবিরে তাশরিক পড়া : ৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত নামাজ। এর প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর একবার তাকবিরে তাশরিক পড়া ওয়াজিব। চাই জামাতে নামাজ পড়া হোক বা একাকি, পুরুষ হোক বা নারী, মুকিম হোক বা মুসাফির। তাকবিরে তাশরিক পুরুষের জন্য জোরে পড়াও ওয়াজিব। তাকবিরে তাশরিক হলো, ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ। ’
ঈদুল আজহার নামাজ পড়া : ঈদুল আজহার নামাজ প্রত্যেক সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন পুরুষের ওপর ওয়াজিব। সূর্যোদয়ের ২০-৩০ মিনিট পর থেকে দ্বিপ্রহরের পূর্ব পর্যন্ত ঈদের নামাজ পড়া যায়। নবীজি (সা.) ঈদুল আজহার নামাজ সাধারণত সূর্যোদয়ের আধাঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে আদায় করতেন। ঈদুল আজহার নামাজ একটু তাড়াতাড়ি পড়াই উত্তম। তবে প্রয়োজনে কিছুটা বিলম্ব করাও নিষিদ্ধ নয়।আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জিলহজ মাসের করণীয়গুলো যথাযথভাবে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
বিভাগ : ইসলামী জীবন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
জুলাই হতাহতের বিচার আদৌ হবে কিনা সংশয় স্বজনের মধ্যে
হরিণাকুন্ডুতে যুবদল সভাপতির উপর গুলি অল্পের জন্য রক্ষা
সচিবালয়ে আগুন, টঙ্গী হত্যাকাণ্ড ও ইসকনের আস্ফালন একই সূত্রে গাঁথা : যুব সমাবেশে মাওলানা মামুনুল হক
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে :পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
সেই সুখরঞ্জন বালির ভারতে গুমের লোমহর্ষক কাহিনী
খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন শাস্তি হলে হাসিনার সুযোগ নেই :অ্যাটর্নি জেনারেল
থার্টি ফাস্ট নাইট নিষিদ্ধ করতে হবে আইন করে :জুমার খুৎবা-পূর্ব বয়ান
হাসিনা-জয়ের ৩০০ মিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রে পাচারের প্রমাণ পেয়েছে এফবিআই
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের রহস্য নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন
সংস্কারের সঙ্গেই নির্বাচন প্রস্তুতি
‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে বিকল্প সোলার সিস্টেম চালু করুন’
আসিফ মাহমুদের হেলিকপ্টারে ছয় দিনে ২৮ বার সফর বিতর্ক
বন্ধ রয়েছে পায়রা বন্দরে পণ্য খালাস কার্যক্রম
ডেঙ্গুতে মৃত্যুহীন ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত ৫৩
নববর্ষ উদযাপনে ৭ বছরে শব্দদূষণ বেড়েছে ৭৪ শতাংশ
হাসিনা পরিবারের দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরুর পরই সচিবালয়ে আগুন : রিজভী
হাসিনার ফ্যাসিজম নিয়ে সস্তা কথা টিকবে না : শফিকুল আলম
চাঁদপুর মেঘনায় ড্রেজারসহ ২৮ জন আটক
ব্যাট হাতেও উজ্জ্বল অভিষিক্ত বশ,চালকের আসনে দক্ষিণ আফ্রিকা
১৬ বছরের অভিনেতার অকাল প্রয়াণে হলিউডে শোকের ছায়া