বেগম রোকেয়ার রচনায়

Daily Inqilab ড. মাহমুদুল আলম

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:৪২ পিএম | আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০২ এএম

নারী জারণের লেখিকা ও মুসলিম নারী সমাজের সংস্কারক বেগম রোকেয়া। তাঁর জীবনী ও রচনা বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে নতুন প্রগতির দিকদিশা। তিনি মুসলিম নারী সমাজকে ধর্মের গোঁড়ামি থেকে বের করার চেষ্টা করেছেন। সমাজ থেকে অন্ধবিশ্বাস, ভ্রান্ত ধর্মীয় আচরণ ও কুলীনপ্রথা দুর করতে পত্র-পত্রিকা, সভা-সমিতি, বালিকা প্রতিষ্ঠান স্থাপনসহ বিভিন্ন সমাজ উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। তাঁর ইসলাম বিষয়ে মন্তব্যগুলো অনেকে ভিন্নচোখে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছেন। অনেকে তাঁকে নারীবাদী লেখিকাদের সাথে তুলনা করেছেন। তারা বুঝেনি নারীবাদ কি? তাঁর রচনা সমগ্র স্বাধীনভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি ইসলামের প্রগতি চিন্তাকে সাহিত্য রসে উপস্থাপন করেছেন। নারীশিক্ষা, আকীদা, ধর্মীয় আমল, পর্দা, মেলামেশা, সাহিত্য চর্চা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁর ইসলামী উদার দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়। ইসলাম সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা সাগর সম। তিনি কুরআন-হাদিসের বাণীগুলো প্রগতির আলোকে কিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর রচিত বিভিন্ন প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা ইত্যাদিতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
‘পিপাসা’ প্রবন্ধে লেখিকা পিপাসার বিভিন্ন ক্ষেত্র তুলে ধরেছেন। সেখানে কারবলার প্রান্তরে ইমাম হোসেন পরিবারে মর্মান্তিক পিপাসার বর্ণনা দিয়েছেন। ইমাম হোসেন, আলী আকবর, কন্যা সকিনা, ফাতেমা,  কাসেম, শহরবানু, জয়নব সবার পানির পিপাসা ও শহীদদের বিবরণ মর্মস্পর্শী ভাষায় বর্ণনা করেছেন। তিনি ইমাম হোসেনের পিপাসার বিবরণ দিয়ে বলেন,
“বীর হৃদয়! একবার হোসেনের বীরতা সহিষ্ণুতা দেখ! ঐ দেখ, তিনি নদীবক্ষে দাঁড়াইয়া-আর কোন যোদ্ধা নাই, সকলে সমরশায়ী, এখন যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি একা। তিনি কোন মতে পথ পরিষ্কার করিয়া নদী পর্যন্ত গিয়াছেন। ঐ দেখ অঞ্জলি ভরিয়া জল তুলিলেন, বুঝি পান করেন; না, পান ত করিলেন না!- যে জলের জন্য আসগর তাঁহারই কোলে প্রাণ হারাইয়াছে, আকবর তাঁহার রসনা পর্যন্ত চুষিয়াছেন- সেই জল তিনি পান করিবেন? না, -তিনি জল তুলিয়া দেখিলেন, ইচ্ছা করিলে পান করিতে পারেন। কিন্তু তাহা না করিয়া নদীর জল নদীতেই নিক্ষেপ করিলেন! বীরের উপযুক্ত কাজ।” (পিপাসা)
তাঁর এ উক্তি মীর মোশারফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ কে উতরে গেছে। নবী পরিবারের প্রতি কতটুকু গভীর ভালোবাসা থাকলে এমন ভাষাজ্ঞান আসতে পারে তা জ্ঞানীমহলেই জানেন। তিনি কারবালার হৃদয়স্পর্শী কাহিনী কেন্দ্র করে শিয়া-সুন্নীর দ্বন্দ্বের কারণ এবং তা নিরসন করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন,  “শিয়াদের বাহ্য আড়ম্বর সুন্নিগণ ভাল মনে করেন না। বক্ষে করাঘাত করিলে বা শোক-বস্ত্র পরিধান করিলেই যে শোক করা হইল, সুন্নিদের এরূপ বিশ্বাস নহে। মতভেদের কথা এই যে, শিয়াগণ হযরত আয়ষা-ফাতেমার বিমাতা সিংহাসন আলীকে না দিয়া মোয়াবীয়াকে দিয়াছেন বলিয়া আয়ষাকে নিন্দা করে। আমরা আয়ষার (আলীর সৎশাশুড়ি হওয়া ব্যতীত আর) কোন দোষ দেখি না। চতুর্থ খলিফা কে হইবেন, ধর্মগুরু মোহাম্মদ (দ) তাঁহার নাম স্পষ্ট না বলিয়া অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া দেখাইয়াছেন। সে নির্দিষ্ট ব্যক্তি মোয়াবীয়া কিম্বা আলী তাঁহারা উভয়ে একই স্থানে দ-ায়মান ছিলেন। তাই মতভেদ হইল। কেহ বলিল ‘চতুর্থ খলিফা মোয়াবীয়া’, কেহ বলিল ‘আলী’। আয়ষা হিংসা করিয়া বলেন নাই, সিংহাসন মোয়াবীয়া পাইবেন। তিনি ঐ অনুমানের কথাই বলিয়াছিলেন মাত্র। সুন্নিগণ মাননীয়া আয়ষার নিন্দা সহ্য করিতে পারে না। শিয়া সুন্নিতে এইটুকু কথার মতভেদ। এই বিষয় লাইলাই দলাদলি।”(পিপাসা)
শত শত বছর ধরে শিয়া-সুন্নির দলাদলি, সংঘাত নিরসনের জন্য লেখিকা ইসলামের একটি চিরসত্য বাণী সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। নবী মোহাম্মদের (সা.) সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিয়েছেন। উম্মুল মোমেনিন হযরত আয়ষা (রা) কে দোষের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। একজন নারী যে, হাদিস বিশারদ, প-িত, ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, খলিফা নির্বাচনে সিদ্ধান্ত প্রদানকারিনি হতে পারেন তার বিবরণ শুক্ষ্মভাবে প্রদান করেছেন। তিনি বাংলার নারী সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়ে দিয়েছেন, নবী মুহাম্মদ পতœীর মাঝে এতোগুণ আর বাংলার নারী ঘরের ভিতর বন্দিনি। ইসলামের শিক্ষা চেতনা কত না উদার!
তিনি ‘পিপাসা’ প্রবন্ধে সৃষ্টির সবার মাঝে পিপাসা দেখেছেন। জলে সবার পিপাসা মিটে। কিন্তু সাগর তারও পিপাসা রয়েছে। তার গভীর গর্জনেও ‘পিপাসা, পিপাসা’। এ পিপাসা নিবারণের জন্য সবাই ব্যস্ত। কিšুÍ এ পিপাসা কোথায় নিবারণ হবে? কিভাবে নিবারণ হবে? তার সমাধানে তিনি বলেন, 
“আমি তবে বাতুল নহি। আমি যে পিপাসা দেখি, তাহা সত্য-কল্পিত নহে! আমি পিপাসা শুনি, তাহাও সত্য-কল্পনা নহে! ঈশ্বর প্রেম, এ বিশ্বজগৎ প্রেম-পিপাসু।”(পিপাসা)
¯্রষ্টার প্রতি তাঁর ভালোবাসা, প্রেম কতখানি গভীর তা এ বাণীর মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। তিনি ¯্রষ্টার প্রেমের মাঝে পিপাসা নিবারণের ঠিকানা পেয়েছেন। সৃষ্টির মাঝে পিপাসা নিবারণের ঠাঁই নেই। এ উক্তি আরো প্রমাণ করে, ইলমে মারেফাতের জ্ঞান বেগম রোকেয়াকে আলোকিত করেছিল। পার্থিব চিন্তা খ্যাতি যশে আখেরাতে সুখ পাওয়া যায় না। আল্লাহর প্রেম, ভালোবাসার মধ্যেই ইহকাল-পরকালে প্রকৃত শান্তি পাওয়া যায়।
মানব সমাজ গঠনের জন্য আল্লাহ পাক নবী আদমের (আ.) স্ত্রী হিসাবে হাওয়া (আ.) কে সৃষ্টি করেছেন। উভয় থেকে সৃষ্টি করেছেন অগনন মানুষ। (কুরআন) উভয়ের মর্যাদা একই। স্ত্রী কখনও স্বামীর দাসী না, বরং অর্ধাঙ্গী। (হাদিস) দাম্পত্যজীবনে স্ত্রীকে দাসীর মতো ব্যবহার করা ইসলাম সমর্থন করে না। (হাদিস) নারীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে অবতীর্ণ করেছেন, সুরা নিসা ও সুরা মারয়াম। বেগম রোকেয়া এই চিরসত্যকে নারী জাতির সামনে এভাবে উপস্থাপন করেছেন-
“আদিমকালের ইতিহাস কেহই জানে না বটে; তবু মনে হয় যে পুরাকালে যখন সভ্যতা ছিল না, সমাজবন্ধন ছিল না, তখন আমাদের অবস্থা এরূপ ছিল না। কোন অজ্ঞাত কারণবশত মানবজাতির এক অংশ (নর) যেমন ক্রমে নানাবিষয়ে উন্নতি করিতে লাগিল, অপর অংশ (নারী) তাহার সঙ্গে সঙ্গে সেরূপ উন্নতি করিতে পারিল না বলিয়া পুররুষের সহচারী বা সহধর্মিনী না হইয়া দাসী হইয়া পড়িল।” (স্ত্রীজাতির অবনতি)
তিনি এ উক্তির মাধ্যমে নারীজাতির অতীত গৌরবের কথা স্মরণ করেছেন। ইসলাম এটাই সমর্থন করে। তিনি নির্বোধ স্ত্রীজাতি সম্পর্কে বলেন,
“নির্বোধ স্ত্রীলোকের কর্তব্য যে প্রত্যেক বিষয়ে নিজেকে অবিশ্বাস করিয়া স্বামীর আদেশ পালন করে।”(স্ত্রীজাতির অবনতি) ঘুমন্ত নারীজাতিকে তিনি সমাজের অন্ধকার থেকে এভাবে বের করতে চেয়েছেন। পরিবারে স্ত্রীর ভূমিকা কী হতে পারে? তার নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি নারীকে পরিশ্রমী হতে বলেছেন। শুধু ঘরের কাজে নয় সমাজেরও কাজ করতে বলেছেন। আর ইসলামও এটা সমর্থন করে। ইসলামে নরনারীর জন্য জ্ঞানার্জন করা ফরজ। (হাদিস) অথচ বাঙালি মুসলিম নারী সমাজে এর উল্টা রীতি প্রচলিত। তিনি নারীজাতিকে এ অজ্ঞতা থেকে জ্ঞানের আলোয় আহ্বান করেছেন। তিনি বলেছেন,
“স্ত্রীশিক্ষার বিরুদ্ধে অধিকাংশ লোকের কেমন একটা কুসংস্কার আছে যে তাঁহারা ‘স্ত্রীশিক্ষা’ শব্দ শুনিলেই ‘শিক্ষার কুফলের’ একটা ভাবী বিভীষিকা দেখিয়া শিহরিয়া উঠেন। অশিক্ষিত স্ত্রীলোকের শত দোষ সমাজ অম্লানবদনে ক্ষমা করিয়া থাকে, কিন্তু  সামান্য শিক্ষাপ্রাপ্তা মহিলা দোষ না করিলেও সমাজ কোন কল্পিত দোষ শতগুণ বাড়াইয়া সে বেচারির ঐ ‘শিক্ষার’ ঘাড়ে চাপাইয়া দেয় এবং শত কণ্ঠে সমস্বরে বলিয়া থাকে ‘স্ত্রীশিক্ষাকে নমষ্কার! আজি কালি অধিকাংশ লোকে শিক্ষাকে কেবল চাকরি লাভের পথ  মনে করে। মহিলাগণের চাকরি গ্রহণ অসম্ভব সুতরাং এই সকল লোকের চক্ষে স্ত্রীশিক্ষা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক।” (স্ত্রীজাতির অবনতি)
এভাবে বেগম রোকেয়া নারীশিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। মুসলিম নারীকে জ্ঞানের তরীতে জীবন পাড়ি দিতে বলেছেন। তাঁদেরকে অলস হয়ে ঘরে বসে থাকতে নিষেধ করেছেন। তাঁদেরকে চাকরি-ব্যবসা সব করতে বলেছেন। তিনি বলেন,
“উপার্জন করিব না কেন? আমাদের কি হাত নাই, না পা নাই, না বুদ্ধি নাই? কি নাই? যে পরিশ্রম আমরা ‘স্বামীর গৃহকার্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসা করিতে পারিব না?” (স্ত্রীজাতির অবনতি)
তিনি এক্ষেত্রে নারীজাতিকে তাঁদের গৌরবগাথাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, “এবং এমন একদিন ছিল, যখন অন্যান্য দেশের মুসলমানসমাজে ‘স্ত্রীদার্শনিক, স্ত্রীঐতিহাসিক, স্ত্রীবৈজ্ঞানিক, স্ত্রীবক্তা, স্ত্রীচিকিৎসক, স্ত্রীরাজনীতিবিদ’ প্রভৃতি কিছুরই অভাব ছিল না। কেবল বঙ্গীয় মোসলেমসমাজের ওরূপ রমণীরতœ নাই।” (স্ত্রীজাতির অবনতি) তিনি নারীজাতিকে পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমাজের কাজ করতে বলেছেন। কেননা তারাও সমাজের অঙ্গ। ইসলামও এটাই সমর্থন করে। নারী সাহাবিগণ ব্যবসা করতো, মাঠে কাজ করত, শিক্ষিতগণ জ্ঞান বিতরণ করতেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) এর স্ত্রী বাজারে ব্যবসা করতেন, হযরত আয়শা, উম্মে সালমা (রা.) সহ অনেক নারী হাদীস বর্ণনা করতেন। বেগম রোকেয়া ইসলামের এই শিক্ষাকে বাঙালি মুসলিম নারীর মাঝে দেখতে চেয়েছিলেন। 
‘অবরোধ-বাসিনী’ বেগম রোকেয়ার অনন্য সাহিত্যকর্ম। ইসলামে পর্দার বিধান আছে। তাই বলে পর্দা রক্ষা করতে গিয়ে নিজের জীবন, সম্পদ, সম্মান ইত্যাদি মানবিক প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো উপেক্ষা করতে হবে, ইসলাম তা সমর্থন করে না। তিনি এখানে নারীজাতির ৪৭টি ঘটনাকে অণুগল্প হিসাবে তুলে ধরেছেন। তৎকালিন সময়ে মুসলিম-হিন্দু নারীসমাজে পর্দা কঠোর ও গুরুত্বের সাথে পালন করা হতো। সংক্ষেপে কয়েকটির বর্ণনা এ রকম :
১. বেগম রোকেয়ার বাড়িতে কাবুলী নারীকে দেখে কুমারী মেয়েদের পর্দা; এমনকি নামাজ ভঙ্গ করে দ্বারে অর্গল দেয়া। বেগম রোকেয়া কুমারী মেয়েদের এ অবস্থা তুলে ধরে বলেন, “কেহ বাঘ ভালুকের ভয়েও বোধ হয় অমন করিয়া কপাট বন্ধ করে না।” (অবরোধ-বাসিনী) কাবুলী নারীর পোশাক খোলামেলা, সে পর্দা করেনি। তার কথাবার্তা, চালচলনে বাঙালিপনা ছিল না। তাই একজন নারী আর একজন নারীর সামনে নিজেকে প্রকাশ করতে কীভাবে লজ্জা বোধ করে, নিজেকে অবরোধ করে সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।২. ২. পাটনায় বিবাহ বাড়িতে শীতের রাতে হাশমত বেগম পালকিতে শিশুপুত্রসহ রাত্রিযাপন করা বিষয়ে বেগম রোকেয়া বলেন, “পাছে  তাঁহার কণ্টস্বর বেহারা শুনিতে পায়, শিশুকেও প্রাণপণ যতেœ কাঁদিতে দেন নাই-যদি তাহার কান্না শুনিয়া কেহ পালকির দ্বার খুলিয়া দেখে! কষ্ট সহ্য করিতে না পারিলে আর অবরোধ-বাসিনীর বাহাদুরি কি?”(অবরোধ-বাসিনী) তৎকালীন সমাজে নারীর মানসিকঅবস্থা নি¤œ ছিল। অর্থাৎ নারীরা নিজেদের এতটাই আড়ালে রাখতে চাইত যে, তার কণ্ঠ কোনো পুরুষের কানে যাতে না পৌঁছায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকত।৩. ট্রেনের প্লাটফরমে হজ গমনেচ্ছু নারীদের বস্তার সাথে তুলনা করে বলেন, “কর্মচারিটি পুনরায় একটা “বস্তায়” জুতার ঠোকর মারিয়া বলিলেন, ‘হা, হা-এই সব আসবাব হাটা লো।’ বিবিরা পর্দার অনুরোধে জুতার গুতা খাইয়াও টু শব্দটা করেন নাই।”(অবরোধ-বাসিনী) হজ যাওয়ার পথে পর্দা পালনের নামে উপুর হয়ে বসে থাকা, যা বস্তা ভর্তি আসবাবের মতো দেখায়। এটা নারীর হীনমনতার পরিচয়। পর্দা পালন করতে গিয়ে পরপুরুষের জুুতার গুতা বৈধ করে নেয়া অবরোধের ঘৃণরূপ।
৪. বাড়িতে আগুন লেগেছে, পরপুরুষ আগুন নেভাচ্ছে। এ অবস্থায় পরপুরুষের সামনে না এসে আগুনে পুড়ে আত্মহত্যা করা বিষয়ে বেগম রোকেয়া বলেন, “দ্বারে আসিয়া দেখিলেন সমাগত পুরুষেরা আগুন নিভাইতেছে। তিনি তাহাদের সম্মুখে বাহির না হইয়া অলঙ্কারের বাক্সটি হাতে করিয়া ঘরের ভিতর খাটের নিচে গিয়া বসিলেন। তদবস্থায় পুড়িয়া মরিলেন, কিন্তু পুরুষের সম্মুখে বাহির হইলেন না। ধন্য! কুল-কামিনীর অবরোধ!”(অবরোধ-বাসিনী)  গহনা রক্ষা পেলো, তবে নিজে বাঁচলো না। আত্মহত্যা করা কবিরা গোনাহ। পর্দার রক্ষা করতে গিয়ে জীবন বিসর্জন দেয়া এটা কী ইসলাম সমর্থন করে?৫. চোরের হাতে সর্বস্ব অলঙ্কার তুলে দেয়া বিষয়ে বলেন, “চোরের হাতে সর্বস্ব সমর্পন করিয়া তিনি অবরোধ প্রথার সম্মান রক্ষা করিলেন।”(অবরোধ-বাসিনী) চোর পরপুরুষ, তার সামনে কথা বললে পর্দা নষ্ট হবে। সম্পদ যাক, প্রতিবাদ করা যাবে না। এ রকম কুচিন্তাকে নারীরা সওয়াব বলে জ্ঞান করত। হাদিস মতে, স্বামীর সম্পদ রক্ষা করা স্ত্রীর দায়িত্ব। কুরআন মতে, বিপদে নিজেকে রক্ষা করা আবশ্যক। হায়রে অবরোধ, নারীর হয় না বোধ। 
এভাবে অবরোধ রক্ষা করতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু, কুকুরের দরজা ঠেলা দেখে পর্দা করা, চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডাক্তার থেকে দুরে থাকা, ট্রেন ভ্রমণে চাদরের আড়ালে পর্দা করা, লজ্জায় অতিরিক্ত ঝাল খাওয়া, পরপুরুষের কারণে ট্রেনের সিটের নিচে লুকায়ে পর্দা করা, পর্দা করতে গিয়ে পালঙ্কের নিচে ঝাটার বাড়ি খাওয়া, মাইয়াখানায় দীর্ঘকাল অবরোধের ট্রেনিং নেয়া, বোরখায় চক্ষু না রাখা, নববধু লজ্জায় ঘরের বাইরে না এসে সুপারির ডিব্বায় পায়খানা করার মতো ইত্যাদি নোংরা ঘটনা ও বিষয়গুলোকে নারীর জন্য পর্দার অন্তরালে অবরোধ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। বেগম রোকেয়া এসব ঘটনার মাধ্যমে নারীদেরকে পর্দার আসল বিধান অবগত করাতে চেয়েছেন। নারীরা কুরআন-হাদিসের জ্ঞান থেকে কতদুর পিছিয়ে ছিল, বেগম রোকেয়া তা খ- খ- আকারে অণুগল্পাকারে অবরোধ-বাসিনীতে তুলে ধরেছেন। সে গল্পগুলোর কতক হাস্যকর, কতক বেদনাদায়ক, কতক নির্মম। সে যাইহোক বেগম রোকেয়ার অবরোধ-বাসিনীর প্রতিটি ঘটনাই সেই সময়কার নারীদের সামাজিক অবস্থান, কঠোর পর্দা প্রথা, অশিক্ষা, কুসংস্কার, পুরুষতান্ত্রিকতা, নির্মমতা প্রভৃতি বর্ণিত হয়েছে। বেগম রোকেয়া এ সব ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে ইসলামের মহান আদর্শে নারী জাতিকে উদজীবিত করেছেন। পরিশেষে বলা যায়, বেগম রোকেয়া নারীবাদি লেখিকা নন; তিনি নারীজাগরণের লেখিকা; নারীমুক্তির অগ্রদূত। কুরআন ও হাদীসের উদার ও প্রগতি দৃষ্টিভঙ্গি তার রচনায় ফুটে উঠেছে। তাঁর ইসলামি চেতনা  অগ্নিগিরির জলন্ত লাভা, কলমের খুরধার সমুদ্র জলরাশি, পর্দানশীল জীবন চরিত্র কাননের গোলাপ। তাঁর তুলনা তৎকালীন মুসলিম নারী সমাজে পাওয়া দুষ্কর।


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নববর্ষের ঘোষণা
রক্তমাখা শার্ট
জেগে থাকো পূর্ণিমা : সমাজ বাস্তবতার আখ্যান
বাংলাদেশের কবিতা ও সমকালীন সাহিত্য
ধৈর্যের বসতঘর
আরও

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া কোরের '৯ম কর্ণেল কমান্ড্যান্ট' অভিষেক অনুষ্ঠিত

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া কোরের '৯ম কর্ণেল কমান্ড্যান্ট' অভিষেক অনুষ্ঠিত

দ. কোরিয়ায় ইয়ুনের আটক বাড়ানোর পর আদালতে হামলা ও বিক্ষোভ

দ. কোরিয়ায় ইয়ুনের আটক বাড়ানোর পর আদালতে হামলা ও বিক্ষোভ

শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ওয়াশিংটনে ট্রাম্প

শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ওয়াশিংটনে ট্রাম্প

ইয়েমেন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, ইসরাইলি বিমানবন্দর বন্ধ

ইয়েমেন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, ইসরাইলি বিমানবন্দর বন্ধ

৬০০ টাকা কেজি দরে ইলিশ বেচবে সরকার, পাওয়া যাবে যেখানে

৬০০ টাকা কেজি দরে ইলিশ বেচবে সরকার, পাওয়া যাবে যেখানে

লাইফ সাপোর্টে কাজী নজরুল ইসলামের নাতি বাবুল

লাইফ সাপোর্টে কাজী নজরুল ইসলামের নাতি বাবুল

স্পেনের এনজিওগুলো ইলন মাস্কের বিরোধিতায় এক্স ছেড়ে যাচ্ছে

স্পেনের এনজিওগুলো ইলন মাস্কের বিরোধিতায় এক্স ছেড়ে যাচ্ছে

যে দেশ বা সমাজে ন্যায়বিচার নেই, সে জাতিকে ধ্বংস করে দেন আল্লাহ: আল্লামা মামুনুল হক

যে দেশ বা সমাজে ন্যায়বিচার নেই, সে জাতিকে ধ্বংস করে দেন আল্লাহ: আল্লামা মামুনুল হক

গাজায় প্রতিদিন ঢুকবে ৬০০ ট্রাক ত্রাণ

গাজায় প্রতিদিন ঢুকবে ৬০০ ট্রাক ত্রাণ

যুদ্ধবিরতির আনন্দে গাজায় কর্মরত সাংবাদিকদের আবেগ-উল্লাস

যুদ্ধবিরতির আনন্দে গাজায় কর্মরত সাংবাদিকদের আবেগ-উল্লাস

ফের শৈত্যপ্রবাহের পূর্বাভাস দিলো আবহাওয়া অফিস

ফের শৈত্যপ্রবাহের পূর্বাভাস দিলো আবহাওয়া অফিস

লিমায় স্প্যানিশ বিজয়ী ফ্রান্সিসকো পিজারোর মূর্তি পুনঃস্থাপন

লিমায় স্প্যানিশ বিজয়ী ফ্রান্সিসকো পিজারোর মূর্তি পুনঃস্থাপন

আবারও পেছাল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরাতে রিভিউ শুনানি

আবারও পেছাল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরাতে রিভিউ শুনানি

‘প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলকভাবে করতে হবে’

‘প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলকভাবে করতে হবে’

রাজনীতির মধ্যে ঢুকতে চায় না ইসি, ভোটার তালিকা হালনাগাদ শুরু সোমবার

রাজনীতির মধ্যে ঢুকতে চায় না ইসি, ভোটার তালিকা হালনাগাদ শুরু সোমবার

টিকটকের যুক্তরাষ্ট্রে পরিষেবা বন্ধ, আইনি নিষেধাজ্ঞার প্রভাব

টিকটকের যুক্তরাষ্ট্রে পরিষেবা বন্ধ, আইনি নিষেধাজ্ঞার প্রভাব

ইউল্যাবের হাল্ট প্রাইজ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ

ইউল্যাবের হাল্ট প্রাইজ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ

স্পিকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা করছিলেন হাসিনা : দ্য হিন্দু

স্পিকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা করছিলেন হাসিনা : দ্য হিন্দু

আওয়ামী দুঃশাসনের যেন পুনরাবৃত্তি না হয়: রিজভী আহমেদ

আওয়ামী দুঃশাসনের যেন পুনরাবৃত্তি না হয়: রিজভী আহমেদ

সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি, আ.লীগের জয়জয়কার

সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি, আ.লীগের জয়জয়কার