রক্তমাখা শার্ট
১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৮ এএম
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান মাসুদ। চাকরি করে মিরপুর এগারোতে; একটি কাপড়ের দোকানে। বাবা-মা, বিয়ের উপযুক্ত এক বোন আর ছোট্ট একটা ভাই নিয়ে সাজানো-গোছানো সুন্দর পরিবার। মাসুদের বাবা একজন দিনমজুর। কিন্তু ইদানিং অসুস্থতা যেন কিছুতেই তার পিছুছাড়ছে না। বাবার কষ্ট লাঘব করার জন্য মাসুদ পড়ালেখার ইতি ঘটায়। জয়েন করে চাকরিতে। মাস শেষে মোটামুটি অংকের একটা মাইনে পায়। সেটা দিয়ে মাসুদের ছোট্ট পরিবার স্বাচ্ছন্দ্যেই চলতে পারে। বাবাকেও আর কষ্ট করে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কামলা খাটতে হয় না।
মাসুদের ছোট বোন আফরোজা।
দেখতে দেখতেই বিয়ের উপযুক্ত হয়ে গেছে। এবার ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে পড়ছে। মাসুদের বাবা-মা চিন্তা করছেন, উপযুক্ত যেহেতু হয়েছে কোথাও বন্দোবস্ত করে দিলে মেয়েটা সুখে-শান্তিতে বাকি জীবন পার করে দিতে পারবে। তাছাড়া উপযুক্ত মেয়ে ঘরে ফেলে রাখাও তো ঠিক না।
মাসুদের বাবা-মা আফরোজার বিষয়টা খুলে বলেন ওকে। খানিক চিন্তা ভাবনা করে মাসুদও সায় দেয়,
‘হ, তাইলে তো পাত্র দেখাদেখি করা দরকার। আচ্ছা, তোমরা খুঁজতে থাকো। আমিও খুঁজি। দেখো, ভালো কোনো পাত্রের সন্ধান মিলে কিনা।’
এরইমধ্যে দেশে শুরু হয়ে যায় আন্দোলন। ছাত্রজনতার কোটা সংস্কার আন্দোলন। কিছুদিন যেতে না যেতেই সে আন্দোলনের গতি বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে তা অসহযোগ আন্দোলনে রূপ নেয়। সাথে সাথে ব্যাপক ধরপাকড় আর হানাহানি মারামারির খবর শোনা যায়। মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে শিক্ষার্থীরা কাঁপন ধরিয়ে দেয় ক্ষমতাসীন সরকারের মসনদ। ছাত্রজনতার এ আন্দোলন একসময় রূপ নেয় আমজনতার আন্দোলনে। দলমতনির্বেশেষে সবাই হাতে হাত রেখে শ্লোগান তোলে, ‘ফ্যাসিবাদের পতন চাই’।
অন্য সবার মতো মাসুদও নেমে আসে পথে। যোগ দেয় মিছিলে। পতন চায় অবৈধ শাসনব্যবস্থার। জুলুমেরবিরূদ্ধে জানায় তীব্র প্রতিবাদ। কিন্তু কয়েকদিন যাবত দেখা যাচ্ছে আন্দোলনকারীরা ব্যাপক বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। পুলিশ বাহিনী লাটিচার্জ করছে। কাঁদানেগ্যাসছুঁড়ছে। ধরপাকড় করে নিয়ে যাচ্ছে। আবার বুলেটও ছুঁড়ছেমুহুর্মুহু। সেদিন মাসুদের চোখের সামনেই তরতাজা এক তরুণের বুক বরাবর বুলেট ছুঁড়লপুলিশ। সে বুলেটের আঘাতে সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল তরুণটি।
মাসুদ সে রাতে ঘুমাতে পারে না। কেবলই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই লাশ। সেই রক্তমাখা যুবকের নিথর নিষ্প্রাণ দেহটি। আর মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে, এই ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে।
রোববার। চার আগস্টদুহাজার চব্বিশ।
গোটা দেশবাসী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। দাবি তোলে সরকার পতনের।
‘দফা এক দাবি এক।’
এতে টনক নড়ে সরকারের। মরিয়া হয়ে ওঠে পুলিশ বাহিনী ও ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। দেশের বিভিন্ন স্থানে আহত নিহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগগুলো আহতদের আর্তনাদ আর আত্মীয় স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে।
সবার মতো মাসুদও থেমে নেই। বিক্ষুব্ধ জনতার বাধভাঙ্গা জোয়ারে সে-ও ভাসতে থাকে। মাথায় দেশের পতাকা বেঁধে শ্লোগানেশ্লোগানেকাঁপিয়ে তোলে রাজপথ। একটিবারের জন্যেও তার মনে পড়ে না গ্রামের বাড়িতে ফেলে আসা অসহায় বাবা-মা আর ছোট্ট দুটি ভাইবোনের কথা।
পাঁচ আগস্ট ২০২৪।
দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ রকমের খারাপ হয়ে ওঠে। পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলি করে পাখির মতো মারতে থাকে সাধারণ মানুষ। কিন্তু বাধভাঙ্গার এই আওয়াজ কিছুতেই বন্ধ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ক্রমশঃ তা অগ্নিস্ফুলিঙ্গে রূপ নেয়।
মাসুদের বাবা-মা সহ পরিবারের সবাই ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। ওর মা খোঁজ নিতে কল করেন ওকে। কিন্তু ও কল ধরে না। কল দেন বাবাও। তা-ও ধরে না। সবার অস্থিরতা বাড়তেই থাকে। ও ফোন ধরে না ধরেই না।
তখন দুপুর দুইটা। হঠাৎ মাসুদের নম্বর থেকে ফোন আসে ওর মায়ের নম্বরে। ধরতেই অপরিচিত এক কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে আসে। মায়ের বুকটা কেমন ধড়ফড় করে ওঠে। আর্তনাদ করে বলে ওঠেন তিনি, ‘আমার পোলাডা কই বাবা! মাসুদ মাসুদ!’ ওপাশ থেকে উত্তর আসতে খানিক বিলম্ব হয়। মাসুদের মা আবারও অনুনয় করে ওঠেন, ‘আমার মাসুদ কই বাবা! হের কাছে দেও।’
এবারও বলতে গিয়ে বলতে পারে না ওপাশের যুবকটি। হারিয়ে ফেলে বলার ভাষা। কান্নাজড়ানোকণ্ঠে অবশেষে উত্তর দেয়,
‘মা, আপনার ছেলে শহিদ হয়ে গেছে।
লাশ আমাদের পাহারায় আছে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে।’
খবরটা শুনতেই উচ্চ স্বরে আহাজারি করে ওঠেন মাসুদের মা। গলা ফাটিয়েচিৎকার করতে থাকেন। সে চিৎকারের আওয়াজ শোনে ছুটে আসে আশপাশের সবাই। মুহূর্তেই মাসুদের মৃত্যুর খবর চাউর হয়ে যায় পুরো গ্রামে।
ওদিকে জ্ঞান হারান মাসুদের মা। কাঁদতেকাঁদতে বাবারও জ্ঞানহীন হওয়ার দশা। ছোট দুই ভাইবোনকেথামানো যাচ্ছে না কিছুতেই। প্রতিবেশী ঘরের মানুষজন সান্ত¡না দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছেন, কিন্তু তাতে কান্নার মাত্রা কেবল বেড়েই চলেছে। এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয় তখন মাসুদদের ঘরে।
মাসুদের ছোট চাচা আর মামা তৎক্ষণাৎ ছুটে চলল ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশে। বাইরে বেরোতেই দেখল, দলে দলে আনন্দ মিছিল করছে লোকজন। খবর নিয়ে জানতে পারল, ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়েছে। ভীষণ কষ্ট আর শোকের মুহূর্তেও তাদের মুখ দিয়ে বের হলো, ‘আলহামদুলিল্লাহ!’
ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে পৌছুতেপৌছুতে রাত দুইটা বাজে। মাসুদের ছোট চাচা ওর লাশ দেখামাত্রইহুহু করে কেঁদে ওঠে। আর মামা পাগলের মতো চিৎকার জুড়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর নিজেদের স্বাভাবিক করে এম্বুলেন্সে তুলে ওর লাশ। তারপর রওনা হয় গ্রামের উদ্দেশে। মাসুদের লাশ গ্রামে পৌঁছতে পৌঁছতে সকাল দশটা বেজে যায়। মসজিদের মাইকে ঘোষণা হয়, বাদ জোহর জানাজার নামাজ।
যথারীতি জোহরের পরপর গ্রামের ঈদগাহ মাঠে লোকজন জড়ো হতে শুরু করে। আশপাশের গ্রামের মানুষজনও যুক্ত হয় নামাজে জানাজায়। এক বিশাল গণজমায়েত হয়ে যায় ওর ওর জানাজায়। যেনবা আসমান থেকেও দলে দলে যুক্ত হয় শুভ্র পবিত্র ফেরেশতারা। পাঁচ দশ গ্রামে এত বড় জানাজার নামাজের জমায়েত সেদিনই প্রথম অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে মাসুদকে কবরস্থ করা হয় গ্রামের কবরস্থানে।
একমাত্র কর্মক্ষম ছেলেকে হারিয়ে ওদিকে পরিবারের সবার বেদিশা অবস্থা। মাসুদের অসুস্থ অসহায় বাবা আরও অসহায় হয়ে পড়ে। শোকে ভেঙে পড়ে পরিবারের সবাই। অসহায় পরিবারটির হাল ধরার মতো আর কেউ-ই রইল না যে আজ! ভাগ্যের নির্মমতার সামনে কিছুই করার নেই তাদের। কেবল অনিশ্চিত এক ভবিষ্যত পড়ে থাকে সামনে।
মাসুদেররক্তভেজা লাল শার্টটি রেখে দিয়েছিল আফরোজা। ক’দিন পরপর আলমিরা খুলে শার্টটা বের করে বুকে মুখে চেপে ধরে ঘ্রাণ শোঁকে। প্রথম প্রথমভাইয়ার পরিচিত ঘামের গন্ধ পাওয়া যেত। কিন্তু কী আশ্চর্য! এখন আর পরিচিত সে গন্ধ নেই। বরং কেমন অচেনা এক আশ্চর্য রকমের সুঘ্রাণ বের হয়! আফরোজা মাকেও শুঁকতে বলে। মা মন ভরে সে ঘ্রাণ শুঁকেন আর অন্যরকম তৃপ্তি অনুভব করেন।
ভাইয়ারএইটুকু স্মৃতি নিয়ে আফরোজা বাকি জীবন পার করতে চায়। জীবনের কাছে নতুন করে আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই ওর। ভাইয়ার মতো এবার জীবনযুদ্ধে নামতে চায় আফরোজাও। দেখতে চায় নিজেকে সংগ্রামী মানুষের কাতারে। কিন্তু সে জানে না, আদৌও কি সফল হবে সে!
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
জুলাই বিপ্লবে আহত ১৪ জনকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হচ্ছে : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার শীর্ষ পদে এখনো ভারতীয়রা
ভারতে নির্যাতনের ভিডিও বাংলাদেশের সা¤প্রতিক ঘটনা হিসেবে প্রচার
দাদাবাড়ি বেড়াতে এসে খুন হলো শিশু সাফওয়ান, আটক ২
নরসিংদীতে ভ্রাম্যমাণ আদালতকে লক্ষ্য করে বালুদস্যুদের গুলিবর্ষণ
নরসিংদীতে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মানববন্ধন
রাঙামাটিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ
আখাউড়ায় মর্টার সেল উদ্ধার
রাজবাড়ীতে আ.লীগ দুই নেতা কারাগারে
কমলগঞ্জে ৮২ শতক সরকারি খাস জমি উদ্ধার
প্রিমিয়ার ভার্সিটি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হলেন চসিক মেয়র
কুষ্টিয়ায় প্লাইউড বোর্ড কারখানায় আগুন
বিএনপি নেতা কায়কোবাদের দারুল উলূম হাটহাজারীসহ বিভিন্ন মাদরাসা পরিদর্শন
মাদারীপুরে পদ্মা-আড়িয়াল খাঁ নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন অব্যাহত
গফরগাঁও সাবেক এমপি বাবেল গোলন্দাজ দম্পতির বিরুদ্ধে দুদকের ২ মামলা
ময়মনসিংহে পুলিশ রেঞ্জ কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারের উদ্বোধন
নওফেল পরিবারের ২৫টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ
নিজ বাড়িতে ক্ষতিগ্রস্ত বন্ধুদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি
যুবদল নেতার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচারের অভিযোগ
ট্রাভেল ব্যান্ড হ্যালির ধুমকেতুর দুই গান