ঢাকা   রোববার, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ৩ ফাল্গুন ১৪৩১

জসীম উদদীন : মাটি ও মানুষের কবি

Daily Inqilab জসীম উদ্দীন মুহম্মদ

১৩ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম | আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম

বাংলা কবিতার প্রসঙ্গ আসলেই আমার মানসপটে যে নামটি সর্বাগ্রে ভেসে উঠে, তিনি আর কেউ নন; বাংলা কবিতার প্রাণপুরুষ মা, মাটি ও মানুষের কবি, পল্লীকবি খ্যাত জসীম উদদীন। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, বাংলা কবিতার হাজার বছরের ইতিহাসে কবি জসীম উদদীন একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর কবিতায় যে সরস প্রাণের পরশ বিদ্যমান; তা আজও অগণিত পাঠকের হৃদয় কাড়ে। রবীন্দ্র-নজরুল যুগের কবি হয়েও তিনি তাদের থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত থেকে আলাদা একটি কবিতার জগৎ বিনির্মাণ করেছেন। সাধারণ গ্রামীন জীবনকে বুকে লালন করে নির্মাণ করেছেন নিজস্ব এক কাব্যভুবন। নিঃসন্দেহে তিনি খুলে গেছেন বাংলা কবিতার এক চিরনতুন শ্বাশত দুয়ার।

গ্রাম বাংলার মাটি ও মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে কেন্দ্র করে এতো দরদি কবিতা, ছড়া, গীতিকবিতা, উপন্যাস রচনা করেছেন; যা বিশ্বসাহিত্যেও আর কেউ লিখেছেন বলে আমার জানা নেই। দেশমাতৃকা, মানুষ এবং প্রকৃতিকে কতটা নিবিড়রভাবে ভালোবাসলে এমন লেখা লিখতে পারা যায়- তা ভাবতেই আমি বিস্ময়ে অভিভূত হই, পুলকিত হই, আবেগে আপ্লুত হই। বাংলা কবিতার মুকুটহীন এই সম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধায়... ভালোবাসায় প্রাণপ্রিয় স্বদেশের ছবি দেখি... হৃদয়পটে বাংলাদেশের ছবি আঁকি। নিমন্ত্রণ” কবিতায় কবি বলেছেন, তুমি যাবে ভাই - যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই - যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়”
..... কী অসাধারণ এবং মায়াভরা আহ্বান! আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এমনি আন্তরিক আহবানকে উপেক্ষা করার সাধ্য এই পৃথিবীতে কারো নেই। কারো হতে পারে না।

আমাদের প্রাণের কবি জসীম উদদীন এর প্রকৃত নাম মোহাম্মাদ জসীম উদ্দীন মোল্লা পিতা মোঃ আনসার উদ্দিন মোল্লা এবং মাতা- আমেনা খাতুন। জন্ম- ১ জানুয়ারি ১৯০৩, গ্রামের নাম- তাম্বুলখানা জেলা- ফরিদপুর। কবিতার প্রতি তাঁর অনুরাগ ছোটকাল থেকেই। একবার তিনি শুনলেন যে, তাদের গ্রামের তাঁতীপাড়ার রহিম মােল্লা কবিগান রচনা করেন। শোনামাত্রই তিনি ছুটে গেলেন রহিম মোল্লার কাছে। গিয়েই বললেন, আমি আপনার সঙ্গে কবিগান রচনার পাল্লা দিতে চাই । বেশ আর যায় কোথায়? শুরু হলাে কবিতা রচনার লড়াই। কেউ কাউকে ছেড়ে দেননি। অবশেষে রহিম মোল্লা ছোট্ট জসিম উদদীনের অসাধারণ কবিত্বশক্তির পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হলেন এবং তাকে এ ব্যাপারে খুব উৎসাহ প্রদান করলেন। মূলত সেই ঘটনার পর থেকেই সহজাত কবিত্ব শক্তির অধিকারী কবি জসীম উদদীন এর কাব্য প্রতিভা সগৌরবে ডালপালা মেলতে শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে মাটি ও মানুষের প্রতি কবির অকৃত্রিম ভালোবাসা-ই তাকে পরবর্তীতে দিগন্ত জোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছে।

অতঃপর বাংলা গীতিকা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কবি জসীম উদদীন আধুনিক কবিতার দিকে চোখ ফেরালেন। নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ শুরু করেন আবহমান বাংলার পল্লী জীবনের দিকে, গ্রামের সহজ-সরল অনাড়ম্বর মানুষগুলোর জীবনবৃত্তের দিকে। আর সেখানেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন বাংলার মানুষের লোকজ জীবনের অবারিত প্রান্তর। তিনি দেখতে পেলেন গ্রামীণ জনপদেই গ্রথিত আছে তাঁর দরদি কলমের তুলির আঁচড়ে লেখা কবিতা নামক শিল্পবৃক্ষের প্রতœবীজ। এরই ফলশ্রুতিতে বাংলার গ্রামীণ-প্রকৃতি আর সাধারণ মানুষ নিয়েই গড়ে উঠেছে কবির কবিতালোক। বিখ্যাত কবর কবিতায় কবির কণ্ঠে যেন সারা বাংলার গণমানুষের প্রতিধ্বনি..
এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক.. এখানেই শেষ নয়। এই কবিতার শেষাংশে আমরা অন্য এক কবি জসীম উদদীনকে প্রত্যক্ষ করি। সেখানে তিনি মরমী এক উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত.. উদ্ভাসিত। যেখানে আছে মহান স্রষ্টার প্রতি কবির গভীর আস্থা ও বিশ্বাসের সরল স্বীকারোক্তি। স্রস্টার কাছে আত্মনিবেদনের অসামান্য আকুতি। কবি বলেছেন, ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে,
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।

মজিদ হইতে আযান হাঁকিছে বড় সুকরুণ সুরে, মোর জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দূরে।
জোড়হাত দাদু মোনাজাত কর, আয় খোদা! রহমান।
ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যু-ব্যথিত প্রাণ”।
এখানেই কবি থেমে যাননি। এরপর অসংখ্য কবিতা, গান, ছড়া, ছোটগল্প এবং উপন্যাসে বাংলা সাহিত্যকে করেছেন প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ। গ্রামীণ জীবনকেন্দ্রিক বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী কবি হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত বাংলার পল্লী-প্রকৃতিকে সাহিত্যে স্থান দিয়ে মহিমান্বিত করেছেন। নতুন প্রাণে কবিতাকে জাগ্রত করেছেন, সজীবতা দান করেছেন। একে একে বচনা করেছেন সব কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ। যেমন: রাখালী (১৯২৭), নকশী কাঁথার মাঠ (১৯২৯, বালুচর (১৯৩০), ধানখেত (১৯৩৩), সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৪), রঙিলা নায়ের মাঝি(১৯৩৫), হাসু (১৯৩৮), রুপবতি (১৯৪৬), মাটির কান্না (১৯৫১), এক পয়সার বাঁশী (১৯৫৬), সকিনা (১৯৫৯), সুচয়নী (১৯৬১), ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে (১৯৬২), ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে (১৯৬২)
মা যে জননী কান্দে (১৯৬৩), হলুদ বরণী (১৯৬৬), জলে লেখন (১৯৬৯), কাফনের মিছিল (১৯৮৮) এবং তার একমাত্র উপন্যাসের বোবা কাহিনী(১৯৬৪)।

জসীম উদদীনের প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ-ই বিচিত্র অনুষঙ্গ এবং বহুমাত্রিক প্রজ্ঞায় উদ্ভাসিত। যা অবশ্যই প্রত্যেক সচেতন পাঠক মহলের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। রূপ-রস আর রূপান্তরের বহুমুখী ব্যঞ্জনায় ভরপুর তাঁর প্রতিটি লেখা। যা অবশ্যই চিরকাল সব শ্রেণি-পেশার পাঠকের অন্তরে দোলা দিয়ে যাবে। তবে অত্যন্ত আফসোসের সাথে একটি কথা না বলে পারছি না, আজও আমরা ভুল বানানে জসীম উদদীন লিখি। উদদীন না লিখে উদ্দীন লিখি। যা একই সঙ্গে চরম বেদনার এবং হতাশার। আমি মনে করি, এটি কেবল আমাদের উদাসীনতাই নয়, প্রকান্তরে বিরল প্রতিভার অধিকারী শক্তিমান এই কবির প্রতি চরম অবহেলার শামিল। যা কখনও কাম্য নয়। কাম্য হতে পারে না। এ ব্যাপারে সবার সচেতনতা কামনা করছি। আগামী জানুয়ারির ১ তারিখ প্রিয়কবি, প্রাণের কবি এবং বাংলা কবিতার মুকুটহীন সম্রাট জসীম উদদীন এর শুভ জন্মদিন। এই উপলক্ষে কবির প্রতি প্রাণঢালা শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জানাই। সেইসাথে আজকের এবং আগামী প্রজন্মের সকল পাঠকের কাছে আকুল আবেদন জানাই, আসুন আমরা পল্লীকবির মতো গ্রাম বাংলাকে ভালোবাসতে শিখি, তাঁর আদর্শ বুকে লালন করতে শিখি, তাঁর মতো জীবন ঘনিষ্ঠ কবিতা লিখি। তবেই তাঁর কবিতা সার্থক হবে। প্রিয়কবি অনন্তলোকে থেকেও আমাদের মাঝে অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন।


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

কবিতা
মেলায় প্রকাশিত নতুন বই
যতন করে রেখো
যুগে যুগে মুক্তির সংগ্রামে বিপ্লবী কবিদের কবিতা ও গান
জুলাই ৩৬
আরও

আরও পড়ুন

ব্যাখ্যা ছাড়াই ২০ অভিবাসন বিচারককে বরখাস্ত করলেন ট্রাম্প

ব্যাখ্যা ছাড়াই ২০ অভিবাসন বিচারককে বরখাস্ত করলেন ট্রাম্প

ইসলাম নিয়ে ব্যবসা করা কোন ইসলামী দল ক্ষমতায় আসতে পারবে না : এ এম এম বাহাউদ্দীন

ইসলাম নিয়ে ব্যবসা করা কোন ইসলামী দল ক্ষমতায় আসতে পারবে না : এ এম এম বাহাউদ্দীন

গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিতে নির্বাচনের বিকল্প নেই: মির্জা ফখরুল

গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিতে নির্বাচনের বিকল্প নেই: মির্জা ফখরুল

নীলফামারী জেলা ছাত্রদলের ফরম বিতরণ ও কর্মী সম্মেলন  অনুষ্ঠিত

নীলফামারী জেলা ছাত্রদলের ফরম বিতরণ ও কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত

আড়াইহাজারে সড়ক দুর্ঘটনায় মাদ্রাসা ছাত্র নিহত

আড়াইহাজারে সড়ক দুর্ঘটনায় মাদ্রাসা ছাত্র নিহত

রাঙামাটিতে কাপ্তাই হ্রদের কাট্টলি বিলে বাঁশের ভেলা

রাঙামাটিতে কাপ্তাই হ্রদের কাট্টলি বিলে বাঁশের ভেলা

বান্দরবানে সেনাবাহিনীর সহয়তায় কুকি-চিনের অত্যচারে পালিয়ে যাওয়া পরিবার নিজ গৃহে ফিরছে

বান্দরবানে সেনাবাহিনীর সহয়তায় কুকি-চিনের অত্যচারে পালিয়ে যাওয়া পরিবার নিজ গৃহে ফিরছে

ফেনী নদীতে অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলন,বিলীন হচ্ছে আশ্রয়ন প্রকল্প,ঘরবাড়ি-কৃষিজমি

ফেনী নদীতে অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলন,বিলীন হচ্ছে আশ্রয়ন প্রকল্প,ঘরবাড়ি-কৃষিজমি

জুলাই আন্দোলনে বিতর্কিত পোস্ট, কলাপাড়ায় চিকিৎসকের শাস্তি ও অপসারণের দাবিতে গণস্বাক্ষর

জুলাই আন্দোলনে বিতর্কিত পোস্ট, কলাপাড়ায় চিকিৎসকের শাস্তি ও অপসারণের দাবিতে গণস্বাক্ষর

শব্দ দূষণে নাকাল বরগুনা শহরবাসী: চরম হুমকির মুখে রয়েছে স্কুল  শিক্ষার্থীরা

শব্দ দূষণে নাকাল বরগুনা শহরবাসী: চরম হুমকির মুখে রয়েছে স্কুল শিক্ষার্থীরা

ফেঁসে যাচ্ছে হাসিনার দোসর মিডিয়াগুলো, প্রশংসায় ভাসছেন শফিকুল আলম

ফেঁসে যাচ্ছে হাসিনার দোসর মিডিয়াগুলো, প্রশংসায় ভাসছেন শফিকুল আলম

এবাদতকে বিমানবাহিনীর অনারারি কমিশন পদে বিবেচনা করা যেতে পারে – জুলকারনাইন

এবাদতকে বিমানবাহিনীর অনারারি কমিশন পদে বিবেচনা করা যেতে পারে – জুলকারনাইন

শেরপুরে সাবেক যুবলীগ নেতা গ্রেফতার

শেরপুরে সাবেক যুবলীগ নেতা গ্রেফতার

লাখো ভক্ত মুরিদের অশ্রুভেজা মোনাজাতের মধ্য দিয়ে ফান্দাউক দরবারের মাহফিল সম্পন্ন

লাখো ভক্ত মুরিদের অশ্রুভেজা মোনাজাতের মধ্য দিয়ে ফান্দাউক দরবারের মাহফিল সম্পন্ন

কিশোরগঞ্জে পুলিশ পরিচয়ে ব্যবসায়ীর টাকা ছিনতাই

কিশোরগঞ্জে পুলিশ পরিচয়ে ব্যবসায়ীর টাকা ছিনতাই

মতলবে নদী ভাঙনের কবলে তিনটি গ্রাম  হুমকির মুখে মেঘনা-ধনাগোদা বেড়ীবাঁধ

মতলবে নদী ভাঙনের কবলে তিনটি গ্রাম হুমকির মুখে মেঘনা-ধনাগোদা বেড়ীবাঁধ

হরিরামপুরে আমজাদ হত্যা মামলা : পরকীয়া প্রেমিকা সাজেদার দিকেই সন্দেহের তীর

হরিরামপুরে আমজাদ হত্যা মামলা : পরকীয়া প্রেমিকা সাজেদার দিকেই সন্দেহের তীর

মানুষের তৈরি আইন দিয়ে মানুষের কল্যাণ সম্ভব নয় : মাওলানা আবুল কালাম আজাদ

মানুষের তৈরি আইন দিয়ে মানুষের কল্যাণ সম্ভব নয় : মাওলানা আবুল কালাম আজাদ

মালিতে স্বর্ণের খনি ধসে ৪৮ জন নিহত

মালিতে স্বর্ণের খনি ধসে ৪৮ জন নিহত

নাসা গ্রুপের নজরুলের ৭৮১ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ, দুদকের মামলা

নাসা গ্রুপের নজরুলের ৭৮১ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ, দুদকের মামলা