জসীম উদদীন : মাটি ও মানুষের কবি
১৩ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম | আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
বাংলা কবিতার প্রসঙ্গ আসলেই আমার মানসপটে যে নামটি সর্বাগ্রে ভেসে উঠে, তিনি আর কেউ নন; বাংলা কবিতার প্রাণপুরুষ মা, মাটি ও মানুষের কবি, পল্লীকবি খ্যাত জসীম উদদীন। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, বাংলা কবিতার হাজার বছরের ইতিহাসে কবি জসীম উদদীন একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর কবিতায় যে সরস প্রাণের পরশ বিদ্যমান; তা আজও অগণিত পাঠকের হৃদয় কাড়ে। রবীন্দ্র-নজরুল যুগের কবি হয়েও তিনি তাদের থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত থেকে আলাদা একটি কবিতার জগৎ বিনির্মাণ করেছেন। সাধারণ গ্রামীন জীবনকে বুকে লালন করে নির্মাণ করেছেন নিজস্ব এক কাব্যভুবন। নিঃসন্দেহে তিনি খুলে গেছেন বাংলা কবিতার এক চিরনতুন শ্বাশত দুয়ার।
গ্রাম বাংলার মাটি ও মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে কেন্দ্র করে এতো দরদি কবিতা, ছড়া, গীতিকবিতা, উপন্যাস রচনা করেছেন; যা বিশ্বসাহিত্যেও আর কেউ লিখেছেন বলে আমার জানা নেই। দেশমাতৃকা, মানুষ এবং প্রকৃতিকে কতটা নিবিড়রভাবে ভালোবাসলে এমন লেখা লিখতে পারা যায়- তা ভাবতেই আমি বিস্ময়ে অভিভূত হই, পুলকিত হই, আবেগে আপ্লুত হই। বাংলা কবিতার মুকুটহীন এই সম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধায়... ভালোবাসায় প্রাণপ্রিয় স্বদেশের ছবি দেখি... হৃদয়পটে বাংলাদেশের ছবি আঁকি। নিমন্ত্রণ” কবিতায় কবি বলেছেন, তুমি যাবে ভাই - যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই - যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়”
..... কী অসাধারণ এবং মায়াভরা আহ্বান! আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এমনি আন্তরিক আহবানকে উপেক্ষা করার সাধ্য এই পৃথিবীতে কারো নেই। কারো হতে পারে না।
আমাদের প্রাণের কবি জসীম উদদীন এর প্রকৃত নাম মোহাম্মাদ জসীম উদ্দীন মোল্লা পিতা মোঃ আনসার উদ্দিন মোল্লা এবং মাতা- আমেনা খাতুন। জন্ম- ১ জানুয়ারি ১৯০৩, গ্রামের নাম- তাম্বুলখানা জেলা- ফরিদপুর। কবিতার প্রতি তাঁর অনুরাগ ছোটকাল থেকেই। একবার তিনি শুনলেন যে, তাদের গ্রামের তাঁতীপাড়ার রহিম মােল্লা কবিগান রচনা করেন। শোনামাত্রই তিনি ছুটে গেলেন রহিম মোল্লার কাছে। গিয়েই বললেন, আমি আপনার সঙ্গে কবিগান রচনার পাল্লা দিতে চাই । বেশ আর যায় কোথায়? শুরু হলাে কবিতা রচনার লড়াই। কেউ কাউকে ছেড়ে দেননি। অবশেষে রহিম মোল্লা ছোট্ট জসিম উদদীনের অসাধারণ কবিত্বশক্তির পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হলেন এবং তাকে এ ব্যাপারে খুব উৎসাহ প্রদান করলেন। মূলত সেই ঘটনার পর থেকেই সহজাত কবিত্ব শক্তির অধিকারী কবি জসীম উদদীন এর কাব্য প্রতিভা সগৌরবে ডালপালা মেলতে শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে মাটি ও মানুষের প্রতি কবির অকৃত্রিম ভালোবাসা-ই তাকে পরবর্তীতে দিগন্ত জোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছে।
অতঃপর বাংলা গীতিকা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কবি জসীম উদদীন আধুনিক কবিতার দিকে চোখ ফেরালেন। নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ শুরু করেন আবহমান বাংলার পল্লী জীবনের দিকে, গ্রামের সহজ-সরল অনাড়ম্বর মানুষগুলোর জীবনবৃত্তের দিকে। আর সেখানেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন বাংলার মানুষের লোকজ জীবনের অবারিত প্রান্তর। তিনি দেখতে পেলেন গ্রামীণ জনপদেই গ্রথিত আছে তাঁর দরদি কলমের তুলির আঁচড়ে লেখা কবিতা নামক শিল্পবৃক্ষের প্রতœবীজ। এরই ফলশ্রুতিতে বাংলার গ্রামীণ-প্রকৃতি আর সাধারণ মানুষ নিয়েই গড়ে উঠেছে কবির কবিতালোক। বিখ্যাত কবর কবিতায় কবির কণ্ঠে যেন সারা বাংলার গণমানুষের প্রতিধ্বনি..
এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক.. এখানেই শেষ নয়। এই কবিতার শেষাংশে আমরা অন্য এক কবি জসীম উদদীনকে প্রত্যক্ষ করি। সেখানে তিনি মরমী এক উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত.. উদ্ভাসিত। যেখানে আছে মহান স্রষ্টার প্রতি কবির গভীর আস্থা ও বিশ্বাসের সরল স্বীকারোক্তি। স্রস্টার কাছে আত্মনিবেদনের অসামান্য আকুতি। কবি বলেছেন, ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে,
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।
মজিদ হইতে আযান হাঁকিছে বড় সুকরুণ সুরে, মোর জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দূরে।
জোড়হাত দাদু মোনাজাত কর, আয় খোদা! রহমান।
ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যু-ব্যথিত প্রাণ”।
এখানেই কবি থেমে যাননি। এরপর অসংখ্য কবিতা, গান, ছড়া, ছোটগল্প এবং উপন্যাসে বাংলা সাহিত্যকে করেছেন প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ। গ্রামীণ জীবনকেন্দ্রিক বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী কবি হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত বাংলার পল্লী-প্রকৃতিকে সাহিত্যে স্থান দিয়ে মহিমান্বিত করেছেন। নতুন প্রাণে কবিতাকে জাগ্রত করেছেন, সজীবতা দান করেছেন। একে একে বচনা করেছেন সব কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ। যেমন: রাখালী (১৯২৭), নকশী কাঁথার মাঠ (১৯২৯, বালুচর (১৯৩০), ধানখেত (১৯৩৩), সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৪), রঙিলা নায়ের মাঝি(১৯৩৫), হাসু (১৯৩৮), রুপবতি (১৯৪৬), মাটির কান্না (১৯৫১), এক পয়সার বাঁশী (১৯৫৬), সকিনা (১৯৫৯), সুচয়নী (১৯৬১), ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে (১৯৬২), ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে (১৯৬২)
মা যে জননী কান্দে (১৯৬৩), হলুদ বরণী (১৯৬৬), জলে লেখন (১৯৬৯), কাফনের মিছিল (১৯৮৮) এবং তার একমাত্র উপন্যাসের বোবা কাহিনী(১৯৬৪)।
জসীম উদদীনের প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ-ই বিচিত্র অনুষঙ্গ এবং বহুমাত্রিক প্রজ্ঞায় উদ্ভাসিত। যা অবশ্যই প্রত্যেক সচেতন পাঠক মহলের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। রূপ-রস আর রূপান্তরের বহুমুখী ব্যঞ্জনায় ভরপুর তাঁর প্রতিটি লেখা। যা অবশ্যই চিরকাল সব শ্রেণি-পেশার পাঠকের অন্তরে দোলা দিয়ে যাবে। তবে অত্যন্ত আফসোসের সাথে একটি কথা না বলে পারছি না, আজও আমরা ভুল বানানে জসীম উদদীন লিখি। উদদীন না লিখে উদ্দীন লিখি। যা একই সঙ্গে চরম বেদনার এবং হতাশার। আমি মনে করি, এটি কেবল আমাদের উদাসীনতাই নয়, প্রকান্তরে বিরল প্রতিভার অধিকারী শক্তিমান এই কবির প্রতি চরম অবহেলার শামিল। যা কখনও কাম্য নয়। কাম্য হতে পারে না। এ ব্যাপারে সবার সচেতনতা কামনা করছি। আগামী জানুয়ারির ১ তারিখ প্রিয়কবি, প্রাণের কবি এবং বাংলা কবিতার মুকুটহীন সম্রাট জসীম উদদীন এর শুভ জন্মদিন। এই উপলক্ষে কবির প্রতি প্রাণঢালা শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জানাই। সেইসাথে আজকের এবং আগামী প্রজন্মের সকল পাঠকের কাছে আকুল আবেদন জানাই, আসুন আমরা পল্লীকবির মতো গ্রাম বাংলাকে ভালোবাসতে শিখি, তাঁর আদর্শ বুকে লালন করতে শিখি, তাঁর মতো জীবন ঘনিষ্ঠ কবিতা লিখি। তবেই তাঁর কবিতা সার্থক হবে। প্রিয়কবি অনন্তলোকে থেকেও আমাদের মাঝে অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান