ঢাকা   শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৩ পৌষ ১৪৩১

বিদ্রোহী কবি নজরুলের মা

Daily Inqilab জোবায়ের আলী জুয়েল

৩১ মে ২০২৪, ১২:১৪ এএম | আপডেট: ৩১ মে ২০২৪, ১২:১৪ এএম

(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
প্রমিলা নজরুলের বিয়ে হয ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল, তাঁদের যখন বিয়ে হয় তখন প্রমীলার বয়স ১৪ আর নজরুলের ২৩। মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার ঐতিহ্য বাহী তেওতা গ্রামে প্রমীলা সেন গুপ্তার জন্ম। পিতার নাম বসন্ত কুমার সেন গুপ্ত। নজরুলের শ্বাশুড়ীর নাম গিরিবালা দিবী। তিনি ছিলেন ব্্রাহ্মনের মেয়ে। নজরুল তাঁর নিজের শ্বাশুড়ীর গিরিবালাদেবী কে কোন দিন মা বলে ডাকেন নি। তাঁকে ডাকতেন মাসিমা বলে। তিনি নজরুলকে সম্মোধন করতেন নুরু বলে।শ্রীযুক্ত গিরিরবালা দেবী তাঁর স্বামী বসন্ত কুমার সেন গুপ্তের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ছিলেন এবং একটি মাত্র সন্তান প্রমীলা জন্মাবার পরেই তিনি বিধবা হয়েছিলেন। তাঁর স্বামী বসন্ত কুমার সেন গুপ্তের প্রথমা স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থাতেই তিনি গিরিবালা দেবীকে বিয়ে করেছিলেন। গিরিবালা দেবীর ‘জা’ ছিলেন বিরজা সুন্দরা দেবী।

প্রমীলার জ্যেঠী বিরজা সুন্দরী দেবীকে যে নজরুল ‘মা’ বলে সম্মোধন করতেন সে কথা তো সকলেরই জানা। তিনিই নজরুলকে হুগলী জেলে নিজ হাতে লেবুর রস পান করিয়ে দীর্ঘ ৩৯ দিনের অনশন ভঙ্গ করিয়ে ছিলেন। সেদিন নজরুলের অনশন ভাঙ্গিয়ে জেল থেকে বাইরে এসে অপেক্ষামান জনতার উদ্দেশ্যে বিরজা সুন্দরী দেবী বলেছিলেন- “খাইয়েছি পাগলকে, কথা কি শোনে। বলে না, অন্যায় আমি সইব না” শেষ পযর্ন্ত আমি হুকুম দিলাম, আমি ‘মা’। মার আদেশ সব ন্যায় অন্যায় বোধের ওপরে। লেবুর রস খাইয়ে এসেছি।” ১৯২৬ সালের অক্টোম্বর মাসে প্রকাশিত হয় কবির বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ “সর্বহারা”। কবি এই গ্রন্থটি বিরজা সুন্দরী দেবীকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গ কবিতাটিতে নজরুল লিখেন-

“মা (বিরজা সুন্দরী দেবী)র শ্রী চরণার বিন্দে”/সর্বসহা সর্বহারা জননী আমার।
তুমি কোন দিন কারো করনি বিচার।/কারেও দাওনি দোষ, ব্যাথা বারিধির
কুলে বসে কাঁদো মৌনা কন্যা ধরণীর।/হয়তো ভূলেছো মাগো, কোন একদিন,
এমনি চলিতে পথে মরু-বেদুইন।/শিশু এক এসেছিল, শ্রান্ত কন্ঠে তাঁর

বলেছিল গলা ধরে “মা হবে আমার?”/বিরজা সুন্দরী দেবী সপরিবারে কলকাতা চলে আসার পর কবি নিয়মিত তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ১৯৩৮ সালে কলকাতায় এই মহিয়সী নারী দেহ ত্যাগ করেন। নজরুল এ সময় তাঁর শয্যাপাশে উপস্থিত ছিলেন।

বহরমপুর জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর যে পরিবারের সঙ্গে কবির পরিচয় হয়, সে পরিবারের কর্ত্রী সুনীতি বালাকেও কবি মায়ের আসনে রাখেন। নজরুল জীবনে সাহিত্য যেমন ছিলো। ঠিক তেমনটি ছিল নারীর অবদান। কবি তাঁর সুখ-দুঃখ অভিমান মুখে প্রকাশ না করে সাহিত্যের মাঝে তুলে ধরেছেন। মায়েদের নিয়ে লিখেছেন একের পর এক কবিতা। এই কবির সাহিত্য মানেই নারীর অবদান। এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

হুগলীর এক মহিয়সী নারী বিশিষ্ট সমাজ সেবিকা এবং লেখিকা মিসেস এম. রহমান কেও নজরুল অপরিসীম শ্রদ্ধা ভক্তি করতেন। তাঁকেও মা বলে ডাকতেন। তাঁর প্রকৃত নাম মোছাম্মদ মাসুদা খাতুন। জন্ম ১৮৮৪ সালে। হুগলির সরকারী উকিল খান বাহাদুর মজহারুল আনওয়ার চৌধুরীর কন্যা এই মিসেস এম. রহমান নজরুর ইসলামকে বিশেষ ¯েœহ করতেন। তাঁর স্বামী ছিলেন স্বনামধন্য বিখ্যাত সাংবাদিক ও সাহ্যিতিক মুজিবর রহমান। সেকালে যা ছিল অস্বাভাবিক চিন্তা হিন্দু মেয়ে প্রমিলা ও মুসলমান ছেলে নজরুলের মধ্যে বিয়ে। বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে নজরুল প্রমীলার ক্ষেত্রে তিনি তাই বাস্তাবায়ন করেন। কলকাতায় নজরুল-প্রমীলার বিয়ে হয় ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল। বিয়ের পর নব দম্পত্তির বসবাসের জন্য তিনিই হুগলিতে নজরুলকে বাসা ভাড়া করে দেন। এই বিদুষী মহিলা ১৯২৬ সালের ২০ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত নজরুল রচনা করেন “মিসেস এম. রহমান” নামের বিখ্যাত কবিতাটি। কবিতাটির শেষ পদের ৬টি চরণ এখানে তুলে ধরা হলোঃÑ

তোমার মমতা মানিক আলোকে চিনিনু তোমারে মাতা,
তুমি লাঞ্চিতা বিশ্ব-জননী! তোমার আঁচল পাতা।
নিখিল দুঃখী নিপিড়ীত তরে, বিষ শুধু তোমা দহে,
ফনা তব মাগো পীড়িত নিখিল ধরণীর ভার বহে।
আমারে যে তুমি বাসিয়াছ ভালো ধরেছ অভয়-ক্রোড়ে,
সপ্ত রাজার রাজৈশ্বর্য মানিক দিয়াছ মোরে।

এই কবিতার প্রতিটি ছত্রে যেনো মাতৃশোকে বিহ্বল কবির কান্না উথলে উঠেছে। এই সময় নজরুল ইসলাম সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুউদ্দীন কে একটি পত্রে লিখেছিলেন মা’র (মিসেস এম. রহমান) মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আমার সব কিছু গুলিয়ে গেলো। বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গিয়েছিলো। আপন পেটের ছেলে চেয়েও বেশি ¯েœহ করতেন আমায়। আমি তার প্রতিদানে কিছুই দিতে পারি নাই। আমি আজ দেউলিয়া যেনো জীবনের জোয়ার-ভাটা দেখছি শুধু।

এখানে উল্লেখ্য নজরুল যখন একজন পাতানো মায়ের মৃত্যুতে শোকের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন তখন গর্ভধারিনী মায়ের কোনো খোঁজ খবর রাখার ও প্রয়োজন মনে করছেন না। এই সময়ে কবির নিজের ‘মা’ জীবিত ছিলেন। নজরুলের ‘মা’ জাহেদা খাতুন মারা যান ১৯২৮ সালের ৩০ মে।

এই সময় আরেক জন মহিয়সী নারী কে তিনি প্রাণ ভরে ‘মা’ বলে সম্মোধন করতেন। তিনি হচ্ছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সহধর্মীনি বাসন্তী দেবী। তিনি ও তাঁকে সন্তানতুল্য ¯েœহ করতেন। দেশ বন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের (জন্ম ১৮৭০ খ্রি. মৃত্যু ১৬ জুন ১৯২৫ খ্রি.) বাড়িতে গেলে বাসন্তী দেবী নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করে কাছে বসে কবিকে খাওয়াতেন।

দেশ বন্ধুর মৃত্যুর পরে কবির নজরুল শোকগাঁথা মূলক যে চিত্তনামা কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেন সেটি ও উৎসর্গ করেছিলেন বাসন্তী দেবীর নামে “ইন্দ্র পতন” কবিতায় নজরুল চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যুকে স্মরণ করে লিখেলেনঃÑ

জন্মিলে তুমি মোহাম্মদের আগে, হে পুরুষ বর!
কোরাণে ঘোষিত তোমার মহিমা, হতে পয়গাম্বর!
যে জ্যোতি পারেনি সহিতে স্বয়ং মুসা ও কোহ-ই তুরে,
সেই জ্যোতিঃ তুমি রেখেছিলে তব নয়ন মণিতে পুরে।
(সংক্ষেপিত)

যাই হোক, আমরা দেখতে পাচ্ছি মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে, যিনি গ্রামের বাড়িতে যাননি, তিনিই আবার পাতানো মায়ের মৃত্যুতে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন।

অদ্ভুদ রহস্য ভরা এই মানুষের মন। খেয়ালী কবি নজরুলের খাম খেয়ালী তো আর কম ছিলনা। কে জানে মায়ের সাথে বিরোধ জিইয়ে রেখে মাকে কষ্ট দিয়ে নিজে কষ্ট পেয়ে অন্য মহিলাদের প্রাণ ভরে ‘মা’ ডেকে তাঁর বুভূক্ষ হৃদয়ের মাতৃ¯েœহের তৃষ্ণা মেটানোর বিষয়টিও তেমনি খেয়ালী পনা ছিল কিনা।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথাই প্রমানিত হয় যে, চির ক্ষুদ্ধ, চির অভিমানী খেয়ালী নজরুল নিজের মায়ের থেকে দূরে সরে গিয়ে মাতৃ¯েœহ পাবার জন্যে উন্মাদের মতো ছুটে বেরিয়েছেন এবং যার কাছেই সে ¯েœহটুকু পেয়েছেন তাঁকেই হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধা, ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে প্রবল আবেগে আকঁড় ধরেছেন। কিন্তু এতদ সত্ত্বেও এই পাতানো নকল মায়েরা কি মাতৃ¯েœহের কাঙাল কবির মায়ের অভাব সবটুকু পূরণ করতে পেরেছেন কি ? (সমাপ্ত)


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

কিশোরগঞ্জ সাহিত্য পরিষদের বোরদা পুরস্কার
রঙ্গীন মাছের শহরে
নিরাপদ থাকুক পরিযায়ী পাখির আবাস
মির্জা আসাদুল্লাহ্ গালিব
আজ ঐতিহ্যবাদী লেখক হোসেন মাহমুদের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী
আরও

আরও পড়ুন

ইহুদিদের ইউসুফ (আঃ)- এর সমাধিতে নিয়ে গেল ইসরায়েলি সেনারা

ইহুদিদের ইউসুফ (আঃ)- এর সমাধিতে নিয়ে গেল ইসরায়েলি সেনারা

কাকরাইলে সাদপন্থিদের জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

কাকরাইলে সাদপন্থিদের জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

ইয়েমেনে হামলার সময় বিমানবন্দরে ছিলেন ডব্লিউএইচওর প্রধান

ইয়েমেনে হামলার সময় বিমানবন্দরে ছিলেন ডব্লিউএইচওর প্রধান

ইসরায়েলি হামলায় ইয়েমেন ও গাজায় ব্যাপক প্রাণহানি

ইসরায়েলি হামলায় ইয়েমেন ও গাজায় ব্যাপক প্রাণহানি

হেলিকপ্টারে সফর নিয়ে বিতর্ক, ব্যাখ্যা দিলেন আসিফ মাহমুদ

হেলিকপ্টারে সফর নিয়ে বিতর্ক, ব্যাখ্যা দিলেন আসিফ মাহমুদ

কুমিল্লায় ছুরিকাঘাতে যুবক খুন

কুমিল্লায় ছুরিকাঘাতে যুবক খুন

সচিবালয়ে আগুন: সংগ্রহ করা হলো সিসিটিভি ভিডিও

সচিবালয়ে আগুন: সংগ্রহ করা হলো সিসিটিভি ভিডিও

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বাশার আল-আসাদের স্ত্রী আসমা

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বাশার আল-আসাদের স্ত্রী আসমা

টেস্ট ক্যারিয়ারের রেকর্ডময় ৩৪তম সেঞ্চুরি পূর্ণ করলেন স্মিথ

টেস্ট ক্যারিয়ারের রেকর্ডময় ৩৪তম সেঞ্চুরি পূর্ণ করলেন স্মিথ

জাহাজে ৭ খুন : লাগাতার কর্মবিরতিতে পণ্যবাহী নৌযান শ্রমিকেরা

জাহাজে ৭ খুন : লাগাতার কর্মবিরতিতে পণ্যবাহী নৌযান শ্রমিকেরা

লেস্টার সিটিকে হারিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে লিভারপুল

লেস্টার সিটিকে হারিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে লিভারপুল

ফের্নন্দেসের লাল কার্ডের দিনে ফের হারল ইউনাইটেড

ফের্নন্দেসের লাল কার্ডের দিনে ফের হারল ইউনাইটেড

শেষের গোলে জিতে চেলসির জয়রথ থামাল ফুলহ্যাম

শেষের গোলে জিতে চেলসির জয়রথ থামাল ফুলহ্যাম

পরলোকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং: ভারতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা

পরলোকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং: ভারতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা

কালীগঞ্জে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর সংবাদ সম্মেলন

কালীগঞ্জে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর সংবাদ সম্মেলন

গ্রাম আদালত সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত

গ্রাম আদালত সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত

মিসরে প্রেসিডেন্ট সিসির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ

মিসরে প্রেসিডেন্ট সিসির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ

কুর্দি যোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি এরদোগানের

কুর্দি যোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি এরদোগানের

৩৫শ’ এজেন্টের অধিকাংশই গুজরাটের পাচারকারী

৩৫শ’ এজেন্টের অধিকাংশই গুজরাটের পাচারকারী

৫ সাংবাদিককে হত্যা করল ইসরাইল বিমান

৫ সাংবাদিককে হত্যা করল ইসরাইল বিমান