আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা
০৭ জুন ২০২৪, ১২:১৩ এএম | আপডেট: ০৭ জুন ২০২৪, ১২:১৩ এএম
চল্লিশের দশকের উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে নবরূপ দান করে। বস্তুত, ত্রিশোত্তর বাংলা উপন্যাস সাহিত্য পরিপূর্ণতা লাভ করে চল্লিশের দশকে এসে। এ কালে ইউরোপীয় ভাবধারার প্রভাব আরও গতিশীল হয়। প্রকৃতপক্ষে ঊনিশ শতকের মধ্যভাগে বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের উদ্ভব হলেও বিশ শতকে তা ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি অর্জন করে। বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথের শিল্পিত পরিচর্যায় বাংলা উপন্যাসের যে ঈর্ষণীয় বিকাশ সাধিত হয়, তা ত্রিশোত্তর ঔপন্যাসিকদের মাধ্যমে সমৃদ্ধি লাভ করে। ত্রিশোত্তর বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে ‘কল্লোল গোষ্ঠী’র একদল লেখক ‘রবীন্দ্রবলয়’ থেকে বেরিয়ে এসে ইউরোপীয় সাহিত্যের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে একটি ভিন্নতর সাহিত্যধারা সৃষ্টি করতে আগ্রহী হন এবং যথারীতি তাঁরা সার্থকতার সঙ্গে বাংলা সাহিত্যে একটি স্বতন্ত্র সাহিত্যধারার সৃষ্টি করেন। এ ধারা বাংলা কথাশিল্পে বহির্বাস্তবতা ও অন্তর্বাস্তবতার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে উপন্যাস-সাহিত্যের বিকাশে এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকগণ ইউরোপীয় ভাবধারা গভীরভাবে আত্মস্থ করে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের (১৮৫৬-১৯৩৯) মনঃসমীক্ষণতত্ত্ব ও কার্ল মার্কসের সমাজবীক্ষা কিংবা ধনতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা নিপুণ উপস্থাপন করেন। এছাড়াও আল্বেয়ার ক্যামু, জেমস জয়েস, জ্যঁ পল সাঁর্ত্রে, ভার্জিনিয়া উলফ্, উইলিয়াম ফকনার প্রমুখ সাহিত্যিকের প্রভাবে তাঁরা উপন্যাসের কাহিনি ও চরিত্রাঙ্কনে নিয়ে আসেন অভিনবত্ব। তাঁরা বাংলা উপন্যাসের গতানুগতিকতাকে পরিহার করে নতুন এক পথ নির্মাণ করেন। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালীন সময়ের ঔপন্যাসিকদের মধ্যে তাঁরা স্বতন্ত্র প্রতিভায় নিজ দেশকালের প্রেক্ষাপটে বিরাজিত সমস্যা ও সংকটকে তাদের রচনায় সাহিত্যিক রূপ দেন। সমকালীন মানুষের জীবন তাঁদের উপন্যাসের মূল উপজীব্য। তাঁরা প্রধানত মানুষের অন্তর্জগৎকে অবলম্বন করে সমকালীন জীবন, জগৎ, চিন্তা-চৈতন্য তাঁদের উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। তাঁদের উপন্যাসে প্রতিফলিত আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এই নিবন্ধে অনুসন্ধান করা হয়েছে।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) জীবনের বহুমুখিতা খুঁজেছিলেন সমাজের বহির্জীবনে। তিনি ব্যক্তিকে অবলম্বন করে মানব-অস্তিত্বের প্রহেলিকার মধ্যে ঢুকতে চাননি। তাঁর উপন্যাসে প্রান্তিক জনমানুষের জীবনভাষ্য ফুটে উঠেছে। গোটা রাঢ় অঞ্চলের গ্রামীণ জীবনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং তারই মাঝে গোটা মানুষের অভ্যুদয় নিপুণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর উপন্যাসে। তিনি শ্রমিকের অতৃপ্ত অশান্ত বুভুক্ষা ও ক্ষুব্ধ বিদ্রোহাত্মক অকৃত্রিম চিত্র অঙ্কন করেছেন। অস্তিত্বের নির্বিকল্প প্রকৃতি অনুসন্ধানের চেয়ে জীবনের ভোগ-উপভোগ, রক্তস্নায়ুপেশিতে বেঁচে থাকাটা তাঁর সাহিত্যে প্রধান উপজীব্য বিষয় হয়ে উঠেছে।
জীবনের প্রতি এক গভীর আসক্তি ও আগ্রহ থেকেই তিনি জীবনের সংঘবদ্ধতার জমাট কেন্দ্রগুলোকে খুব কাছ থেকে দেখতে চেষ্টা করেছেন। তিনি আপনকালের পটে স্থাপন করে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে মানুষের জীবনের নাট্যলীলাকে খুঁটিয়ে দেখতে চেয়েছেন। ফলে, তাঁর সাহিত্য নির্দিষ্টকালে, নির্দিষ্ট অঞ্চলে নিবন্ধ জীবনই মহাজীবনের অনিঃশেষ কাহিনিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গোপিকানাথ রায়চৌধুরীর বক্তব্য স্মরণযোগ্য : কল্লোল-গোষ্ঠীর তরুণ লেখকদের অবক্ষয়ধর্মী দ্বিধাগ্রস্থ জীবন-চেতনার পটভূমিতে তারাশঙ্কর নিয়ে এলেন এক সুস্থ সবল ও ঋজু জীবনবোধ, জীবনের রস ও রহস্যের এক আদিম প্রাণবন্ত চেতনা। এই ‘জীবন’ তাঁর আলোচ্য পর্বের সাহিত্যে বহু বিচিত্ররূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। কখনও ক্ষয়িষ্ণু সামন্তজীবনের করুণ অতীতচারণায়, কখনও বা লোকজীবনের রোম্যান্টিক রূপচিত্রে সহজিয়া বৈষ্ণব, বেদে-সাপুড়ে, ডোম বাউড়ীর জীবনকথায়। আবার কখনও বা দারিদ্র্যপীড়িত কৃষকের করুণজীবনচিত্রে অর্থনৈতিক দুর্গতির চাপে নিরূপায় কৃষক কর্তৃক শ্রমিক-বৃত্তি গ্রহণের অসহায়তার বর্ণনায় কিংবা আদর্শদীপ্ত অহিংস জাতীয়তাবাদে তাঁর ব্যাপক ও গভীর সুস্থ জীবনাগ্রহ মূর্ত হয়ে উঠেছে। ভারতবর্ষের উপনিবেশিক বাস্তবতা তারাশঙ্করের সাহিত্যে প্রতিকী মহিমায়, প্রতিরোধে-প্রতিবাদে, দ্রোহে-আপোসে, রাজনীতিতে-অর্থনীতিতে, দেশে-কালে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কালিন্দী (১৯৪০), গণদেবতা (১৯৪২), পঞ্চগ্রাম (১৯৪৩), হাঁসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৪৭) প্রভৃতি তারাশঙ্করের প্রতিনিধিত্বশীল উপন্যাস।
তারাশঙ্করের উপন্যাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালের গণজাগরণের প্রেক্ষিতে সৃষ্ট জীবনচেতনার প্রতিফলন ফুটে উঠেছে। এ সময়ে বাংলা সাহিত্য বৈচিত্র্যের বাহক হয়ে উঠেছিল। সেই সঙ্গে সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের রূপান্তর তাতে বিধৃত হয়েছিল। প্রাচীন বিশ্বাসের পটভূমি অনেকাংশে শিথিল, নতুন মূল্যবোধের আবির্ভাব তখন স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি- এই কালপর্বেই বাংলা সাহিত্যে তারাশঙ্করের আবির্ভাব।
বাস্তবতা এই যে, অসহযোগ আন্দোলনের পূূর্বেই তিনি প্রত্যক্ষভাবে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারতীয় জাতীয় রাজনীতির সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং পরবর্তীতে দেশ-কাল-মানুষ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জনের পর তা তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলতে প্রয়াসী হন। এ কারণে তারাশঙ্করের উপন্যাসে সামজিক রূপান্তর, পুরনো ধারার ভাঙন ও নতুন যুগের অভ্যুদয়, শ্রেণিদ্বন্দ্ব এবং এ যুগের বিভিন্ন সমস্যা স্থান পেয়েছে। এই দেশপ্রেম ও বৃহত্তর জনজীবন সম্পর্কে উপলব্ধি তাঁর উপন্যাসগুলিকে সমগ্রতা দান করেছে। সমাজের ব্যাপক ভাঙনক্রিয়ার মধ্যেও তিনি আশাবাদী ছিলেন। তারাশঙ্করের নৈতিক চেতনা তাঁর সমস্ত রচনার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। ‘অকল্যাণের মধ্যেও কল্যাণ ও পুণ্যের জন্য সংগ্রাম করতে হবে’- এই বক্তব্যকেই তিনি তাঁর উপন্যাসে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন।
তারাশঙ্করের গণদেবতা ও পঞ্চগ্রাম সমকালের বাঙালির সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের ভাষ্য। উপন্যাসের প্রথম অংশ ‘গণদেবতা’য় পল্লিজীবনের নানাবিধ সমস্যার কথা ফুটে উঠেছে। আধুনিক সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রভাবে গ্রাম্যসমাজের প্রাচীন রীতিনীতি ও অর্থনৈতিক অবস্থার বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ উপন্যাসে গ্রাম-পঞ্চায়েতের আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা, বর্তমান যুগের প্রেক্ষাপটে সমাজশৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়াস কীভাবে প্রতিহত হয়েছে তা লেখক সুচারুরূপে চিত্রিত করেছেন।
পঞ্চগ্রামের কাহিনিতে জমিদারি প্রথা, উপায়হীন জীবিকাহীন গ্রামীণ অভিজাত শ্রেণি, সনাতনী আচার-অনুষ্ঠান সংস্কারে প্রশ্নহীন আস্থাশীল উচ্চবর্ণের মানুষদের নাভিশ্বাস, ভেঙে যাওয়া গ্রাম সমাজের চাষী, কামার-কুমোর, তাঁতি, কলু, মুচির জীবন চিত্র একযোগে চিত্রিত করেছেন। এ উপন্যাসে দরিদ্র চাষী প্রজারা শত বাঁধা-বিপত্তি সত্ত্বেও ধর্মঘটের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। হিন্দুরা দেবুর নেতৃত্বে ও মুসলমানরা ইরসাদের নেতৃত্বে সম্মিলিতভাবে আন্দোলন করে। এ আন্দোলন থেকে সরে যাওয়ার জন্য শ্রীহরি ঘোষ দেবুকে এবং দৌলত শেখ ইরসাদকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু এতে কোনো সাড়া না পেয়ে জমিদার প্রজাধর্মঘট প্রতিহত করার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করে। সকল জমিদার একত্রিত হয়ে প্রজাদের সমস্যায় ফেলে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে এর সুফল ভোগ করে। প্রজাদের সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা না করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। সেই সাথে দেবুর নামে কুৎসা রটিয়ে মুসলমানদের পৃথক করে দেয়।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পঞ্চগ্রাম গ্রামীণ জীবন নির্ভর উপন্যাস। লেখক এ উপন্যাসে গ্রামীণ সমাজ-বাস্তবতার চালচিত্র অত্যন্ত সাবলীলভাবে চিত্রিত করেছেন। ‘গণদেবতা’য় জমিদার ভূমি জরিপের পর পরই খাজনা বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত নেয় তা কৃষকেরা মানতে রাজি হয় না। মূলত ফসলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে জমিদার খাজনা বৃদ্ধি করতে চায়। অন্যদিকে চাষী-প্রজারা জমিদারের খাজনা বৃদ্ধি মেনে নিতে পারে না। তাদের কথা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনেসের দাম ফসলের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে। সংসারে যে পরিমাণ খরচ বেড়েছে সে পরিমাণ উপার্জন বাড়েনি। চাষীরা যা উৎপাদন করে তার সিংহভাগই চলে যায় জমিদার-মহাজনের ঘরে। সে কারণে তাদের সংসার চালিয়ে অতিরিক্ত খাজনা দিতে তারা সমর্থ নয়। একদিকে জমিদার চাষীদের বাস্তব অবস্থা জানার পরও খাজনা বৃদ্ধিতে বদ্ধপরিকর। অন্যদিকে চাষীরা অতিরিক্ত খানা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
পঞ্চগ্রামে সমকালীন সমাজ ব্যবস্থা ও উত্তাল রাজনীতির পটভূমিকায় আসল দেবু ঘোষের নব জীবনবোধ চিত্রিত হয়েছে। উপন্যাসে দেবু যখন পঞ্চগ্রামের মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ইরসাদকে সঙ্গে নিয়ে একাত্ম হয়ে জমিদারদের অত্যাচার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে ঠিক তখনই জমিদারেরা সুকৌশলে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গার সৃষ্টির আশঙ্কায় উত্তেজনায় মেতে উঠল।
এ বিষয়টি উপস্থাপনের মাধ্যম লেখক বিপরীত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দু’টি প্রতিবাদী চরিত্রের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রূপায়ণে সচেষ্ট হয়েছেন। এ উপন্যাসের দেবুর ভাবনায় লেখকের স্বপ্নম-িত স্বদেশভাবনা ব্যক্ত হয়েছে। হাঁসুলী বাঁকের উপকথা শুধু তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা নয়, বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের ইতিহাসে এ উপন্যাসটি একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে নিয়েছে। বাঁশবাঁদি গ্রামের কাহারেরা অশিক্ষিত। এ গ্রামে নেই কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ সকলকেই কাজ করে খেতে হয়। তারা সমস্ত হিসাব-নিকাশ রাখে মুখে মুখে। কিন্তু জাঙল বা চন্দপুরের বাবুরা সব কিছু লিখে রাখে। কাহারদের সঙ্গে বাবুদের পার্থক্য এইটুকুই।
মূলত হাঁসুলী বাঁকের উপকথা উপন্যাসে লেখক বিশ শতকের প্রায় মধ্য পর্যায়ে রাঢ়বঙ্গের একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী কাহার সম্প্রদায়ের জীবনভাষ্য উপস্থাপনের অন্তরালে সমকালীন দেশ-কালের আর্থ-সামাজিক ও ভূ-রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত এক বিশেষ কৌশলে উপস্থাপন করেছেন। লেখক এ উপন্যাসে কাহার সমাজের রূপান্তর নব্য-ধনী করালী চরিত্রের প্রতীকী চিত্রায়নে সমকালীন বিশ্ব রাজনীতির ভয়ংকর প্রকাশ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়া এবং যুদ্ধকালীন ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উপনিবেশ বিরোধী ‘ভারত-ছাড় আন্দোলন’ উপকথার ‘হাঁসুলী বাঁক’ প্রতীকী রূপায়নে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছে।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাসে মানুষের সমাজকে, মানুষের জীবনকে চিত্রিত করেছেন। নিরন্তর বয়ে চলা জীবনের বাস্তব রূপদান করেছেন তাঁর উপন্যাসে। বাংলাদেশের একটি বিশেষ সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির দালিলিক চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর উপন্যাসে।
এ কথা অবশ্য স্বীকার্য যে, সামন্তসমাজের অবসান ও ধনতান্ত্রিক সমাজ জীবনের সূচনাপর্বের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক শিল্পরূপ তাঁর উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়রূপে চিত্রিত হয়েছে। তাঁর ‘চৈতালী ঘূর্ণি’র শ্রমিক আন্দোলনের চিত্র, ধাত্রীদেবতা-গণদেবতা-পঞ্চগ্রাম উপন্যাসের সামজিক সংঘাতময় জীবনের সমান্তরাল রেখায় স্থাপিত রাজনৈতিক আন্দোলনের অভিঘাত কালিন্দী’র ব্যতিক্রমী ইঙ্গিতবহ উপস্থাপন তাঁর শিল্পিত শৌকর্যকে বহুলাংশে স্বতন্ত্র করেছে। তারাশঙ্করের আঞ্চলিকতা, সমাজের অচ্ছুত-অন্ত্যজ নি¤œবর্গের মানুষের গোষ্ঠীজীবনের প্রতি আকর্ষণ, নিষ্ঠুর আদিমতা, আভিজাত্য, কৌলিন্য ইত্যাদির নিরেট উপস্থাপন তাঁর উপন্যাসকে কালোত্তীর্ণ করেছে।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯০৩-১৯৮৮) ত্রিশোত্তর বাংলা কথা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃত। তাঁর উপন্যাসে জীবনের কুৎসিত, বীভৎস, দারিদ্র্যপিষ্ট, বিক্ষুব্ধ, পাপ-পিচ্ছিল প্রভৃতি বিষয় তুলে ধরেছেন। দরিদ্রের প্রতি সহানুভূতি ও হৃদয়হীন সমাজ ব্যবহারের বিরুদ্ধে অভিযান যে কেবল সব সময় সাহিত্যসৃষ্টির প্রেরণা দিতে পারে না, বিষয় নির্বাচনের উপরই যে সাহিত্যের উৎকর্ষ নির্ভর করে না, এই সম্ভাবনার প্রতি ত্রিশোত্তর বাংলা কথাশিল্পীগণ সার্থকভাবে রূপদান করেছেন। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের সাহিত্যাদর্শন হলো বিবাহের বন্ধন, অন্ধ-সংস্কার আর একঘেয়ে জীবনযাত্রার নিষ্পেষণে প্রেমের মৃত্যু। রবীন্দ্রনাথের বর্ণিত মিথুনাসক্তির বা অচিন্ত্যকুমারের সেক্স-এর বৃহত্তর উপলব্ধি মূলত ফ্রয়েডের লিবিডোতত্ত্বজাত। শরীরের প্রয়োজনে প্রেম ও নরনারীর সামাজিক বন্ধন অনুসৃত হয়ে থাকে। অথচ অচিন্ত্যকুমার নরনারীর সামাজিক বন্ধনকে অস্বীকার করলেন।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত রবীন্দ্রপ্রতিভায় মুগ্ধ ছিলেন। একসময় তিনি ভাবতেন রবীন্দ্রনাথই সবকিছুর চরম পরিপূর্ণতা। কিন্তু কল্লোলে এসে তাঁর সে ভাব আস্তে আস্তে কেটে যেতে লাগল। তিনি দেখলেন এক নতুন পৃথিবী। ভাবলেন, আর অনুকরণ নয়, সৃষ্টি করতে হবে নতুন অধ্যায়। নতুন সাহিত্য সৃষ্টির এ প্রবল আকাক্সক্ষা থেকেই তিনি সফল হয়েছিলেন। যার ফলে তিনি বাংলা সাহিত্যে লাভ করলেন স্থায়ী আসন।
মূলত ভারতীয় জীবনাদর্শের ভিতর প্রেম ও পারিবারিক জীবন হচ্ছে অত্যন্ত অবিচল ও একনিষ্ঠ; এই অবিচল ও একনিষ্ঠতা ভেঙে দেবার ‘উদ্ধত যৌবনের উদ্দামতা, সমস্ত বাধা বন্ধনের বিরুদ্ধে নির্ধারিত বিদ্রোহ’ প্রবল অপরাধ এবং বাংলা সাহিত্যে সম্পূর্ণ অভিনব। অচিন্ত্যকুমারের নায়ক নায়িকারা স্থবির সমাজের পঁচা ভিত্তিকে উৎখাত করার আন্দোলন করার জন্যে ভারতীয় সামাজ জীবনকে ‘টুটাফুটা’ কিংবা ‘বেদে’ করে দিয়েছে। অচিন্ত্যকুমারের ক্ষেত্রে যৌনতা হচ্ছে সাহিত্যের উপাদান, তবে বুদ্ধদেব বসুর মতো ‘বীভৎস যৌন মিলন’ নেই; অনেক ক্ষেত্রে অচিন্ত্যকুমার রোমান্টিক ভাবদৃষ্টির আশ্রয় নিয়েছেন। (চলবে)
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
নরওয়েতে বাস দুর্ঘটনায় ৩ জন নিহত, ৪ জন গুরুতর আহত
ঐক্য-সংস্কার-নির্বাচন নিয়ে জাতীয় সংলাপ শুরু আজ
ইহুদিদের ইউসুফ (আঃ)- এর সমাধিতে নিয়ে গেল ইসরায়েলি সেনারা
কাকরাইলে সাদপন্থিদের জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
ইয়েমেনে ইসরাইলি হামলা, অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন ডব্লিউএইচও প্রধান
ইসরায়েলি হামলায় ইয়েমেন ও গাজায় ব্যাপক প্রাণহানি
হেলিকপ্টারে সফর নিয়ে বিতর্ক, ব্যাখ্যা দিলেন আসিফ মাহমুদ
কুমিল্লায় ছুরিকাঘাতে যুবক খুন
সচিবালয়ে আগুন: সংগ্রহ করা হলো সিসিটিভি ভিডিও
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বাশার আল-আসাদের স্ত্রী আসমা
টেস্ট ক্যারিয়ারের রেকর্ডময় ৩৪তম সেঞ্চুরি পূর্ণ করলেন স্মিথ
জাহাজে ৭ খুন : লাগাতার কর্মবিরতিতে পণ্যবাহী নৌযান শ্রমিকেরা
লেস্টার সিটিকে হারিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে লিভারপুল
ফের্নন্দেসের লাল কার্ডের দিনে ফের হারল ইউনাইটেড
শেষের গোলে জিতে চেলসির জয়রথ থামাল ফুলহ্যাম
পরলোকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং: ভারতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা
কালীগঞ্জে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর সংবাদ সম্মেলন
গ্রাম আদালত সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত
মিসরে প্রেসিডেন্ট সিসির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ
কুর্দি যোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি এরদোগানের