নির্মলেন্দু গুণ ও তার কবিতা
০২ আগস্ট ২০২৪, ১২:২০ এএম | আপডেট: ০২ আগস্ট ২০২৪, ১২:২০ এএম
আমার যা বলবার স্পষ্ট করেই আমি তা বলবার চেষ্টা করি। যা কঠিন আমার মন তাতে সহজে সাড়া দেয় না, সহজ করে পাওয়ার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। চারপাশের কঠিনের ভিড়ে আমি চাই সহজ করে বলতে। জানি এ স্বভাব নাগরিক কবির নয়। লোক কবির। স্বীয়কবিতা প্রসঙ্গে নির্বাচিতার ভূমিকায় অকপটে বলে যাওয়া এই জীবন্ত কিংবদন্তির নাম কবি নির্মলেন্দু গুণ। তিনি যেমন সহজ তাঁর কবিতাও দুর্বোধ্য নয়। কবিতার অন্তরীক্ষে আশা, হতাশা, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, প্রেম, স্বাধীনতা, শরীর, হৃদয়, দুঃখ, যুদ্ধ ইত্যাদি বিষয় উঠে আসে। স্যাটায়ারধর্মী এই কবি যেন আজন্ম ক্ষুধা নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন গণমানুষের আবেগ ও হৃদয়কে আলোড়রন করে ঐশ্বর্যমন্ডিত করতে কবিতার স্রোতে স্নিগ্ধ বাতাসের ভেলায় ভাসিয়ে। সাবলীল আর সহজবোধ্যের নির্মোঘ সাক্ষর তিনি প্রতিটি কবিতাতেই খুব সন্তর্পণে রেখেছেন। কখনো তিনি প্রেমিক কখনো নিপীড়িত জনতার বিপ্লবী সুর। তার কবিতাগুলোর বিষয়ভাবনার গভীরতা অতল। আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক সহজ মনে হলেও গভীরতা ক্ষুরধার। স্বাধীনতা এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো- এই একটি কবিতাই তাঁকে চিনিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। রাজনীতিসচেতন এই কবির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ এর ‘হুলিয়া’ প্রকাশের পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নিমিষেই আধুনিক কবিতার মধ্যমণি বনে যান। হুলিয়ার কিছু লাইন হতে এখানে তুলে না ধরলেই নয়-
‘ওরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞেস করবে ঢাকার খবর: আমাদের ভবিষ্যত কী? আইয়ুব খান এখন কোথায়? শেখ মুজিব কি ভুল করেছেন? আমার নামে কতদিন আর এরকম হুলিয়া ঝুলবে?আমি কিছুই বলবো না আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকা সারি সারি চোখের ভিতরে বাংলার বিভিন্ন ভবিষ্যতকে চেয়ে চেয়ে দেখবো উৎকন্ঠিত চোখে চোখে নামবে কালো অন্ধকার, আমি চিৎকার করে কন্ঠ থেকে অক্ষম বাসনার জ্বালা মুছে নিয়ে বলবো: আমি এসবের কিছুই জানি না, আমি এসবের কিছুই বুঝি না।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থসমূহের মধ্যেথদীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী, যখন আমি বুকের পাঁজর খুলে দাঁড়াই, প্রিয় নারী হারানো কবিতা, না প্রেমিক না বিপ্লবী, অমিমাংসিত রমণী, আবার একটা ফুঁ দিয়ে দাও, চৈত্রের ভালোবাসা, মুঠোফোনের কাব্য, ও বন্ধু আমার, নেই কেন সেই পাখি ইত্যাদি। কবি নির্মলেন্দু গুণের প্রতিটি কবিতায় শৈল্পিক নিষ্ঠা ও প্রাকরণিক দক্ষতা বিদ্যমান। তার ‘স্ববিরোধী’ কবিতায় তিনি নিজেকে চিনেয়েছেন বার বার।
‘জন্মের সময় আমি খুব কেঁদেছিলাম, এখন আমার সবকিছুতেই হাসি পায়। আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম, এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি।’
কোথাও কোনো কোষ্ঠকাঠিন্যময়তা নেই। নেই কোনো শব্দের ধাঁধা যোগে তৈরি পাঠক-ঠকানো সস্তা উপরচালাকি। কখনো কখনো নন্দনতত্ত্ব বা পরাবাস্তববাদ তার কবিতার অংশ হয়েছে। কখনো হয়েছে প্রেম। ‘স্ত্রী’ তার বহুল জনপ্রিয় একটি কবিতা।
‘তার প্রতিটি উৎফুল্ল লগ্নে এক-একটি চুম্বন,/প্রতিটি রক্তিম মুখে এক-একটি নিঃশ্বাস দিতে হবে।/সভ্যতা ধংস হোক, গুরুজন দাড়াক দুয়ারে, শিশুরা কাদতে থাক, যমদূত ফিরে যাবে এবং অভাব/ দেখো লজ্জা পেয় ম্লান হবে কিশোরীর মতো।’
বিবৃতিধর্মী এই কবির অনেক কবিতা আছে দীর্ঘাকৃতির এবং সেগুলো শিল্পের বিচারেও মানোত্তীর্ণ।
তাঁর ‘পৃথিবী’ নামক কবিতাটি পাঠক সমাজে ব্যাপক নাড়া দেয়।
আমি খাদ্য চাই ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের মতো, দ্রৌপদীর মতো/বস্ত্র চাই, চাই সর্বগ্রাসী প্রেম, চাই শূর্পণখার মতো নারী, চাই আকন্ঠ নিমগ্ন নেশা, চাই দেশী মদ ।/ আমার সমস্ত ক্ষুধা তোমাকে মিটাতে হবে, হে পৃথিবী,/ তুমি বলেছিলে অভাব হবে না, এ-পৃথিবী নেশা ও নারীর, আমি চলে এসেছিলাম একা, শুধু তোমার জন্যে ।’
বস্তুত তার কবিতাগুলো প্রাণের গভীরে সাইরেন বাজিয়ে তুলে, হৃদয়কে মথিত করে ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয়। কবি আবুল হাসান স্মরণে লিখা তার কথা মালাগুলো -‘কবরে কী করে লেখো? মাটি কি কাগজ? খাতা?ভালোবেসে উস্কে দিই প্রাণের পিদিম, এই নাও, অনন্ত নক্ষত্র তুমি, অন্ধকারে আমাকে সাজাওফের মাতৃগর্ভে, বলো দেবদূত প্রেমিকা কি মাতা? এইসব ঝিঁঝি পোকা, এরা কি ঈশ্বর নাকি পাখি, উদ্বাস্তু উন্মুল মোক্ষ, যৌবনের, কোন পাত্রে রাখি? পাঠক সমাজকে এখনো সমানভাবে ভাবিয়ে তুলে।
সেই সময়ে রচিত নির্মলেন্দু গুণের একটি সুপরিচিত কাব্যগ্রন্থের নাম ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র।’ ‘তোমাকে নিশ্চয়ই একদিন আমি কিনে দিতে পারবো/একসেট সোনার গহনা, নিদেনপক্ষে নাকের নোলক/একখানা।/তোমাকে নিশ্চয়ই একদিন আমি কিনে দিতে পারবো/একটি আশ্চর্য সুন্দর ইজিপ্সীয়ান কার্পেট। মখমল-নীল শাড়ি পরে/তুমি ভেসে বেড়াবে সারা ঘরময় রাজহাঁস;/‘কিন্তু তার আগে চাই সমাজতন্ত্র।’
‘আকাশ ও মানুষ’ কবিতায় তিনি যেন অন্য কেউ। অসহায় কবি সত্তার পরিহাসের বিক্ষুব্ধ আস্ফালন।
‘প্রিয়জন চলে গেলে মানুষই ব্যথিত হয়, আকাশ নির্বিকার, আকাশ কখনও নয়।
তোমরা মানুষ, তাই সহজেই দুঃখ পাও, হে ঈশ্বর, আমাকে আকাশ করে দাও।’
এই যে দুঃখ সহ্য করার জন্য শক্তি চেয়ে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা, আকাশ করে দেয়ার জন্য আকুতি তা বোধকরি বাংলা সাহিত্যে প্রথম কারোর শাণিত কলমের হলাহল। তিনি জীবনকে যেমন দেখেছেন আড়ষ্টতায় তেমন দেখেছেন ডানামেলা গাঙচিলের মতো। কবির মনে যখন যা এসেছে তাই হয়ে উঠেছে একেকটা আগুনের পরশপাথর। তার প্রেমিক সত্তা জাগ্রত হলে অকপটে নিজের দ্বিধান্বিত অস্তিত্বকে স্বীকার করেছেন। শুধু তোমার জন্য কবিতায় অনেকটা এভাবে- ‘কতবার যে আমি তোমোকে স্পর্শ করতে গিয়ে গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন। তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও কতবার যে আমি সে কথা বলিনি সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন। তোমার হাতের মৃদু কড়ানাড়ার শব্দ শুনে জেগে উঠবার জন্য দরোজার সঙ্গে চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম আমার কর্ণযুগল; তুমি এসে আমাকে ডেকে বলবে:
‘এই ওঠো,/আমি, আৃমিৃ।/আত্ম-জিজ্ঞাসার অহমিকতা নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় নেই। তিনি যেমন সমাজ সমাজসচেতন কবি, যুগোর্ত্তীণ কবি তেমনি তিনি রাজনীতিসচেতন কবিও। ‘পোয়েট অব বঙ্গবন্ধু’ খ্যাত এই কবি ধীরে হয়ে উঠেন আওয়ামীপন্থী। রাজনৈতিক সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে নিজস্ব কাব্যভাষায় তা জনতার কাছে পৌঁছে দিতে হয় তা তিনি খুব ভালো বুঝেন। ষাটের দশকের চলমান সহিষ্ণুতার ভেতর দিয়ে কবিসত্তা জাগ্রত করার দুর্দান্ত দুঃসাহস তিনিই দেখালেন সময়ের হাতে কলম ছেড়ে দিয়ে। কবি নিজেই বলেছেন, ‘আমি জানি, সংগ্রামই সত্য, সংগ্রামই সুন্দর। প্রেম, সেও এক সংগ্রাম।’
‘সেই রাত্রির কল্পকাহিনী’ কবিতায় তিনি জাতির পিতা স্মরণে লিখলেন-
তোমার বুক প্রসারিত হলো অভ্যুত্থানের গুলির অপচয়
বন্ধ করতে, কেননা তুমি তো জানো, এক-একটি গুলির মূল্য
একজন কৃষকের এক বেলার অন্নের চেয়ে বেশি।
কেননা তুমি তো জানো, এক-একটি গুলির মূল্য একজন
শ্রমিকের এক বেলার সিনেমা দেখার আনন্দের চেয়ে বেশি।
মূল্যহীন শুধু তোমার জীবন, শুধু তোমার জীবন, পিতা।
রাজনীতির মোড়ক উন্মোচন করতে গিয়ে তিনি প্রেম, প্রকৃতি, সমাজ, পুরাণ, চিত্রকল্প ইত্যাদি বিষয়গুলোও খুব নিঁখুতভাবে ছেঁকে তুলেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তার রচিত বিখ্যাত সেই কবিতা ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসি নি’ এর দিকে তাকালেই বুঝা যায়-
সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ গতকাল
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
বঙ্গবন্ধুকে তিনি স্বীয় পিতার আদলে স্থান দিয়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে তিনি মুষড়ে উঠেছেন। ‘প্রত্যাবর্তনের আনন্দ’ কবিতাটি বঙ্গবন্ধুর আত্মকথনে রচনা করেছেন। স্বদেশে ফিরে আসা বীরের চেতনার কথা, জীবনের কথা, বিজয়ের কথা, আর মাটিতে লুটিয়ে পড়া বীরের দেহাবশেষ চোখে পড়তেই হৃদয়ের রক্তক্ষরণে এরচে উত্তম কোনো কবিতার লাইন হতে পারে না।
‘আনন্দের ঘোর কাটতে না কাটতেই,
একাত্তরের পরাজিত এজিদবাহিনী
রাত্রির অন্ধকারে সংগঠিত হয়ে পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট সপরিবারে হত্যা করলো আমাকে।... বহুদিন পর আজ সত্য জয়ী হয়েছে-, সংগ্রাম জয়ী হয়েছে, সুন্দর জয়ী হয়েছে।
আজ আমার খুব আনন্দের দিন।’
কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষ্যমতে-যখন আমি নগ্ন হই, তখনই আমি কবি। তিনি স্বভাব কবি, লোক কবি। তাঁর কবিতা কখনোই পাঠক বিমুখতায় মুখ থুবড়ে পড়ে রয়নি। জয়প্রিয়তার তুঙ্গে উঠা এই কবির রয়েছে সাহিত্যকর্মস্বরূপ নানান সম্মাননা। বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, কবি আহসান হাবীব সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও কবি তাঁর জীবন ও কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন অসংখ্য দেশি-বিদেশি নানান পুরস্কার ও সম্মাননা। ‘সিলেকটেড পোয়েমস অব নির্মলেন্দু গুণ’ নামে কবি নির্মলেন্দু গুণের নির্বাচিত কবিতার সংকলন বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ইরানে উদ্ভাবনে নারীদের অবদান ২৪ শতাংশের বেশি
প্রকাশায় ৯৩ শতাংশ নকল করেও পদোন্নতি পান রাবি অধ্যাপক সাহাল উদ্দিন
বোরহানউদ্দিনে নিখোঁজের দুই ঘন্টা পর লেবু বাগানে মিললো শিশুর লাশ
নাবালক ছাত্রের সঙ্গে জবরদস্তি যৌন সঙ্গম, ৩০ বছরের জেল শিক্ষিকার
সেনাকুঞ্জে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর প্রতিনিধি দলের অংশগ্রহণ
মার্কিন সংসদের নারী শৌচাগার ব্যবহার করতে পারবেন না রূপান্তরকামী এমপি
বাগেরহাটে হত্যা মামলায় যুবকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড
অন্তবর্তীকালীন সরকারের নির্দেশনা পালনের প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন জিওসি
কুড়িগ্রামের উলিপুরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে শিশুর মৃত্যু
ভারতে পাচারকালে সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে দুই নারী উদ্ধার
কুরআন-সুন্নাহর আইন ছাড়া দেশে শান্তি আসবে না : চাঁদপুরে হাবিবুল্লাহ মিয়াজী
শাহজাহান ওমরকে জুতা ও ডিম নিক্ষেপ
জীবনে উত্তম কর্ম, জ্ঞান ও উন্নত চরিত্র অর্জন করতে হলে সফল ব্যক্তিদের সান্নিধ্য অবলম্বন আবশ্যক
নড়াইলে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার মামলায় জেলা আ.লীগ সভাপতি কারাগারে
নোবিপ্রবির সঙ্গে তুরস্কের আনাদোলু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউশনাল এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর
শিক্ষার্থীদের মতের ভিত্তিতেই ছাত্রদলের রাজনীতি চলবে : নাছির
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লাইনচ্যুত ট্রেন উদ্ধার, চলাচল স্বাভাবিক
না.গঞ্জে ২৪ ঘন্টায় ৪৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত
খরচ চালাতে লকার রুম, দরজা বিক্রি করছে রিয়াল মাদ্রিদ
যুক্তরাষ্ট্রে গৌতম আদানির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি