কবিতা এবং বিবিধ দিক

Daily Inqilab জসীম উদ্দীন মুহম্মদ

২৩ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৩ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৩ এএম

কিছুদিন ধরে মনটা খুবই খারাপ যাচ্ছে। তবে খারাপ বলাটা একেবারে অভিযুক্ত নয়; বরং বলা চলে বিক্ষিপ্ত। আর এই বিক্ষিপ্ততার নানাবিধ কারণ রয়েছে। এই যেমন ব্যক্তিগত থেকে আন্তর্জাতিক। আর এইসব কিছুর মাঝে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কারণ তো রয়েছেই। যাক এইসব ফিরিস্তি আওড়াতে চাই না। কেননা এইসব আওড়ালে নতুন কয়েক হাজার মহাকাব্য লিখলেও শেষ হবে না। এবার আসল কথায় আসা যাক। শুরুতেই সরল স্বীকারোক্তি দিতে চাই, আমি নেহায়েতই একজন কবিতার মানুষ। যদিও প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ফিচার, মতামত, গল্প, উপন্যাস এসবও সাধ্যমতো লেখার চেষ্টা করি। কিন্তু এইসব যতই লিখি না কেন... কবিতার সরস ভুত কখনও আমার মাথা থেকে দূর করতে পারিনি। কীভাবেই বা দূর করব..? যে কবিতার সাথে আশৈশব জড়িয়ে আছি, চিন্তা-চেতনা, মন-মনন, প্রতিবেশ সবকিছুতে যে কবিতা আঁচড়; সেই কবিতাকে কি কখনও ভোলা যায়? যায় না।
কবিতার সাথে এই যে আমার এতো মাখামাখি, এতো ভালোবাসাবাসি, এতো ঢালাঢালি... তবুও দুঃখে, ক্ষোভে, শোকে কতবার যে কবিতার লেখা ছেড়ে দিতে চেয়েছি তারও কোনো ইয়ত্তা নেই। কয়েকদিন হয়ত কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলেছি, কিন্তু শেষমেষ আর পারিনি। বারবার আমি পরাজিত হয়েছি। বারবার কবিতা বিজয়ী হয়েছে। মান-অভিমানের এই খেলায় কবিতার গলায় বিজয় মুকুট উঠেছে। এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্নটি করা যাক। কেন বারংবার কবিতা লেখা ছেড়ে দিতে চেয়েছি, এর সোজাসাপ্টা জবাব হল, কবিতা চোর এবং ক্লোন কবিদের মারাত্মক দৌরাত্ম্য! বেশ কয়েক বছর আগে একদিন একজন কবিবন্ধু আমাকে জানালো, আমার একটি কবিতা একজন চুরি করেছে। আমি সেদিন আকাশ থেকে ধপাস করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলাম। কারণ সারাজীবন ধরে এটাই জানতাম যে, টাকা-পয়সা, স্বর্ণালংকার ইত্যাদি মূল্যবান সামগ্রী চুরি হয়। তাই বলে কবিতা চুরি এখানেই শেষ এরপর আমার আরও অনেক কবিতা চুরি হয়েছে। আর ক্লোন তো হরহামেশাই হচ্ছে-- তার কোনো ইয়ত্তা নাই।

তথ্য-প্রযুক্তির এই স্বর্ণযুগে লেখা চুরি করা যেমন সহজ, তেমনি লেখা চোরকে সনাক্ত করাও সহজ। ফেসবুক, গুগল, ইউ টিউব, টুইটার সহ যে কোনো মাধ্যমে লেখা কিংবা লেখার অংশবিশেষ দিয়ে সার্চ করলে সহজেই জানা যাবে আপনার লেখাটি কেউ চুরি করেছে কিনা! প্রশ্ন হল, যারা অন্যের কবিতা চুরি করেন এবং ক্লোন করেন, তারা কি বিষয়টি জানেন না? আমি মনে করি, তারাও বিষয়টি অবশ্যই জানেন। তবে কেন তারা চুরি করেন? তাদের কি ধরা পড়ার ভয় নেই? আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, তারা জেনে বুঝেই অন্যের লেখা চুরি করেন। কারণ কথায় আছে, চোরা শোনে না ধর্মের কাহিনি। এই চুরিবিদ্যা আসলে একটা রোগ বিশেষ। আত্মহত্যা যেমন একটি রোগ; তেমনি অন্যের লেখা চুরি করা আরও বড় রোগ। নাম উল্লেখ না করেই বলছি, বিগত কয়েকদিন আগের ঘটনা, আমার পরিচিত এক কথিত কবি বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট কবি, যিনি পল্লীকবি হিসাবে সমধিক পরিচিত তাঁর একটি ছড়া ফেসবুকে নিজের নামে পোস্ট করেছেন। তাও আবার কোনো প্রকারের পরিবর্তন ছাড়াই! ভাবা যায়, কী মারাত্মক ধৃষ্টতা! তারপর জানা গেল, তার অধিকাংশ কবিতাই হয়ত চুরি করা, নয়ত ক্লোন করা। আমি তো কেবল একজনের উদাহরণ দিলাম! ফেসবুক কবিদের মধ্যে এমনি আরও হাজারো কথিত কবি আছেন, যারা এভাবেই প্রতিনিয়ত অন্যের কবিতা চুরি কিংবা ক্লোন করে নিজ নামে প্রকাশ করে কবি হয়ে দিব্যি বসে আছেন। এমনকি সেইসব কবিদের কবিতা বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হচ্ছে। তারা দশহাত ভরে বাহবা কুড়াচ্ছেন। শুধু এখানেই শেষ নয়, জাতীয় পত্রিকার পাতা খুললেও সেইসব কথিত কবিদের লেখা প্রথম সারিতে দেখা যায়! কী সেলুকাস!

ক্লোন কবিদের সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন তথাকথিত কবি আছেন, যারা দেশ-বিদেশের প্রথিতযশা এবং স্বনামধন্য কবিদের কবিতা সামনে নিয়ে লিখতে বসেন। অত:পর কোনো একটি কবিতাকে টার্গেট করে শুরু হয় ক্লোনিং। শব্দের স্থলে শব্দ, বাক্যের স্থলে বাক্য বসিয়ে শুরু হয় নকল পিরামিড বিনির্মাণের মহাযজ্ঞ। শুরুতেই আপনি বিষয়টি ধরতে পারবেন না। আপনার কাছে মনে কী অসাধারণ একটি কবিতা। তারপর ভালোভাবে পড়তে থাকুন। পড়তে পড়তে আপনার কাছে একটা সময় মনে হবে, এটা তো অন্ত:সারশুন্য! অসংলগ্ন শব্দচয়ন এবং বাক্য বিন্যাস। আপনি পুরো বারকয়েক পড়েও কিছুই বুঝতে পারছেন না। কেবল কবিতার গতরে পায়চারি করছেন, কোনো ভাবার্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারছেন না। অনেকটা শ্বেতী রোগীদের শরীরের মতোন। শরীরের চামড়ার ভেতরে-বাহিরে একেক স্থানে একেক রুপ। হয়ত তখন আপনি অবচেতন মনেই এই কবিতাকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে মারবেন। আপনি যদি কবিতার বোদ্ধা পাঠক হয়ে থাকেন, তাহলে হয়ত একটা সময় বুঝতে পারবেন কবিতাটি কবির মৌলিক লেখা নয়- ক্লোন করা! স্বাভাবিক ভাবেই এটা বুঝতে পারার পর এই কবি সম্পর্কে আপনার অন্তরে তীব্র ঘৃণার জন্ম নেবে।

এখন প্রশ্ন হল, নিজের ব্যক্তিত্ব, সৃজনশীলতা, আমিত্ব এবং সর্বোপরি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে এভাবে কবিতা চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে কবির কতটা লাভ? বিষয়টা তো এমন নয় যে, চোর সারাজীবন চুরি করেই যাবে; কিন্তু গেরস্ত একদিনও চোর কে হাতেনাতে ধরতে পারবেন না। পৃথিবীতে কি এমন কোনো চোর আছে, যে কোনোদিন ধরা পড়েনি? যদিও এই বিষয়ে কোনো রিসার্চ আমার জানা নেই, তবুও আমি মনে করি, এমন কোনো চোর এই ধরাধামে নেই। জীবনে দুই একবার উত্তম-মধ্যম খাননি; এমন চোরও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাহলে কবিতা চোর এবং ক্লোন কবিরা কি এসব জানেন না? আমি মনে করি অবশ্যই জানেন। তদুপরি অনেকেও ইতোমধ্যে ধরাও পড়েছেন। মান-সম্মান খুঁইয়েছেন। কিন্তু তবুও কবিতা চোর এবং ক্লোন কবিরা থেমে নেই। তারা তাদের কাজ করেই যাচ্ছেন! মান-সম্মান হারানোর পরোয়া করছেন না। কেবল চরম হতাশার সঙ্গে বলতে হচ্ছে, এরপরেও তারা বারবার একই কাজ করছেন! নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিচ্ছেন না। অপমান অপদস্ত হওয়াকেও তারা তেমন কিছুই মনে করছেন না! আরও ভয়ংকর ব্যাপার হল, এইসব চুরি করা লেখা যদি কোনো জাতীয় কিংবা আঞ্চলিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তখন সম্পাদক মহোদয় কি এর দায় এড়াতে পারবেন?

লেখা চোরদের শুধুই কি মান-ইজ্জত হারানো? যতটা জানি বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনী কাঠামোতে লেখা চুরির বিরুদ্ধে কপিরাইট আইনে ব্যবস্থা নেওয়াও সম্ভব। কিন্তু সাধারণত আমরা কেউ আইনী ব্যবস্থা নিই না। নিতে চাই না। ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চাই। আমার মতে, এটাও অসাধু লেখা চোরদের উৎসাহিত হওয়ার একটি অন্যতম কারণ। কেউ কেউ যদি লেখা চোরদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন, চোরদের জেল-জরিমানা হতো; তাহলে হয়ত এদের দৌরাত্ম্য অনেকাংশে কমে যেত। অন্যথায় তাদের থামানো প্রায় অসম্ভব। তবুও আমি মনে করি, যারা অন্যের কবিতা চুরি করেন, অন্যের কবিতা ক্লোন করে কিছুটা পরিবর্তন, পরিমার্জন সাপেক্ষে নিজের নামে চালিয়ে দেন; তাদের আত্ম-বিশ্লেষণ, আত্মোপলব্ধি সবচেয়ে জরুরি। কবিতা চুরি এবং ক্লোন করা যে কত মারাত্মক অপরাধ তার বোধোহয় একান্ত কাম্য।

যেসব কথিত কবি এবং লেখক বন্ধুরা এহেন জঘন্যতম কাজটি করেন, তাদের উদ্দেশ্যে সামান্য কিছু কথা বলে আমার এই লেখাটি শেষ করতে চাই। দয়া করে আপনারা এই অপকর্ম না করে নিজ থেকে লিখুন। অন্তত নিজ থেকে লেখার চেষ্টা করুন। তাতে করে আপনার লেখাটি হয়ত শুরুতেই খুবই মান সম্মত হবে না... কিন্তু তাতে কী? কানা হোক, খোঁড়া হোক এটি আপনার নিজের সন্তান। পাশাপাশি বড় বড় কবি যাদের কবিতা-ছড়া আপনার ভালো লাগে; তাদের লেখা প্রচুর পরিমাণে পাঠ করুন। নিয়মিত পাঠের অভ্যাস গড়ে তোলার পাশাপাশি মাঝে-মধ্যে নিজেও লিখুন। আপনার হৃদয় থেকে যা আসে, তা-ই লিখুন। আশা করা যায় এভাবে লিখতে লিখতেই একদিন আপনিও ভালো লিখতে শুরু করবেন। স্বনামে বিখ্যাত হবেন।


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

কবিতা
নষ্ট সময়
সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ : বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগের কারিগর
কবিতা
বাসের টিকিট ও মফিজের ভাবনা
আরও
X

আরও পড়ুন

ফরিদপুরে মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে বাবা আটক

ফরিদপুরে মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে বাবা আটক

নভেম্বর ২০, ২০২৪—আমাদের হৃদয়ে চিরকালের জন্য খোদাই করা একটি দিন

নভেম্বর ২০, ২০২৪—আমাদের হৃদয়ে চিরকালের জন্য খোদাই করা একটি দিন

শুল্ক আরোপ নিয়ে নানা দেশে টানাপোড়েন, অটল অবস্থানে ট্রাম্প

শুল্ক আরোপ নিয়ে নানা দেশে টানাপোড়েন, অটল অবস্থানে ট্রাম্প

ভারতের ২১ শহরে তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে

ভারতের ২১ শহরে তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে

সুনামগঞ্জে শুরু হয়েছে দেশীয় জাতের বোরোধান কাটা

সুনামগঞ্জে শুরু হয়েছে দেশীয় জাতের বোরোধান কাটা

গুলশানে স্পা সেন্টারে অভিযান এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে মালিক গোলাম মহিউদ্দিন

গুলশানে স্পা সেন্টারে অভিযান এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে মালিক গোলাম মহিউদ্দিন

ড. ইউনূসের সন্তানেরা কোথায় কি করেন?

ড. ইউনূসের সন্তানেরা কোথায় কি করেন?

ভারতে ওয়াকফ বিল নিয়ে বিক্ষোভ, বিজেপি নেতার বাড়িতে আগুন

ভারতে ওয়াকফ বিল নিয়ে বিক্ষোভ, বিজেপি নেতার বাড়িতে আগুন

সাবেক এমপি আফজাল ৭ দিনের রিমান্ডে

সাবেক এমপি আফজাল ৭ দিনের রিমান্ডে

ক্ষমা চাইলেন ড্যাফোডিলের সেই শিক্ষিকা

ক্ষমা চাইলেন ড্যাফোডিলের সেই শিক্ষিকা

সারাদেশে চলছে ‘নো ওয়ার্ক নো ক্লাস’ কর্মসূচি

সারাদেশে চলছে ‘নো ওয়ার্ক নো ক্লাস’ কর্মসূচি

ইসরায়েলি বর্বর হামলায় গাজায় ২০ দিনে ৪৯০ শিশু নিহত

ইসরায়েলি বর্বর হামলায় গাজায় ২০ দিনে ৪৯০ শিশু নিহত

চট্টগ্রামে কোরিয়ান ইপিজেড পরিদর্শনে ৪০ দেশের প্রতিনিধি

চট্টগ্রামে কোরিয়ান ইপিজেড পরিদর্শনে ৪০ দেশের প্রতিনিধি

রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে গেছে শত বাংলাদেশি

রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে গেছে শত বাংলাদেশি

ইন্দুরকানীতে ডায়রিয়া রোগীর প্রকোপ হাসপাতালে কলেরা স্যালাইন সংকট

ইন্দুরকানীতে ডায়রিয়া রোগীর প্রকোপ হাসপাতালে কলেরা স্যালাইন সংকট

গাজায় মানবিক বিপর্যয় নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ, অবরোধ তুলে নেওয়ার আহ্বান

গাজায় মানবিক বিপর্যয় নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ, অবরোধ তুলে নেওয়ার আহ্বান

এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রে ১৪৪ ধারা, কোচিং-ফটোকপি বন্ধসহ একগুচ্ছ নির্দেশনা

এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রে ১৪৪ ধারা, কোচিং-ফটোকপি বন্ধসহ একগুচ্ছ নির্দেশনা

এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় ধস, তেলের দামেও পতন

এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় ধস, তেলের দামেও পতন

গাজা ইস্যুতে সিসি ও ম্যাখোঁর সঙ্গে জর্দানের রাজার বৈঠক আজ

গাজা ইস্যুতে সিসি ও ম্যাখোঁর সঙ্গে জর্দানের রাজার বৈঠক আজ

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ ফের শুরু আজ

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ ফের শুরু আজ